|| ৩||
[সত্যকাম একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে চাপাগলায়। আধো-অন্ধকার রাস্তা। একটি বাড়ির পাশে ওরা দাঁড়িয়ে। বাড়িটি গৌতমবাবুর। মেয়েটি চুমকি। তার পরিচয় তথাকথিত সমাজে 'বাজে মেয়ে'। গৌতমের বাড়ির আলো পড়েছে দুজনের উপর।]
সত্যকাম: (চাপা গর্জন) : কেন এসেছিস? কতোবার বলতে হবে তোকে?
চুমকি : এবার দাও না দাদা, আর এসবোনি। (কান্না)
সত্যকাম : আবার ! কেন যাচ্ছিস না বল্ তো? বলেছি না আমাকে ডাকবি না ওই নামে?
চুমকি : বেস্! চলে যাচ্চি। ঠিক বলেছিলো মাইরি সবনম, চুমকি, ভদ্দরলোক বনে গেচে তোর মায়ের পেটের ভাই ---যাসনে ওদের কাছে। আমিই বোকা মাইরি--- [প্রস্থান উদ্যত]
সত্যকাম : শোন্ এদিকে !
[চুমকি ফিরে আসে]
চুমকি : বলো মাইরি।
সত্যকাম : মা...মা কেমন আছে রে? ধর এটা, দু-হাজার আছে আপাতত, ডাক্তার দেখছে মাকে?
চুমকি : লোকালে বলেচে বেসিদিন নেই। (কান্না) জবার মরণ ওইসে হবে? বলে কতো ---
সত্যকাম : চুপ! একটা বাজে কথা নয়। নরক থেকে তোকে আসতে বলেছিলমা বোন, আসিসনি তুই জেদ করে। এখন সেরকম কিছু ঘটলে তোকে নিয়ে আসবো আমি। বুঝেছিস?
চুমকি : সি তুমি ভদ্দরলোক বনে গেছো, আমাকে লিয়ে এলে তোমাকে ভি কেউ ইজ্জৎ দেবে আর? না গো দাদা, জবার বেটির আর শখ করা ঠিক লয়। (প্রস্থান)
[সত্যকাম দরজায় হেলান দিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে।]
[মঞ্চে দেখা যায় গৌতমের বসার ঘর। আসবাবপত্রের কোনো বাহুল্য নেই। টেবিলে একইভাবে কাজ করছেন। দেয়ালে ওনার স্ত্রীর হাস্যময়ী মুখের ছবিতে ফুলের মালা]
গৌতম : (স্বগত) : অদ্ভুত চিন্তা মাথায় দিয়ে গেল মেয়েটা আজ! রাজহংসের মুখ বানাতে হবে? বলে কিনা সত্য আর মিথ্যা আলাদা করতে গেলে রাজহংসের মুখ চাই? যাতে দুধ কা দুধ আর পানি কা পানি বোঝা যাবে? নাহলেই বিভ্রান্তি আর সাংস্কৃতিক দূষণ। Strange! আচ্ছা, সার্ত্রে সাহেব যে বলেন, "Existence of truth is an existential reality"! তাহলে সত্য খুঁজতে রাজহাঁসের দ্বারা আর বেশী কী হবে?
[ বৃদ্ধা পরিচারিকা ঘরে ঢোকে]
গৌতম : কী বলছো দুর্গার মা?
দুর্গার মা : আজকেও দুপুরে খাননি? এখনও কি সেইটেই করবেন? খাবেননি কিছু?
গৌতম : একটু পরে খেয়ে নেবো। তুমি যাও।
দুর্গার মা : একখানা কতা বলি বাবু, বৌদিদি কিন্তু দেকছেন আপনার এই দশাখানা। তিনি যেখানেই থাকুন, শান্তিতে নেই।
গৌতম : (রেগে উঠে) : কেন বলো তো দুর্গার মা? কেন তিনি মৃত্যুর পরেও ভাববেন আমার জন্য? আমি ভেবেছি? এতোটাই কাজে মত্ত ছিলাম যে শেষসময়টায় আসতে পারিনি। তাহলে আজও--- আজও আমাকে নিয়ে কেন ভাববে সে? এটা কেমন নিয়ম? দায়িত্ব একতরফা হয় না। হতে পারে না!
[দুর্গার মা ভয় পায়। খাবারের থালা টেবিলে রেখে চলে যায়]
[সত্যকাম প্রবেশ করে।]
সত্যকাম : স্যার, একটা বিষয় জানতে এলাম। খুব জরুরি দরকার।
গৌতম : বলে ফ্যালো।
সত্যকাম : 'ভদ্রলোক' শব্দটা কি গালাগালি?
গৌতম : তোমার বোন কি একাই চলে গেল নাকি রয়েছে এখনও বাইরে?
[সত্যকাম চমকে ওঠে]
সত্যকাম : স্যার... আপনি কি করে।.
গৌতম : কালি, কলম, মন টেবিলে থাকলেও কানটা জানালার বাইরে রাখাই যায়। বাবা সত্যকাম, আগে নিজে ঠিক করো তুমি কি চাও?
সত্যকাম : কথা যখন হচ্ছে স্যার, আর সত্যকাম কেন? 'গুন্টু মস্তান' বলেই সম্বোধন করুন। কুলিবস্তির ঊর্বশী জবার ব্যাটা গুন্টু। যার ভাত কেড়ে খেয়েছে কুকুরে, জামা কেড়ে নিয়েছে মাতব্বররা। (রুদ্ধ কান্না)
গৌতম : সে এক কলমচি ভদ্রলোকের ধমকে উত্তর দেয়, 'কে পড়াবে? তুমি? পারবে? নাহলে জ্ঞান দিতে এসো না বাবু।' রোখ চেপে গেলে আমাকে থামানো খুব কঠিন জানো তো? পাঁকের অতল অন্ধকারেও হীরে-মানিক কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে থাকে। সেগুলিকে খুঁজে আনাই আমার চ্যালেঞ্জ। (হাসি)
কতোই বা বয়স ছিলো সেদিন তোমার?
সত্যকাম : তেরো-চোদ্দো বোধহয়। আপনি সমাজের তোয়াক্কা না করে, নিজের সম্মানের কথা না ভেবে পড়লেন আমাকে নিয়ে।
গৌতম : হাতে উঁচানো আঙুল, রাগ কী বাবা অতটুকু ছেলের ! ওই আকরিক রাগকে বাস্তবের ফার্নেসে যুক্তির ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে আকার দিয়ে আজকে ---
সত্যকাম : সহ-সম্পাদক সত্যকাম আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু স্যার, ভদ্রসমাজ আমার পরিচয়টা জানলে কী হবে? মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল / পতঙ্গের মতো সবে বিস্ময় বিকল?
গৌতম : জানি না। তবে এটা তো তপোবনের যুগ নয়। তাই আমি তোমাকে 'সত্যকুলজাত' বলে সার্টিফিকেট দিলেও কি সেটা গ্র্যান্টেড হবে বাবা?
( গৌতম জড়িয়ে ধরেন তাকে)
সত্যকাম : না স্যার। কোনোদিন কিছু ছিলো না। আজও কিছু নেই। এমনকী আমার বোনটাও আজ ভদ্রলোকদের অপছন্দ করতে শুরু করেছে। শুধু এই জার্নির কথাটা হয়তো মনে থাকবে। যে পাঁকের পথ পেরিয়ে নক্ষত্রলোকের দিকে যাত্রা আপনার হাত ধরে শুরু করেছি.....(কান্নায় ভেঙে পড়ে)
গৌতম : My boy, জীবন একটা কাঁচের গোলক ছার্ড় কিচ্ছু না। তার একেকটা তলে একেকরকম রঙ। কেঁদো না, প্লিজ। কোনোটার সাযুজ্য নেই কোনোটার সঙ্গে।তবু আমরা জীবন নিয়ে উদ্বেল হই, সংস্কৃতি-প্রগতির গর্ব করি। কিছুই প্রকৃত নয়। কে ধারণ করছে এসব? মরীচিকা মাই বয়! কে সত্য বলোতো? সহ - সম্পাদক সত্যকাম নাকি গুন্টু মস্তান?
সত্যকাম : জানি না। তবে এটুকু বলবো স্যার, একই জীবনের দুই বিপরীত প্রান্তে ওই একটি মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। যন্ত্রণা একইরকম --শুধু কেউ কাউকে ছু ঁতে পারছে না। আমি....আমি আসছি স্যার। শারদীয়া সংখ্যার কাজ রয়েছে.... (প্রস্থান)
গৌতম : সারাদিন রাজহা ঁসের পালক ঘেঁটেই গেলাম....সেই একই পেলবতা, কোমলতা.... পার্থক্য নিরুপণের সামর্থ্য কই?
(ঘর জুড়ে সাদা কাগজ উড়তে থাকে। শুধুই সাদা কাগজ ছড়িয়ে পড়ে মঞ্চ জুড়ে)
রাজহংসের মুখ কোথায়?
[তীব্র আক্রোশে গৌতম টেবিলে মাথা রাখেন। মঞ্চ অন্ধকার হয়।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।