সকাল সাড়ে এগারোটার শো, সাবেক রাইফেল স্কয়ার, বর্তমান সীমান্ত স্কয়ারের সিনেপ্লেক্স শাখায় দেখলাম মুজিব দা মেকিং অফ নেশন। সময় আর জায়গার নাম কেন বললাম এইটা আগে বলি, পরে সিনেমার আলাপ করছি। শুক্রবার সকালবেলা সিনেমা দেখার লোক খুব বেশি থাকার কথা না, আমি ইচ্ছা করেই এই সময়টা নিছি এইটা দেখার জন্য যে এমন উলটাপালটা সময়ে আর ধানমণ্ডির মত জায়গায় কয়জন আসে সিনেমাটা দেখতে।আমি বা আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল এই সিনেমা দেখবে আওয়ামীলীগের তেলবাজ নেতাকর্মীরাই। হলে সিট পাওয়া যায় না এইটা এদের কারণেই। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম মুজিব, জাতির পিতা এখনও কতখানি সাধারণ মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয়। আমি এই দিক দিয়ে মুগ্ধ। আমি দেখলাম একদম সাধারণ মানুষ, মা খালা, মামা চাচা ধরণের মানুষ দিয়ে হল ভর্তি! আছে শিশু কিশোর কিশোরীরাও। এত লম্বা একটা সিনেমা এরা পুরোটা কোন শব্দ ছাড়া টানা দেখে গেল, সিনেমা মনে হয় এখানেই সার্থক।
সিনেমার আলাপে আসি। মুজিব কেমন সিনেমা? ভাল সিনেমা। এবং সিনেমাই, ডকুমেন্টারি না। অনেকেই, বিশেষ করে তাত্ত্বিকেরা ইতিহাস নিয়ে খুব চিন্তিত দেখলাম। ৩২ নাম্বারের বাড়ি কবে তৈরি আর সিনেমায় কবে দেখাইছে, ২৫ তারিখ রাতে শেখ হাসিনা ৩২ নাম্বারে ছিল না কই ছিল ইত্যাদি। সিনেমার শুরুতেই এর উত্তর দিয়ে দেওয়া হয়েছে, কাহিনীর প্রয়োজনে, গল্পের ধারাবাহিকতার জন্য সংযোজন বিয়োজন করা হয়েছে! ব্যাস, আলাপ শেষ। তবে এরপরেও কথা থাকে। কিছু বিষয় শ্রেফ গবেষণার অভাব বলে মনে হয়েছে। বা মনে হয়েছে অবহেলা। এগুলা বাঞ্ছনীয় না।
এইটা আসলে যারা মুজিব নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করছে, যারা বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখে তাদের জন্য না। এত এত বই পড়া হয়েছে যে এখন চোখের সামনে ভাসে ইতিহাসের বিভিন্ন চরিত্র। তাই একটু অস্বস্তি লাগতেই পারে। আমার লাগছে। ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় ডুবে যাওয়ার সুযোগ আছে, আমিও গেছি। এইটা বর্তমান প্রজন্মের জন্য জরুরি সিনেমা। কেন? কারণ এরা এক পাতাও বই পড়ে না, গল্প উপন্যাস যাও ধরে দেখে কিন্তু গবেষণামূলক? নন ফিকশন কিছু যেন এদের কাছে আতঙ্কের নাম। এরা এই সিনেমাটা দেখলে মোটামুটি ধারণা পাবে একটা লোক কই থেকে উঠে এসে কোথায় পৌঁছে গেছিল। জানবে একদম মাটি থেকে উঠে আসা একটা মানুষ গোটা জাতিকে কীভাবে পরিচালিত করেছে স্বাধীনতার দিকে।
বাংলাদেশের মাপে এই সিনেমাটা দারুণ একটা সিনেমা। আরও ভাল করা যাইত? অবশ্যই যাইত। ভালোর তো শেষ নাই। কাজেই ভাল করা যাইত না, এইটা সেরা এমন বলাটা বোকামি, মূর্খের মত কথা বলা হবে। অবশ্যই ভাল করা যেত। আমার মতে সিনেমাটার দৈর্ঘ্য আরও বড় হওয়া উচিত ছিল। এবং দুই বা তিন পর্বে শেষ করা গেলে হয়ত মুজিব নামক বিশাল ব্যক্তিত্বটার কিছুটা ধরা যেত। এত অল্পে মুজিবের মত মানুষের জীবনের পুরো গল্প বলা সম্ভব না।
আমার কাছে কয়েকটা দৃশ্য ভাল লেগেছে। একটা জায়গায়, বাকশাল গঠনের পরে শেখ মনি ( সম্ভবত) বঙ্গবন্ধুর বাসায় তর্জনগর্জন করছে, এর মধ্যে বেগম মুজিব তাকে থামিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলতেছে যারা দলে নাই তাদের আবার ফেরায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর, মাওলানা ভাসানিকে নিয়া আস, আর... বলে শেখ মনির দিকে তাকিয়ে কথা থামিয়ে দেন। ওই দৃষ্টিটা, শেখ মনির দিকে অমন করে তাকিয়ে থেকে যার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে করলেন না, এইটা ইতিহাস না জানাদের জন্য বুঝা মুশকিল তিনি কার কথা বলতে চেয়েছেন! আমি একটা ধাক্কাই খেয়েছি এই দৃশ্যটা দেখে। এই ছোট দৃশ্যটা বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ ঘুরে যাওয়ার মত একটা ঘটনার ইংগিত! দারুণ!
এ ছাড়া বিজয়ের পরে মুজিব পরিবারকে উদ্ধার করার জন্য মেজর অশোক তারার দৃশ্যটা ভাল লাগছে। পুরোপুরি ইতিহাস মেনে করা হয়েছে এমন বলা যাবে না। কিন্তু অশোক তারার উপস্থিতিটাই ভাল লাগছে। আমি ভালছিলাম একটা গোঁজামিল দিয়ে দিবে হয়ত বা দেখাবেই না মুজিব পরিবার কীভাবে উদ্ধার হল। যাই হোক, ভাল ছিল ব্যাপারটা।
শুভ কেমন মুজিব? চলন সই। যতখানি খারাপ মনোভাব নিয়ে গেছিলাম ততখানি খারাপ না। আমার ধরনা, দেশের বাহিরের দর্শক, যারা শুভকে চিনে না, যারা তৃষা কে চিনে না তারা ভাল করে তাদের মূল্যায়ন করতে পারবে। আমাদের চোখে দুইটাই পরিচিত মুখ, মানে মুজিবের চেহারা যেমন আমাদের মুখস্থ তেমনই শুভর চেহারাও। তাই আমাদের জন্য একটু কষ্টকর মুজিব হিসেবে শুভকে মেনে নেওয়া বা তৃষাকে বেগম মুজিব হিসেবে। দীঘিকে ছোটবেলার রেণু মানে বেগম মুজিব হিসেবে ভাল লাগছে কারণ দুইটা চেহারাই অপরিচিত। এমনেও দীঘি ভাল করছে। শুভ পরিশ্রম করছে এইটা বুঝা গেছে। কিন্তু আমি বুঝি নাই যে এত পরিশ্রম করতে রাজি ছিল সে পরচুলা পরতে গেল কেন? গোঁফটা পর্যন্ত রাখতে পারত না? এই দিকটা খেয়াল করলে আরও ভাল হত।
৮০ কোটি টাকা বাজেট দেখে অনেকেই মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছিল। আমার কাছে বরাবরই মনে হয়েছে এইটা কোন বাজেটই না। এই মাপের একটা সিনেমা বানাতে এর দুই তিন গুন টাকা হলে ভাল সিনেমা বানানো সম্ভব। গ্রাফিক্সের কাজ গুলো আরও আরও ভাল করা যেত। এই সিনেমার যে বেশ চোখের পড়ার মত দুর্বল দিকটা তা নিয়ে একটু বলি, এইটাও বাজেট ভাল হলে হয়ত কাটিয়ে উঠা যেত। তা হচ্ছে আন্দোলন, মিটিং মিছিল, জনসভার দৃশ্য গুলো! শ্যাম বেনেগাল দেখেই হয়ত এমন হয়েছে। ঢাকার বুকে আন্দোলন কেমন হয় বা ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭০ এই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের কোন আভাসই পাওয়া যায়নি সিনেমায়। যে কয়টা জনসভা দেখানো হয়েছে তাতে জনসভার গর্জন, জনসভার আবেদন কিছুই ফুটে উঠেনি। এইটা সুযোগ ছিল সহজেই করার। ইন্দিরা গান্ধীর যেমন রিয়েল ফুটেজ দেখানো হয়েছে, আন্দোলনের দৃশ্য গুলার, জনসভার দৃশ্য গুলাতেও তেমন রিয়েল ফুটেজ দেখাতে পারত।
এক ঝলক, কয়েক সেকেন্ডের জন্য টিক্কা খানকে দেখানো হয়েছে অথচ কোথাও মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতির কোন দৃশ্যই রাখা হয়নি। সম্ভবত ৭৫ পরবর্তী ভূমিকাই দায়ী এর জন্য, যদিও মুস্তাক পুরোটা জুড়েই আছে।
শ্যাম বেনেগালের গান্ধী বা বোস যে মাপের মুজিব সেই মাপের কাছাকাছিই গেছে কিন্তু উৎরে যেতে পারেনি। এই বয়সে তিনি আগের কাজ আর দিতে পারেনি। একদিন এর চেয়েও চমৎকার কিছু একটা তৈরি হবে, সেই আশায় রইলাম।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।