'ছয়ে রিপু' গল্পগ্রন্থের শুরুতেই লেখক সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ছটি গল্পই আদ্যন্ত রাজনৈতিক। তাহলে, এগুলিকে কী আমরা শুধু রাজনৈতিক গল্প হিসেবেই পড়ব? নাকি এ হল, গল্পে রাজনীতি? যৌন সিনেমা নাকি সিনেমায় যৌনতা, যেরকম আর কি। গল্পে রাজনীতি বা সিনেমায় যৌনতা নিয়ে সমস্যা তুলনায় কম, কিন্তু এই ধরণের বিভাজনে, রাজনৈতিক গল্প যৌন সিনেমার মত প্রোপ্যাগান্ডার দোষে দুষ্ট হয় অনেক সময়। প্রোপ্যাগান্ডা কোথাও রাজনীতির, কোথাও বা যৌনতার। কিন্তু তাতেও কোনো আপত্তি নেই যদি রাজনীতি বা যৌনতা বা অন্য-কিছু হয়ে ওঠার আগে শিল্পটির মধ্যে থাকে সেই শৈল্পিক দ্যোতনা যাকে আমাদের দেশে রস বলা হয়। অর্থাৎ, শিল্পটিকে আগে রসোত্তীর্ণ হতে হবে, তারপর বিচার্য তার মধ্যে রাজনীতি আছে না যৌনতা আছে না ইতিহাস আছে না দর্শন আছে.. ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সমাজ, রাজনীতি, যৌনতা হল বাধ্যতামূলক সেইসব দেহাবয়ব যাদের ভিতরে লেখক রস নামক প্রাণটি পুরে পাঠকের কাছে পাঠান এবং পাঠক চেষ্টা করেন ঐ দেহাবয়ব অতিক্রম করে রস নামক প্রাণটির স্বাদ পেতে। অর্থাৎ শিল্পের আঙ্গিনায়, সমাজ রাজনীতি যৌনতা ইত্যাদি ব্যতিরেকে রস যেমন হতে পারে না, আবার রস ব্যতিরেকেও এগুলি নিষ্প্রাণ। তার মানে দুটির পারস্পরিক সমঝোতার উপরই নির্ভর করছে একটি শিল্পের সমৃদ্ধি। এই বিচারে 'ছয়ে রিপু'র সিদ্ধি ঈর্ষণীয়।
সমাজ সচেতন, ঐতিহাসিক, রহস্যরোমাঞ্চ, ভীতিপ্রদ, অলৌকিক ও স্মৃতিমেদুর এইগুলিই লেখক-নির্ণীত দেহাবয়ব যার মধ্যে তিনি পুরে দিয়েছেন ছটি রিপুর ব্যঞ্জনা। মজা হল লেখক রস বা ব্যঞ্জনা হিসেবে পাঠ্যবস্তুর অন্দরে যা ভর্তি করে পাঠাবেন, পাঠক যে খুঁড়ে সেইটিই খুঁজে পাবেন এর কোনোই নিশ্চয়তা নেই। আর আধুনিক ভাষা-তাত্ত্বিক দর্শন অনুযায়ী, খুঁড়ে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা যে পাঠ্যবস্তুতে যত বেশি তার শৈল্পিক সমৃদ্ধিও তত বেশি। যত বেশি বিনির্মাণ, ততবেশি মানের ঊর্ধ্বক্রম। 'ছয়ে রিপু'র লেখক-নির্ণীত দেহাবয়বগুলির একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই রাজনৈতিক চেতনা। কিন্তু তার মধ্যে লেখক অবধারিত ভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন আরো নানাবিধ ব্যক্তিক ও সামাজিক গুণাবলী বা ফ্যাকাল্টি যেগুলির যোগসাজশে গল্পগুলির একমাত্রিক কোনো সূত্র নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই বহুমাত্রিকতাই তৈরি করে বহুবিধ অর্থের, বিনির্মিত হতে হতে যা একেক জনের কাছে প্রকাশ পায় একেক ভাবে। মার্ক্সের থেকে ধার করে সাহিত্য-তাত্ত্বিক মার্সাল বারম্যান ১৯৮২ সালে প্রকাশিত আধুনিকতা নিয়ে তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছিলেন, 'All that is solid melts into air'। কারণ আধুনিকতা কেবলমাত্র একটা নির্দিষ্ট সময়কে সূচিত করে না, শুধুমাত্র বর্তমানকে সূচিত করে না। আধুনিকতা হল একটা কালিক ও অস্থায়ী অভিজ্ঞতা, একটি নির্দিষ্ট উপায় যার মাধ্যমে সময় অনুভূত হয়। আধুনিকতার এই বোধ 'ছয়ে রিপু'-র প্রত্যেকটি গল্পের পরতে পরতে রয়েছে। কিন্তু এ তো আধুনিকতার সেই মানদণ্ড যা আধুনিক সাহিত্যের শুরুতেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এবং আধুনিকতা বাস্তবকে খণ্ডিত হিসেবে দেখলেও সেই খণ্ডিত বাস্তবের মধ্যে খোঁজে এক অন্তর্লীন সম্পূর্ণতাকে। এই সম্পূর্ণতা তৈরি হয়, যেহেতু আধুনিকতার দায় আছে কোনো মেটা-ন্যারেটিভকে পূরণ করার। আর এখানেই 'ছয়ে রিপু', আমার মতে আধুনিকতার বোধকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে যথার্থ ভাবে পা বাড়িয়েছে উত্তরাধুনিকতার সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে যেখানে জাঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতারের ভাষায় 'Incredulity of the meta-narrative' দেখা দিয়েছে মূর্ত হয়ে। সমাজ সচেতন গল্পটি যেমন, আজকের এনআরসি, সিএএ-র রূপকে পড়া যেতেই পারে, বা রহস্যরোমাঞ্চ-কে কিংবা অলৌকিক গল্পটিকে আজকের নির্দিষ্ট কোনো রূপকে পড়া যেতে পারে। কিন্তু আমার আগ্রহ গল্পগুলির (একমাত্র ঐতিহাসিক গল্প 'উনিশে এপ্রিল' বাদ দিয়ে) সেই অতি-দেশাত্মক ঝোঁকের দিকে যেখানে প্লট স্থানীয় হয়েও আন্তর্জাতিক এবং নির্মাণশৈলী প্লটানুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন! পাঠক ভেবে দেখবেন এই গল্পগুলির স্থান এই মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোনো দেশ হতে পারে এবং স্থান ও প্রেক্ষিত ভেদে সেক্ষেত্রে তা বহন করবে আলাদা আলাদা ব্যঞ্জনা। কোনো একটি মেটা-ন্যারেটিভকে পূরণ না করার এটাই কিন্তু প্রধান শর্ত।
'এই ধরনের অপরাধে সেদিনই ছিল আমার হাতেখড়ি, যেজন্য বিপদটা হল।...' (শীতবন্দরে)। 'গোলমালটা ঠিক কীভাবে শুরু হল বলা খুব কঠিন।..' (পাইথনের গপ্পো)। 'কেলোটা হল বড়দিনে।...' (বড়দিন)। 'আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ঝড় আসার কথাই ছিল।...'(ক্যাম্পফায়ার, আমাদের রাতের উৎসব)। এই জাতীয় সূচনা লেখকের একটি বিশেষ স্টাইল। শুরুর এই কৌতূহল না মেটা পর্যন্ত পাঠক স্বস্তি পাবেন না। কিন্তু চিত্তাকর্ষক হল সেটা মিটে যাওয়ার পরে পাঠক টের পাবেন অতিরিক্ত কি একটা যেন বলা হল, যা প্লটের চাইতেও বেশি করে বেরিয়ে আসছে লেখকের অননুকরণীয় নির্মাণকৌশল থেকে! যেন, কী বলা হলর সঙ্গে, কিভাবে বলা হল ব্যাপারটাও সমান মনোযোগের দাবিদার। 'পাইথনের গপ্পো', 'শীতবন্দরে' এবং 'বড়দিন', পরিকল্পনা ও প্রয়োগের বিচারে আমার অনুভূতির সবচেয়ে গভীরে আঘাত হানতে সফল হয়েছে। রবি ফ্রিজের মধ্যে কিচ কিচ শব্দ শোনে, ভিখিরি মালটা উড়ে কোথায় চলে যায়, রঞ্জন = রঞ্জন মানুষের ক্ষেত্রে খাটে না, স্তূপীকৃত দাহ্য বস্তুর চারপাশে নগ্ন যুবক-যুবতী…, এইসব কখনো সোজাসুজি কখনো তির্যকভাবে এমন অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করে যার প্রভাবে পাঠক চমকিত হতে বাধ্য। 'The metichut of a garden chap'-র লেখককৃত বাঙলা ভাবানুবাদের সঙ্গে রজতকান্ত রায়ের সত্য ইতিহাস বিনির্মিত হয় খোদ লেখকেরই হাতে! অত্যাশ্চর্য এইসব সন্নিবেশ আমার মতই পাঠককে বাধ্য করবে 'ছয়ে রিপু'র গল্পগুলি বার বার পাঠ করতে।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য' কিংবা 'ক্রীতদাস ক্রীতদাসী' কত মোটা? বইয়ের সাইজ নয়, বিচার্য বইয়ের মান। আধুনিক ভাষাতাত্বিক দর্শন বলছে লেখক যা লেখেন তা হল এক্রিচার, আর পাঠক যা পড়েন তা হল লিটারেচার। এক্রিচার একবার লিটারেচার হয়ে গেলে লেখকের আর কিছু করার থাকে না। 'ছয়ে রিপু' হল কৃশকায় সেই লিটারেচার মানের নিরিখে যা বাঙলা ছোটগল্প প্রেমিদের মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী হতে চলেছে খুব শীঘ্রই।