এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  ঘুমক্কড়

  • নামদাফা এবং – ৩

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | ঘুমক্কড় | ২২ জানুয়ারি ২০২২ | ১৯৭৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • | | | | ৫  | | | |
    কাকচক্ষু জল নিয়ে নোয়া ডিহিং আবার কে!
    ছবি সৌজন্য ঃ সমরেশদা।
     
    হুলক গিবন বাংলায় যাকে উল্লুক বলে,  ভারতে তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণে আর  দিবাং নদীর উত্তর ও উত্তরপূর্ব তীর বরাবর অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, আসাম মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে। ক্যাপড লাংগুর, অর্থাৎ কিনা টুপিপরা মুখপোড়া হনুমান,  তাদেরও স্বাভাবিক বাসস্থান এই অঞ্চলেই। এই দুই প্রজাতিই নন-হিউম্যান প্রাইমেট। এর মধ্যে উল্লুকদের ভাবসাব অনেকটাই মানুষের মত। পুরুষ উল্লুক ঘন কালো লোমেভরা শরীর, কপালে সাদা চওড়া পট্টির মত, মেয়ে উল্লুক কিছুটা বাদামী রঙ,  চারপাশটি সাদা লোমে ঘেরা মুখখানা যেন ফুলের মত ফুটে থাকে গরবিনী উল্লুকিনীর।  মাঝেসাঝে ঘন ঘিয়ে রঙের উল্লুকিনীও দেখা যায় বটে তবে সে খুবই কম। উল্লুকের লেজ থাকে না, এদের হাত দুটো মস্ত লম্বা হয় আর চার হাত পায়ে একডাল থেকে অন্যডালে দুলে দুলে ঝাঁপ খেয়ে চলাফেরা করে অত্যন্ত দ্রুত। এদের চলাফেরা দেখেই সম্ভবত সার্কাসে ট্র্যাপিজের খেলা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতে প্রাপ্ত  উল্লুকদের পুরুষ ও মেয়ে  উল্লুকছানা বড়সড় হলে দল ছেড়ে আলাদা হয়ে গিয়ে সংসার পাতে। সাধারণত একটা দলে বাবা আর মা উল্লুক আর তাদের দুই তিনটে ছানাই থাকে। 
     
    ক্যাপড লাংগুরের কপালের উপরে একগোছা কালো স্পাইকড চুল, ঠিক যেন টুপিটি কপালে আলগোছে নামিয়ে হনু বাবাজী জঙ্গলে বেড়াতে বেরিয়েছেন। এরা আবার দলবেঁধে থাকতেই ভালোবাসে, এক এক দলে মোটামুটি হনুমান ও হনুমতী মিলিয়ে  ৮ থেকে ১২ জন থাকে। চলাফেরাও করে দলেবলে।  দেবান ইকো হাটের রান্নাঘরে অনিলদা ও তাঁর সহকর্মী বলেন এই তো লক ডাউনের মধ্যে ক’মাস লোকজন তেমন আসে নি তাই কটি উল্লুক পরিবার আর টুপিওলা হনুর দল দিনে তিন চারবার করে ঘুরে যাচ্ছিল। উল্লুকরা ডালে ডালে দৌড়ানোর সময় তীব্রস্বরে ডাকে ‘উক উক উকু উকু উউকু উউকু উউক্কু উউককু উউক উউক’।  অনেক দূর থেকে শোনা যায় সেই আওয়াজ। হনুদের ডাকও নাকি যথেষ্ট তীব্র, তবে তা  শোনার সৌভাগ্য হয় নি আমাদের। ক্যাপড লাঙ্গুররা আইইউসিএন লিস্টে ভালনারেবল হিসেবে চিহ্নিত এখনো পর্যন্ত।  তবে মানুষের চাহিদা যত বাড়ছে ততই  এরা ক্রমশ  কমে আসছে সংখ্যায়। নানারকম পাতা ফল ফুল শেকড় এদের খাদ্য, মূলত গাছে গাছেই চরে বেড়ানো এদের একটা বৈশিষ্ট্য  হল  পুরো দল একটাই লম্বা সারিবেঁধে যাতায়াত করে। আগেরজন যে ডালে ল্যাজটি পেঁচিয়ে ঝুল খেয়েছে পরেরজন ঠিক সেই জায়গায় নিজের ল্যাজের প্যাঁচটি জড়াবে। 
     
    কখন বসের আসবে টেলিফোন, তখন খুলবে ঘরের দরজা। তাতে কি! আমরা ততক্ষণ মনের আনন্দে আড্ডা দিই।
    ছবি সৌজন্য : - রূপম মুখার্জী
     
    যতক্ষণ না হেড অফিসের অনুমতি আসে ততক্ষণ আমরা বারান্দা আর সিঁড়িতে হাত পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা দিই। মোবাইল নেটওয়ার্ক সেই গেট পেরিয়ে ঢোকার অল্প আগেই হাওয়া হয়ে গেছে। সে গেট পেরিয়ে আবার খানিক  ফেরত না যাওয়া অবধি আর আসবে না। বিদ্যুতও আসে নি এখানে। তবে সারি সারি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানো আছে। তাতেই গোটা চত্বর  ফটফটে সাদা আলোয় আলোময় হয়ে থাকে। রাতের বেলা আমি  আর মধুমিতা বলাবলি করি এত বেশী আলো না লাগালেও পারত এরা। কিন্তু রাত্তির তো এখনো দেরী আছে, সবে বেলা বারোটা। এদিকে টিনের চালে কিসের যেন আওয়াজ হচ্ছে খটাং খটাং করে বেশ জোরে নিয়মিত ব্যবধানে। যাচ্চলে এ আবার কি উৎপাত। ইতিমধ্যে দেবাশীস দেখে ফেলেছে ঘরের গা লাগোয়া মস্ত উঁচু গাছটায় একটা মোটাসোটা  তাগড়াই দেখতে চকচকে কালো কাঠবেড়ালি ফল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর বিচিগুলো নীচে টিনের চালে ফেলছে ঠঙাৎ ঠঙাৎ করে। ইয়া ঝোপালো  কি তার ল্যাজের বাহার! জায়েন্ট মালয়ান স্ক্যুইরেল। আমাদের উৎসাহে বিরক্ত হয়ে নাকি ওর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল বলে, কে জানে কেন ত্রিং করে লাফ মেরে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। আর আমরা  আদেখলা শহুরেরা আশায় আশায় উর্ধমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আরো কতক্ষণ। 
     
    অরুণাচলের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ​​​​​​​কাঠ ​​​​​​ ও ​​​​​​​খড়ে ​​​​​​​ছাওয়া ​​​​​​​কুঁড়েঘর। ​​​​​​​
    ছবি সৌজন্য :-  রূপম মুখার্জী
     
    কিছু পরেই অবশ্য ডর্মিটরির পেছনে আর একটা গাছে দুজন আরো দুটো মালয়ান স্ক্যুইরেল দেখে ফ্যালেন। ডেকে দেখান। চেষ্টা করি ছবি তোলার, কিন্তু নাহ ক্যামেরায় কিসব সেটিংস কবে যেন করেছিলাম, কেবলই ঝাপসা আসে এত কাছের ছবি।  ইতিমধ্যে ঘর টর খুলে দিয়েছে। করিমভাই টেনেটুনে স্যুটকেস  ব্যাগগুলো বারান্দায় তুলে দেন। দুপুরের খাবার তৈরী হচ্ছে গরমাগরম। নদীর ধারের ঘরগুলোতে থাকতে পারব না, যা বুঝলাম। কাঠের মেঝেয় বাঁশের বিছানা, চাটাইয়ের দেওয়ালে অজস্র ফুটো,  রাতে নদীর হাওয়া আসবে কনকনে, বাথরুমটাও বেশ ইসেমত।  তা আমাদের ঘরে ঢুকে হাত মুখ ধুতে গিয়ে দেখি আমাদের পাকা বাথরুমেও  কমোডের সিস্টার্নটা ভাঙা, ফ্ল্যাশ করা যাবে না। বাথরুমের দুইপাশ বরাবর পাইপ আর দুটি কল, দুটো ৫০ লিটারের  বালতি আর দুটো মগ। ঘরের সাথে পেছনে একটা ছোট বারান্দা, শেষপ্রান্তে একটা বেসিন। বারান্দায় ছাদ পর্যন্ত  জাল দেওয়া, পেছনেও জঙ্গল। বেরিয়ে এসে রূপমকে একবার জিগ্যেস করি  সিস্টার্নটা ঠিক করানোর কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা।  দুই হাত উলটে বলেন প্রশ্নই নেই, মিয়াও থেকে প্লাম্বার এনে ঠিক করাতে হবে, তাও যদি সেই প্লাম্বার অন্য কোথাও কাজে চলে গিয়ে না থাকে তবেই। 
     
    অগত্যা, কি আর করা যাবে! এই চারটে ঘরের পাশে মাঝারি সাইজের সিন্টেক্স বা ওরকমই কোন কোম্পানির ট্যাঙ্ক, সাথে একটা দুমুখো স্যুইচ লাগানো কল আর পাইপ চলে গেছে ঘর, ডর্মিটরি পেরিয়ে সেই রান্নাঘর অবধি। দেখে শুনে বোঝা গেল  কল এইদিকে ঘুরলে ঘরের বাথরুমে,  বারান্দার বেসিনে জল আসে আর ওইদিকে ঘুরলে রান্নাঘরে জল যায়। এখন রান্নাবান্না হচ্ছে তাই কল ওইদিকে ঘোরানো। মনে মনে নোট করি রাত্রে শোবার আগে অনিলদাকে বলে বালতিদুটো একদম ভরতি করে রাখতে হবে। খেয়েদেয়ে আমরা বসি বারান্দায় সিঁড়িতে। সূর্যাস্তের মিনিট কুড়ি আগে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, ওখান দিয়েই নাকি হুলক গিবনরা আর ক্যাপড লাঙ্গুররা যায়। এই টুপিওলা হনুরা নাকি ঠিক সুর্যোদয় আর সুর্যাস্তের আগে দলে দলে দৌড়ে লাফিয়ে গিয়ে নদীখাতে নেমে দিগন্তরেখার কাছাকাছি উঠতে থাকা বা ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সেই সময় ওদের পেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেও ওদের কোন হুঁশ থাকে না। ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফিতে অভিজ্ঞ রূপমের মুখে এই গল্প শুনে মনে হয় তবে কি এই দেখেই কোনকালে হনুর সূর্য্যকে বগলে চেপে ধরার গপ্পোটা  বানিয়েছিল কেউ?  আজ সূর্যাস্ত ৪টে ১৬ মিনিটে, পৌনে চারটে নাগাদ রওনা দিই আমরা। 
     
    এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, দুদিকে ঝুঁকে আসা বড় বড় গাছ, ঘন সবুজ জঙ্গল আর হাল্কা চড়াই বেয়ে পৌঁছে যাই অভীষ্ট জায়গায়। সাদা ধবধবে চেহারা, গায়ে এদিক ওদিক ক'টা কালো ছাপছোপ, আর কান আর চোখ জুড়ে ধ্যাবড়ানো কালো ছোপওলা  একটা ছাগল,   দেবান বাংলোর পোষ্য আমাদের সঙ্গ নেয়। সেই যে সেই রাস্তাটা উঠে গেছিল বিজয়নগরের দিকে, প্রায় সেই বিভাজকের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে চুপচাপ দাঁড়াই  সবাই, দেবাশীস একটু উঠে জঙ্গলের ভেতরে ঢোকে কোন পাখির আওয়াজ লক্ষ করে আর ওকে একা যেতে দেখেই ছাগলটা ওর সঙ্গ নেয়। মিনিট দশেক পরে অবশ্য দেবাশীস  বেরিয়ে আসে ছাগলটাকে বকতে বকতে, কোথাও প্রজাপতি বসা দেখলেই সে ব্যটা লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে ওদের উড়িয়ে দিচ্ছিল, বেচারা একটাও ঠিকঠাক ছবি নিতে পারে নি।  এই ছাগলটা উত্তরবঙ্গ বা সিকিমের হোমস্টেগুলোর এলাকার কুকুরের মত বাংলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে সঙ্গে যায় যতটা ওর এলাকা তত অবধি, কাউকে একলা কোন দিকে যেতে দেখলে ও তার সঙ্গ নেয় অতি বিশ্বস্তভাবে, আবার ফিরে আসে। কিন্তু যতই হোক ব্যটা তো ছাগল, তাই কুকুরের মত সমাদর ওর জোটে না আর আমার  মনে পড়ে সেই হিতোপদেশের  গাধা আর কুকুরের গল্পটা।
     
    আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখি, ফিসফিস করে কথা বলি ঘাড় উঁচিয়ে আকাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করি সূর্যাস্তের আর কত বাকী। রূপম বলেন আর পাঁচ মিনিট দেখে ফিরে যাব, ওরা আসলে এই সময়ই আসবে নাহলে আর নয়। শৈলেনদা এরই মধ্যে মস্ত ক্যামেরা বাগিয়ে কোন পাখিকে ধরার চেষ্টা করছেন। হঠাৎই গোটা জঙ্গল জুড়ে বেজে ওঠে ঘন্টার আওয়াজ। সিকিমে যাঁরা নিয়মিত যান নিশ্চয়ই শুনেছেন এই অপার্থিব ঘন্টা।  ঘন্টাঝিঁঝি বা বেল ক্রিকেট, ফিনফিনে পাতলা দুটো ডানা ঘষে ঘষে এই আওয়াজ বের করে। সব ডাকাডাকি থামলে  ফেরার পথ ধরা। এসে আবারও নদীর ধারে যতক্ষণ না ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়। দেবান বাংলোটা এমন জায়গায় যেখান থেকে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু সূর্যাস্তের দেড়ঘন্টা পরেও নদী পেরিয়ে জঙ্গলের ওই কোণায় যে দক্ষিণ পশ্চিম আকাশ তার দিগন্তরেখা ঘেঁষা আঁচল টকটকে লাল হয়ে থাকে। গোটা আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে, আমলকি গাছের মাথায় হীরের দুলের মত ঝকঝকে সন্ধ্যাতারা, আস্তে আস্তে একটি দুটি করে  রাতের ক্লাসে হাজিরা দিচ্ছে অন্য তারারাও, তবুও দিগন্তের আঁচল তখনো লাল থেকে গাঢ় লাল হয়ে মেরুণ হয়ে আসছে আর সেই রঙটুকু ফোটাতেই যেন অল্প একটু তুঁতেনীল লেগে আছে উপরে। 
     
    সূর্যাস্তের একঘন্টা পরেও এই রঙ ধরে রেখেছিল আকাশ
    03/12/2021
     
    এই অদ্ভুত সুন্দর দিনটার ঝোলায়  আরো কিছু দেবার ছিল, কিন্তু সেসব তো রাত আরেকটু ঘন হলে। তার আগে বরং  অন্য একটা গপ্পো বলি। অন্ধকার বেশ একটু ঘন হতে  সবাই যে যার ঘড়ে ঢোকে, আমিও। গপ্পোবই খুলে বসেছি সবে,  রুম্মি বাথরুমে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে আসেন, হাঁইমাই করে বলেন সেই ভাঙা সিস্টার্নের কথা। তা সে তো আমি সেই দুপ্পুরবেলাই দেখেছি। তাই শুনে আরো রেগে যান, কেন বলি নি কাউকে? কি জ্বালা বলেছি তো, ও এখানে ঠিক হবে না। তেড়েমেরে দেবাশীসদের ঘরে গিয়ে বকাবকি শুরু করেন, একে একে সব ঘর থেকে লোকজন বেরোয়, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বই নিয়ে কানে প্লাগ গুঁজে গ্যাঁট হয়ে বসি বিছানায়। অতঃপর কী হইল জানে শ্যামলাল। মিনিট দশেক বাদে রুম্মির প্রত্যাবর্তন, পিছু পিছু  মিস্টার পার্ফেক্টও আসছিলেন চল চল ঘরটা বদলিয়ে নাও বলতে বলতে। রুম্মি দিলেন তাঁকে এক বেমক্কা ঝাড়, ‘নাআ ঘরে আরো লোক আছে তার মতামতটাও জানতে হবে।‘ জানলাম যেসব ঘরে আস্ত সিস্টার্ন,  সেখানেও ফ্ল্যাশ করার পরে অতিই ধীরে জল আসে এবং বয়ে যায়। কঠিন তরল পদার্থদের মহাভিনিষ্ক্রমন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করে রুম্মি জানান ‘নাহ আমরা যাব না। ও-ও রাজী নয়,  বলল থাক।‘ 
     
    যাক্কলা! এ দেখি  আমার নামে বিল কেটে দিল! যাকগে, দুদিনের দুনিয়া, সবই মায়া। আমি আবার বইয়ে মুখ গুঁজি। কিন্তু নাহ, রুম্মি আমাকে একলা ঘরে বসে থাকতে দেবেন না, ওঁদের সাথে গিয়ে ওঁদের আসরে যোগ দেবার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। তা গেলাম বুঝলেন, মিস্টার এন্ড মিসেস পার্ফেক্ট আর দেবাশীস সেখানে ভ্যাট-৬৯ এর বোতল খুলে বসল, সাথে খেজুর চানাচুর ইত্যাদি। এই ভ্যাট-৬৯ জিনিষটা যে কি লেভেলের অখাদ্য কি বলব!  এরা কেন এত আহ্লাদ করে খাচ্ছে খোদায় মালুম। তবে খেজুরগুলো ভারী ভাল ছিল। দেবাশীসের রহস্য রোমাঞ্চ টাইপ গপ্পোগুলোও খাসা, এ মানতেই  হবে। গপ্প গড়ায়, গড়াতে গড়াতে গাছে ওঠে, পাহাড়ে ওঠে। বাইরে কিছু জোরে জোরে কথার আওয়াজ, উঠে গিয়ে দেখি ভাবতে ভাবতেই রূপম ঢোকেন হুড়মুড় করে ‘আরে একটা ফ্লাইং স্ক্যুইরেল, দেখবেন তো শীগগির আসুন’। দৌড়ে বেরিয়ে দেখি অন্যরা মোবাইলের টর্চ সেই হুউউইইইই উঁচুতে গাছের মাথায় ফেলে ছবি তোলার চেষ্টা করছেন  আর বেচারি সাদাটে রঙের ছোট্ট  কাঠবেড়ালি  এত আলো ফালো দেখে বিরক্ত হয়ে  ক্র্যাঁঅ্যাঁ ক্র্যাঁঅ্যাঁ  করে চেঁচাচ্ছে। ব্যাটা এতটাই উঁচুতে বসা আর মোবাইলের আলো এত দূর্বল যে ছবি কিছুতেই আর উঠছে না। 
     
    এরই মধ্যে সেই যে সেই ফরেস্ট বাংলোটা, যেখানে ঘ্যাঁচাম্যাচা করে কাজ হচ্ছিল, সেইদিক থেকে একজন জঙ্গলরক্ষী  একটা  বেশ বড়সড়  টর্চ নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলেন, গাছের মাথায় ফেললেন আলো। মোবাইলের তুলনায় একটু জোর হল বটে, কিন্তু ছবি তবুও উঠল না। আসলে বারান্দা আর চলাচলের রাস্তার আলোটুকু ছাড়া বাকী তো গহীন ঘন মিশমিশে অন্ধকার। এদের নাম  উড়ন্ত হলেও এরা আসলে ঠিক পাখির মত করে ওড়ে না, বরং গ্লাইড  করে যায়। এদের  সামনের আর পিছনের পা পাতলা চামড়া দিয়ে জোড়া অনেকটা হারমোনিয়ামের বেলোর মত। দরকারমত পুরোটা মেলে ধরে বাতাসে ভেসে ভেসে এক গাছ থেকে আরেকটায় যায়। পরে নেট ঘেঁটে দেখেছি গায়ের রঙ  বাদামী, অত আলো পড়ে সাদা দেখাচ্ছিল। শৈলেনদা হেডব্যান্ডে লাগানো খুব  জোরালো আলো আর ক্যামেরা নিয়ে এলেন আর এতক্ষণ ধরে ওর আপত্তি জানানোতে বিন্দুমাত্র কান না দেওয়ায় তিতিবিরক্ত হয়েই এবারে পা’জোড়া ছড়িয়ে ভেসে একটু দূরের একটা গাছে তারপর আরেকটু দূরে করে অন্ধকারে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘরলাগোয়া এই মস্ত উঁচু গাছটা দেখি বিভিন্ন জাতের কাঠবেড়ালির ভারী প্রিয়।  অপূর্ব সুন্দর এই প্রাণীটাকে  দেখে ভারী  কৃতজ্ঞ বোধ করি। 
     
    রাতের খাওয়া যথারীতি চমৎকার। সঙ্গে আনা বোতলগুলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, কাল তো নদী পেরিয়ে নামদাফা জঙ্গলের ভেতরে যাওয়া। অনিলদাকে বলা হয় মিয়াওতে গাড়ি পাঠিয়ে কিছু জলের বোতল আনিয়ে রাখতে। সবাই বলাবলি করেন এ তো সোজা নদী থেকে তুলে জল দিচ্ছে, তাইই খাওয়া, একটা ফিল্টার পর্যন্ত নেই, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ব্যপারটা। আমি জলের বোতল সঙ্গে যা এনেছিলাম সে এখানে আসতে আসতেই শেষ, নদীর জলই খাচ্ছি সেই দুপুর থেকে। হায় তখন যদি জানতাম ব্যপারটা মোটেই ভাল হয় নি! যাক সে কথা যথাসময়ে বলা যাবেখন। এরমধ্যে দলের সবচেয়ে সিনিয়ার, ৭৬ বছর বয়স্ক যুবক জানান যে তিনি কাল যাবেন না, শরীর গতিক মোটেই সুবিধের ঠেকছে না, ষুধু শুধু গিয়ে আর পাঁচটা লোককে বিপদে ফেলতে চান না। খেয়েদেয়ে অনিলদাকে বাথরুমে জল ভরার ব্যবস্থা করতে বলে পায়ে পায়ে আবার নদীর ধার। এলোমেলো এদিক ওদিক দেখতে দেখতে আকাশের দিকে চোখ পড়ে আর স্থাণু হয়ে যাই। দেবব্রত বিশ্বাস গমগম করে মাথার মধ্যে গেয়ে ওঠেন ‘আজি যত তারা তব আকাশে ...’ কয়েকশো কিংবা কয়েক হাজার তারা, একেবারে সোওজা চওড়া হীরের নেকলেসের মত, না ভুল বললাম হীরে আর পোখরাজ বসানো পাতের মত ছায়াপথ উপুড় হয়ে আছে নোয়া ডিহিঙের উপরে। মৃদু আবছা নদীর আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই কোত্থাও। 
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | ৫  | | | |
  • ভ্রমণ | ২২ জানুয়ারি ২০২২ | ১৯৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জয় | 82.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ০২:০৪502997
  • সূর্যাস্তের ছবিটা দেখে ক্যাপড লাঙ্গুর হয়ে গেলাম!
     
    "মহানিষ্ক্রমণ(সিস্টার্ন)"এর প্রবলেম বাজে প্রবলেম- এই জন্যই ক্যাম্পিং/ ক্যারাভান হলিডে এডিয়ে চলি।
  • | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ১১:৪৭503021
  • হা হা জয়, না যাওয়া ভাল, তবে গিয়ে চেল্লামিল্লি না করাই উচিৎ।  জায়গাটা কেমন কোথায়  সেটা দেখা দরকার আর কি। 
  • সমরেশ হালদার | 2401:4900:314d:195f:0:4a:e189:***:*** | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ১৭:৩৩503031
  • উল্লুকিনী!!  শব্দটা দারুণ বেছেছেন। তবে, ঐ ক্যাপড লাঙ্গুরের সূর্যাস্ত দেখাটা পুরেটাই গপ্পো বলে মনে হয়। আর, তখন ওদের গায়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা  নাঃ, এতটা নেওয়া যা না কি!? 
  • | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ১৮:০৫503032
  • কে জানে!  এই ক্যাপড লাঙ্গুররা জলে নামে কেবলমাত্র জলজ শ্যাওলা বা পাতাটাতা খেতে। সূর্য দ্যাখে কিনা কে জানে!  হাহাহাহা।
    বনশ্রীর বেণুদার গপ্পগুলো ভাবলে এইটা ত নিতান্ত নিরিমিষ্যি।
  • aranya | 2601:84:4600:5410:64fc:e9bb:c58c:***:*** | ২৪ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:২৩503054
  • সুন্দর লেখা । সূর্যাস্তের ছবি টু গুড 
  • Mousumi Banerjee | ১৯ মার্চ ২০২২ ১৬:০০505001
  • ক্যাপড লাঙ্গুরের সূর্যাস্ত,বা সূর্যোদয় দেখার ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। চমৎকার লেখা। সূর্যাস্তের ছবি ও বর্ণনা দুই ই দারুণ।ছবি তো অসাধারণ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন