নদীটা পেরোতে হয় ছোট্ট দাঁড়বাওয়া নৌকোয়। এমনিতে কোথায় যেন একটা বেশ শক্তপোক্ত কিন্তু টলমলে বাঁশের সাঁকোও আছে। মানে পায়ের নীচে খান তিনেক বাঁশ আর দুইদিকে ধরার জন্য দুটো বাঁশ নদীর দুই পারে শক্ত করে বাঁধা। তো সেটা নাকি নদীতে জল যখন খুব কম থাকে তখন পেরোবার জন্য। কিন্তু সে সাঁকোটা আমি বেমালুম কোথাও দেখতেই পেলাম না।অনিলদাকে জিগ্যেস করায় খালি বললেন ‘আসে আসে ওইদিকে’। কোন এক অনির্দেশ্য দিকে সে সেতু হয়ত আছে, হয়ত বা ভেঙে গেছে বর্ষায়, কে জানে। মোটকথা এখন পেরোতে হবে ওই নৌকো করে। মূল ফরেস্ট বাংলোর মাঠ থেকে পাহাড় বেয়ে খাড়া নেমে গেছে বেশ পাকাপোক্ত এক সিঁড়ি। নীচেটা অবশ্য বাঁশের। সামান্য ঘাসপাতা পেরিয়েই শুরু হয়ে যায় নদীখাত, ছোটবড় অজস্র পাথর পেরিয়ে গিয়ে নৌকোয় ওঠা। এখানে বলে রাখি নদী পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে গেলেই বনবিভাগ নিযুক্ত গাইড নেওয়া অত্যাবশ্যক। দেবান বাংলো থেকে হলদিবাড়ি অবধি ৫ কিলোমিটার পথ, এইটুকুই রূপম নিয়ে যান, নিজেও গেছেন ওই পর্যন্ত।
তবে সিরিয়াস ট্রেকাররা ৫ বা ৬ দিনের ট্রেকটা নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে যে কোন পূর্ণাঙ্গ ট্রেকের মত ওই ৫-৬ দিনের রেশন ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়, এই গাইডরাই নিয়ে যান। একদিনের ট্রেক হিসেবেও সাধারণত হর্নবিল পয়েন্ট অবধি যায় মানুষ। হলদিবাড়ির পরে আরো ৫ -৭ কিলোমিটার গেলে তবে হর্নবিল পয়েন্ট। তবে এই অংশটুকু যেতে মাঝে একঘন্টা বেশ খাড়া চড়াই চড়তে হয়। যাঁরা পুরো একদিনের ট্রেক নেন, তাঁরা সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে হলদিবাড়ি ক্যাম্পে মধ্যাহ্নভোজ সেরে হর্নবিল পয়েন্ট অবধি গিয়ে ফেরত আসেন। তবে ওই অবধি গেলে একরাত সেখানে ক্যাম্প করে থাকাই ভাল। নামটা হর্নবিল পয়েন্ট হয়েছে সেখানে ধনেশপাখির প্রাচুর্য্যের জন্য। তা পাখির দেখা পেতে খুব সকাল আর সুর্যাস্তের পর অন্ধকার নামার ঠিক আগে অবধিই আদর্শ সময়। আর সেজন্য রাত্রিবাস করতে হবে। জঙ্গলে ঢোকার খরচ ১০০ টাকা মাথাপিছু দিনপিছু, গাইডের ফি ৮০০ টাকা প্রতিদিন। আমরা জঙ্গলে থাকছি দুই রাত্তির আর গাইড নিচ্ছি একদিনই। এছাড়া পুরো নামদাফা ট্রেক করে বালুঘাট অবধি গেলে চার বা পাঁচদিনের জন্য কুলি ভাড়া করতে হবে। তার আলাদা খরচ।
নামদাফার গেটে পার্মিট এন্ট্রি করানোর সময়ই গাইডের ব্যপারে কথা বলে নেওয়া ভাল। এমনিতে বাংলোর কর্মীরাও খবর পাঠিয়ে দেন, গাইড এসে যায় সক্কাল সক্কাল। তো এই নদীখাতের ছোটবড় পাথরের উপর দিয়ে হাঁটার ব্যপারটা বেশ গোলমেলে। বিশেষ করে আমার মত কারোর যদি শরীরের সেন্টার অব গ্র্যাভিটি গোলমেলে থাকে আর নিয়ারলি ফ্ল্যাট ফুট হওয়ার জন্য ধুপধাপ পড়ে যাবার প্রবণতা থাকে তাদের এইখান দিয়ে হাঁটার জন্য বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। নাহলে যেকোনো মুহূর্তে আলগা পাথর সরে গিয়ে পা মচকানো বা পড়ে যাবার প্রভুত সম্ভাবনা। এরপরে দাঁড়বাওয়া নৌকোয় ওপারে গিয়ে আবারো ওই রকস এন্ড পেবলসের উপর দিয়ে হাঁটা। পা ফসকালে চলবে না। নীলসবুজ নদীর জল, অতিস্বচ্ছ জলের নীচে কালচে সবুজ, হলুদ ছোট বড় পাথর, দুলেদুলে চলা নৌকো, চারপাশের পাহাড়, জঙ্গল সবমিলিয়ে নদীবক্ষ থেকে চারপাশের সৌন্দর্য্য ভাষায় বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। নদীখাত শেষ হলে আসে লম্বা লম্বা ঘাসের বন, তা আন্দাজ ৭-৮ ফুট লম্বা ঘাস সেখানে, বা আরো একটু লম্বাও হতে পারে। এই ঘাসের বনে ঢুকে যাবার পর দলের সবচেয়ে লম্বা লোকটাকেও উল্টোদিকের ফরেস্ট রেস্ট হাউসের চত্বর, যেটা পাহাড়ের উপরে, থেকে দেখা যায় না।
ঘাসবনের ভেতর দিয়ে রাস্তাটা ঘুরে গিয়ে সামনে প্রায় আড়াইতলা উঁচু পাহাড়, ওতে চড়ে তবেই নামদাফা কোর এরিয়ায় ঢোকা। আর এই পাহাড়ে চড়ার জন্য আছে বাঁশ ও কাঠের তৈরী মই। অরুণাচলে আসার আগে আমরা কেউ কক্ষণো অমন মই বেয়ে পাহাড়ে চড়া দেখি নি বাপু। তিনখানা লম্বালম্বি বাঁশ নীচ থেকে উপর পর্যন্ত পাতা আর তার উপরে কিছুটা ব্যবধানে দুটো করে বাঁশ আড়াআড়ি পাতা, শক্ত করে বাঁধা। সুইপাশে ধরার জন্য দুটো করে বাঁশ ওইরকম উপর থেকে নীচ অবধি শক্ত করে বাঁধা। পুরো মইটাই বেশ শক্ত করে বাঁধা হলেও তাই বেয়ে ওঠা, বিশেষ করে নামাটা একটু চাপের। ভার্টিগো থাকলে তো বিশেষ মুশকিল। আর ওঠার সময় যদি বা কাউকে পেছন থেকে সাপোর্ট দিয়ে ঠেলেঠুলে তোলা সম্ভব, কিন্তু নামার সময় একেবারে একলাই নামতে হবে। গাইডের ভাষ্যমতে এইটাই নাকি জঙ্গলে ঢোকার একমাত্র পথ। আমার কিরকম বিশ্বাস হয় না, অতখানি জঙ্গল নদীর ধার দিয়ে দিয়ে গেলে আর কোন অপেক্ষাকৃত ঢালু পথ নেই, পুরোটাই খাড়া এটা কিরকম অবিশ্বাস্য লাগে। পরে ঈপ্সিতা বলল অরূণাচলের সর্বত্রই এইরকম মইয়ের ব্যবস্থা, মানুষের বাড়ির দোতলায় উঠতেও আর পাহাড়ে উঠতেও।
এরপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। হলদিবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি সহজই। তবে একসারিতে যেতে হয়, পাশাপাশি তিন চারজন গপ্পো করতে করতে চলা যায় না। মাঝে একজায়গায় মস্তমোটা গাছের গুঁড়ি আড়াআড়ি পড়ে আছে একটু উঠে টপকে যেতে হয়। তারই লাগোয়া একটা গাছে লাল লাল লম্বাটে মত ছড়া ছড়া ফল না ফুল কি যেন ধরে আছে, গাইডসায়েব তুলে এনে ভেঙে খাওয়ান, ভারী মিষ্টি খেতে। চলার পথে একজায়গায় সবচেয়ে সামনের জন থমকে দাঁড়ান। পেছনের মানুষেরা উঁকিঝুঁকি মারেন কী ব্যপার – প্রায় একশো কি দেড়শো প্রজাপতি বসে আছে অপূর্ব ফর্মেশান। সামনের জন মোবাইল বাগিয়ে ফোটো তুলে এগিয়ে যান, প্রজাপতিরা উড়ে যায়। পেছনের এক সিরিয়াস ফোটোগ্রাফার আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করেও সেই ফর্মেশান আর পান না ফিরে এসে আফশোস আর ক্ষোভ চলতে থাকে পরবর্তী আরো তিনদিন। সিরিয়াস ফোটোগ্রাফির শখ তো আর সবার থাকে না, তাই যাদের থাকে তাঁরা ট্রিপের শুরুতেই অন্যকে যদি একটু নিজেদের ইচ্ছে আশা টাশাগুলো বলে দেন তাহলে হয়ত নিজের প্রত্যাশামত ছবিও পাবেন আর ক্ষোভটোভও কম হবে। গ্রুপ ট্যুর মানেই তো সকলেরই একটু মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া, এই আর কি।
নামদাফায় যদিও বিগ ক্যাট প্রজাতির চার রকম প্রাণীর (টাইগার, লেপার্ড, স্নো লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড) সন্ধান পাওয়া যায় তবে এতটা নীচে লোক চলাচলের পথের এত কাছে তারা আসে না, বলা ভাল তাদের আসার দরকার হয় না (ভাগ্যিস!), জঙ্গল এখনো যথেষ্ট ঘন এবং জঙ্গলের অনেকটাই মানুষের, অন্তত শহুরে মানুষের জন্য প্রায় অগম্য স্থান। কিন্তু চোরাই কাঠ পাচারকারিদের উৎপাতে বেমক্কা বন নিধনের ফলে নামদাফার জীববৈচিত্র্য অনেকটাই ঝুঁকির মুখে। আর কতদিন তথাকথিত উন্নয়নের জাঁতাকল ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নামদাফা বাঁচবে জানি না, এখনো অন্তত অনেকটাই আছে। এমনকি নদীর ওইপারের কোর এরিয়াতে না ঢুকলেও প্রজাপতিই যে কতরকম দেখা যায়, পাখি সেও তো কতরকমই দেখা যায় আর দেখা যায় নানারকম রঙ বেরঙের পোকা। ও হ্যাঁ নামদাফায় কিন্তু প্রচুর অজস্র জোঁক। এখানে পাঁচ রকম বিভিন্ন প্রজাতির জোঁক দেখা যায়। শুকনো আবহাওয়ায় এমনিতে জোঁক কম হলেও ডিসেম্বরেও কিছু জোঁক দিব্বি মানুষের গোড়ালি কিম্বা জুতোমোজা ও জিন্সের ফাঁক গলে পায়ের গোছে ঝুলে পড়েছে। নদী পেরোলেই সঙ্গে যথেষ্ট নুন বা মুভ, ভোলিনি জাতীয় স্প্রে সঙ্গে নেওয়া ভাল।
বুড়ির বাড়ির মত দেখতে ওইটেই হলদিবাড়ি ক্যাম্প।
আমাদের গ্রুপের পরিকল্পনা ছিল হলদিবাড়ি ক্যাম্প ছুঁয়ে ফিরে এসে দেবান ট্যুরিস্ট লজে মধ্যাহ্নভোজ করা হবে। আমার যদিও আবছা মনে হচ্ছে যাত্রা শুরুর আগের ব্রিফিঙে শুনেছিলাম যে জঙ্গলের মধ্যে প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে যাওয়া হবে, খেয়ে তারপর ফেরার পথ ধরা। তা সে হয়ত গ্রুপের সকলেই পঞ্চাশোর্ধ মানুষ দেখে প্ল্যান পরিবর্তন হয়েছে। যাই হোক সবাই ফিরে আসেন মোটামুটি দুটো নাগাদ। কেউ কেউ ফ্রেশ হতে ঘরে ঢোকেন, কেউ বা এমনিই সোজা খাবারঘরে। অনিলদাও তৈরী গরমাগরম ভাত, ডাল, ডিমের ঝোল, কি একটা যেন শুকনো শুকনো তরকারি আর পাঁপড়ভাজা নিয়ে। দলের সজলদা রুটি ছাড়া খেতে পারেন না, তাঁর জন্য কটা রুটিও বানিয়ে আনেন ঝপাঝপ। এদিকে সবাই যখন ট্রেক করতে গেছে করিমভাই তখন গিয়ে মিয়াও থেকে জলের বোতলের ক্রেট তুলে এনেছেন দুইখানা আর সাথে যাদের যা যা মদের অর্ডার ছিল তাও। সকলেই মোটামুটি একমত যে একবার গড়িয়ে নিতে বিছানায় গা ঠ্যাকালে আর ওঠা মুশকিল হবে। অতএব নদীর ধারে কুঁড়েঘরের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আড্ডা জমে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে গড়িয়ে প্রায় রাত। এরই মধ্যে একটি র্যাাকেট টেলড ড্রংগো আমাদের মাথার উপর দিয়ে খানিক ওড়াউড়ি করে যায়। আজ হুলক গিবনের ডাক শুনেছি, কিন্তু তারে আমি চোখে দেখি নি।
অন্ধকার গাঢ় হলে মদ্যপায়ীরা গিয়ে জমা হয় শৈলেনদাদের ঘরে, আমরা গিয়ে বসি খাবারঘরে। যথারীতি আড্ডা চলতে থাকে, চলতেই থাকে। নানারকম বেড়ানোর গল্প, রূপমের ট্রিপ নিয়ে যাবার বিচিত্র অভিজ্ঞতা সে সব এক সে বঢ়কর এক। আজকেও রাত্রে মুরগি, অনিলদা অবশ্য আমাদের মাছ খাওয়াবেন বলেছিলেন, আমরাই মানা করলাম, পরের পরেরদিন ব্রহ্মপুত্রের ধারে রাত্রিবাস, ম্যালা মাছ খাওয়া যাবে সেখানে। আজ আকাশে ছাড়া ছাড়া মেঘ, তারা দেখা যায়ই না প্রায়। খেয়েদেয়ে ঘরে আসি, আজকে ঘুমাতেই হবে। হয়েছে কি, আগেরদিন রাত্রে প্রায় ঘুম হয়ই নি। শুয়ে চোখ লেগেছে কি লাগে নি প্রায় কামান গর্জনের মত নাকের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে চমকে উঠে ভাবি রুম্মি বুঝি, পরে দেখি না পাশের ঘর থেকে আসছে। সে কি ডাক রে ভাই! দেয়াল ভেদ করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে প্রায়। কিরকম একটা সাইলেন্সার ছাড়া বাইক স্টার্ট নেবার মত করে শুরু করে চলতেই থাকে। আর তার সাথে ঠিক এইরাতেই বিগড়ে বসে আমার লোহা হজম করা পেটও। শুয়ে শুয়ে ভাবি পাশের ঘরের কোনজন এমন ২৫০ ডেসিবেলে গর্জাচ্ছেন? পরেরদিন দুপুরে সে রহস্যের সমাধান হয়েছিল, থেকে যাওয়া ৭৬ বছরের যুবকেরই এত শক্তি। আরো পরে জেনেছি তাঁর রুমমেট টানা ছয়রাতই ঘুমাতে পারেন নি।
# ছবিগুলো প্রায় সবকটাই সহযাত্রীদের থেকে নেওয়া। সমরেশদা রূপম, শৈলেনদা।
## খান দুয়েক ভিডিওও আছে মই বেয়ে পাহাড়ে চড়া ও নামার,কিন্তু সে এখানে তোলা গেল না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।