সবসময় তো চলছি আমরা । কোনো না কোনো ভাবে। গন্তব্য নেই। চলাটাই সারকথা। গন্তব্যে গেলেই তো সব শেষ। তাই এই পথ চলা শুধু পায়ে হেঁটে চলা নয়। স্বপ্নে, মনে, অন্তরে, ভাবনায় ভালোবাসায় দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া। এদের প্রত্যেকটির আলাদা গন্ধ, রঙ, স্বাদ। কোথায় গিয়ে মেশে কেউ জানে না। তাই সে পথ রুহানি। মিস্টিক। নীল আর ধূসরে বিলীন। চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে। সাদামাটা হেটো পথ নক্ষত্রবীথি হয়ে ওঠে তখন। আমরাও অনন্তকাল ধরে সেই পথেরই সন্ধানী।
১
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রিয় কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য লেখেন ১৭৫২ সালে। নিজের কাব্যকে নৌতন মঙ্গল বলে পরিচয় দেবার অভিলাষ ছিল তাঁর। তিনি যেমন মঙ্গল কাব্যের প্রথা ভেঙেছেন, তেমনই ‘বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত’ করেছেন। বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দুস্তানি শব্দ মিশিয়ে রসকথা পরিবেশন করলেন,
“না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।।”
ভাষা বহতা জলের মতো। তাকে শুচিবায়ুগ্রস্ত হলে চলবে না। সমাজে যা ঘটে চলে সেই বহমান সমাজেরই ছবি, ভাষানদীর জলে এসে মুখ দেখে।
আশ্বস্ত হোন। আমি কাব্য আর ভাষা নিয়ে রসালাপে ব্যাঘাত ঘটাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করি না, সে ক্ষমতাও রাখি না। আমার নজর চকচকে ও রসনা সিক্ত হচ্ছে এই পঙ্ক্তিগুলির দিকে তাকিয়ে।
সঘৃত পলান্ন রেঁধে মা অন্নপূর্ণা শিবঠাকুরের জন্য কী কী রাঁধলেন—
“কচি ছাগ মৃগ মাংস ঝাল ঝোল রসা
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমূসা
অন্ন মাংস সিক ভাজা কাবাব করিয়া।”
মাছ, মাংস বাঙালি খেত বিলক্ষণ, কিন্তু রন্ধন প্রণালী লক্ষ করলে কী দেখি! বিরিয়ানি, কাবাব, কালিয়া, দোলমা/বাগা, পুর ভরা খাবার, অগ্নিতাপে দগ্ধ ‘বেকড’ সেকচী, সমূসা বা শিঙারা। অর্থাৎ একেবারে যাবনী মিশাল। মোগল-পাঠান তো বটেই, আরমানি-গ্রিক-পোর্তুগিজ সব্বাই রয়েছে। নবাব-বাদশাদের রসুইঘর দিয়ে এই যাবনী মিশালের কী খিচুড়ি পাকানো হল সেইটাই নেড়েচেড়ে দেখি।
২
এই সূত্রে একবার দেখে নেওয়া যাক সেই সময়ে সারা ভারতবর্ষে কোথায় কী হচ্ছে! দিল্লিতে মোগল সাম্রাজ্যের সূর্যের তেজ কমেছে। বাবার হল আবার জ্বর সারিল ঔষধে, অর্থাৎ বাঘা বাঘা মোগল জমানা শেষ। মসনদে আসীন তুলনামূলক ভাবে আপাত গুরুত্বহীন মোগলরা। পাশাপাশি তেজ ক্রমশ বাড়ছে কমছে আওয়াধেরও।
এখন মজার ব্যাপার হল নবাবি আওয়াধ আর মোঘলি দিল্লির বেশ ভালো টক্কর ছিল। সব বিষয়ে। কিন্তু সেটা প্রকট ছিল দস্তরখোয়ানে অর্থাৎ কিনা খাবারদাবারে, পাকশালে।
এদিকে ইতোমধ্যে বাংলার তদানীন্তন কেন্দ্র মুরশিদাবাদের রান্নায়, বলাই বাহুল্য মোগলাই আঁচ ভালোভাবেই ধরেছে। তবুও বলতে হবে সে আঁচ অত উসকে উঠতে পারেনি, হয়তো পাশাপাশি বাংলার রন্ধনশৈলীর প্রভাবে। এখানে নবাবেরা শুক্তো খেতেন। সেই শুক্তে মেশান হত বাদাম, পেস্তা, কিশমিশ। উচ্ছে তার তিক্ততা হারিয়ে বিদেশি চোগাচাপকানে মিষ্টি হাসন দিত। এনারা পোস্তর হালুয়া বানাতেন। এ ছাড়া চিতুয়া বলে প্যানকেকের মতো একটা খাবার বেশ পছন্দ করতেন। গোবিন্দভোগ চাল সারারাত ভিজিয়ে বেটে ঈষৎ টোকো গোলা দিয়ে চিতুয়া বানানো হত। বাকি সব পদে কম বেশি মোগল প্রভাব।
আর-একটু পিছিয়ে যদি যাই, দেখছি দুটি আকর্ষণীয় বই। একটির নাম ‘মানসোল্লাস’, অন্যটি ‘নিমাতনামা’।
‘মানসোল্লাস’ আর ‘নিমাতনামা’র মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য আছে নামকরণে এবং বিষয় নির্বাচনে। কিন্তু ‘মানসোল্লাস’ বারো শতকের, ‘নিমাতনামা’ লেখার সময় ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। দুটি বই এর নামকরণের মধ্যেও মিল—উল্লাস আর আনন্দ। বিষয়বস্তুর মধ্যেও যথেষ্ট মিল। খাবার, রান্না, সুগন্ধির দুটি বইতে বিস্তারিত বিবরণ আছে। ‘মানসোল্লাস’ সংস্কৃতে লেখা, দক্ষিণ ভারতের। ‘নিমাতনামা’ উর্দু-ফারসিতে লেখা মান্ডুর সুলতান ঘিয়াথ শাহের আনন্দযাপন।
তার রচনাকাল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। ইতিহাসের কালপঞ্জী অনুসারে মোগলদের আসার আগে লেখা। দিল্লিতে লোদি শাসন। মধ্যভারতের মালব অঞ্চল বরাবরই সমৃদ্ধ ছিল। এইখানে বসে ঘিয়াথ শাহ একটা রান্নার বই লিখেছিলেন খুব যত্ন করে। বইটিতে অনেক ছবি আছে। প্রায় সব ছবিতেই দেখা যায় ঘিয়াথ শাহকে ঘিরে রান্নার যজ্ঞি বাড়ি বসেছে। বইটিতে আটপৌরে রান্না থেকে কেতাদুরস্ত রান্না সবই লেখা আছে। আহার্য দ্রব্য ছাড়াও শরবত ও পান বানানোর বিশদ ও বিচিত্র পদ্ধতি নিয়ে লেখা আছে। ভেষজ ও ঘরোয়া ওষুধ টোটকা এবং সুগন্ধি বানানোর কায়দাকানুন বেশ আলোচনা করেছেন তিনি। এই বই মোগল পূর্ব যুগের খাবার সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা দেয়। ঘিয়াথ শাহ খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পাকপ্রণালীর কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন, বইটি পড়লেই তার সম্যক ধারণা হয়। সুলতান যুদ্ধ করতেন না, দরবারি কাজকারবার কিছুই দেখতেন না। তরবারি নামিয়ে তিনি খুন্তি ধরেছিলেন।
কয়েকটি নমুনামাত্র তুলে ধরছি। শুরু করি শরবত দিয়ে। পেশ করছি ঘিয়াদ শাহি শরবত, ডুমুর ফলসা আর খেজুর একসঙ্গে কুচিয়ে নিন। জলে মিশিয়ে খুব করে নাড়াচাড়া করে সিরাপ মেশান। এবারে এই শরবতের সঙ্গে আসছে কোফতা।
মাংসকে ভালো করে পেটাতে হবে। পিটিয়ে পিটিয়ে নরম হয়ে এলে ছড়িয়ে দিন পোস্ত দানা। এবারে দিন নুন, মৌরি জাফরান, কর্পূর আর কস্তুরী।
মাংসটাকে ওইসব দিয়ে মেখে তারপর গোল্লা পাকিয়ে লেবু পাতা দিয়ে মুড়ে ফেলতে হবে। লেবুপাতাটা টক টক হলেই ভালো। এইবার বেশ কিছুক্ষণ রেখে মাংসের হাড়গোড় দিয়ে ফোটানো ঘন সুরুয়ার মধ্যে সেদ্ধ করে গরম গরম কোফতা খেতে হবে।
এবারে পান সাজার গল্প। ঘিয়াথ শাহি পানের বিরা। পান পাতা ধোয়া হবে কর্পূর আর গোলাপ জলে। একটা পদ্ম নকশা কাটা শ্বেত পাথরের গামলায়। এগারোটি পান দিয়ে নবাবের পানের বিরা। মিহিন চুন তৈরি হল। আর সুপুরিকে কুচি কুচি করে কেটে ফুটিয়ে নিতে হবে ঘৃতকুমারী তেলে, তারপর ওই সুপুরি কুচিগুলোতে জম্পেশ করে মাখাতে হবে কস্তুরী আর সাদা অম্বরগ্রিস। একটু গোলাপ সুগন্ধি ছিটেফোঁটা।
অম্বরগ্রিস সমেত এমন অনেক উপাদান এখন পাওয়া যায় না বা সহজলভ্য নয়।
আরও একটা শুনুন, জাফরান, চন্দন, কস্তুরী, কর্পূর একটু একটু নিয়ে তাতে একটু গোলাপজল আর অম্বরগ্রিস মিশিয়ে পান দিয়ে থেঁতো করবে। করতেই থাকুন, করতেই থাকুন। না এখনই খাবেন না। একটা ভেজা খড়ের পাথা দিয়ে খুব করে বাতাস করুন খুব জোরে জোরে। তারপর সেই থেঁতো পান ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে এলে টুপুস করে মুখে ফেলুন!
আরও শুনুন তবে, জ্বরজারি হলে, গরমে শরীর শুকিয়ে নাক দিয়ে রক্ত বেরুলে, বমি বমি ভাব হলে এই পান থেঁতোটাই তখন ওষুধ!
পেট গরম হলে চাট্টি ভাত খাবার কথাও লেখা আছে। শব্দও ব্যাবহার করা হয়েছে, ভাত।
‘নিমাতনামা’য় লেখা আছে ভাত ভিজিয়ে রাখতে হবে লেবুজলে। লেবুর রস পুরো শুষে নেবার পর ওই ভাত ঠান্ডা জলে সাতবার ধোবেন। তারপর তাজা তাজা ফুল গাছ থেকে পেড়ে ভিজে ভাতের ওপর বিছিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ পরে ফুলগুলো সব তুলে ফেলে দিয়ে সেই লেবু আর ফুলের গন্ধ মাখা ভাত খাবেন।
সুলতানি ভারতের খাবারের একটি বিশ্বস্ত দলিল হল পর্যটক ইবনবতুতার বিবরণ। তিনি তুঘলক জমানায় মহম্মদ বিন তুঘলকের সময় ভারতে আসেন। কাঁঠাল তাঁর লেখায় খুব সুখ্যাতি পেয়েছে। দানাশস্য, তেল, মশলা, ভেষজ জড়িবুটি, মাংস, মাছ, রুটি, সামোসা সবকিছুই তিনি উল্লেখ করেছেন। আম এবং আদা, নুন দিয়ে জারিয়ে রাখার কথাও। রাজখানার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে রয়েছে রুটি, পাতলা করে বানানো। খন্ড খন্ড মাংস, ঘি মশলায় রান্না করে ঘি ভাতের ওপর সাজান। খুব জনপ্রিয় খাবার ছিল সম্বুসক, শিঙারা। মাংসের কিমা, বাদাম, পেস্তার পুর ভরে তিন কোনা এই শিঙারা বানানো হত। আমন্ড বাদাম বাটা আর মধুর পুর ভরা পিঠে ধরনের সুস্বাদু খাবারও ইবন উল্লেখ করেছেন।
৩
মোগল দস্তরখোয়ান একটি অতি বিচিত্র রঙের বিচিত্র নকশার কার্পেট। মোগল রসুইঘর এক ব্যস্ত গবেষণাগার, যেখানে বছরের পর বছর রন্ধন শিল্পের রসায়ন নিয়ে নিপুণ কারিকুরি চলেছে। কয়েকশো বছর পেরিয়ে আজও সেইসব খাদ্য তার জনপ্রিয়তা থেকে নড়েনি। চাঘতাই তুর্কের দল যখন ফারঘানার ফলমূলের রসাল নন্দন ছেড়ে এদেশে এল, বাবরের মোটেও তা ভালো লাগেনি।
কিন্তু ধীরে ধীরে যতই দিন গেছে সেই রসুই খানদান রসিক সম্রাটদের এবং বেগম বিশেষ করে নূরজাহানের হাতে পড়ে এক অনুপম রন্ধনশৈলীর শিরোপা পরে এক কালজয়ী পেশকশ হয়ে উঠল। তুর্ক, আফগান, পারস্য, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, দাক্ষিণাত্য এই সব অঞ্চলের রন্ধন প্রণালী আর মশল্লা মিলেমিশে হয়ে উঠল বেশ কয়েকশো বছর ধরে এক উমদা জায়কা।
তাহলে আসুন, বিসমিল্লাহ্ এ রহমান এ রহিম বলে শুরু করি। কী বলুন?
উৎকর্ষ ও সৌকর্যের চূড়ান্ত সীমায় উঠেছিল মোগল খানদান। ইতোমধ্যেই কোরমা, কালিয়া, কাবাব, পোলাও আর সবজি রান্নায় রকমফের এসেছে। পোর্তুগিজদের হাত ধরে লঙ্কা, আলু আর টমেটো ঢুকেছে পাকশালায়। আবার ইওরোপীয় কেক, পুডিংও দস্তরখোয়ানে মাঝে মাঝে জায়গা করে নিচ্ছে।
সম্রাটরা সাধারণত বেগম ও হারেমসুন্দরীদের সঙ্গে বসে খানাপিনা করতেন। বিশেষ বিশেষ দিনে, উৎসবে-তেওহারে মন্ত্রী ও সভাসদদের সঙ্গে আহারে বসতেন।
মোগল দস্তরখোয়ান, রং, খোশবায়, রান্নার প্রণালী নিয়ে দস্তুরমতো পরীক্ষানিরীক্ষার একটা মহাকাব্য। আদবকায়দা, দস্তুর, রেওয়াজ সব মিলিয়ে স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ-মোহ-মাদকতার এক নশিলি দাস্তান, এ গল্পের যেন শেষ নেই।
হেকিম অর্থাৎ রাজবৈদ্য কী কী রান্না হবে তা একবার সরেজমিনে দেখে নিতেন। দেখে নিতেন প্রয়োজনীয় খাদ্যগুণ বজায় থাকছে কি না। উদাহরণস্বরূপ, পোলাও-এর চালে রুপোর পাতলা মোড়ক, যা হজমে সাহায্য করে এবং একই সঙ্গে কামোত্তেজক! বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক!
একবার রান্নার মেনু ঠিক হয়ে যাবার পরে প্রায় কয়েকশো রসুইকর মাঠে নেমে পড়ত। কাজও তো নেহাত কম ছিল না। বৃষ্টির ধরে রাখা জলে রান্না হত। শাহজাহানের সময়ে রান্নায় মশলার পরিমাণ খুব বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যমুনার জল পেটের পক্ষে ভালো ছিল না। আদা, জিরে এই সব মশলা ব্যবহার করে সেই দোষ কাটান দেওয়া হত।
মহার্ঘ দস্তরখোয়ানের ওপর খাবার পরিপাটি করে বিছিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হত। মোগল রান্নাঘরে এ দেশের যেসব খাদ্যদ্রব্য ঢুকেছিল সেগুলো হল চন্দন, পান, আম, ফলসা, কলা, লাউ, বাতাসা, সোহাগা। আর কাশ্মীরের বড়ি! না আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। বড়ির নানান কিসিমের অবতার আছেন। কাশ্মীরি, পাঞ্জাবি, বাঙালি, দক্ষিণি।
ফরঘানার ফলপ্রীতি এদেশে মোগলরা সঙ্গে করে এনেছিল। চেরি, অ্যাপ্রিকট, আঙুর, তরমুজ, এদেশের মাটিতে ফলতে শুরু করে। তবে মোগলদের আম্রপ্রীতির তারিফ করতেই হয়। শাহজাহান নাকি নিজের চোখের সামনে আমের ওজন মাপা দেখতেন। তাঁর এই আম আশিকির জন্য রসুইঘরে নানান গবেষণা চলত ‘বাদশাহ নামদার’, হুমায়ুন আহমেদের মধু দিয়ে লেখা একখান কিতাব, সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে। সেখানে এমন সুন্দর একটি আমের বর্ণনা আছে, পড়লেই মুখে জল এসে যায়।
“বাঙ্গালমুলুক থেকে কাঁচা আম এসেছে। কয়লার আগুনে আম পোড়ানো হচ্ছে। শরবত বানানো হবে। সৈন্ধব লবণ, আখের গুড়, আদার রস, কাঁচা মরিচের রস আলাদা আলাদা পাত্রে রাখা। দুজন খাদ্য পরীক্ষক প্রতিটি উপাদান চেখে দেখছেন। তাঁদের শরীর ঠিক আছে। মুখে কষা ভাব হচ্ছে না, পানির তৃষ্ণা বোধও নেই। এর অর্থ উপাদানে বিষ অনুপস্থিত।”
এরপর বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন সম্রাট হলেন। ‘বাদশাহ নামদার’ থেকে একটা বর্ণনা না দিয়ে থাকা যাচ্ছে না। হুমায়ুন বঙ্গ দেশের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। ঠিক হল সম্রাট একবেলা আহার করবেন। এইবার পড়ুন সেই খাবারের ফর্দ।
পোলাও, পাঁচ ধরনের। রুটি সাত প্রকারের। কিশমিশের রসে ভেজানো পাখির মাংস, ঘি-এ ভাজা। পাখিদের মধ্যে আছে হরিয়াল, বনমোরগ, বিশেষ শ্রেণির ময়ূর, আস্ত ভেড়ার রোস্ট, বাছুরের মাংসের কাবাব, পাহাড়ি ছাগের রোস্ট, সম্রাটের বিশেষ পছন্দের খাবার। এ ছাড়াও ফল, শরবত, মিষ্টান্ন। সম্রাটের যুদ্ধকালীন বাবুর্চির সংখ্যা ছিল একহাজার। প্রধান বাবুর্চির নাম ছিল নাকি খান। ইনি নতুন নতুন খাবার উদ্ভাবন করতেন। তাঁর উদ্ভাবিত একটি খাবার নাকি পুরোনো ঢাকার রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়। খাবারটির নাম গ্লাসি। মোগল আমলের গ্লাসির রেসিপি হল, পাতলা পাতলা করে কাটা খাসির মাংস, শজারুর কাঁটা (শরদিন্দু মশাই এর সরেস গোয়েন্দা গল্পের চেয়ে কিছু কম রহস্যময় না!) অথবা খেজুড় কাঁটা দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে দিতে হবে। এরপর কিশমিশের রস, পোস্ত বাটা, শাহি জিরা বাটা, আদার রস, পেঁয়াজের রস, রসুনের রস, দই, দুধ এবং গমবাটা, লবণ, জয়িত্রি, জায়ফল, দারুচিনি গুঁড়ো দিয়ে মেখে মাটির হাঁড়িতে রেখে ঢাকনা দিয়ে দিতে হবে। মাটির হাঁড়ি সারাদিন রোদে থাকবে। খাবার পরিবেশনের আগে অল্প আঁচে মাংস ভইসা ঘি দিয়ে ভাজতে হবে।
কী বুঝলেন? এই হল গিয়ে তাঁদের যুদ্ধকালীন সামান্য আহার!
‘আইন-ই-আকবরী’তে তিন ধরনের খাবারের কথা লেখা আছে, যা সম্রাট আকবর পছন্দ করতেন। সুফিয়ানা, খুব ছিমছাম খাবার, নিরামিষ। চাল, গম, শাকসবজি, শরবত, হালুয়া, এই হল সুফিয়ানা খানা। দ্বিতীয় প্রকারে ভাত এবং মাংস প্রধান খাবার, পুলাউ, সুল্লা, হালিম, শোরবা। তৃতীয় প্রকার হল জমকালো মশলাদার মুসম্মন, দম পুখত, মালঘুবা, কাবাব, দো পিয়াজা।
মোগল আমলের দুটি রসুই-এর কিতাবের কথা দেখছি। জাহাঙ্গিরের পাকশালার গল্প ‘আলয়ান-এ-নেমাত’ আর শাহজাহানের সময়ের ‘নুশখা-এ-শাহজাহানি’।
‘আলয়ান-এ-নেমাত’ থেকে যেটুকু তথ্য হাতে এসেছে তার মধ্যে তারিফ-এ-কাবিল তথ্যগুলো এইরকম, দই, পুলাউ, কাবাব এমনকি ঘি বিভিন্ন রঙে পেশ করা। পেশকশ, একটা কেতাদুরস্ত ব্যাপার। খাবার বানালেই হল না। দেখনধারী হওয়া দরকার!
ময়ূরের কাবাব। মুর্গার গলায় মোতি চূর্ণ ভরে দেওয়া। এবং নেমাত-এ লেখা আছে মাংস যখনই রান্না হত তাতে সবজি মেশানো হতই। কুমড়ো, শালগম, আনারস, আম, আপেল ইত্যাদি। এখানে নানা ধরনের বড়ি আর আচারের কথা লেখা আছে। মশলা খুব গতানুগতিক, লঙ্কা প্রায় নেইই। এমনকি রসুনও তুলনামূলক ভাবে কম।
জাহাঙ্গিরের প্রিয় ছিল খিচুড়ি। সে খুচুড়ি এককথায় মোগলাই খিচুড়ি। খিচড়ি দাউদখানি, খিচড়ি মুখতারখানি, খিচড়ি হিম্মাত পসন্দ। কিচড়ি মহাবতখানি। খিচড়ির সঙ্গে তার উদ্ভাবকের নাম জড়িয়ে নাম রাখা হত। এই ভাবেই একদিন রান্না হল খিচড়ি জাহাঙ্গিরি।
‘আলয়ান-এ-নেমাত’-এ আবার এটিকেট বা আদবকায়দা নিয়ে বেশ মজার মজার কথা লেখা আছে। যেমন, বেশি খেও না। ভালো করে হাত ধুয়ো, দু মুঠো খেতে পাচ্ছ বলে ঈশ্বরকে স্মরণ করবে, পাশে বসে যে খাচ্ছে তার পাতের দিকে তাকাবে না, দাঁত খুঁটবে না, খুঁটতে হলে লুকিয়ে খোঁট, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে খেতে ইচ্ছে না করলে বরঞ্চ শরীর খারাপের ভান করো, কিন্তু ‘খাব না’ এমন বলবে না।
শাহজাহানের জীবনে প্রথম ও শেষ কথা ছিল হুশন, সৌন্দর্য। তার সঙ্গে কোনো আপস নয়। কাজেই তার আমলে রান্নাবান্নার ব্যাপারটি একেবারে সূক্ষ্মতম পর্যায়ে উঠেছিল।
‘নুশখা-এ-শাহজাহানি’ আপনাকে হাত ধরে একেবারে রান্নাঘরে ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে। মোগলরা নোনতা-মিষ্টি স্বাদ পছন্দ করতেন। আখরোট, আমন্, পেস্তা, কিশমিশ, জাফরান ঢালাও ব্যবহার হত। খাবারে রং আনবার জন্য সানগারফ (cinnabar) দেওয়া হত।
‘নুশখা-এ-শাহজাহানি’-তে রান্নার টিপস বা গুরুত্বপূর্ণ অথ্য দেওয়া আছে অঢেল। রাজকীয় হেঁসেলে কীভাবে মাছ কুটে ধোওয়া হবে, মাংসের হাড় কীভাবে নরম হবে, ফুলের গন্ধ আর আনাজের রস দিয়ে গন্ধ আর রং কীভাবে আনা হবে, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে চুলার নীচে কীভাবে গ্রিল বা পোড়ানো হবে, দম রান্না কীভাবে হয়। ওয়াহ জনাব, সে এক আজিব খাজানা বটে!
দম দিয়ে রান্না, অর্থাৎ দম পুখত।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে। উন্নতির রেখা যখন ঊর্ধ্বমুখী হয়, তা নীচে নামতে বাধ্য। ইতিহাস তো তাই শিখিয়েছে!
এত জাঁকজমক আওরঙজেব পছন্দ করতেন না। নিজে নিরামিষ খেতেন। আট বছর আগ্রা দুর্গে শাহজাহান বন্দি ছিলেন। গল্পে আছে, আওরঙজেব নাকি মাত্র একটা খাবার বেছে নিতে দিয়েছিলেন তাঁর আব্বা হুজুরকে। আর শাহজাহান বাছলেন কাবলি ছোলা কারণ ওটা নানারকম ভাবে খাওয়া যায়। তুলতুলে মালাই মাখা ঝোলে শাহজাহানি ডাল ওই কাবলি ছোলা দিয়েই বানান হত।
‘নুশখা-এ-শাহজাহানি’-তে যেসব খাদ্যসম্ভারের লোভনীয় বর্ণনা দেওয়া আছে সবিস্তারে, তার মধ্যে আছে নান। মোগলদের আমলের আগে যে নান তুনুক বা নান তানুরি (তন্দুরি)। মোগলরা বলাই বাহুল্য এত নানকে আরও লোভনীয় করে তুলতে একটুকুও দেরি করেনি। তন্দুর এবং তাওয়া দুটোতেই নান বানান হত।
নান-এ-তুনাক ছাড়াও ছিল পনিরের নান, লাচ্ছা পরোটার মতো বাখরখানি, নান-এ-বাদাম, নান-এ-বেসানি, ছাতু বা বেসনের রুটি, দারুচিনির গন্ধ মাখা। কালোজিরে, জিরে, পোস্ত দানা ছিটানো নান-এ-তাফতান। পেস্তা দেওয়া নান। আর একটা সে ব্যাপক উমদা—নান-এ-খুরমা। খেজুরের পুর ভরা। আহা! আর ছিল দই, খামির, দুধ, ময়দা, ঘি এর লাজিজ কিসসা, শীরমল।
এর পরে বলতে হয় স্যুপের কথা। ইউরোপের হাত ধরে নয় ওই পশ্চিম এশিয়া থেকেই এদেশে বয়ে গেছেন তিনি।
সোবরা, সুরুয়া বা পরস্যে যাকে বলে আশ। কত রকমের আশ! ভেড়ার মাংস, কাবলি ছোলা, দই, গোলমরিচ, জাফরান, দারুচিনি, নানান সবজির টুকরো, এইসবই ছিল সুরুয়া বা আশের মূল উপাদান।
এরপর কালিয়া আর দো পিয়াজা, যা খেতে হত ভাত বা রুটির সঙ্গে। কালিয়া আর দো পিয়াজায় এসে মোগল রন্ধনশৈলী একেবারে তুবড়ির রোশনাই খেলিয়েছে। আহা! কত রকমের কত ধরনের, লিখতে গেলে মনকষ্টে মারাই যাব হয়তো! তার মধ্যে একটা দুটো পেশ করার লোভ সামলানো দায়! কালিয়া আম্ব! টক-মিষ্টি-ঝাল আমের ঘন জমিতে তুলতুলে ভেড়ার মাংসের মেহফিল। ডিমের কুসুম আর শুকনো ফল দিয়ে ঠাসা কালিয়া শিরাজি।
নানা রকমের সবজি পুড়িয়ে ওই পোড়া ধোঁয়া মাখা গন্ধ সমেত চটকে নিলে ভর্তা তৈরি হয়। আমরা এ বেশ জানি। মোগল রান্নাঘরে মাছ-মাংস-ডিম, ভর্তার তালিকায় ঢুকে গেল। ভর্তা মাহি নামে খাবারটা একেবারেই কলাপাতায় মোড়া মাছের পাতুরি। কাঞ্চন যাকে ওরা বলেন কাচনার, সেই ফুলের কুঁড়ির ভর্তা। বেশ, বেশ। চলুক তবে গবেষণাগারে পরীক্ষা।
এরপর আসল খেলার শুরু। মাটিতে আর তুবড়ির পাগলপন নয়। সিধে হাউই। তার সাত রঙের চকমকি আতশে আকাশের গায়ে লেখা হচ্ছে জীর বিরয়ান আর পুলাউ-এর দাস্তান। মূল সূত্রটি হল ঢিমে আঁচে ভাত রান্নার কারিকুরি, মশলা আর মাংসের সুচতুর ও কৌশলী মিশেলে। এই রান্নার জাদুকরেরা সব পারস্য থেকে এসেছিল। মোঘলশাহি ঘরানার মাস্টার স্ট্রোক, একেবারে সপাট হাঁকিয়েছে জীর বিরয়ান আর পুলাউতে। লিখতে গেলে স্রেফ একটি হামজানামা হয়ে যাবে।
স্বাদ কোরকের এই মায়াবী গোলোকধাঁধায় পথ হারাব নিঃসন্দেহে। রন্ধন শিল্প এই শব্দবন্ধের সাক্ষাৎ ও মোক্ষম প্রমাণ হল মোগল দস্তরখোয়ানের এই অংশটি। এবং সে শিল্প যে কত চূড়ান্ত ও শৌখিন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, এক একজন রসুইকর যে কীরকম জাদুকাঠি নাড়তে জানত ভেবে বিস্মিত হতে হয়। খিচুড়িকেও এরা এমন উচ্চ মার্গে নিয়ে যেতে পারত যে, সাধারণ গেরস্ত ঘেরাটোপ ছেড়ে বেচারা খিচুড়ি, শাহি জোব্বা চাপিয়ে দিব্যি আমোদ করে মজলিশ জমাত। পুলাউ তে আম, কলা, আনারস, কমলা লেবু, ফলসা, তেঁতুল এইসব ফল ব্যবহার করাও হত। জীর বিরয়ান আর পুলাউ-এর লম্বা তালিকা যদি কেউ পড়তে থাকেন জোরে জোরে, মনে হবে সুর ঝংকারে শায়েরি গজল গাওয়া হচ্ছে!
যেমন নাখুদি পুলাউ ওয়া কোফতা। ইয়াখনির জলে সেদ্ধ ফুরফুরে ভাতের মধ্যে নানান রঙের ছোটো ছোটো মাংসের বল, যেন বেহেশতের বাগিচায় বুলবুলি গান গাইছে। খেতে আর ইচ্ছে করবে না, শুধু চেয়ে থাকবেন।
আগুনে ঝলসে নিয়ে খাবার বানানোর প্রাচীন প্রথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিশীলিত হতে হতে নানান রকম শূল্য পক্ব, উখ্য মাংস হল কাবাব। মোঘল হেঁশেলে তৈরি হত বহু রকমের কাবাব, খাগিনা, হারিশা, সিশ্রাঙ্গা। এ ছাড়া সামোসা আর পুরি।
হারিশা অর্থাৎ ছাড়িয়ে নেওয়া বা শ্রেডেড। খাগিনা, ডিমের অমলেট। সিশ্রাঙ্গা অর্থাৎ মাখা বা স্ম্যাশড। আর এই সব পদ্ধতিতে নানান লোভনীয় লাজিজ খানায় লবেজান হয়ে থাকতেন ওনারা।
আসুন এবারে শিরিনিহায়। উচ্চারণ করলেই মনে হয় শিশির রাতে নিশি পদ্ম ফুটেছে। তা তো মনে হবেই কারণ এটা মিঠাই দপ্তর। রান্নাতে মিষ্টি ব্যাবহার করা মোগলরা পছন্দ করতেন। একটু মিষ্টি দিতে হয়। মিষ্টি মিষ্টি করতে নয়। ওই কয়েক দানা মিঠাস, স্বাদের অসামান্য মেলবন্ধনে পেটে কলিজায় হৃদয়ে কবিতা লিখতে কাজে লাগে! তারপর দস্তরখোয়ানে মিষ্টি পাকানো আর সাতরঙা হাউই নয়, সেগুলো তখন আশমানের তারা। বাকলাভা, বালুশাহি, মোতিচুর লাড্ডু, কুলফি ফালুদা, হালুয়া, শির বেরেঞ্জ, জারদ বেরেঞ্জ, খাজা, ইমারতি, ইন্দেরসা। নাম শুনেই বুঝতে পারবেন কী পরিমাণ সংস্কৃতির মিশেল ঘটিয়ে ছেড়েছেন চাঘতাই তুর্করা।
তবে হ্যাঁ, খুব আহ্লাদের বিষয় হল এরা যথার্থই খাদ্যরসিক ছিলেন, নইলে মাছ ধোওয়ার স্পষ্ট নির্দেশিকায় বলে দিয়ে গেছেন সরষের তেল দিয়ে মাখাতে হবে! কদরদান ছিলেন, মানতেই হবে।
৪
আন বান শান শৌকতে, ঠাটেবাটে, আদবকায়দায় দিল্লিকে চুনৌতি দিতে পারত কেবল আওয়াধ। সফদরজং, মোগলদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেই প্রতিপত্তি খাটিয়ে আওয়াধের মানমর্যাদা তিনি প্রচুর বাড়িয়ে নিলেন। দিল্লিতে সফদরজঙ্গের মকবরা এক প্রধানমন্ত্রীর মকবরা, কোনো মোগল বাদশার নয়। এর গুরুত্ব ভেবে দেখার মতো।
আওয়াধের দস্তরখোয়ান নিয়ে মজলিশ বসাতে হলে কয়েকটা তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আদতে ইরান থেকে আসা এই শিয়া মুসলমান শাসকেরা স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সহিষ্ণুতার ধারার এক নাম হল গঙ্গা জমুনি তেহজিব।
আর সেই কারণেই আওয়াধ অঞ্চলে আমিষের সঙ্গে নানান শাকাহারী খাবারও সমান জনপ্রিয়।
মোগল খানদানের প্রভাব থাকলেও আওয়াধি খানার এক নিজস্ব ঘরানা আছে। বিভিন্ন মশলার জাদুমিশেল আর ঢিমা আঁচে রান্না, এখানকার ঘরানা। এই ঘরানায় রয়েছে নাফাকাত আর নাজাকাত অর্থাৎ পরিশীলন আর সূক্ষ্ম পেলবতা। খাবারকে দর্শনধারী হতে হবে, তার থেকে চনমনে সুগন্ধ বের হতে হবে এবং স্বাদে হবে অতুলনীয়। বর্ণ-গন্ধ-স্বাদের ত্রিকোণ প্রেম।
কিন্তু সে একেবারে মজে যাওয়া প্রেম কোনো ছন্দপতন চলবে না। আওয়াধের নবাবি রসুইঘরের তিন ধরনের রাঁধুনি ছিল।
প্রথম হল বাবুর্চি। বাবুর্চির সঙ্গে কথা কইতে আসতেন হেকিম। ওই মোঘলশাহির মতোই। বাবুর্চি হেঁশেলের বড়ো বড়ো রান্নাগুলো প্রচুর পরিমাণে করত। এরপরে আসছে রকাবদার। এরা হচ্ছে রসিক রসুইকর। এদের কাজ রান্না নিয়ে গবেষণা ও অল্প পরিমাণে খাবার বানানো প্রকৃত খাদ্যরসিকের জন্য। গান্ডেপিন্ডে গিলবার জন্য না। রান্না হয়ে যাবার পর তার সাজ সাজাওট, তাকে গয়না, নোলক, মুকুট, টায়রা পরানোর কাজও তাদের করতে হত। রাঁধুনিদের সবথেকে তলায় ছিল নানফুস যারা নান, কুলচা, রোটি, শিরমল, তাফতান এইসব বানাত। এ ছাড়া বাসন ধুত একদল, মশালচিরা মশল্লা তৈরি করত, খাবারের ট্রে বয়ে আনত মেহরিরা। শুধু এখানেই শেষ হয়ে গেল না। এর ওপর ছিল দারোগা। আজ্ঞে হ্যাঁ! দারোগা-এ-বাওয়ারচি। এরা খাবাবের তদারকি করত, মান ঠিক আছে কি না, এইসব ঘুরে ঘুরে দেখত।
আওয়াধি রান্নার সবচেয়ে উল্লেখ্য পদ্ধতি হল দমপুখত। ঢিমে আঁচে রান্না, অনেকটা সময় নিয়ে, মুখ ঢাকা পাত্রে যেখানে ভেতরের ভাপেই রান্নাটা হয়ে যাবে। বলা হয় নবাব আসাফ-উদ-দৌলা কাজের বদলে খাদ্য প্রকল্প চালু করেন। তার সময়ে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। বড়া ইমামবাড়া বার বার ভাঙা হত, বার বার গড়া হত। হাজার হাজার প্রজাকে কাজ দেবার জন্য। আর কাজ দিলেই খাদ্য দিতে হবে। চাল, মাংস, মশলা, সবজি সব মিশিয়ে একটাই খাবার বানানো হত ঢিমে আঁচে। ঢিমে আঁচের রান্নায় খাদ্যগুণ নষ্ট হয় না, উপকরণের নিজস্ব রস গন্ধ ভালোভাবে বজায় থাকে। এ ছাড়াও আওয়াধে চালু ছিল ভুনা রান্না আর কাবাব। এক হাত কাটা ‘টুন্ডে’ কাবাব বানিয়ে ব্র্যান্ড খুলে ফেলল। দন্তহীন নবাবের জন্য বানানো হল গালাওটি কাবাব। এতে নাকি একশো ষাট রকমের মশলা দেওয়া হত। এখন অত নিশ্চয় হয় না। খাদ্যরসিকের মতে গালাওটি কাবাব মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে মনঃসংযোগ করলে এক-একটা মশলা আস্বাদের স্বর্গ সুখ পাওয়া যায়।
আওয়াধ তথা লখনউতে গিয়ে গিলৌরি পান না খেলে আওয়াধি খানপানের দাস্তান শেষ হয় কেমন করে?
আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ, সেই গিলৌরিকে রাখলেন তার শায়েরিতেও—
“গিলৌরি রাকিবোঁ নে ভেজি হ্যাঁয় সাহাব
কিসি অউর কো ভি খিলা লিজিয়ে গা
মুচালকে কা কিউঁ নাম আয়া জুবান পর
মহব্বত কা হাম সে লিখা লিজিয়েগা”
(পান পাঠিয়েছে আপনার শত্রু, জনাব
অন্য কাউকেই খাইয়ে দিন।
মুক্তির পরোয়ানার কথা কেন এল মনে
আমার তরফ থেকে ভালোবাসাই লিখে নিন।)
এই ভালোবাসার আস্বাদ দিয়েই দাস্তারখোয়ানের দাস্তান শেষ করি। মনের আনন্দই বড়ো কথা তা না থাকলে পরমান্ন খেয়েও সুখ নেই। আর পেটে খিদে থাকলে শাক-ভাতকেই পরামান্ন মনে হয়।
খুব ইন্টারেস্টিং তো!!!!
ওয়াও!!!
হামিনস্ত! হামিনস্ত!!! হামিনস্ত!!!!
এমন খাবার না চাখলে জীবন নষ্ট...
খুব ভাল লেখা। তথ্য আর ভালবাসা একসুতোতে বোনা
Chamotkar, onek kichu janlam.
ওহ! ক্ষুধা লেগে গেল! পেটে কিল মেরে একটু দ্বিমত পোষণ করি। টমেটো পর্তুগিজরা আনেনি সম্ভবত। টমেটো ইংরেজরা এনেছিল।
দারুণ কৌতুহলকর। তারিয়ে তারিয়ে পড়লাম।
ধন্যবাদ, বেশ ভাল লাগল। রসবতী মোঘলাই মশালায় ম-ম করছে। দু’টো বিষয় জানার ছিল। শিঙাড়া শব্দটি এসেছে শৃঙ্গাটক থেকে। তৎসম শব্দ। তা কি পানিফল না সামোসা? পলান্ন আর পোলাও— এদের কেউ কি বহিরাগত? নাকি একই মায়ের সন্তান। পালিত ভিন্ন ঘরে? ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র মতো?
মাংসে আনাজ দিয়ে রান্নার চল খুব একটা দেখিনি। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আছে বোধহয়। সেদিন এক দক্ষিণ ভারতীয় ভিডিয়োয় দেখছিলাম। ইউরোপে তো আছেই। স্টেকের সঙ্গে কুমড়োর টুকরোই দেখেছি।
লালমোহনবাবুর ভাষায় বলতে হয়, "এই একটা ভেঙে দশটা হত"।
অসাধারণ লাগলো।
গত দুইদিন আগেও মুরগি খেয়েছি পটল দিয়ে। দারুণ ছিল স্বাদ। আমাদের এদিকে গোরুর মাংসে পেঁপে দিয়ে রান্না করা হয় প্রায় সময়েই। তবে তা মাংস সিদ্ধ হতে সাহায্য করার জন্য না স্বাদের জন্য জানি না। আমার কাছে লাগে খাইতে। তবে বগুড়ার দিকে শুনেছি কচির লতি দিয়ে মাংস বা মাংস দিয়ে কচুর লতি রান্না করে খায়! আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি। জামালপুরে আরেকটা খাবার আছে, আমরা শেরপুর জামালপুর পাশাপাশি হলেও আমাদের এখানে এই খাবার খাওয়া হয় না, তা হচ্ছে চাউলের গুড়া দিয়ে মহিষের মাংস রান্না। ওরা একে বলে মিল্লি। খেতে অসাধারন লাগে। মহিষের বদলে গোরু দিয়েও করে। রীতিমত বাজারে মিল্লি রান্না করে মাইক দিয়ে মানুষ ডেকে মিল্লি বিক্রি করে। মানুষ হুমড়ি খেয়ে মিল্লি কিনে নিয়ে যায়। বড় কোন আয়োজনেও মিল্লি করে ওরা। শেরপুরের চর অঞ্চলেও মিল্লি চলে।
Muhammad Sadequzzaman Sharif
একটু আপনাদের আলোচনায় ঢুকছি। টম্যাটো পর্তুগিজদের হাত ধরেই ভারতে আসে। ব্রিটিশরা তাকে জনপ্রিয় করে। তাদের জন্যই চাষআবাদ বাড়ে। বাংলায় ইংরেজদের জন্যই টম্যাটোকে বিলিতি বেগুন বলা হত।
টম্যাটোর ইতিহাস দারুণ আকর্ষক। আপনার মন্তব্যের পরে পড়লাম। একসময়ে ইউরোপে টম্যাটোকে বিষ ফল হিসেবে সন্দেহের চোখে দেখা হত।
চমৎকার লেখা। ভাষা খুব সাবলীল। একটানে পড়ে ফেলা যায়। আরো লিখুন।
@দীপক দাস। সদ্য গোলাম মুরশেদের 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' পড়ে শেষ করলাম। সেখানে স্পট দেখলাম যে টমেটো ইংরেজদের আনা। তিনি বলছেন ১৬ শতকের প্রথম ভাগে মেক্সিকো থেকে ইংরেজরা এই ফল ইউরোপে নিয়ে আসেন। তারপর ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন ইংরেজরা। শুধু তাই না, তিনি বলছেন টমেটো নিয়ে আসনেও অনেক দেরি করে। প্রমাণ হিসেবে তিনি ১৯০৬ সালে সুবল মিত্ররের অভিধানের কথা বলেছেন, ১৯৩৩ সালের হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানের কথা বলেছেন যেখানে টমেটো শব্দ নেই। আবার বলেছেন বিশ শতকের গোরায় কলকাতার খাদ্য বস্তুর হিসেবে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত টমেটোর কথা উল্লেখ করেছেন। টমেটো ইংরেজরা এনেছে এর পক্ষে আমার কাছে আর অন্য কোন তথ্য প্রমাণ নেই। যদি আপনি কিছু জানাতে পারেন তাহলে আমি জানার জন্য অপেক্ষায় থাকব।
Muhammad Sadequzzaman Sharif
স্যার, আলোচনাকে ফেসবুকের পোস্টে নিয়ে যেতে পারি? তাতে আমার একটা সুবিধা হয়। আমি নথি পোস্ট করতে পারি। আমি একটু প্রযুক্তি-খঞ্জ। ফলে এখানে সুবিধা করতে পারছি না।
ফেসবুকে আরেকটি সুবিধা হতে পারে। আরও অনেকে দ্রুত মতামত দিতে পারবেন।