কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছিল। আলো ঝলমলে শহরটা যেন সলমা জরির কাজের মতো আটকে ছিল আকাশের গায়ে।
অতনু বড়ো রাস্তায় পা বাড়াতেই বিদিশা বলে উঠল দাঁড়াও, যেয়ো না।
অতনু অবাক হয়ে বলল, কেন? মাথা ঘুরছে?
ঘাড় নাড়ল বিদিশা, না।
-তবে?
-আমি পারব না।
-কী পারবে না ?
-রাস্তা পেরতে।
-কেন?
-গাড়িগুলো এসে পড়বে গায়ের মধ্যে।
হাল্কা হেসে অতনু বলল ধুর বোকা এখনো তো সিগনাল লাল হয়ে আছে।
বিদিশা বলল, এক্ষুণি সবুজ হয়ে যাবে।
অতনু বলল, ঠিক আছে, রিল্যাক্স। সময় নাও। পরের বার লাল হবার সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভ নেবে।
অতনুর ডান হাতটা খামচে ধরে ছিল বিদিশা। মাথা গরম হচ্ছিল অতনুর। সময় নষ্ট। শুধু শুধু এই ন্যাকামির কোন মানেই হয় না। দ্বিতীয় বার সিগনাল লাল হতেই বিদিশাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল অতনু রাস্তার ওপারে। সামান্য কিছু কেনাকাটার পরিকল্পনা আছে ওদের। সামনে দুর্গা পুজো। সব কিছু ফেলে দিয়ে এখানে এসে বসে আছে। তারা ঢুকলো একটা শপিং মলে। থরে থরে সাজানো জামা প্যান্ট সালোয়ার কুর্তা। বিদিশা জলতরঙ্গের মত সেগুলো হাত দিয়ে দিয়ে নাড়ে আর চলে যায়। চোয়াল শক্ত হয় অতনুর। ধৈর্য্যের ও একটা সীমা আছে জানেনা বিদিশা। অতনু বলে একটা কিছু নাও, সেই থেকে তো দেখেই যাচ্ছ।
বিদিশা ওর ভাইয়ের পুঁচকি মেয়েটার জন্য একটা জামা তুলে নিয়ে বলে শুধু এটুকুই থাক। ওরা ফিরে আসে হোটেলের ঘরে। ফেরার সময় কিনে আনে রুটি তরকা, সেটা দুজনে মিলে খায়। অতনু আলক্ষে তাকিয়ে থাকে বিদিশার দিকে। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিছু হয়নি বিদিশার, অতনু জানে। নাটক চলছে, নাটক। কিন্তু সেটা প্রমাণ হবার অপেক্ষা করতেই হবে তাকে।
ভিতরে ভিতরে দাঁত কিশমিশ করে অতনুর। কি সু্নিপুণ অভিনেতা বিদিশা যে সবাইকে ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ একথা মুখ ফুটে প্রকাশ করবার উপায় নেই তার। সবাই ছি ছি করবে। তাকে দায়িত্বশীল স্বামীর ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। সে যেন রঙ্গ মঞ্চে আটকে পড়া মৃত সৈনিক, তুমুল হাততালি যার কোন কাজে লাগে না মঞ্চে উপস্থিত থাকা ছাড়া। সে বলল কালকে সকাল আটটায় এ্যাপয়েন্টমেন্ট। গুছিয়ে রাখ কী পরবে, কী কী রিপোর্ট নেবে, সব। তারপর এগিয়ে গেল বিদিশার কাজে হাত লাগাতে।
পরদিন সকালে স্নান সেরে তৈরি হয়ে স্ক্যানের ছবি, ব্লাড রিপোর্টের কাগজ সব প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঝুলিয়ে তারা গিয়ে দাঁড়ালো রাস্তায়। না, সেদিন আর রাস্তা পেরনর চক্কর নেই। সেই ফুট থেকেই পেয়ে গেল অটো রিক্সা। আজ তাদের যেতে হবে হার্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট। হার্টের কোন সমস্যা আছে কিনা দেখা হবে বিদিশার। নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে সে অতনুকে। নেহাত ফুরফুরে আবহাওয়ায় সকাল বেলা বেরলে বেশ একটা বেড়ানো বেড়ানো লাগে। আর দক্ষিণের হাসপাতাল গুলোও তো তেমনি, ঝকঝক করছে চারিধার, ক্যাফে, ক্যান্টিন। সে বিদিশার হাতটায় চাপ দিয়ে বলল, তোমার কিচ্ছু হয়নি দেখো। তবে একবার সবকিছু দেখিয়ে নেওয়া তো ভালোই। বিদিশা বলল, তবে তুমিও একবার চেকআপ করে নাও সবকিছু।
সে বলল, নানা আমি ঠিক আছি।
দৌড়ে গিয়ে লাইন দেওয়া হলো রেজিস্ট্রেশনের। এই চলছে সমানে কয়েকদিন ধরে। তারা এসেছে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় স্নায়ু ও মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকেন্দ্রে বিদিশার চিকিৎসা করাতে। সে কি লম্বা লাইন । ভিড়ে গিজগিজ করছে চারিধার। এর মধ্যে অর্ধেকই বাঙ্গালী। এর থেকেই টের পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থার কী হাল। আবার ব্যাপারটা ঠিক তা না-ও হতে পারে। হুজুগও এর কারণ হতে পারে। কোথাও বেড়াতে গেলেও তো সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে বাঙ্গালীর। আমি একটা সেরা জায়গায় নিজের চিকিৎসা করালাম, এই একটা আত্মতৃপ্তি আর কি। যে আত্মতৃপ্তির জন্য বিদিশা জেদ ধরেছিল এখানে আসার।
এক লাইন থেকে দৌড়ে গিয়ে আর এক লাইন। রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাক কয়েক ঘণ্টা। মাঝখানে ক্যান্টিনে গিয়ে একটু ইডলি কিম্বা ধোসা খেয়ে আসা। হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর। তখন তুমি একটু পাবে বসার জায়গা। তোমার স্লটের জন্য নির্দিষ্ট টোকেন। তীর্থের কাকের মত ফের অপেক্ষা ডাক্তারের দেখা পাওয়ার। কত বিচিত্র সব মানুষ জন যে এসেছেন। এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, দাদা কোথা থেকে আসছেন?
অতনু বলল, কল্যাণী।
ভদ্রলোক বললেন, ও। আমার বাড়ি কাঁকিনাড়া।
অতনু বলল, কাকে দেখাবেন?
-আমাকেই।
-কী হয়েছে আপনার?
ভদ্রলোক একটু গলা নামিয়ে বললেন, চোখের দোষ। ধরুন আমি কোন মেয়ের দিকে এমনিই তাকিয়েছি, কিন্তু আমার দৃষ্টিটা খুব বাজে হয়ে গেল, আমি চোখ মেরে দিলাম। আমি কিন্তু বুঝতেই পারছিনা কিন্তু মেয়েটা রেগে গেল। একদিন তো মার খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছি মশাই। ওখানে ডাক্তার মাসে একটা করে ইঞ্জেক্শন দিচ্ছিলেন তা ভাবলাম একবার ভালো জায়গায় দেখিয়ে আসি। তা আপনি কাকে দেখাবে?
অতনু খানিক থমকালো। অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে বক্বক্ করা বিদিশা একদম পছন্দ করে না। কিন্তু অতনুর ভালোই লাগে। দিব্যি সময়টা কেটে যায়। বলল, আমার স্ত্রীকে। বলতেই ভদ্রলোক বিদিশার দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে আপাদমস্তক মাপলেন যে অতনু ভাবল ভদ্রলোকের যথার্থ চিকিৎসার দরকার আছে। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে আপনার স্ত্রীর?
অতনু জানে সব কিছু খুলে বলতে গেলে বিদিশা রেগে যাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি বলল, মাথা ব্যথা। ভদ্রলোক বললেন, মাথা ব্যথার জন্য এতদূর এসেছেন?
অতনু বলল, এ ব্যথা সে ব্যথা নয়। সাংঘাতিক যন্ত্রণা। যাই বলে, অতনু সেখান থেকে সরে গেল। যদিও অতনুর ইচ্ছে করছিল সব খুলে বলে দিতে। নাটক যখন তখন সব লোক জানুক। হাততালিটা জোড়েই পড়ুক।
ডাক্তার অতনুর মনের কথাই বললেন। বললেন, মনে হয় না খুব গুরুতর কিছু তবে সিটি স্ক্যান আর ই ই জিটা করে পরের সপ্তাহে বড় ডাক্তারকে দেখাতে হবে। এই এক মুশকিল, এদের খপ্পরে পড়েছ কি আর নিস্তার নেই। এটা করো, সেটা করো। এদিকে অতনুর সমস্ত কাজ পড়ে রয়েছে। ডিপার্টমেন্টের চাবি তার কাছে, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জিনিস পত্র বার করতে অসুবিধা হচ্ছে। সে ভেবে ছিল দুচার দিন লাগবে, একটু বুড়ি ছোঁয়া করে দিয়েই ফিরে যাবে। কেউ বলতেও পারবে না যে সে দায়িত্ব পালন করেনি আবার তার খুব একটা কিছু অসুবিধেও হবে না কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে সে গাড্ডায় ফেঁসে গেছে।
রাস্তা পেরিয়ে সিটিস্ক্যান আর ই ই জি করার কেন্দ্রে পৌঁছল তারা। সেখানে গিয়ে তো আর এক বিপত্তি। ই ই জির ডেটই নাকি পাওয়া যাবে না এর মধ্যে। অনেক বলে কয়ে বিদিশাই জোগার করল একটা ডেট। এবং সে রিপোর্টও স্বাভাবিক। বড় ডাক্তারের কাছে ভিড়ও বড়সড়। সারাদিন প্রায় বসে থাক চেয়ারে। সেই ভিড়ের মধ্যে কারো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, কার কষ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। কেউ ওষুধ খেতে খেতে এত পৃথুল সে তার মা তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারছে না, কোমরে দড়ি বেঁধে টানছে। অতনুর চোয়াল শক্ত হচ্ছে। তাকে এমন প্যাঁচে ফেললে বিপাশা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। বসে থাকতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনের মধ্যে উদ্বেগ, কী বলবে বিপাশা ডাক্তারকে কে জানে। সে যে এত করছে বিপাশার জন্য সেটা কি সে মনে রাখবে না একবারও!
সেখান থেকে হার্ট। এখানকার ডাক্তাররাই রেফার করলেন হার্টের হাসপাতালে। আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে কে জানে। যদিও এখানেও জানে অতনু কিছুই বেরবে না, তবু দেখিয়ে নেওয়াই ভালো, কেউ বলতে তো পারবে না অতনু অবহেলা করেছে। ভেতরে ভেতরে একটু হাসিও পাচ্ছে অতনুর। বিনা কারণে কী চলছে কদিন ধরে। আবার রাগও হচ্ছে, আর কত দিন! আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, চকচকে কাঁচের মত রোদ, পুজো পুজো বাতাস চারদিকে, এসময় কি কারো ডাক্তার বদ্যি করে বেড়াতে ভাল লাগে! সবচেয়ে বড় কথা এতদিন ধরে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে তার নিজেরই যেন মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সেই মনের জোরটা যেন আর নেই। হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ছটফট করে উঠছে।
ইসিজি হলো, ইকো হলো, হল্টার মনিটর হলো, চারিদিকে তার জুড়ে জুড়ে একটা যন্ত্র ঝুলিয়ে দিল বুকের মধ্যে যেটা চব্বিশ ঘন্টা বাদে গিয়ে আবার খুলে আসতে হবে। ভয়টা যেন ক্রমশ ছেয়ে যাচ্ছে অতনুর মধ্যে। বিদিশা যেন মাটি খুঁড়ে কিছু না বের করে এনে থামবে না। শরীরটাকে এত খুঁচো খুঁচি করার দরকার কি!
না এত সব করেও কিছু ত্রুটি বেরল না বিদিশার। কিন্তু তার থেকে কি ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে বিদিশা সুস্থ্? না, তা না এসে তারা উল্টে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে ওর অসুখটা আসলে মানসিক অসুখ। এবং রেফার করে দিলেন মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে। সেখানে গিয়ে কী বলবে বিদিশা? বুকের মধ্যে দিব দিব করছে অতনুর। কী এমন করেছে অতনু? একটা কাজ কি ঠিক ভাবে করতে পারত বিদিশা! নিজের ব্যাঙ্কের আকাউন্ট নাম্বারটা পর্যন্ত ঠিক করে জানেনা সে, তাকে কোন কাজ ছেড়ে দেওয়া যায়? তুমি পারবে না বলে সব কাজ হাত থেকে টেনে নিয়ে করে দিয়েছে অতনু, সেটাই তার দোষ হয়ে গেল! ছেলেকে পড়ানো থেকে রান্নাবান্না সব কাজে সে উদাস, ছন্নছাড়া। তাই হয়ত অতনু তুমি পারবে না বলে একটু ধমকে উঠেছে, হয়ত একটু বেশিই ধমকেছে তাই বলে এমন প্রতিশোধ নেবে বিদিশা!
বেশ কিছুদিন ধরেই বিদিশার ভাবগতি ভালো ঠেকছিল না অতনুর। সব কাজেই সে বলতে আরম্ভ করেছিল আমি পারব না। প্রথমটায় অত আমল দেয়নি অতনু কিন্তু যেদিন সে ইস্কুল যাবার সময় বলে উঠল আমি পারব না, তখন অবাক হলো অতনু, বলল, পারবে না মানে?
রুখে উঠে জবাব দিল বিদিশা, পারব না মানে পারব না। আমি ইস্কুল যেতে পারব না, আমার ভয় করছে।
অতনু অবাক হয়ে বলল, কেন?
-জানিনা।
-কি জন্য ভয় করছে বলবে তো।
-মনে হচ্ছে আমি ট্রেনে উঠতে পারব না।
-ঠিক আছে আমি উঠিয়ে দিয়ে আসব।
-না।
-কি না?
-আমি পড়াতেও পারব না।
-কেন এমন মনে হচ্ছে তোমার?
-জানিনা। আমার মনে হচ্ছে আমি কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারব না।
এরপর অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে অতনু কিন্তু বিদিশাকে আর স্কুলে পাঠাতে পারেনি। এত জনপ্রিয় শিক্ষিকা ছিল সে অথচ পড়ানোর প্রতি আত্মবিশ্বাসটাই যেন টলে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সব কাজেই ভয় পেতে শুরু করল সে। অতনু পড়ল মহা ফাঁপড়ে। এবার তো আর ডাক্তার না দেখালেই নয়। একবার তো স্কুলে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি করতে মাথা ঘুরে কেমন যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ক্ষণিকের জন্য। যদিও অতনুর মনে হল সবটাই অভিনয়। কিন্তু এবার সে বাধ্য হলো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। এবারেও বিদিশার এক গোঁ স্থানীয় ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ সে খাবে না তাকে নিয়ে যেতে হবে দক্ষিণের সেরা সেই হাসপাতালে। অতনু এখন খাঁচায় পড়া বাঘ। খবরটা পাঁচ কান হতে শুরু করেছে, অতএব সে বাধ্য হলো এখানে আসার।
মনটা তিরিক্ষে হয়ে আছে অতনুর। কদিন ধরে ঘুরে ঘুরে এখনো একটা প্রেসক্রিপশন লেখানো গেল না। এবার বাড়ি ফিরে যেতেই হবে। মেন্টাল হেলথের ডাক্তার নিশ্চয়ই ধরে ফেলবেন বিদিশার চালাকিটা, এবার আর ঘুরাবে না, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেবে। এবার যদি হেনস্তা করার সাধটা মেটে বিদিশার।
সন্ধ্যে বেলা খেতে বেরলো তারা। ষোলো নম্বর ক্রশ রোড পেরিয়ে এসে তারা দাঁড়ালো দু নম্বর মেন রোডের ধারে। আঙুর লতার মত পেঁচিয়ে অতনুর ডান হাতটা ধরে আছে বিদিশা। গাড়ির হেড লাইট গুলো সাঁই সাঁই করে পেরিয়ে যাচ্ছে ওদের সামনে দিয়ে। ওদের রাস্তা পেরতে হবে। কিন্তু অতনুর চোখের সামনে ক্রমশ রাস্তাটা যেন কালো সমুদ্রের মত হয়ে উঠছে। তার পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে সমস্ত গাড়ি গুলো এখুনি যেন উঠে পড়বে তার ঘাড়ের ওপরে। তার ভয় লাগছে। সে তবু সাহস সংগ্রহ করে বিপাশাকে বলল, চল। বিদিশা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমার ভয় লাগছে।
রোজ রোজ এই ন্যাকামি আর ভালো লাগে না। হঠাৎ কি হলো অতনুর মাথার মধ্যে এক ঝট্কা মেরে সে বিদিশাকে ঠেলে দিল সামনের দিকে। বিদিশা হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তার ওপরে। ঘ্যাস করে একটা গাড়ি এসে থেমে গেল বিদিশার গায়ের কাছে। বিদিশার মাথাটা কি থেঁতলে গেল? কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে লোকজন এসে ঘিরে ধরল অতনুকে, আপনি ধাক্কা মারলেন না? হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা দেখেছি আপনি ধাক্কা মারলেন তো ভদ্রমহিলাকে, বলে উন্মত্ত জনতা কিল চড় ঘুসি মারতে লাগল অতনুকে। অতনু বার বার বলার চেষ্টা করছিল আমাকে মারবেন পড়ে, আগে ওর কী হয়েছে দেখুন। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল ধাক্কা মেরে এখন আবার আদিখ্যেতা হচ্ছে।
জনতার হাত থেকে যতক্ষণে ছাড়া পেল অতনু ততক্ষণে অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে। ঘাড় উঠিয়ে অতনু সামনে কোথাও বিদিশাকে দেখতে পেল না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে রাস্তা পেরলো, এদিক খুঁজলো, ওদিক খুঁজলো, রাস্তার আনাচে কানাচে, বন্ধ হয়ে যাওয়া শুনশান বাজারের গলি ঘুঁজিতে। খুঁজতে খুঁজতে সে চিৎকার করে ডাকল, বিদিশা তুমি কোথায়? কিন্তু কোথাও সারা পেল না। হতাশ হয়ে সে যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন তার চোখ পড়ল ফ্লাইওভারে। যেখানে মাঝ রাস্তা দিয়ে উল্টো দিকে হেঁটে চলেছে বিদিশা। না তার কোন ডানা গজাচ্ছে না, সে উড়েও যাচ্ছে না কোথাও, সে শুধু হেঁটে যাচ্ছে আর সমস্ত গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে হেঁটে চলার। যেহেতু মানুষের দৃষ্টির সীমারেখা আটকে থাকে দিগন্তে তাই অতনুর মনে হচ্ছে বিদিশা মিলিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। আকাশের গায়ে।
বাহ!
এই গল্পটার সাথেও ছবিটা আশ্চর্য্য! এই ছবি আমি দেখেছি আগে, কিন্তু গল্পটার সাথে অদ্ভুত!
আশ্রয়ের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে বিদিশারা এমন ধাক্কা খায় যে অতনুদের জীবন থেকে এভাবেই হারিয়ে যায় মনের সীমানা পেরিয়ে.....মননশীল লেখনী
ইন্টারেস্টিং লাগল। নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা ক্রমশ অনিয়ন্ত্রিত পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা আর কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না। একমাত্র লেখক পারতেন; কিন্তু এই লাইনটাতে তিনি হাত গুটিয়ে নিলেন নিখুঁত ঈশ্বরের মতো:
"না তার কোন ডানা গজাচ্ছে না, সে উড়েও যাচ্ছে না কোথাও, সে শুধু হেঁটে যাচ্ছে..."
ফলত লক্ষ্য করলাম একটি আনস্টেবল দৃশ্যে গল্পটা শেষ হলো:
"সমস্ত গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে হেঁটে চলার।"
হয় গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে, অথবা চরিত্রটিকে, যে সিস্টেমে কেওসের এজেন্ট, তাকে এলিমিনেট করে দেবে।
শেষদিকে ভুল করে বিদিশা বিপাশা হয়ে গ্যাছে।
গাঁথুনি, গঠন ও যবনিকা তিনটিই খুব ভাল লাগল। মনে হল বিদিশার ভীতি ধীরে ধীরে অতনুকেও গ্রাস করে, সেই গ্রাস অতনুকে করে তোলে নিয়ন্ত্রণহীন, তাতে বিদিশা পায় এক ধরণের মুক্তি। অনিন্দিতা গোস্বামীকে অভিনন্দন!
ভাল লাগল।
গল্প ঠিকমত এগিয়েছে। খুব-ই কৌতূহল হচ্ছিল যে এ-গল্প শেষ হবে কিভাবে। গল্পকার রীতিমত শক্ত হাতে সে চ্যালেঞ্জ সামলেছেন। কুর্নিশ।
বাঃ গল্পের শেষ তো বটেই, বিল্ড আপটি ও চমৎকার লাগল।
ঘটনাবহুল আখ্যান নয়, নিগূঢ় মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানে মানবমনের গহনে পৌঁছে অজানা অনুভূূতির উন্মোচনই লেখকের 'forte', সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মনোদ্বন্দ্বের নিপুণ ব্যবচ্ছেদে প্রতিটি অনুচ্ছেদ পাঠককে ভাবায়।
বেশ অন্যরকম...
অনিন্দিতার ন্যারেটিভ স্টাইলটা আমার বরাবরই ভালো লাগে। চোখের সামনে ঘটনাক্রম ভেসে ওঠে। ঠিক যেন সিনেমা। এই ক্ষমতা ঈর্ষনীয়।
ভালো লাগলো... একটাই অভিযোগ সব বাজে কাজগুলো কি পুরুষ রাই করে!!অতনু এত অল্পে নিজেকে হারিয়ে ফেললো মুহূর্তের জন্য হলেও.. তার মনে কি আগে এটা এসেছিল?
বিদিশা কি আসলেই মিলিয়ে যাচ্ছে
অতনুর কাছ থেকে।
খুবই ভালো লাগলো লেখা।
অনেক অনেক শুভকামনা।
অনুভূতিপ্রবণ / সংবেদনশীল গল্প। মেয়েদের মিলিয়ে যাওয়াটা দেখতে ভাল লাগে না। কষ্ট হয়। তা সে গল্পেই হোক আর বাস্তবে। ভাল গল্প। শুভকামনা অনিন্দিতাকে।
অতনুর তদারকি ও আশ্রয়ে বিদিশার চিকিৎসা ও দিনযাপন। এমনি ভাবে গল্পের পরিনতিতে বিদিশা কোন শূণ্যে যেন মিলিয়ে যায়। খুব উপজীব্য লেখা। ভালো লাগলো ' আশ্রয়' গল্পটা। লেখিকাকে অভিনন্দন জানাই!
আপনার উৎসবে ইস্পেশাল "আশ্রয়" - সম্পর্কে -
"শুধু শুধু এই নেতা মীর কোন মানে হয় না।"
"ধৈর্যের ওএকটা সীমা আছে জানে না বিদিশা।"
শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ইতিবাচক মানসিকতা কে স্মরণ করাতে আশ্রয় একটি নিখুঁত সাহসি প্রচেষ্টা।
আর পরিণতি হিসেবে প্রতীকী অতনুও বিদিশার বাস্তবে হারিয়ে যাওয়া কাম্য ছিলনা দু' জনের কাছে - মননশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে।