জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে যারা দাস ছিল তারা নিজেরাই দাসব্যবস্থাকে সমর্থন করত, ‘প্যারাডাইস’ উপন্যাসের এক চরিত্র এরকমটাই বলছে। এই দ্বীপপুঞ্জে ভারত মহাসাগরের নীল নোনা জল খেলা করে যার মধ্যে অবস্থিত প্রাচীন, ভগ্নপ্রায় বহু বন্দর যেখানকার নোঙর করা ভাসমান যানগুলি থেকে এখনো শোনা যায় শৃঙ্খলিত দাসদের মর্মান্তিক আর্তনাদ, হাহাকার। এটি তানজানিয়ার অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যা ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত আব্দুলরাজাক গুর্নাহর কল্পনার আঁতুড়ঘর। দ্বীপপুঞ্জের বদ্ধ পরিবেশে নানা জাতি, উপজাতি জড়িয়েমড়িয়ে বাস করে -- আরব (মূলত ওমানের), ভারতীয় (গুজরাটি, কিছু শিখ), গ্রিক, জার্মান, ইংরেজ, বেলজিয়ান, ইয়েমেনি, সোমালি, আঞ্চলিক বহু গোষ্ঠি, গহন অরণ্যের ক্ল্যান ইউরোপিয় সভ্যতার আলো যাঁদের এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। মহাসাগরের জল পূর্ব আফ্রিকার এই অজানা পান্ডববর্জিত শহরগুলির তট ধুয়ে যায়, যে শহরগুলির রাস্তা দিয়ে শতাব্দী দুয়েক আগেও শিকল বাঁধা নারী পুরুষ জাহাজে আরোহণ করে দূর দিগন্তে যাত্রা করত। ‘মেমোরিজ অফ ডিপার্চার’এ হাসানের চেতনায় সেই সব স্মৃতি কিন্তু এখনো ধাক্কা মারে। তার মায়ের কাছে সে বিন সঈদের গল্প শুনেছে, যে অতীতের এক খুনে, ডাকসাইটে দাস ব্যবসায়ীর বংশধর ছিল এবং যার এতোটাই প্রতিপত্তি ছিল যে খুনখারাপি করলেও শ্বেতাঙ্গ শাসকরা তার নাগাল পেতো না। হাসানের সুন্দরী মা ছিল উগান্ডার এক লরি চালকের কন্যা যে এহেন বিন সঈদের প্রেম হেলায় প্রত্যাখান করেছিল। কিন্তু তাতে ভাগ্য তার প্রতি সদয় হয়নি। অবশেষে তার মা যাকে বিয়ে করে সে এক লম্পট, মদ্যপ যে প্রায়শই রাতে বাড়ি ফেরে না, ফিরলেও তাকে বেদম মারধোর করে। বাপের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে সংসার উজাড়। কামনার তাড়নায় এক বোন উদ্দাম যৌনতায় নিজেকে সঁপে দেয়।
নিঃসঙ্গ, দিশাহারা হাসান শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ঘিঞ্জি, নোংরা সমুদ্রঘেঁষা এক জনপদ যেখানে পায়ুকাম অবাধ, যেখানে কৃষাঙ্গ ছেলেদের অপহরণ করে আরবদের কাছে বেচে দেওয়া হয়। এদের থেকে বাঁচতে হাসান মসজিদে আশ্রয় নেয়। সামনের হলে ‘মাই ফেয়ার লেডি’ সিনেমা চলছে। একটা রেডিও ঘিরে লোকজন আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ নিয়ে তর্ক করছে; তুমুল উত্তেজনা, আরবরা ইহুদিদের সাঁড়াশি আক্রমণে ঘিরে ফেলেছে; কেউ একজন হঠাৎ ফুট কাটল আণবিক বোমার ফলে বাচ্চা মেয়েদের বিশালাকৃতি স্তন হয়। সংবাদপত্রে ইংল্যান্ডের রাণীর পাশে দেশের অবিসংবাদিত নেতার ছবি যার চোখের তল মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে শুঁয়োপোকার আকার ধারণ করেছে, যার মূর্তির ডিজাইন করতে দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রীকে ডেনমার্কে যেতে হয়। এই পরিবেশে হাসান হাঁসফাঁস করে। কিন্তু তবুও সে স্বপ্ন দেখে, দমবন্ধকরা এই যন্ত্রণা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়ে। বোম্বে থেকে মাদ্রাজগামী ভাসমান জাহাজ থেকে সে তার মামাতো বোনকে জানায় যে তাকে নিতে সে ফিরে আসবে।
গুর্নাহর উপন্যাসের চরিত্ররা আর ফিরে আসে না। তারা শিকড়হীন, নিজেদের জীবনের ওপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, পূর্ব আফ্রিকার টালমাটাল ইতিহাস তাদের নিরন্তর একটা সংকট থেকে আরেকটা সংকটে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। ২০২০ সালে লেখা ‘আফটারলাইভস’এ আমরা দেখি ইলিয়াসকে জার্মান ঔপনিবেশিক বাহিনী, আস্কারি অপহরণ করে। যুদ্ধের পরে গ্রামে ফিরে সে দেখে তাঁর বাবা মা আর নেই এবং তার বোন আফিয়াকে কেউ নিয়ে চলে গেছে। আরেকটি চরিত্র হামজা চুরি হয়নি, তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সে আস্কারিদের মধ্যেই বড় হয়েছে; একজন জার্মান অফিসারের ছায়াসঙ্গী সে, যে তাকে রক্ষা করে আবার নিয়মিত ধর্ষণ করে। তার জীবন একটা বিভীষিকা যার ফলে রক্তের প্লাবনে যুদ্ধর সর্বসংহারকারী নৃত্যর রূপ সে বুঝে উঠতে পারে না।
‘প্যারাডাইস’ গুর্নাহর চতুর্থ উপন্যাস যেটি বুকার পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছিলো এবং তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছিল। উপন্যাসের মূল চরিত্র ইউসুফের বাবা দেনায় ডুবে আছে। ঋণ শোধ না করতে পারার দরুণ সে ছেলেকে আঙ্কল আজিজের কাছে সমর্পণ করে। ইউসুফের মনে পড়ে যখন সে বাড়ি ছাড়ে তার মা কাঁদেনি, তাকে জড়িয়ে ধরে আদরও করেনি, তাকে শুধু বিবর্ণ লাগছিল, যেন অসুস্থ। স্টেশনে পৌঁছে সে দেখেছিলো সাবেকি হলুদ পতাকার পাশে আর একটি নিশান যেটার ওপরে রুপালি বর্ডারের মাঝে একটি কালো ক্রুশ যার অর্থ জার্মান অফিসাররা ঐ ট্রেনে তাদের সহযাত্রী; ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের সাথে ঔপনিবেশিক শাসকের রক্তচক্ষু মিলে মিশে যায়। তার কান্না পেয়ে গেছিল কিন্তু পাশে আজিজকে ঝিমাতে দেখে তার অশ্রু শুকিয়ে গেছিল; আর কখনো চেষ্টা করেও সে কাঁদতে পারেনি। পরে সদ্য কিশোর ছেলেটির অবাক লেগেছে ভেবে যে সে একবারও জিজ্ঞাসা করেনি কেন সে আজিজের সাথে যাচ্ছে, কতো দিনের জন্য যাচ্ছে, কখনো তার মনে হয়নি যে সে আর কোনদিনও ফিরে আসবে না। শহরে গিয়ে সে আজিজের ব্যবসায় বেগার খাটে, সেখানে তার সাথে খলিলের দেখা হয়। খলিল বিন্দাস, ইউসুফকে ছোটো ভাইয়ের মতো কাছে টেনে নেয়। প্রথমেই তাকে জানিয়ে দেয়, শোনো আজিজ তোমার কোনও আঙ্কল নেই, তাকে তুমি সঈদ বলবে আর তুমি এখানে এসেছো কারণ তোমার বাবার থেকে সঈদ টাকা পায়, আমিও তাই, আমার বাবা ছিল তার কাছে দেনাগ্রস্ত; সে তো ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে, আমারও সবকিছু চুকেবুকে গেছে। খলিলের পাতানো বোন আমিনাও তাই। দুটো বাচ্চা মেয়েকে ডিঙিতে তুলে কিছু লোক পালাচ্ছিল, খলিলের বাবা দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও একজনকে উদ্ধার করে। আমিনা খলিলের পরিবারে বড় হয় তারপর দেনার দায়ে সেও আজিজের সম্পত্তি হয়ে যায়।
ইউসুফ কিন্তু আজিজকে আঙ্কলই ডাকে, সঈদ নয়। আজিজ বাণিজ্যের কাফিলা নিয়ে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়, মাসের পর মাস কেটে যায়, কখনো বছর। ফিরে আসে ভুবনজয়ী সম্রাটের মতো সামনে পিছনে বাজনাদারেরা যার আগমন ঘোষণা করে। ইউসুফ তার সাথে সফরে যায়, ঊষর মরুভূমি, গভীর গহন অরণ্য কোনও স্থানই তাদের অগম্য নয়। এমন সব জায়গায় তারা বিচরণ করে যেখানে মানুষের জীবন তখনো প্রাচীন, সরল, জটিলতা-মুক্ত, মুদ্রায় লেনদেন যেখানে অভাবনীয়। সাম্প্রতিক অতীতেও এসব জায়গা ছিল দাস ব্যবসায়ীদের লীলাক্ষেত্র। গাছ থেকে ফল পাড়ার মতো ওমানি আরবরা এখানে দাস সংগ্রহ করত। মামুলি কিছু খেলনা, গয়না দিলে তারা নিজেরাই এসে ধরা দিতো, সঙ্গে ভাইবোনেদের নিয়ে আসত। তখন পয়সাই পয়সা; দলে দলে মানুষ চালান হয়ে যেতো দূরদূরান্তের বাগিচাতে, শহর গড়ার জন্য ব্যবহার করা হতো তাদের বিনি পয়সার শ্রম।
বাণিজ্যের এই চক্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল গুজরাটি বানিয়ারা, ইন্ডিয়ান মুক্কি, যারা বণিকদের চড়া সুদে টাকা ধার দিত। এরা মূলত দোকানদার এবং মহাজন। অন্য পেশার মানুষও আছে, যেমন ‘মেমোরিজ….’ এ হাসানের ঠাকুমার দীর্ঘকালের চিকিৎসক ডাক্তার মেহতা কিংবা ‘প্যারাডাইস’ এর কালাসিংহ, শিখ গাড়ির চালক, যে সুযোগ পেলেই বানিয়াদের বিরুদ্ধে তার ঘৃণা উগড়ে দেয়। এদের মধ্যে অনেকেই ধনী এবং বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষ। এরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেয় এবং সামান্য সুযোগ পেলেই বণিকদের ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে। তাবড় ব্যবসায়ীরাও এদের সমঝে চলে। পুরো পূর্ব আফ্রিকার উপকুলবর্তি অঞ্চল বিশেষ করে কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া জুড়ে এদের ব্যবসা। বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবাদ-বিরোধি লড়াইয়ে এরা কোনদিনই স্থানীয় মানুষদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। স্থানীয়রা যখন ঔপনিবেশিক শাসন উপড়ে ফেলে ক্ষমতায় এসেছে তখন হয়তো এরা সাময়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু নিজেদের পুঁজির জোরে নতুন জমানার সাথে আবার একটা কার্যকারি সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। এর ফলে এদের ভাবমুর্তি একেবারেই উজ্জ্বল নয়, মানুষের মধ্যে এরা রক্তচোষা এবং সুযোগসন্ধানি এক সম্প্রদায় হিসাবেই পরিচিত। ভারতীয়দের কখনো বিশ্বাস করবে না, সীমাহীন এদের লোভ; মুনাফার জন্য এরা নিজেদের মাকেও বেচে দিতে পারে, সাধারণ মানুষ এরকমটাই বলে।
দাস ব্যবসা এখন আইনত নিষিদ্ধ। ব্যবসা অন্য রূপ নিয়েছে। তবে এখনো বিনিময় প্রথা চলে। গ্রামে ব্যবসা করতে হলে উপজাতি সর্দারকে খোশামোদ করতে হয়, মূল্যবান সামগ্রী নজরানা দিতে হয়, বিশেষ করে নেশাদ্রব্য পেলে সে খুশ। ভারতের কুঠার, নিড়ানি, আমেরিকার ছুরি, জার্মান তালার চাহিদা আছে; তবে সুতিবস্ত্র, ক্যালিকো, বাফতা, মসলিনের মতো কাপড়ের ভীষণ কদর, পেলেই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। যেখানে আজিজের কাফিলা যায় সেখানেই তারা দেখে ইউরোপিয়ানরা তাদের আগে সেখানে পৌঁছে গেছে। তারা সেখানে কিছু সৈন্য মোতায়েন করেছে, প্রাথমিক একটা শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে। শ্বেতাঙ্গরা নৃশংস, অসীম প্রতিপত্তিশালী, ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে। তাদের হাতে ঝিলিক মারা তরবারি, আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। স্থানীয় মানুষ তাদের রীতিমতো চমকায়। তাদের চেহারা খোলসছাড়া এক সরীসৃপের মতো, সোনালি চুলের কারণে ভ্রম হয় যে তারা নারী! নানা মিথ ভেসে বেড়ায় তাদের সম্বন্ধে---তারা লোহা খায়, ইস্পাতের পোশাক পড়ে, তাদের থুতু বিষাক্ত, তারা মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে, তাদের মুখ দিয়ে নাকি ধোঁয়া বেরোয়, এক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কথায় আসলে যা নাকি জিন। এক প্রবল প্রতাপশালী জার্মান পাহাড়ে বাস করে তার দুর্গটা নাকি একটা চুম্বক যেটার আকর্ষণে আক্রমণকারীদের অস্ত্রশস্ত্র আপনা থেকেই সেটাতে আটকা পড়ে যায়। কৃষাঙ্গদের তারা সতর্ক করে যে বাণিজ্যের নাম করে যারা আসে তারা তোমাদের দাস বানাতে চায়। অথচ তারা নিজেরাই সমস্ত জমি কেড়ে নেয়, বিনা পয়সায় সবাইকে দিনভর খাটায়, সমস্ত কিছুর ওপর কর আরোপ করে। অন্যথা হলেই কারাবাস, নয় চাবুক এমনকি সর্বসমক্ষে গাছ থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি। নিজেদের আশ্রয় বানানোর আগেই তারা একটা কারাগার তৈরি করে, তারপর একটা গির্জা, তারপর একটা বাজারের জায়গা যেটার ওপর তারা কড়া নজর রাখে। তারা যত্রতত্র শোয়, যা পায় তাই খায়, গান্ডেপিন্ডে খায়।
আফ্রিকার কোনও লেখকই বোধহয় সচেতন ভাবেও চিনুয়া আচেবে এবং তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘থিংগস ফল এপার্ট’ এর প্রভাব অস্বীকার করতে পারেন না। সেই ছয় দশক আগে তিনি দেখিয়ে গিয়েছিলেন কীভাবে বলপ্রয়োগ ও ধর্মের মণিকাঞ্চন যোগে বহিরাগতরা উপনিবেশ স্থাপন করে। ‘প্যারাডাইস’এ আমরা দেখি ধর্ম দিয়ে কীভাবে অনায়াসে কৃষ্ণাঙ্গদের বশ করে ফেলা যায়। এক লুথেরান যাজক পাহাড়ে যে গির্জা বানিয়েছে সে তাদের আশ্বাস দেয় যে ঈশ্বরের নির্দেশে সে তাদের আত্মাকে মুক্তি দিতে এসেছে। উপাসনার সময় ছাড়া গির্জা স্কুল হয়ে যায় যেখানে যাজক স্থানীয় বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখায়। এই ভাবে পাদ্রির ঈশ্বর তাদের ঈশ্বর হয়ে যায়। পাদ্রির উপদেশে তারা বহুগামিতা পরিহার করে, নেশাদ্রব্য ত্যাগ করে। ইউরোপিয়ানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে রাতে হামিদের ঘুম হয় না। সে কালাসিংহকে বলে তুমি জান না এরা শুধুমাত্র ব্যবসা করতে আসেনি, এরা আমাদের মাটি লুট করতে এসেছে, আমাদের দেশ, সর্বস্ব। পাহাড়ের অতো হিংস্র, পরাক্রমশালী উপজাতিদেরও তারা নিকেশ করে দিয়েছে; তাদের নেতাদের জ্যান্ত কবর দিয়েছে। সারা বিশ্বকে তারা কব্জা করতে চায়। একটা সময় আসবে যখন আমরা তাদের আইন মাফিক কাজ করবো, তাদের গল্প বলে বেড়াবো, আর আমরা শুধু দাস হিসাবেই পরিচিত হবো।
বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে জার্মানরা তখন দেশজুড়ে রেল লাইন স্থাপন করছে, উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। যে কোনও জনপদে জার্মান আস্কারিদের আগমন তখন একটা ত্রাস। দলে দলে ছেলেমেয়েদের তারা অপহরণ করে, পাশবিক ভাবে নিজেদের স্বার্থে তাদের কাজে লাগায়। তাদের প্রতিপত্তির ফলে আঙ্কল আজিজের ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়ে। ইউসুফ আমিনা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত কিন্তু আজিজ একটা পাহাড়প্রমাণ পাঁচিলের মতো তাদের মাঝে খাড়া হয়ে আছে, তার পিছনে ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। জীবন তাদের জন্য কী পসরা সাজিয়ে বসে আছে তা কে জানে …
আবদুলরাজাক গুর্নাহর ভাষা নিরাসক্ত, সংযত। অস্বাভাবিক সব ঘটনা তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক, উচ্ছাসহীন ভাবে বলেন, যেন আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই ঘটছে না। তাঁর মুখ্য চরিত্রগুলি প্রায় সবই শিকড়হীন, ভাসমান, যাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত; অনেকটা যেন তাঁর নিজের মতো যখন ষাটের দশকের শেষে তিনি দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে তখন এক বিপ্লব ঘটে গেছে যা আরব এবং বহিরাগত বিরোধী একটি জাতিদাঙ্গার রূপ নিয়েছেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে লেখক অভিবাসি জীবনের যন্ত্রণা, অপমান উপলব্ধি করবেন কিন্তু সেটা তো আরেকটা গল্প।