সেই যে বলেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখে নিয়ে অফিসে যোগ দেব, সেই কথা মনে করেই ভোর পৌণে ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেল পরেরদিন। কিন্তু বাপরে ক্কি ঠান্ডা বাইরে, কম্বল থেকে হাত পা বের করাই দুঃসাধ্য মনে হয়। ল্যাগব্যাগ করতে করতে উঠে জানালার পর্দা সরাতেই দেখি আকাশ একেবারে কাচের মত পরিস্কার, চালধোয়া জলের মত আবছা আলো বাঁদিকটায়, ডানদিকে আর ঢাল বেয়ে নীচে এখনো চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশ যখন পরিস্কার তখন বসি একটু জানালার পাশে। এর আগের দুবার এদিকে এসেও কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখ দেখি নি, আগাগোড়া ঘুমিয়ে ছিল লেপ মুড়ি দিয়ে। খুব ছোট ছোট কতগুলো পাখি মহা ওড়াউড়ি লাগিয়েছে। এদেরকেই আমাবিল বলে কী? ৫.৫২ তে প্রথম আবছা গেরুয়া রঙ ছেয়ে যায় মাথাটায়, আস্তে আস্তে গেরুয়া গাঢ় হয়ে কমলা। কমলা থেকে কয়েক সেকেন্ড লাল হয়েই লালচে সোনালী। এই রঙটা ঝকমক করে অনেকক্ষণ। ধীরে ধীরে রূপোলী হয়ে সাদা হয়ে গেলে উঠে মুখ ধুয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে চেয়ার টেনে বসি। সবে ৬.২৫, বাইরে কোথাও বোধহয় গিজারের স্যুইচ আছে, অন করে নি ফলে দাঁত জিভ প্রায় অসাড় হয়ে আছে। সূর্য্যের ওম পেতে উল্টোদিকের ব্যালকনিতে যেতে হবে, সেদিকেই শহর জেগে উঠছে। থাক একটু বসি বরং।
নীলম কফি আনেন সাথে স্থানীয় বেকারির বিস্কুট। নমসেওয়াল হোমস্টের মালকিন নীলম অসম্ভব কর্মঠ, সেই কোন সকালে উঠে স্নান সেরে ছাদে উঠে যান পুজো করতে, একটা ছোট মন্দির আছে সেখানে। ঘন্টা দেড়েক বাদে নীচে এসে তিনতলার বারান্দায় ঝোলানো ছোট সিংহাসনের দরজা খুলে আরতি মন্ত্রপাঠ ইত্যাদি সেরে নীচে চলে যান। আন্দাজ করি প্রত্যেক তলাই সম্ভবত ঠাকুরের আওতায় এবং দুইবেলা তাদের যথাবিহীত অর্চনা হয় টয়। বাড়িতে লোক বলতে তিনজন, মালিক মুখিয়াজি, মালকিন নীলম মুখিয়া আর একজন কাজকর্মের সহায়ক, বাপু। ও আর একটি চমৎকার কুকুরও আছে, নাগা নাম তার। আমাকে যে ইউনিটটা দেওয়া হয়েছে তাতে একটা বসার ঘর, সোফাসেট ওয়াল হ্যাঙ্গিং, গাছ, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। লাগোয়া ছোট্ট কিচেনেট, ইন্ডাকশান কুকার, ফ্রীজ, ফিল্টার আর দুজনের মত বাসনপত্র, শোবার ঘরটাও যথেষ্ট বড় এবং উপযুক্ত আসবাব দিয়ে সাজানো, লাগোয়া বাথরুম পরিস্কার। বসার ঘরের অন্যদিকে আরেকটা ঘর আছে আপাতত তালাবন্ধ, কেউ একটু বড় পরিবার চার বা পাঁচজনের হলে ওই দ্বিতীয় শোবারঘরটা কাজে লাগে আর কি।
আমার ওয়ার্কেশান প্যাকেজে আছে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, রাতের খাবার আর সকালে বিকেলে দুবার চা। তা চা আমি বিলকুল খাই না, কফি বলতে এঁরা বোঝেন নেসক্যাফে গোলা, সেও আমি খেতে পারি না। কফি অবশ্য আমার সঙ্গেই থাকে আর এখানে তো প্রায় সবই রয়েছে বানিয়ে নেবার মত। কফি মেকার অবশ্য নেই, তা ওইটুকু মানিয়ে নেওয়াই যায়। খাবার দাবারের যে কি এলাহী ব্যবস্থা সে আর কি বলব! পর্ক ভালবাসি শুনে নীলম বেজায় খুশী। প্রাতরাশে সাধারণত দুধ কর্নফ্লেক্স, একটা কমলালেবু আর একটা আপেল কিম্বা কলা আর ডিমসেদ্ধ কি পোচ কিম্বা অমলেট। দুপুরে কোনোদিন মোমো দিলেন ত একটা হটকেসে খান কুড়ি পর্ক কি চিকেন মোমো বানিয়ে সঙ্গে দুর্দান্ত চাটনি সহযোগে দিয়ে গেলেন। কোনোদিন হয়ত থুকপা কিম্বা স্রেফ এগ-চিকেন চাউমিন গ্রেভিওয়ালা। রাতের খাবার আসে বেতের ট্রেতে করে কাঁসার থালা কাঁসার বাটি সাজিয়ে। ভাত। ডাল, এওটা তরকারি পাঁপড়ভাজা প্রায় রোজই থাকে, আর সাথে থাকে নেপালী স্টাইলে মাটন কিম্বা চিকেন কি পর্ক কি ডিমের পদ। কোনোদিন সাথে থাকে বাড়িতে পাতা ঘি। রান্নায় তেল একটু বেশী, কিন্তু স্বাদ একেবারে হমীনস্ত।
জনপদের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হল তার বাজার। যে কোনও নতুন শহর বা মফস্বলে গেলে বাজার আর বইয়ের দোকান দেখার চেষ্টা করি। কনকনে ঠান্ডা আর ঝলমলে রোদ্দুর গায়ে মেখে এলোমেলো হেঁটে বেড়াতে বড় ভাল লাগে। এই শহরের রাস্তার ধারে ধারে ফুটপাথ, মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় রাস্তা নেমে গেছে ঘুরে ঘুরে। নীচের ঢালের হোটেল বা হোমস্টের টুকটুকে লাল কি ঝকঝকে সবুজ ঢেউখেলানো ছাদ, আর একটু খেয়াল করে দেখলে দেখা যায় কারুকার্য করা গেট। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা যেমন যেমন উঠেছে বা নেমেছে ফুটপাথও তেমন তেমন ধাপে ধাপে উঠে নেমে গেছে। সিঁড়ি ভাঙতে আলস্য লাগে, নেমে আসি রাস্তায়। বিনুনী করা ল্যাজের আধা ঘুমন্ত কুকুর ঘাড় তুলে দ্যাখে এ কোন আনাড়ি যে ফুটপাথ ছেড়ে গাড়িচলা রাস্তায় নেমে যায়! ইস্কুলফেরত কিশোরী পিঠু পিঠে চলতে চলতে কোটের কলার তুলে কান ঢাকে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে কেউ গিটারে টুং টাং করছে, সন্ধ্যেবেলা এই গিটারেই ঝমাঝম সুর উঠবে। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে সারি দিয়ে বোলেরো দাঁড়ানো, অল্প কটা স্কর্পিও, ট্যাভেরা। দার্জিলিঙ, কার্শিয়াঙ, অহলদারা কি ইচ্ছেগাঁও চলে যাও যেখানে ইচ্ছে।
বিনুনী ল্যাজ ঘড়ির মোড় ট্রাফিক কন্ট্রোলে দুজন সুন্দরী পুলিশ, পথনির্দেশ চাইলে হাসিমুখে দেখিয়ে দিয়েও একজন নেমে এসে একটু এগিয়ে দেন। ধন্যবাদ দিয়ে ঠিক পথে খানিক গিয়ে খেয়াল হয় নাম জিগ্যেস করি নি তো। যেখানে ডেরা বেঁধেছি সেখানকার মালকিন হিমালয়ান বুক স্টোরের কথা বলে দিয়েছিলেন, ঢুকে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি, ঘাঁটাঘাঁটি করি। বইয়ের সংখ্যা ও মান কোনওটাই সুবিধের লাগে না। দোকানের মালিক একঘন্টা পরে আসতে বলেন একটি কফি টেবল বই দেখাবেন এই শহরের উপর। শুনেটুনে তেমন আগ্রহ জাগে না। ঘাড় নেড়ে হাঁটা দিই। আরো পাঁচরকম জিনিষের সাথে প্রচুর সংখ্যক শীতবস্ত্রের দোকান। মোড়ের মাথায় শীতবস্ত্রের মস্ত দোকানের মালিক ছেলেটির আদিবাড়ি আম্বালায়। সেও ভারী শীতের জায়গা তাই ওর ঠাকুর্দা ঠাকুমাকেও এখানে নিয়ে এসেছেন ওর বাবা বছর ছয়েক আগে, চলতে চলতে শুনি। মাথায় উলের টুপি গায়ে মোটা জ্যাকেট পরে দোকানী হয় উদাসমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে রোদ্দুর মাখছেন নয়ত পাশের দোকানীর সাথে গল্প জুড়েছেন। ক্রেতার প্রতি আবাহনও নেই বিসর্জনও না। ক্রেতা নিতান্তই কিনতে আগ্রহী হলে স্মিতমুখে ভিতরে ঢুকে বিকিকিনিতে ব্যস্ত হন। দেখে ভারী আরাম লাগে, কারো বিশেষ তাড়া বা উত্তেজনা কিছু নেই।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশভাগের পরপর কাশী নাথ কউল কাশ্মীর থেকে চলে আসেন এই শহরে। জীবিকা নির্বাহের জন্য খোলেন ছোট্ট একটি বইয়ের দোকান কাশী নাথ এন্ড সন্স। তাঁর মৃত্যুর পরে ছেলে অনিল কউল আর ছেলের বৌ সঙ্গীতা কউল চালান বইয়ের দোকানটি। পাশেই গা লাগোয়া একটি স্টেশনারি দোকানও আছে তাঁদের। আমাকে 'কাশীনাথ' লিখতে দেখে অনিলবাবু শুদ্ধ করে দেন, একসাথে নয় নাম হল কাশী, মিডল নেম নাথ ওটি আলাদা হবে। অনিলবাবু নানারকম বই এনে দেখান। মাথায় খেলে ফেরার ফ্লাইটের বরাদ্দ পনেরো কেজির ওপরে নিতে গেলে অতিরিক্ত গাঁটগচ্চা যাবে। আমার আগ্রহ দেখে একটা ম্যাপ বের করে দেন মোটামুটি ভারতের পশ্চিম থেকে পূর্ব অবধি হিমালয়ের ম্যাপ। এইটেই খুঁজছি আজ বছরখানেক। সিকিমের ওপর একটি বই দিয়ে বলেন এই বইটা যে সময়টুকুর কথা আছে বইতে, সেসময় দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলাও সিকিমের রাজার অধীনে ছিল। পরে ইংরেজরা দখল করে এই জায়গাগুলো। মোবাইলে আমাজনের সাইট খুলে দেখি ভারতে পেপারব্যাকের দাম ২০০০ এর ওপরে। আর আমাজন ডট কমে $ ৩৭ + $ ২০(শিপিং)। সে তুলনায় এই হার্ড বাউন্ড বইটা তো এক চতুর্থাংশ দাম। ধুত্তোর অতিরিক্ত লাগেজ দেখা যাবেখনে।
ফিরতে হবে ফিরতে হবে। আর থাকা যাবে না, এবারে নামতেই হবে ধুলোধোঁয়াভরা সদা উত্তেজিত, সদা ক্রুদ্ধ জনপদে। যতটুকু পারা যায় চোখ মন দিয়ে শুষে নিই এই শান্ত নিরিবিলি জনপদটিকে। আসবো আবার।
সকালের তিস্তা
ভর দুক্কুরবেলা
(শেষ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।