আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস থ্রি বা ফোর - এ পড়ি। ফেব্রুয়ারি মাস, সেবার কোন কারণে বার্ষিক পরীক্ষার পর পরই নানাবাড়ি যাওয়া হয়নি, এদিকে খেজুরের রস শেষ হয়ে যাবে বলে বাসায় মা'কে অস্থির করে ফেলছি ... শেষমেশ এই ফেব্রুয়ারিতেই নানা বাড়ি যাওয়া হল...খেজুর গাছ, খেলার মাঠ... বেশ যাচ্ছিল, হঠাৎ খেয়ালে আসলো, একুশে ফেব্রুয়ারি চলে এসেছে, অথচ ঢাকায় ফেরার কোন নাম নিশানাই নিচ্ছে না বড়রা! অস্থিরতা ঘিরে ধরল, এর আগে কখনো ঢাকার বাইরে পার করিনি একুশে ফেব্রুয়ারি- সে সময় এখনকার মত এত জাঁক-আন্তর্জাতিক ছিল না সে, তবে ঘরে ঘরে তাকে নিয়ে আবেগ ছিল, মানুষ অনেকটা রাস্তা খালি পায়েই হাঁটত, এই ফেব্রুয়ারিতে কেউ একটা ইংলিশ শব্দ বললে দাঙ্গা হাঙ্গামা পর্যন্ত বেঁধে যেত। সেই একুশে প্রভাত ফেরিতে যেতে পারবো না, বইমেলায় ঘুরতে পারব না - মেনে নিতে পারছিলাম না।
সে সময় এই দিনগুলোতে পুরো ঢাকা যেন মঞ্চ নগরি হয়ে উঠত, অলিতে গলিতে বসে যেত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেখানে গান কবিতা চলতো, পাড়ার ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে বুড়োদেরও প্রতিভা প্রমানের সুযোগ মিলত, পুরো রাস্তা জুড়ে আলপনা আঁকা হত, রংবেরংয়ের কাগজ, ফেস্টুন উড়তে আকাশে, ফুল চুরির ধুম লাগত। তো সেই একুশে ফেব্রুয়ারি করতে না পেরে কাঁদো কাঁদো মুখে নানাবাড়ির উঠোনে বসে আছি, মিন্টু ভাই এসে বলল, 'কি যাবি, আমার স্কুলে? ওখানেও একুশে ফেব্রুয়ারি করতে পারবি।' মিন্টু ভাই আমার এক মামাতো ভাই, যে গ্রামেই বাস করে, আমার থেকে বছর ছয়-সাতেক বড় ছিল। ... আমি ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে তাকালাম, গ্রামে, এই অজ পাঁড়াগায়ে আবার একুশ? ...অনতিদূরে দেখতে পেলাম, মিন্টু ভাইয়ের বাইক। গ্রামের একটি স্কুলের একুশ না, বরং ঐ বাইকটি আমায় আগ্রহী করে তুলল। তো সেই ভাঙ্গাচোরা স্কুলে গিয়ে যা ভেবেছিলাম, তা-ই দেখতে পেলাম- কোন শহীদ মিনার নাই। সাজসজ্জা নাই। মঞ্চ নাই। মনে মনে একটু হাসলামও। শহরের সেই বক্র হাসি, যা একান্ত স্বভাবজাত ও চিরাচরিত।
অল্প কিছু ছেলেমেয়ে দেখতে পেলাম জটলা করে আছে জায়গায় জায়গায়। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য স্কুলের বিশাল মাঠ ভরে গেল, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারীবৃন্দ ছাড়াও ছিল শত উৎসুক গ্রাম বাসি, আরো কিছুটা পরে, একটা মেলা মত বসে গেল, খেলনাপাতি, হাওয়াই মিঠাই, পিঠা, কটকটি, আইসক্রিম, চুড়ি ...বাংগালির প্রিয় সব শব্দেরা। একটু পর মিন্টু ভাই আমাকে নিয়ে গেল মাঠের উত্তর দিকে যেখানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হবে। ... আগে কাছে থেকে এভাবে দেখিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে কোথায় থেকে ইট, কাঠ, বাঁশ, রশি ও আরো কিছু উপকরণ চলে এল। পরে সেগুলো দিয়ে দেখলাম একটা জিনিস দাঁড়িয়ে গেছে যা শহীদ মিনারের মত দেখতে। কাছেই একটি স্টেজ মত করা হল। এদিকে মাইক এনে দাঁড়িয়ে রইল কয়েকজন ছাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে দিল সেই অমর সুর .... 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ....'। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রথম ফুল দিলেন। এরপর ফুলের ঢল নামলো, গ্রামে তো ফুলের অভাব হয় না, আর চুরিও করতে হয় না, দেখলাম ফুলের ভারে শহীদ মিনারের ঢলে পড়ার অবস্থা .... এরপর স্কুল ছাত্রদের কবিতা ও গানও চলল মাইকে।
পুরো অনুষ্ঠানে আমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছিলাম নিজেকে, কারণ সেখানে নেতৃত্ব দিতে যে কজন ছিল, আমাদের মিন্টু ভাই ছিল তাদেরই একজন। আর আমি তো সেই ভাইয়ের হাত ধরে বা সামনে পিছেই ছিলাম সারাটাক্ষণ। ....এতদিন বাদে স্মৃতিটা খুব করে তাড়াচ্ছে আমায় কারণ সেই মিন্টু ভাই এক বছর আগে এই একুশ প্রহরেই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে... একদিন সে আমায় নিয়ে গিয়েছিল এক আশ্চর্য একুশের অনুষ্ঠানে, যেখানে হয়ত শহরের মত বাদ্য বাজনা ছিল না, কিন্তু ভালবাসার রংয়ে পুরো আকাশ বর্ণিল হয়ে উঠেছিল ....সে-ই ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একুশ....
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।