২০১০ এ উদ্বোধন হওয়া নামসাইয়ের গোল্ডেন প্যাগোডা বা পিস প্যাগোডা হল বার্মিজ স্টাইলের বৌদ্ধমন্দির, কোংমু খাম নামেও পরিচিত। ওয়ার্ল্ড ত্রিপিটক ফাউন্ডেশান কোংমু খামকে ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক ত্রিপিটক সেন্টার হিসাবে গড়ে তুলছে। ২০ হেক্টর জায়গা জুড়ে ছড়ানো এক মস্ত চত্বর, মূল প্যাগোডার চারপাশে বাগান, বসার জায়গা, ঠিক ঢোকার দরজার পাশেই স্যুভেনিরের দোকান। আমি আর দেবাশীস ঢুকে এটা সেটা নেড়ে দেখি। দেবাশীস টুকটাক কেনাকাটি করে, একটা মুড়ির গুঁড়োর বিস্কুট, ভারী ভাল খেতে। বেচারা একটাই বড় প্যাকেট কিনেছিল বাড়ির জন্য। তা সে ফেরার আগেরদিন রাতে ‘তুমি কিনলে আমাদের কেনো দেখালে না? কেনোও? একটা পার্ট কেটে দাও আমার বাড়ির জন্য নেব’ শুনতে শুনতে শেষে পুরো প্যাকেটটাই দিয়ে দিল বা বাধ্য হল বলা যায়। বিস্কুটের প্যাকেট আবার অমনি কেটেকুটে দেওয়া যায় নাকি! কিন্তু সেসব তো পরে। আপাতত ২০১০ এ তৈরী হওয়া অর্বাচীন এই প্যাগোডার ভেতরে কিইবা দেখব! আমি বরং ঘুরেফিরে বাগানটা দেখি। বাইরে এসে দেবাশীসের সাথে বসে বসে আগামী বর্ষার পরে ১২০০ বছরের পুরানো গুম্ফা দেখতে যাবার প্ল্যান করি। বাকীরাও আসে একে একে শুধু দুজন ছাড়া।
আমরা গাছের ছায়ায় বাঁধানো বেদীতে বসে বসে গল্প করি, দেবাশীস আর রূপম এদিক ওদিক ইতিউতি দেখে , যদিই ওঁরা এসে যান। শেষে ফোন করা হয় এবং জানা যায় ওঁরা প্যাগোডার ভেতর দিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকের গেটের কাছের কোন একটা কফিশপের পাশে অপেক্ষা করছেন। কি আশ্চর্য! কেন? নাকি নামার সময়ে জিগ্যেস করায় গাড়িচালক ওইখানেই গাড়ি রাখার কথা বলেছিলেন। অতঃপর প্রায় মিনিট দশেক হেঁটে ওঁরা ফেরত আসেন, চালকের উপরে মৃদু তর্জন গর্জনসহ গাড়িতে ওঠেন। রোয়িঙের সূর্যাস্ত দেখা নাকি আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকে, অতএব কোথাও একটা দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলি আমরা। চালকের পাশের সীটে বসার সুবিধে হল চলতে চলতে টুকটাক নানারকম গপ্প শোনা যায়। একটা বড়সড় ব্রীজে উঠি, দুদিকে নীল জলের বিস্তার। মাঝে মাঝে চরা, পাশ দিয়ে ঘুরে আবার অতল নীল। করিমভাই বলেন এইটা দিবাং নদী, সেএইই পরশুরাম কুন্ড থেকে এসেছে, সামনে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিশে গেছে। আমি একটু ধন্ধে পড়ে যাই, কারণ আজকেই গুগলে দেখছিলাম ১৯৫০ এর ভূমিকম্পে লোহিত নদীর থেকে পরশুরাম কুন্ড সৃষ্টি হয়েছিল। পরে ফিরে এসে ভাল করে ঘেঁটে দেখছি পরশুরাম কুন্ডের উপরের পাহাড় থেকে ব্রহ্মপুত্রের বিনুনী ফর্মেশান দেখা যায়। সেক্ষেত্রে লোহিত, দিবাং, সিয়াং তিনজনেই পরশুরামের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করেছে বটে।
দিবাং নদী গাড়ির ভেতরে তখনও যাকে বলে থমথমে আবহাওয়া, ফলে ব্রীজের মাঝামাঝি একটু ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাবার প্রস্তাবে কেউই পাত্তা দিল না, আমিও আর জোর না করে চলতি গাড়ি থেকেই কয়েকটা ছবি নিলাম। শুধু নদীগুলোকে ভাল করে দেখতেই অরুণাচলে আরো কয়েকবার আসতে হবে। রোয়িঙে আমরা থাকব দিবাং ভ্যালী জাঙ্গল ক্যাম্প, হেল্প ট্যুরিজমের মাধ্যমে এঁদের সাথে যোগাযোগ বুকিং ইত্যাদি করা যায়। জাঙ্গল ক্যাম্প মালিক রূপমের ব্যক্তিগত বন্ধু, আমরা যে দুটো গাড়িতে ঘুরছি সেই দুটোও ওঁরই। শুনেছি উপরে নীচে ঘন কমলালেবু বাগান ও ব্যক্তিগত মালিকানার জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের ধাপে গোটা চারেক বাংলো আর দরকারমত খাটানো হয় এমন কয়েকটা তাঁবু নিয়ে তৈরী এই ক্যাম্প, প্রতিটা বাংলোর সাথে দিবাংভ্যালী ফেসিং ব্যালকনি বেতের চেয়ার টেবিল দিয়ে সাজানো। বেলা পৌনে চারটে নাগাদ পৌঁছে যাই আমরা ক্যাম্পের চত্বরে। গাড়ি থামে, মালপত্র নামে ধীরেসুস্থে, আমরাও নামি। বাঁদিকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে মুখোমুখী দুটো বাংলো, মাঝের কাঠের মাচায় সামনের গাড়ির মালপত্র নামিয়ে রাখা হচ্ছে একটা দুটো, পেছনে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখছি কমলা রঙের সূর্য দিগন্তরেখার দিকে ঢলেছে। তাহলে আমরা থাকব ৯০ডিগ্রি কোণে যে অন্য দুটো বাংলো সেখানে।
এখানেও কাঠ বাঁশ কঞ্চি ইত্যাদি দিয়েই তৈরী বেশ বড় ঘর, দুটো আলাদা খাট আর তাতে শুধু যে ছত্রী লাগানো তাই নয় আবার মশারী টাঙিয়ে গুটিয়ে তোলা আছে ওপরে। সেই যে আগেকার দিনে বড়সড় জমিদার বাড়ির ছবিটবিতে যেমন দেখা যায় সেইরকম। প্রথমেই ব্যাকপ্যাক আর আর কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে ব্যালকনির দরজা খুলি, পেছনে কমলালেবু গাছের বন কিন্তু তা পেরিয়ে নীচের উপত্যকা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আর ... আর এইটা উত্তর দিক তাই এখনই বেশ অন্ধকারমত হয়ে আছে। একটু নিরাশ লাগে, যাহ আমাদের গাড়িটা আগে এলে আমরা ব্যালকনিতে বসেই সূর্যাস্ত দেখতে পেতাম। ইতোমধ্যে দেবাশীস এসে আমার স্যুটকেসটা ঘরের সামনে বসিয়ে গেছে, ভেতরে ঢুকিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিই। আহা দেবানের পরে এ একবারে রাজকীয় বাথরুম, আবার বাড়ির মত মেঝের জল সরানোর জন্য রাবার লাগানো ওয়াইপারও আছে দেখি। সকালে যদিও স্নান করেই বেরিয়েছি তবু পরিচ্ছন্ন বাথরুম দেখে আরেকবার স্নানের ইচ্ছে হয়, কিন্তু না আগে সূর্যাস্ত দেখা তারপর বাকীসব। খাবারঘর সংলগ্ন বারান্দা থেকে নদী ও সূর্যাস্ত সবচেয়ে ভাল দেখা যায় রূপম বলেছিলেন।
বাইরে যেন কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে, চাপা গলায় কেউ যেন কাউকে খুব বকছে! খানিকটা অবাক হয়েই কাঁধের ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরোই। ওরে বাবারে ... বাইরে পুরো বজ্রবিদ্যুতসহ ঝঞ্ঝাবাত্যা, অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি। আমাকে দেখেই মিস্টার পার্ফেক্ট চাপাগলায় গর্জে ওঠেন ‘এই তোমরা। তোমরা কেন আগে আগে এসে খারাপ ঘরে উঠে এসেছ? ওইদিকে সূর্যটা দেখতে পাও নি? এখানে অন্ধকারে মুখ গুঁজে থাকো এখন।“ যাব্বাবা এ আবার কি!? যাঁরা আগে ছিলেন তাঁরা সামনের ঘরে ঢুকে গেছেন এর মধ্যে আমাদের কী ভূমিকা? নাহ সেসব উনি শুনতে রাজী নন। মিসেস পার্ফেক্ট রূপমকে ডেকে কথা বলতে বলেন। নাহ তাও তিনি বলবেন না, তিনি কাউকেই কিছুই বলবেন না। আমরা, আমরাই দায়ী আমরাই ভুগব। সে নাহয় হল, কিন্তু আমরা খাবারঘরে গেলেই তো দেখতে পাব সূর্যাস্ত। এত কাঁইকিচিরের কী আছে রে বাপু! ধুত্তেরি নিকুচি করেছে, আমি বিরক্ত হয়ে মাচা থেকে নামি, পায়ে পায়ে এগোই খাবারঘরের দিকে। তথাকথিত ‘ভাল ও লোভনীয়’ বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছেছি কি পৌঁছাই নি পেছন থেকে বজ্রপাতের মত মিসেস পার্ফেক্টের গর্জন ভেসে আসে ‘রূপঅম এদিকে শুনে যান’। সেই গর্জনে গোটা ক্যাম্পচত্বর স্থানু হয়ে যায়, শুধু রূপম কুলকাল এগিয়ে যান।
‘আমাদের কেন খারাপ ঘর দেওয়া হয়েছে’ অভিযোগের উত্তরে সেই ভাল ঘরে উঠে যাওয়া দম্পতি সানন্দে ঘর বদলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন, রূপম ঝটপট মালপত্র শিফট করানোর ব্যবস্থা করেন, দুটো ঘরই বদলানোর প্রস্তাবও দেন। কিন্তু মিস্টার পার্ফেক্ট ওই পাশেরটাতেই থেকে যাবেন, কোত্থাও শিফট করবেন না জানান। পুরো ব্যপারটার কদর্যতায় আমার বড় অপ্রস্তুত লাগে, লজ্জা করে। বারেবারে সরি বলি রূপমকে, দেবাশীসকে। দেবাশীস হাত নাড়ে ‘ছাড়ো তো। তুমি সরি সরি করছ কেন?’ এই ঘরের ব্যালকনি থেকে সূর্য শুধু নয় একফালি উপত্যকা আর ফিতের মত দিবাং নদীও দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকি, খাবারঘর সংলগ্ন বারান্দা ডাকছে। রুম্মি সেই গর্জনের পর থেকেই একেবারে চুপ করে গেছেন, ব্যালকনিতে বসে আছেন। খাবারঘর থেকে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেছে, খেতে খেতে ওদিকে যাবেন কিনা জিগ্যেস করায় রুম্মি জানান নাহ যাবেন না। সামান্য দু’একটা প্রশ্নেই বেরিয়ে আসে আরো অনেক কিছু। মেয়েদের সেই চিরন্তন একপক্ষকে খুশী করতে গিয়ে অপরপক্ষের কাছে অতি খারাপ হয়ে যাওয়ার গল্প। চুপ করে শুনি, বিশ্বাস করি একজন মানুষের প্রতিটা কাজের দায়িত্ব তার নিজেরই, কিছুই বলি না অবশ্য। মনটা আরো অন্ধকার হয়ে যায়।
খাবারঘর পেরিয়ে কাঠ ও বাঁশের টানা বারান্দা। ক্যামেরা ফোন ইত্যাদি বাগিয়ে সবাই উপস্থিত সেখানে। আর সামনে দিগন্তজোড়া ক্যানভাসে চলছে রঙে রেখায় ছবি আঁকা। কমলা থেকে লাল হয়ে মেরুণ হয়ে সূর্য টুপ্পুস করে নেমে যায়, ডুব দেয় দিবাঙে। বিশাল উপত্যকা ছড়িয়ে থাকে রূপোলি থেকে নীল হয়ে পার্পল হয়ে যাওয়া দিবাঙের ধারাগুলো বুকে নিয়ে, কমলালেবু গাছেরাও সেজে ওঠে লাল কমলার নানা শেডে, সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট কি একঘন্টা পশ্চিম আকাশ ধরে রাখে রঙের ছোপ। ওখান থেকে নেমে ভেতরের প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়াই, খাবারঘরের জানলা দরজা দিয়ে লালে লাল আকাশ আর মাথার উপরে পেট্রোল ব্লু আকাশ ধীরে ধীরে মুছে নেয় মনের উপর লেপ্টে থাকা কালো অন্ধকার।
‘কলুষ কল্মষ বিরোধ বিদ্বেষ হউক নির্মল,হউক নিঃশেষ-‘ সুচিত্রা মিত্রর জোরালো বলিষ্ঠ গলার সাথে মিশে যেতে থাকে আমার গলা।
সূর্যাস্তের এক ঘন্টা পরে - রোয়িং