আন্তর্জাতিক মানের একটি সাহিত্যধারার বাহন হিন্দি। ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের এই ভাষায় রচিত সাহিত্যকে মোটামুটি চারভাগে ভাগ করা যায়। বীরগাথা কাল—একাদশ থেকে চতুর্দশ শতক। ভক্তিকালের কবিতা চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতক। রীতি বা শৃঙ্গারকালের কবিতা (প্রেমের কবিতা)—অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতক। এবং আধুনিক কাল—বিংশ শতক পরবর্তী সাহিত্যকর্ম। এই আধুনিক পর্বে একসঙ্গে এত নক্ষত্র সমাবেশ ঘটেছে, যা বিশ্বের খুব কম সাহিত্যেই দেখা যায়। শুধু তাই নয়, পরীক্ষানিরীক্ষার দিক থেকেও হিন্দি সাহিত্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে যেমন ছায়াবাদ, নঈ কবিতা বা অ-কবিতা আন্দোলন, তেমনি গদ্যেও বাস্তব, জাদুবাস্তব, অনির্ণয়বাদ সময়ের দাবি মেনে এসেছে। ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র (১৮৫০-১৮৮৫), মুন্সী প্রেমচন্দ (১৮৮০ – ১৯৩৬), সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ওরফে নিরালা (১৮৯৬ – ১৯৬১), হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী (১৯০৭ – ১৯৭৯), মহাদেবী বর্মা (১৯০৭ – ১৯৮৭) থেকে শুরু করে যশপাল (১৯০৩-১৯৭৬), ভীষ্ম সাহনী (১৯১৫-২০০৩), বিনোদ কুমার শুক্লা (জন্ম ১৯৩৭) ছুঁয়ে নির্মল বর্মা (১৯২৯ – ২০০৫), কেদারনাথ সিং-কেও (১৯৩৪-২০১৮) পেছনে ফেলে হিন্দি সাহিত্যের নতুন প্রজন্ম এসে গেছে।
এমন কিছু লেখকের গল্পের সংকলন কাঠের স্বপ্ন। গল্পগুলির নির্বাচন ও অনুবাদ করেছেন মিতা দাস। এখানে ন-জন লেখকের বারোটি গল্প জায়গা পেয়েছে। প্রথম গল্পটি ‘কাঠের স্বপ্ন’, যে নামে এই সংকলনের নাম। লেখক বিশিষ্ট গজানন মাধব মুক্তিবোধ। যাঁর জন্ম ১৯১৭ সালে। আর শেষ গল্পটির লেখক জয়শ্রী রায়। জন্ম ১৯৬৬। যার মানে মিতা দাস এখানে হিন্দি সাহিত্যের মোটামুটি পঞ্চাশ বছর সময়কালকে ধরেছেন। যার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশভাগ, নারীর স্বাধিকার, গ্রামের পতন ও নগরায়ণ, পণ্যায়িত সমাজ ধরে গেছে। তাই গল্পগুলি হয়ে উঠেছে অর্ধ শতাব্দীর ভারতবর্ষের দলিল।
ধরা যাক, অশোক ভৌমিকের চৌকিদার গল্পটি। চাঁদগড় বলে একটি জায়গায় একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, রাতে না ঘুমিয়ে সে ছবি আঁকে বা বই পড়ে। তাই সবাই তাকে নিশাচর বলে। আর এই স্বভাবের জন্যে তার ঘনিষ্ঠতা হল এলাকার চৌকিদার হরিরামের সঙ্গে। খুঁড়িয়ে হাঁটা, সামান্য বেতনের রাতপাহারাদার হরিরামের যে এমন বর্ণাঢ্য অতীত আছে সেটা ওর সঙ্গে না মিশলে জানাই যেত না।
সোজপুর গাঁয়ের বাসিন্দা হরিরাম বাড়ি থেকে পালিয়ে ব্রিটিশ ফৌজে যোগ দিয়েছিল। পোস্টিং হল সিঙ্গাপুরে, জাপানিরা সেসময় সিঙ্গাপুর কবজা করে ফেলেছে। হরিরাম এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। তারপর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল তার জীবনে। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাস। নেতাজি এসে পৌঁছোলেন সিঙ্গাপুরে। হরিরামের যেন জন্মান্তর হল “উনি স্লোগান দিলেন ‘তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদী দুঙ্গা। সত্যি বলছি সাহেব, গোলামি যে কী সেটা প্রথমবার অনুভব করলাম। নেতাজীকে স্বাগত জানাবার জন্যে ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠকুরীর ব্যান্ড গান করল- সুভাষজী সুভাষজী ওহে জানে হিন্দ আ গয়ে, নাজ হ্যাঁয় জিস পে হিন্দ কো ওহ শান-এ হিন্দ আ গয়ে।”
শুনতে শুনতে স্বাধীনতার ছ-বছর পরে জন্মানো সেই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের মনে হল এই হরিরামকে দিয়ে সে সিগারেট আনিয়েছে! হরিরামের কাছ থেকে সে একটু একটু করে সেই সোনার সময়ের কথা জানতে পারে। কদম কদম বাড়ায়ে যা-র স্রষ্টা বংশীধর শুক্লাজি, আজাদ হিন্দ ফৌজের কৌমি গান সৃষ্টির ইতিহাস। নেতাজির ইচ্ছেয় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জন গণমন-র ওপর ভিত্তি করে হিন্দিতে নতুন গান লিখলেন কর্নেল আবিদ হাসান সাফরানি (মূল গল্পে কেন তিনি আবিদ আলি বলে উল্লিখিত হলেন এবং তরজমাকারেরও কীভাবে এই গুরুতর ভুল চোখ এড়িয়ে গেল তা ভেবে অবাক হচ্ছি।)—শুভ সুখ চ্যায়েন কি বরখা বরসে, ভারত ভাগ হ্যায় জাগা।
আবিদ হাসান সাফরানি ও সুভাষচন্দ্র বসু
‘শুভ সুখ চ্যায়েন কি বরখা বরসে’ গানটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও গানটি শুনুন এখানে—
কিন্তু স্বাধীন ভারতে আবিদ হাসান সাফরানি নাম কে জানে? জয় হিন্দের স্লোগান নাকি যার দেওয়া? বংশীধর শুক্লা? কারা ছিল এরা? ইমোশনাল ফুল্স সব। নেতাজি রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হলেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীকে গ্রেপ্তার করা হল। বিচারের নামে প্রহসন হল। নেহরুর হাতে দেশ তুলে দেওয়ার আগে সাহেবরা নাকি শর্ত দিয়েছিল আজাদ হিন্দ বাহিনির কাউকে চাকরি দেওয়া যাবে না। তাই তারা চৌকিদার আর চাপরাশির চাকরি করে। মানুষ বলবান হয় না, সময় বলবান হয়। সাধারণ জনগণমনে নেহরু বনাম সুভষের একটি নির্মাণ আছে বটে, কিন্তু তা একেবারেই ইতিহাস সমর্থিত নয়। ইতিহাস অনেক জটিলতর ও বহুমাত্রিক। সংবেদনশীল গল্পকারের কাছে সেই সচেতনতা প্রত্যাশিত, যাতে এই ভ্রান্ত ‘বাইনারি’-গুলি অহেতুক প্রচার না পায়।
হরিরামের এই সামান্য চাকরিও চলে গেল একদিন। সে ফিরে গেল সোজপুর গ্রামে। ডেঙ্গুতে মারাও গেল একদিন। কেউ জানল না, চিনল না স্বাধীনতার এক অসাধারণ সেনানীকে দেশ হারাল। সহজ ন্যারেটিভে লেখা এ গল্প সোজা এসে বুকে ধাক্কা দেয়। হরিরাম হয়ে ওঠে ভারতের সত্যি ইতিহাসের প্রতীক, যে ইতিহাস আজও লেখা হয়নি, যা পড়ে আছে অবহেলা এবং কৌশলী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে। এইরকম একটি গল্প বাঙ্গালি পাঠককে পড়ার সুযোগ করে দিলেন বলে মিতা দাসকে কৃতজ্ঞতা।
আর-একটি অসাধারণ গল্প কৈলাস বনবাসীর ‘এই সময়টা পাখিদের জন্য’। কালীপুজোর বাজার করার অভিজ্ঞতার মোড়কে এই সময়ের পণ্যায়নের চেহারা উঠে এসেছে। এখন এই বিশ্ব একটা বিরাট বাজার ছাড়া আর কিছু নয়। ‘রঙ্গিন বিজ্ঞাপনের ঝলকে চোখ দুটো ধাঁধাঁ হয়ে গেছে। ঘরে টিভি খুললেও দেখতে পাওয়া যায় পুজোর বিজ্ঞাপন। দীপাবলির শুভকামনা, সিরিয়ালগুলিতেও পুজোর জোরদার কেনাকাটা। নেতা হোক, অভিনেতা হোক, সবাই হ্যাপ্পি দেওয়ালি বলে এক গাল হাসছেন। বড় অসহ্য লাগছে। প্রত্যেক কোম্পানি কিছু না কিছু অফার দিচ্ছে। নারকেল ভাঙো অফার, ফাটকা ভাঙো অফার, স্ক্র্যাচ মেলানো অফার। চারদিক শুধু বাজার আর বাজার... আমাদের পুজোও যেন একটি বাজারে পরিণত হয়ে যাক, যেভাবে ওরা বাজারের হাতে সঞ্চালিত। আমি বুঝে উঠতে পারি না যে দীপাবলী ওদের না আমাদের।’
ঠিক এইরকম সংশয় নিয়ে পুজোর বাজারে ভিড়ের ধাক্কা খেতে খেতে লেখক দেখতে পেলেন চার-পাঁচজন গ্রাম্য মহিলা মাটিতে তাদের সাদামাটা জিনিস সাজিয়ে বসেছে, তার মধ্যে ধানের শিসের ঝালর ছিল। তারা বলে এগুলো নিয়ে গেলে পাখিরা ধান খেতে আসবে।
নীল রঙের সুতির শাড়ি পরা সাদামাটা চেহারার গ্রাম্য মহিলার এই একটি কথায় সে যেন হয়ে ওঠে ইকোফেমিনিজমের এক প্রতীক। এই পৃথিবী যে শুধু মানুষের নয়, তার ওপর পাখি, পশু, গাছপালা সবার সমান অধিকার। নারীরা এ কথা বোঝে নিবিড় করে। তাই তো তারা খর বৈশাখে জল দেয় তুলসী গাছটিকে, রুটির টুকরো রেখে দেয় পাড়ার নেড়ি কুকুরের জন্য, কেউ তাদের মমতা থেকে বঞ্চিত হয় না। ধানের ঝালর হাতে নিয়ে লেখক ভাবে এই ঝালর টাঙালে তার বাড়ি সুন্দর হয়ে উঠবে, ধানের সুগন্ধে ম ম করবে বাড়ি।
কিন্তু পরক্ষণেই তার স্বপ্ন ভেঙে দেয় তোলাবাজরা। তারা ওই মহিলাদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে হুমকি দেয়।
বাজি ফাটে চারপাশে, কানফাটানো আওয়াজ। ‘আমার মনে হল এই সময় কেউ পাখিদের কথা ভাবছে না। তারা ভয়ে যেন কোথায় লুকিয়ে আছে।’
মনে দাগ কেটে যায় নূর জহীরের ‘বালুচরি’ গল্পটি, যেখানে দরিদ্র বালুচরি শিল্পী আকরম আলি প্রচুর অর্থের বিনিময়েও নিজের বোনা একটি বালুচরি শাড়ি বিক্রি করে না। কারণ সেই শাড়িটা সে মা দুর্গার জন্যে তৈরি করেছে। শাড়ি কিনতে আসা শেখ তাজ্জব হয়ে যায় এই কথা শুনে।
‘আক্রমের চেহারায়... একটি শিশুর মতো স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল। ঠিক তেমনি খুশি যে কোন বাচ্চা নিজের বাড়ির ঘুলঘুলিতে পাখির ডিম দেখে বোধ করে। প্রথমে ডিম, তারপর ছোট্ট ছোট্ট পাখির বাচ্চা, কিছুদিন পর দেখা যায় ছোট্ট ছোট্ট পাখনা। আর সেই বাচ্চা পাখিদের প্রথম ওড়া, আহা! মখমলে জড়ানো বালুচরি শাড়িটাকে বুকে জড়িয়ে সে বড়ই সম্মানের সঙ্গে বলল, আপনারা মানুষ হয়েও শিল্পের দাম ও মর্ম বোঝেন না, তাজ্জব বোধ করছি!’
দেশভাগের নির্মম গল্প গুলজারের ‘রাভী পার’, যখন সদ্য জন্মানো পাকিস্তান থেকে একটি শিখ শরণার্থীর দল ট্রেনের মাথায় চেপে আসছে হিন্দুস্থান, আসার পথে ঝুড়িতে রাখা দুটি শিশুর একটি মারা যায়, তাকে রাভী নদীতে ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়ে দর্শন সিং বোঝে সে আসলে জীবিত শিশুটিকে ছুড়ে ফেলেছে, মৃতটিকে বুকে আঁকড়ে রেখেছে তার স্ত্রী সাহনী। ওই মৃত শিশুটি যেন দেশভাগের ফল, যাকে আমরা আঁকড়ে ধরে আছি বুকে।
সুধা অরোরা, জয়া জাদবানীর গল্পে পাই নারী স্বাধিকার চেতনা। গার্হস্থ্য হিংসার বলি মেয়ের চিতার সামনে দাঁড়িয়ে মা ভাবে ‘বার বার মেয়ে হয়েই জন্মাতে ভালবাসবি। একশো বছর ধরে মেয়েই হবি আমার জানা। যত দিন না তুই নিজের ভাগের আকাশ পাস, তোর নিজের জমি, তোর নিজের ভাগের আকাশ। সব শুধু আর শুধু তোর নামের।’
মিতার নির্বাচিত প্রতিটি গল্পের বিষয় এবং আঙ্গিক আলাদা। এই বৈচিত্র্য সংকলনটিকে আকর্ষণীয় করেছে। তবে এই নির্বাচনের পেছনে তাঁর ঠিক কী ভাবনা কাজ করেছে তা জানা গেল না, কারণ মিতা কোনো ভূমিকা লেখেননি। অনুবাদ পত্রিকার সম্পাদক কবি বিতস্তা ঘোষাল অবশ্য প্রকাশক হিসেবে একটি তথ্যনিষ্ঠ ভূমিকা লিখেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ। কিন্তু অনুবাদকের কথা থাকলে এই সংকলনটির গুরুত্ব আরও বাড়ত। লেখক অশোক ভৌমিকের করা প্রচ্ছদটি চমৎকার।
রিভিউ ভাল লেগেছে। নেহেরু-সুভাষ দ্বৈরথের একমাত্রিক সরল মিথ নিয়ে সতর্কবার্তাটি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত ন'জন লেখকের মধ্যে তিনজন ছত্তিশগড়ের।
মুক্তিবোধ = রাজনন্দগাঁও,
বিনোদন শুক্ল= রায়পুর,
জয়া জাদবানী= বিলাসপুর।
অনুবাদক মিতা দাস ও ভিলাইনগর।
হিন্দি গল্পের অনুবাদ বাঙালি পাঠকের জন্য খুব জরুরি। হিন্দি সাহিত্য যে "খোট্টা" ভাষার অনুন্নত লেখালেখি মাত্র নয় তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি। উর্দু আর পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে হিন্দি সাহিত্য স্বমহিমায় দাঁড়াতে পারে। বেশ কিছু হিন্দি কবিতা শুনেছি যা অতি মনোগ্রাহী। হিন্দি কবিতারও অনুবাদ হাতে পেলে বাঙালি পাঠক সমৃদ্ধ হবেন।
সমৃদ্ধ হলাম
এই বইখানি ফোনে বা হোয়াটসআ্যপে
অর্ডার করতে চেয়ে হোয়াটসআ্যপে মেসেজ করতে চাইছিলাম। হলনা।
ফোনে চেষ্টা করলাম। নম্বরের কোন অস্তিত্ব নেই।