এক তে, দো তে, বুককাঠি, কাপকাঠি, কান্নিক - এ শব্দগুলো চেনা লাগছে নাকি? লাগলে আপনি কনোজিয়ার বা তার কাছাকাছি। আপনার আর এ গপ্পো পড়ে কাজ নেই। যারা বুঝল না তাদের জন্য বলি এগুলো ঘুড়ির টেকনিক্যাল টার্ম। 'তে' হল ঘুড়ির মাপের ইউনিট আর বুককাটি হল ঘুড়ির মাঝখান দিয়ে যে কাঠি ডান থেকে বাম দিকে যায় সেটা। ঘুড়ির ব্যালান্স ঠিক করতে বুককাটির ডান বা বাম দিকে কাগজ পাকিয়ে দেওয়াকে বলে কান্নিক। যে কাঠিটা ওপরের দিকে গোল হয়ে বুককাঠির দুই প্রান্তে এসে লাগে সেটা হল কাপকাঠি। এসব শব্দের উৎস বলতে পারব না, আমি কনোজিয়ার নই, এমনকি ঘুড়ি ওড়াতেও পারি না। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার নৈহাটিতে আমার মামাবাড়ি, এসব টার্ম সেখানেই শোনা। আমার ঘুড়ি ওড়াতে শেখার প্রবল ইচ্ছার মৃত্যু ঘটেছিল ওখানেই। তবে সে ইচ্ছা জ্যান্ত থাকার সময়েই ওই শব্দগুলো কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশে গিয়েছিল।
ঘুড়ি ওড়ানোর সাথে জড়িত নানাবিধ পতনের রঙিন গল্প আমাদের চার পাশে উড়ে বেড়াচ্ছে বহুদিন ধরে। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাত থেকে পড়ে যাওয়া, কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরতে গিয়ে পুকুরে পড়ে যাওয়া, অন্যের ছাতে পড়ে থাকা ঘুড়ি চুরি করতে গিয়ে সে বাড়ির মেয়ের প্রেমে পড়ে যাওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সে সব নয়, আমার হল না-ওড়ানোর গল্প। আমার মামারা ঘুড়ি ওড়ানো, তুবড়ি তৈরি আর সাঁতারে ওস্তাদ ছিলেন। আমি ওই সব বিষয়েই মাইনাসে রান করি, তাই "নরানাং মাতুলক্রমঃ" কথাটায় আমার বিশ্বাস নেই। যা হোক, মামাবাড়ি যাওয়ার আগে আমার প্রথম ঘুড়িপ্রাপ্তির কথাটা জানাই।
মুজতবা আলি সাহেবকে নকল করে বলি, সেই সময়ে ৪৪ নম্বর নামের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান বাগুইআটি থেকে শিয়ালদা হয়ে হাওড়া স্টেশনে যাতায়াত করত। আমি তখন প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। পাড়ার বড় বড় দাদারা ঘুড়ি ওড়ায়। সে ঘুড়ি দ্রুত উঠে যায় উপরের দিকে। এখনকার মত বর্ষার খামখেয়ালিপনা তখনও আরম্ভ হয়নি, তাই ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা ছানার মত মেঘ বিশ্বকর্মা পুজোর আগে থেকেই দেখতে পাওয়া যেত। সেই নীল আকাশে রঙিন ঘুড়িদের ভেসে বেরানো দেখে মনে হত ওরা স্বর্গে পৌঁছে গেছে। আর দাদাদের উল্লাস তাদেরও স্বর্গসুখ দিচ্ছে বলে মনে হত। আমারও স্বর্গলাভের সাধ হল। সুতরাং পরের বছর বিশ্বকর্মা পুজোর কদিন আগে থেকে প্রবল বায়না জুড়েছি ঘুড়ি লাটাই কিনে দিতে হবে। ৭০-এর দশকের শেষের দিকের সল্টলেক। ঘুড়ি টুড়ি কাছাকাছি পাওয়া যায় না। কি একটা দরকারে শিয়ালদা যেতে হয়েছিল বাবা-মা আর আমাকে, সেখান থেকেই ঘুড়ি লাটাই কেনা হল বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন। খান তিনেক ঘুড়ি আর যদ্দুর মনে পড়ে ছোট লাটাইয়ে জড়ানো সুতোর রঙ ছিল সবুজ, মাঞ্জা টাঞ্জা সম্ভবত ছিল না। শিয়ালদা থেকে ৪৪ নং বাস ধরা হল। তাতে সাংঘাতিক ভিড়, পাঁচ মিনিটও লাগবে না, ঘুড়ির প্রাণপাখি সুতো ছাড়াই উড়ে যাবে। কি করা যায়? এখনকার কলকাতায় প্রাইভেট বাসগুলোর ড্রাইভারের পিছনের একটা ছোট অংশ জুড়ে গ্রিল থাকে, তখন থাকত পুরোটা জুড়ে। সেই গ্রিলের গায়ে মহিলাদের আসনে ড্রাইভারের দিকে পিছন করে বসতে হত। সে যাক, আমার পিতৃদেব কোনও উপায় না দেখে ওই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঘুড়ি চালান করে দিলেন ড্রাইভারের কেবিনে, লাটাই থাকল হাতেই। আমরা নামব ভি আই পি রোডের ওপর দমদম পার্কে, যে জায়গা এখন দুর্গাপূজার জন্য বিখ্যাত। সেখানে নামার পর বাবাকে ড্রাইভারের কেবিন থেকে ঘুড়ি উদ্ধার করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কন্ডাকটর কিছু টক ঝাল কথা শুনিয়েছিল।
সে যাক, উত্তেজনায় রাতে ভাল ঘুম হল না। পরের দিন একটু বেলা হতেই ঘুড়ি ওড়াবার প্রস্তুতি শুরু হল। বাবার ঘুড়ি ওড়ানোর সখ ছিল না। মায়ের তো কথাই উঠছে না। তবে মামারা যে হেতু ওস্তাদ উড়িয়ে ছিলেন, তাই কিছু প্যাসিভ জ্ঞান তাঁর ছিল। সেই জ্ঞানের ওপর ভরসা করে আমাদের কোয়ার্টারের দোতলার বারান্দা থেকে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু এবং ঠিক তার পরের মুহূর্তেই দেওয়ালে ধাক্কা এবং/অথবা বারান্দা থেকে জল বেরোনোর নালিতে খোঁচা লেগে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। রাগ দুঃখ আর চোখ ভরা জল নিয়ে যা যা মনে হচ্ছিল, তাকেই সংক্ষেপে প্রকাশ করেছে মোহমুদগর - "নলিনী দলগত জলমতি তরলং। তদ্বজ্জীবনমতিশয় চপলং।।" বারান্দা থেকে খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়ার পরেও বাকি দুই ঘুড়ির কেউই আর উড়তে চাইল না। সম্ভবত প্রথম জনের অকালমৃত্যুতে তারা এতই শোকাহত ছিল যে ওই দুজন আত্মহত্যা করল বলাটাই ঠিক হবে। এর পর ঘুড়ি নিয়ে খুব একটা বায়না আর করিনি। শৃগাল আর দ্রাক্ষাফলের উপাখ্যান অনুযায়ী ঠিক করে নিয়েছিলাম ঘুড়ি ওড়ানো খুবই খারাপ খেলা -- ডাংগুলি বা মার্বেলের মত। ওই দুই খেলাতেও একই রকম পটু ছিলাম কিনা।
কাট টু নৈহাটি। কয়েক বছর পরের বিশ্বকর্মা পুজো। আমার মামারা আর ঘুড়ি টুড়ি ওড়ান না। মামাবাড়ির ঠিক পাশেই চিনুদের বাড়ি। চিনু, আর কয়েকটা বাড়ির পরের বিকু আমার বন্ধু। চিনুদের বাড়ির ছাদে আমরা জমায়েত হয়েছি। আমাদের চেয়ে একটু বড় জিৎদাও আছে। ঘুড়ি ওড়ানোর প্রস্তুতি চলছ। ঈশপের গল্প ভুলে ঘুড়ির ব্যাপারে তখন আমি ফের ঘোর উৎসাহী। তবে কাজে একেবারেই আসি না। জিৎদা ভালো ওড়ায়, চিনু আর বিকু মোটামুটি। জিৎদা ওড়ালে ওই দুজনের কেউ লাটাই ধরে।
"লাটাই ধরা" ব্যাপারটা কিন্তু হেলাফেলা করার নয়। ওড়ানোর সময়ে লাটাই নামক বস্তুটি তিন ভাবে রাখা যায় - কর্তা (যিনি ওড়াচ্ছেন)-র বা কর্মী (যিনি সাথে আছেন)-র হাতে, কর্তার পায়ে এবং মাটিতে বা অন্য কোনও জায়গায়। মোদ্দা কথা হল ঘুড়িকে দূরে পাঠাতে লাটাই-এর সুতো টানলে তা যেন সহজেই খুলে আসে, আর ঘুড়িকে কাছে আনতে টেনে নামানো সুতো যেন দ্রুত গুটিয়ে ফেলা যায় (নইলে মাটিতে পড়ে থাকা মাঞ্জা দেওয়া সুতো জড়িয়ে যেতে পারে)। এক হাতে বা দুই পায়ের ফাঁকে লাটাই রেখে ওই দুই কাজ করা বেশ কঠিন, তাই কর্তার কর্মী লাগে। নইলে লাটাই মাটিতে বা অন্য কোথাও রাখে যাতে খুলে আসাটা অন্তত সহজে হয়।
নৈহাটির আকাশে স্বর্গের দাবিদার অনেক। পেটকাট্টি, ময়ূরপঙ্খী, মোমবাতি, চাঁদিয়ালে আকাশ প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর পরই কোনও না কোনও ছাদ থেকে উল্লাসধ্বনি ভেসে আসে - "ভোঁওওওক্কাটা"। আর সেই সঙ্গে ঠ্যাং ঠ্যাং ঠ্যাং ঠ্যাং করে বেজে ওঠে কাঁসর ঘণ্টা। হঠাৎ দেখা যায় বাতাসে ভেসে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে কোনও কেটে যাওয়া ঘুড়ি। স্বর্গ থেকে পতন ঘটেছে তার। এমন ভেসে যাওয়া ঘুড়িকে ধরার জন্য ছাদে রাখা থাকে ঝুলঝাড়ু বা ওই জাতীয় লম্বা লাঠি। তাই নিয়ে মাঝে মাঝে পাশাপাশি দুই ছাদের বাসিন্দাদের মধ্যে লাঠালাঠিও বেধে যায়। তা বাধুক, সেদিন দুপুর থেকে চিনুদের ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়ানো চলছে। চিনু আর বিকু লাটাই-এর দায়িত্বে, জিৎদা ওড়াচ্ছে। কখনও কখনও লাটাই ছেড়ে ওরাও সুতো টানছে বা ছাড়ছে। আমি শুধুই উৎসাহী দর্শক, কারণ আমি পরীক্ষীত আনাড়ি। খান তিনেক ঘুড়ি কাটতে পেরেছি আমরা, আমাদের একটিও কাটা যায়নি। ফলে ওদের সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গের চোকাঠে পা রেখে ফেলেছি আমিও। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এবার ঘুড়িকে বাড়ি ফেরাতে হবে। এমন সময়ে জিৎদা আমায় বলল, "লাটাই ধর"। উফফ, সে কি রোমাঞ্চ, সে কি উত্তেজনা... চিনুর থেকে লাটাই হাতে নিলাম। আমি এখন জানি কেমন করে লাটাই ধরতে হয়। দু হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ফাঁকে আলগা করে ফেলে রাখতে হয় তার দুই ডাঁটি, কর্তা সুতোয় টান দিলে লাটাই বনবন করে ঘোরে। গম্ভীরমুখে লাটাই নিলাম, চিনু আর বিকুকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার "হম ভি কিসিসে কম নহি"। জিৎদা সুতোয় টান দিল, আমার দুই আঙুলের ফাঁকে ঘুরতে লাগল লাটাই-এর ডাঁটি, আর আমাদের লাল-কালো পেটকাট্টি ফরফরিয়ে দূরে উড়ে গেল, কি অনির্বচনীয় সে অনুভূতি। স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক পৌঁছে গেছি। আলো কমে আসছে, আকাশের ঘুড়ির সংখ্যাও। আর কিছুক্ষণ থাকলে স্বর্গের একচ্ছত্র মালিক হয়ে যাব। বিকু বলল, "জিদ্দা, এবার নামাও।" আমার রাগ হল, কেন রে বাপু? তোদের হাতে যখন লাটাই ছিল আমি কিছু বলেছি? কিন্তু লাটাই ধরতে হাতটা কনুই থেকে ওপর দিকে ভাঁজ করে রেখেছি অনেকক্ষণ, হাত ব্যাথা করছে একটু। এতক্ষণ লাটাই ধরে থাকা অভ্যাস নেই। মুখে অবশ্য কিছু বললাম না। জিৎদা বলল, "আর একটু পরেই নামাচ্ছি।" এমন সময়ে একখানা গোলাপী হলুদ ময়ূরপঙ্খী ধেয়ে এল আমাদের ঘুড়ির দিকে। উদ্দেশ্য পরিস্কার, সে লড়তে চায়। আমিও তাই চাই, যুদ্ধে জিতে তবেই স্বর্গের অধিকার দাবী করব। শুরু হল লড়াই - মন, প্রাণ সব কেন্দ্রীভূত হল ঘুড়ির দিকে। সেনাপতি জিৎদা লড়ে যাচ্ছেন, আমি নাম-কাটা সেপাই হিসাবে সাহায্য করছি। দেখা যাচ্ছে ময়ূরপঙ্খীর কর্তাও ভালো যোদ্ধা। পেটকাট্টি এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে। আমিও কখনও সুতো ছাড়ছি, কখনও গোটাচ্ছি। হাতের ব্যাথাটা বাড়ছে। হাতটা একটু নামানো দরকার, তবে তুলে নেবো সাথে সাথেই। যেই নামিয়েছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই সুতোয় টান দিল জিৎদা। চেষ্টা করেছিলাম ডাঁটি আলগা রাখার, হয়নি ঠিকমতো, সুতো এগোলো না। ময়ূরপঙ্খী কিছু একটা করল। আর আমাদের ঘুড়ি কাটা পড়ল, শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ। দূরের কোনও ছাদ থেকে ভেসে এল "ভোঁওওওক্কাটা"। সেই সঙ্গে কাঁসরের ঠ্যাং ঠ্যাং সঙ্গত। সারা দুপুর বিকেলের সাথী লাল কালো পেটকাট্টি আমাদের ছেড়ে দুলতে দুলতে ভাসতে ভাসতে আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল।
তারপর জিৎদা কি বলেছিল, বিকু-চিনু কি করেছিল সে সব তুচ্ছ কথা। কেবল মনে হচ্ছিল আমি আরও এক বার একটি ঘুড়ির মৃত্যুর কারণ হলাম। যুদ্ধে জিতে স্বর্গলাভ আমার হল না, অর্ধপথেই পতন হল। আর কখনও ঘুড়িতে হাত দিইনি। বড় হয়ে দেখেছি মানুষের জীবন আর মৃত্যুও এমনই সরু সুতোয় বাঁধা। সেদিন হোয়াটস্যাপে সচিত্র সুপ্রভাত বার্তায় একজন জানালো, ঘুড়ি আকাশে ততক্ষণই সুন্দরভাবে ওড়ে যতক্ষন সুতো দিয়ে মাটির সঙ্গে তার যোগ থাকে। বুঝলাম মাটিতে পা না থাকলে স্বর্গলাভ হয় না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।