যে কারণেই হোক মানুষের কেন জানি অগাদ আস্থা ফিফার প্রতি। সকাল বিকাল আমরা আইসিসিকে গালিগালাজ করলেও কেন জানি ফিফাও দুই নাম্বারই করতে পারে এইটা আমাদের মাথায় আসে না। আমরা ধরেই নেই যে ফিফা অতান্ত সৎ ভাবে চলে, কোন দুর্নীতির আশেপাশে তারা নাই। সাধারণ চিন্তা অনেকটাই এমন।
কিন্তু আমরা এখন জানি ফিফার দুর্নীতির কাছে সব শিশু। ফিফা নিজেকে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের মত মনে করে। নিজের ইচ্ছা মত একনায়কতন্ত্র চালায়, কারো কোন টু টা শব্দ পর্যন্ত করার উপায় নাই।
ফিফা যে শুধু মাত্র এখন এমন তা না। বহু আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু ফুটবলের প্রচণ্ড আবেগের কাছে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নাই। দীর্ঘদিন এডিডাসের কাছ থেকে অবৈধ টাকা ঘুষ নিয়ে মার্কেটিঙের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিল এডিডাসকে। সেই ১৯৭৮ সাল থেকেই চলছিল। এরপরে যিনি দায়িত্ব নেন, স্লেপ ব্লাটার তিনি এই দুর্নীতির খবর দিয়েই ব্লাকমেইল করে ক্ষমতায় আসেন। সরাসরি আসা যায়নি। নির্বাচন ছিল। তৎকালীন উইফার প্রধান নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে এক প্রকার ঘোল খাইয়ে ক্ষমতায় আসেন ব্লাটার। কনকাকাফ আর আফ্রিকার ভোট গুলো রীতিমত টাকা দিয়ে কিনে নেন। আফ্রিকাকে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি প্রেসিডেন্ট হলে আফ্রিকায় বিশ্বকাপ নিয়ে যাবেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে আফ্রিকায় বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু আফ্রিকায় কোথায়? মিশর? দক্ষিণ আফ্রিকা? কোথায়? ভোটে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে যায়। কিন্তু ভোট আসল কোথা থেকে? মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ভোট বিক্রি করেন কনকাকাফের প্রেসিডেন্ট! আর এই ঘুষ লেনদেন হয় ফিফার মাধ্যমে!
২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব কাতারকে দেওয়ার পর থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে ঠিক সঠিক তরিকায় কাতারকে আয়োজক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজকের জন্য সেবার আগ্রহ দেখিয়েছিল ইংল্যান্ড, আমেরিকা। দুই দেশের রথী মহারথীরা হাজির ছিলেন অনুষ্ঠানে। আমেরিকা থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ছিলেন, মরগান ফ্রিম্যান ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে প্রিন্স উইলিয়াম, ডেভিড ব্যাকহাম উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নাম ঘোষণা করা হয় কাতারের! এখন সবাই জানে কত টাকার লেনদেন হয়েছিল। এরপরে রীতিমত মাফিয়া অপরাধীদের যেভাবে ধরা হয় তেমন করে ফিফার কর্মকর্তাদের ধরা হয়েছিল। নানা সময়ের দুর্নীতি নিয়ে বহিষ্কার হয়েছেন স্লেপ ব্লাটার।
কাতার দায়িত্ব পাওয়ার পরে শুরু করে কর্মযজ্ঞ। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি এই প্রথম শীতে আয়োজন করা হচ্ছে বিশ্বকাপের। কাতারের মত কট্টরপন্থী দেশ অনেক আইন কানুন পরিবর্তন করেছেন। এবং সেই সাথে যা করেছেন তা হচ্ছে মানবাধিকারের চরম ভাবে লঙ্ঘন। গার্ডিয়ান একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে গত বছরের হিসাব বাদেই দশ বছরে শ্রমিক মারা গেছে প্রায় সাত হাজার! ( ৬৭৫১ জন), এর মধ্যে বাংলাদেশিই আছে ১০১৮ জন। এবং এই মৃত্যুর কোন জবাবদিহির চেষ্টা করেনি কাতার কর্তৃপক্ষ। নানা সময়ে নানা রকমের বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বলেছে এগুলা স্বাভাবিক মৃত্যু। অন্যদিকে অ্যামিনেস্টি সহ আরও বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা দাবী করছে মৃত্যুর সংখ্যা গার্ডিয়ান যা প্রকাশ করেছে তার প্রায় দ্বিগুণ! আয়োজনের পূর্বেই কাতারের হাতে নিরীহ শ্রমিকদের যে রক্তের দাগ লেগে গেছে তা আর কোনমতেই মুছা সম্ভব না। ফুটবল ইতিহাসে সব সময়েই কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
কাতার শুধু যে শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যাচার করেছে তা না। তারা যারা ওই দেশে এখনও আছে তাদেরকে জোর করে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। দূরে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে থাকতে বাধ্য করছে। মজুরি দেয় নাই, ছুটি দেয় নাই। স্রেফ চলে যাও এখান থেকে! কেন? কারণ এই নোংরা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত শ্রমিকদের ইউরোপ আমেরিকার ঝকঝকে মানুষের সামনে আনা যাবে না। কারণ এতে কাতারের লক্ষ্য পূরণে সমস্যা হবে। সেখানে থাকবে শুধু টাকা পয়সার পসার সাজিয়ে যারা বসে থাকবে তারা। শ্রমিক তুমি দূরে যাও!
ঘুষ দিয়ে আয়োজক হয়ে, স্টেডিয়াম তৈরি করে আবার ভেঙে ফেলে যে আয়োজন কাতার করতে চাচ্ছে তার কারণ কী? মানে এমন একটা কাণ্ড কেন করতে হল কাতারকে? যতদূর বুঝা গেছে তা হচ্ছে কাতার নিজেকে আরব আমিরাতের মত তৈরি করতে চায়। মানুষ কাতারে খেলা দেখতে যাবে, শান শওকত দেখবে। মুগ্ধ হয়ে এরপরে ছুটিতে যাবে, ব্যবসার আলোচনা করতে যাবে, ইত্যাদি! সেই স্বপ্ন পূরণে খেটে খাওয়া শ্রমিক বড্ড বেমানান। তাই হটাও শ্রমিক!
কাতারের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল। তবে মানবাধিকার নিয়ে আসলে ফিফা চিন্তাই করে না। ১৯৭৮ সালে একনায়কতন্ত্র চলা অবস্থায় আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফিফা। সেই সময় নানা জায়গা থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছিল। ফিফা বলেছে খেলার সাথে রাজনীতি মেশানো যাবে না। তাই সামরিক জান্তার সাথে এক মঞ্চে বসে খেলা উপভোগ করেন ফিফা প্রেসিডেন্ট। আর স্টেডিয়াম থেকে কয়েকশ মিটার দূরে বন্দী শিবিরে হাজার হাজার আর্জেন্টাইন, যারা বিনা বিচারে, অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে বন্দী হয়ে আছে। ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপকে তুলনা করা হয় ১৯৩৬ সালের জার্মানি অলিম্পিকের সাথে, সেই অলিম্পিকে হিটলার মঞ্চে বসে অলিম্পিক উপভোগ করেছিল!
ফুটবল উম্মাদনার কাছে সব কিছুই ভেসে যায়। খেলাই দেখা বাদ দিয়ে দিবে সবাই, এমনও বলার কোন যুক্তি নাই। কারণ আমি রক্তের বদলা হিসেবে খেলা দেখা বাদ দিলাম, তাতে কারো কিছুই যাবে আসবে না। বাতিল করতে চাইলে আরও আগে পুরো দুনিয়া জুড়ে যদি প্রবল আন্দোলন করা যেত তাহলে হয়ত সম্ভব হত। এখন বাতিলের কোন সুযোগ নাই। এখন এই আয়োজন ব্যর্থ মানে হচ্ছে অনেক মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু। একেকটা খেলোয়াড় শৈশব থেকে স্বপ্ন দেখে বিশ্বকাপের মঞ্চে একদিন খেলবে। আমাদের এশিয়ার সংস্কৃতি থেকে ফুটবল উম্মাদনা বুঝা মুশকিল। ল্যাটিন আমেরিকা বা ইউরোপে যেভাবে ফুটবলকে আরাধনা করা হয় তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম বয়ে বেড়ায় ফুটবল ঐতিহ্য। ব্রাজিলের বস্তির ভিতরে হয়ত একজন বসে আছে যে বড় হলে একদিন ফুটবল বিশ্বকে মাতাবে। আর তাই অধীর হয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে সে, এবারের খেলটা তার দেখা খুব দরকার! এমন করেই তৈরি হয় সেখানকার ফুটবলাররা।
কাজেই এখন, রাত পোহালে যখন খেলা শুরু হয়ে যাবে তখন বিশ্বকাপ বাতিল করার মত কথা বলার যুক্তি নাই। আমার চাওয়া কী? খুব ছোট্ট চাওয়া। আমি চাই উম্মাদনায় ভেসে যাওয়ার সময় মনে রাখুন ওই ক্রংক্রিটের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যা আমরা দেখছি তার প্রতি পরতে পরতে রক্ত লেগে আছে আমার দেশের ভাইদের। মানুষের রক্ত লেগে আছে, ঘাম মিশে আছে, যার ন্যায্য মূল্য দেয়নি অসভ্য কাতার সরকার। আমরা মনে রাখি শ্রমিকদের কথা, কাতার একটা রক্তচোষা দেশ, এইটা যেন আমরা মনে রাখি। ব্রাজিল আর্জেন্টিনা, জার্মান ফ্রান্স, বেলজিয়াম প্রেমে ভুলে যেন না যাই যে আমরা এই আয়োজনে হেরে যাওয়া দল। আমাদের ভাইদের হারিয়ে দিয়েছে জোর করে। রক্ত দিয়েও জিততে পারেনি তাঁরা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।