১
এবার মে দিবসে মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট থেকে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক অব্দি দুর্বার মহিলা সমণ্বয় কমিটির ট্যাবলো সহযোগে বিরাট মিছিল এবং তারপর পার্কের সামনে প্রকাশ্য রাজপথে যৌনকর্মীদের আইপিটিএর বিখ্যাত গণসংগীতের সঙ্গে নাচ, আবৃত্তি এবং শ্রমিকের অধিকার দাবী করে বক্তৃতা মহানগরকে চমকে দিয়েছে। মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই প্রচেষ্টা এবং দাবীকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রচুর মানুষ। যারা ভ্রু কুঁচকেছেন তাদের মনেও অনেক প্রশ্ন। তার মধ্যে মুখ্য হচ্ছে, যৌনকর্মীকে সত্যিই শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা। আইনী অধিকার পেলে তার পরিণাম কী হবে। সমাজের পক্ষে এইসব পদক্ষেপের ফলাফল শুভ হবে কি? আর গৌণ প্রশ্নের মধ্যে যেটি সবচেয়ে মাথা উঁচু করে থাকে সেটি হলো, এইসব পদক্ষেপের কারণে পেশাটিকে রোমান্টিসাইজ করা হচ্ছে কি না আর এই পেশা গ্রহণে তা পরোক্ষ উৎসাহ যোগাবে কি না।
গৌণ দিয়ে শুরু করে মুখ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করা যেতে পারে। আদিম এই পেশাটিতে ঠেলে দেবার পেছনে যদিও দারিদ্র, বিশ্বাসঘাতকতা, ঘর বাঁধবার দুস্তর স্বপ্ন, যা মরিয়াও মরে না-- এইগুলি এবং হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রায় একশ পার্সেন্ট দায়ী, তবু কাঁচা পয়সার প্রাবল্য একটা বড় ব্যাপার। অনেক মেয়েই সেই লোভ কাটিয়ে উঠতে পারেনা। আর পুনর্বাসনের নামে তার সামনে যেসব প্রকল্প রাখা হয়, সেগুলোর অবস্থা অতি করুণ। দিনে দশ বার ঘন্টা সেলাই মেশিন চালিয়ে বা বিড়ি বেঁধে সে মাসিক যা ইনকাম করবে সোনাগাছিতে একদিনে তার বহুগুণ বেশি করবে। এই খানে ছোট্ট একটি তথ্য। একজন জনপ্রিয় যৌনকর্মী দিনে গড়ে প্রায় কুড়ি জন খদ্দেরের সন্তুষ্টি বিধান করে। এদের প্রায় প্রত্যেকের টাকায় তার আত্মীয় স্বজন প্রতিপালিত হয়। যেন সব লেডি দস্যু রত্নাকরের জীবনকাহিনী। পাপের ভাগ নয়, টাকার ভাগ চাই।
পুনর্বাসনকে যারা সর্বরোগহর বলে মনে করেন তাদের জন্য আরো তথ্য। যৌনকর্মীর জীবন লাঞ্ছনাময়, কিন্তু আপেক্ষিক স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ। নিজেকে ধ্বস্ত করে সে ইচ্ছেমত উপার্জন করতে পারে এবং সেই উপার্জন ইচ্ছামত খরচ করতে পারে, যা আজও অনেক চাকুরীরতা গৃহকন্যা, গৃহবধূর অধরা। সেই স্বাধীনতা হারিয়ে একটা পরাধীন নিস্তরঙ্গ জীবন তার পক্ষে কতটা কাম্য সে খতিয়ান নেওয়া হয়না। পুনর্বাসিত জীবনেও যৌন লাঞ্ছনা খুব সাধারণ ব্যাপার। একবার লাইনের মেয়ে জানলে প্রত্যাবর্তনকামীর আর উপায় নেই, প্রায় সবাই সুযোগ নিতে চাইবে।
যে আত্মঘাতী জীবন সে পরিত্যাগ করতে চেয়েছে তার পারিশ্রমিকহীন পুনরাবৃত্তি তার কিরকম লাগতে পারে ! মুক্তির পিপাসা তাকে বদ্ধজলাতে ফিরিয়ে আনলে সে তো তা প্রত্যাখ্যান করবেই।
তবে টাকা এবং স্ফূর্তির কারণে পেশাকে রোমান্টিসাইজ যৌনকর্মী নিজেও করে না। আড়কাঠি এবং উপভোক্তা ছাড়া এ পেশাকে রঙিন স্বপ্নের বুদবুদে আর কেউই বোধহয় সাজায় না। শরীরী উন্মাদনা দুদিনেই জুড়িয়ে যায়, পড়ে থাকে মেশিনের মতো অনুভূতিহীন একটি নারীদেহ যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিতে অপারগ। কিন্তু টাকার বিনিময়ে সেটিকে নিয়ে যা খুশি করবার অধিকার জন্মায় উপভোক্তার। কতো যে বিকৃতি, কতো যে অনাচারের শিকার সেই মরা শরীর ! চড়া নেশা, অজস্র ব্যথা মরার পিল এবং এন্টি ডিপ্রেস্যান্টের ব্যবহার ছাড়া এ পেশায় টেঁকা যায় না। এছাড়া দুর্বার এবং আপনে আপের মতো এন জি ও দের নিরন্তর কাজের ফলে নানা ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হয়ে পচে মরবার ঝুঁকি যে কতো এটা এখন এ মহল্লায় সবাই জানে। ফলে শুরুতে ভোগলালসা যদি থেকেও থাকে, খুব শিগগির তার ফলাফল সামনে আসে এবং যৌনকর্মী নিজের কাজকে রোমান্টিসাইজ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।
কিন্তু আদতেই কি সত্যি অনুভূতিহীন এইসব মেয়েরা?
২ - স্বাধীনতা আন্দোলন ও যৌনকর্মীর রাজনৈতিক চেতনা।
বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র বসুর লেখায় জানা যায় ১৯০৭ সালে চিৎপুরের কিছু যৌনকর্মী বিপ্লবী যুবকদের আপ্রাণ সাহায্য করেছিলেন। যুগান্তরের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন ব্রিটিশের আজ্ঞাবহ পুলিশ সূর্যাস্তের পর সভা নিষিদ্ধ করে। কিন্তু অনুশীলন সমিতির দামাল ছেলেদের আটকাবে কে ! সরকারি নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে তারা বিডন স্কোয়ারে সভা ডাকলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের বক্তব্যে সরকারবিরোধী লাভাবর্ষণ পুলিশের সইল না। তারা লাঠি চালানো চালু করল। পালটা আক্রমণে গিয়ে জনতা ইট পাথর ছুঁড়তে লাগলো। এমন সময় দেখা গেল এক অচিন্তনীয় দৃশ্য। মহল্লার বাড়িগুলির ছাদ থেকে যৌনকর্মীরা সমানে পুলিশের ওপর ইট ছুঁড়ছেন। আসন্ন গোলমালের আশঙ্কায় তারা হয়তো ছাদে ইটপাথর জড়ো করে রেখেছিলেন এবং কাদের ওপর তা ছোঁড়া হবে তাও ঠিক করা ছিল।
আশ্চর্য কী, ১৯২১সালে এরাই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে সভা করে অসহযোগ আন্দোলনের সাহায্যার্থে সোনাগাছি অঞ্চলে ব্যাপক অর্থসংগ্রহ করেন।
মানদা দেবীর (কাল্পনিক চরিত্র কিনা সঠিক জানা যায়নি ) শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিতে এই ব্যাপারটি বিস্তারিত বলা আছে। ১৩২৮ সালের শ্রাবণ সংখ্যা প্রবাসীতেও এই ঘটনার উল্লেখ আছে। যদিও প্রবাসী এই প্রচেষ্টাকে ঘৃণ্য মনে করতো এবং সমাজপতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে বেশ্যাদের এই রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সমাজকে কতো নীচে টেনে নামাবে তা প্রমাণ করতে প্রবাসী ছিল মরীয়া। 'পাপ ব্যবসায়ে নিযুক্ত নারীকুলে'র যে কোন শুভ প্রচেষ্টাকেই কালিমালিপ্ত করার চক্রান্ত আজও কেমন বলবৎ সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রসঙ্গটি ব্যক্ত করি।
১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গের বিধ্বংসী বন্যার মোকাবিলায় কলকাতায় আচার্যের সভাপতিত্বে বেঙ্গল রিলিফ সোসাইটি সংগঠনটি কাজ করতে শুরু করে। এর সদস্য পদ অলংকৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডাঃ নীলরতন সরকার ও আরো জ্যোতিষ্করা। আশ্চর্য নয় যে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই কমিটি লাখ টাকারও বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছিল। যৌনকর্মীদের তাতে প্রচুর অবদান ছিল, মাসিক বসুমতীতে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পূর্তি স্মারক গ্রন্থে রতনমণি চট্টোপাধ্যায় একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার বিবরণ দেন। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে এলো যৌনকর্মীরা। তাদের সঙ্গে টাকাপয়সা এবং কাপড়চোপড়ের বোঝা। এসো এসো, মা লক্ষ্মীরা -- আচার্যের মুখনিঃসৃত এই সাদর স্নেহসম্বোধনে সমাজপরিত্যক্তাদের মনে কী কৃতজ্ঞতার লহর উঠেছিল তা সহজেই অনুমেয়।
সামাজিক, রাজনৈতিক কাজে এই মহিলাদের অংশগ্রহণ তখনও প্রবল সমালোচনা ডেকে এনেছিল, এখনো তাই। তবে তাতে যে এরা বাধাপ্রাপ্ত হননি, মে দিনের মিছিল তাইই বলে। তারকেশ্বর মোহান্তবিরোধী আন্দোলন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মরদেহ নিয়ে মিছিল ইত্যাদিতে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন আজকের লড়াকু মেয়েরা তাদেরই উত্তরসূরি।
এই সেদিনের ঘটনা। বামফ্রন্ট রাজত্বেও দুর্গাচরণ মিত্তির স্ট্রিটের মেয়েরা রাজনৈতিক মিটিং শেষে কর্মীদের প্রসারিত বস্ত্রখন্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টাকা পয়সার সঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারও দান করে বসতেন। বাধ্য হয়ে পার্টি থেকে গয়না গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়।
এই লেখা শেষ হবার আগেই ইমেইলে দুর্বারের নিমন্ত্রণ পত্র এলো। আগামী ১৩ই মে মৌলালী যুবকেন্দ্রে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কনভেনশন। দেশ জুড়ে গরীব আদিবাসী দলিত জনজাতি এবং উপজাতি মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইতেও এরা আছেন। বোঝা যাচ্ছে রাজনৈতিক চেতনার প্রবহমানতায় কোন ছেদ পড়েনি। স্বাধীন দেশে কুশাসকের কাজকাম নিয়েও এরা সচেতন।
কমিউনিস্ট ইস্তেহারের নীতিসমূহের জয়লাভ করার ব্যাপারে মার্কস ছিলেন নিশ্চিত এবং এই ব্যাপারে তার একান্ত নির্ভরতা ছিল শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিগত বিকাশের ওপর, যা নিশ্চিত ভাবে উঠে আসবে মিলিত লড়াই ও আলোচনা থেকে। যৌনকর্মী শ্রমিকের মর্যাদা পায়নি এখনো, কিন্তু তার বুদ্ধিগত বিকাশের পথটি সুগম হয়েছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আলোচনা ও লড়াইয়ের ফলেই।
৩ - দাবীটি বহুমাত্রিক
আইনি স্বীকৃতির দাবীটি বহুমাত্রিক। এটি বিশাল একটি দ্বৈততা যে যে পুরুষকে যৌনকর্মী পরিষেবা দেয়, সন্তুষ্টি বিধান করে, সেই পুরুষই তার লাঞ্ছনার মূল উৎস। ছলনাময় পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার মরীয়া জেহাদের একটি প্রকাশ হলো আইনি স্বীকৃতির লড়াই, একথার চমৎকার ব্যাখ্যা ক্যাথরিন এ ম্যাকিনন দিয়েছেন তাঁর বাটারফ্লাই পলিটিক্সের ল'জ পাওয়ার শীর্ষক অনুচ্ছেদে। তাঁর মতে আইন ও ক্ষমতা সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে। আইন রচিত হয় ক্ষমতাবানেদের দ্বারা, বলেও ক্ষমতার কথা। আইনি অধিকার থাকা অর্থ সেই ক্ষমতার ছিটেফোঁটা হলেও ভাগ পাওয়া।
আইনি ক্ষেত্রেও নারী ঐতিহাসিক ভাবে বঞ্চিত, আগ্রাসিত। ঐতিহাসিক ভাবে তাকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল বহুকাল, এখনও আয়ের সমতা এবং বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সমান সুযোগ সুবিধে তার অধরা। কন্যাভ্রূণ হত্যার কথা মনে রাখলে প্রতীতি জন্মাবে যে ভূমিষ্ঠ হবার আগে থেকেই সে চরম বঞ্চনার শিকার। সবচেয়ে কঠিন আর সবচেয়ে নোংরা কাজটির বরাদ্দ থাকে তার জন্যই। নারী যেন সর্বদা বেওয়ারিশ এবং অন্য কারো হাতের পুতুল, তাই তার শারীরিক লাঞ্ছনা ঘটতে পারে যখনতখন। লাঞ্ছনাকারী হতে পারে নিজের পরমাত্মীয় বা একেবারে অপরিচিত রাস্তার মানুষ। শরীর তার, কিন্তু জন্ম দেবার চয়েস প্রায়শই তার নয়। পরিষেবা এবং সমাজ বাঁচাবার নামে ঝুঁঝকো অন্ধকারে তাকে রাস্তার ধারে রোজ কিনতে পাওয়া যায়।
এইজন্য ক্ষমতা সর্বদাই পুংলিঙ্গ। আর ক্ষমতাহীনতা আর সাধারণ নারী আজও সমার্থক। অর্ধেক আকাশকে এই অসাম্য গেলানো হয় তারই সুরক্ষা ও সম্ভ্রমের নামে। এ কথা ঠিক যে আইন প্রণয়ন করে এ সমস্যা মিটবে না। বরং আইনের নামে এই বঞ্চনা টিঁকিয়ে রাখাই রেওয়াজ। আইনের সাহায্য নিয়েই অনেক দেশে পর্নোগ্রাফি তৈরি হয়, যেখানে নারীর ভূমিকা মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা, মেয়েদের গর্ভের অধিকার দেওয়া হয়না, এবোরশন করলে মৃত্যুদণ্ড অব্দি জায়েজ করা হয়, গার্হস্থ হিংসার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয় বিবাহ দেবতার সৃষ্টি এই যুক্তিতে। আইনের প্রশ্রয়ে এইসব অসাম্য যখন শুধু টিঁকেই থাকে না, তার আরো রমরমা হতে থাকে তখন আইনী ব্যবস্থাকে পিতৃতন্ত্রের চাল বলেই মনে হবে, আইনকে ক্ষমতার মদগর্বী ভাষা। এই পক্ষপাতপূর্ণ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আইনের বাধা জয় করেই একজন যৌনকর্মী আইনি অধিকার, এক্ষেত্রে শ্রমিকের মর্যাদা পেতে পারে। তাই তার বহুমাত্রিক লড়াইটি বহু ব্যঞ্জনার জন্ম দেয়।
৪ -
যৌনকর্মীরা কি শ্রমিকের অধিকার পাবার যোগ্য?
শ্রমিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থেকে শ্রমশক্তি ব্যয় করে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে। মালিক সেই উদ্বৃত্ত চুরি করে শ্রমিককে শোষণ করে। এটি নিও লিবেরালিজমের কালে রমরমিয়ে এসে পড়া সার্ভিস সেক্টরের ক্ষেত্রেও প্রোযোজ্য। শ্রমচুরি চালু না থাকলে বিপুল লাভের হালফ্যাশনের শপিং মলগুলিতে বারো ঘন্টা এক ঠ্যাঙে দাঁড় করিয়ে রেখে চার থেকে ছ' হাজার মাইনে দেওয়া যায় না সেলসম্যান ও গার্ডদের। যৌনকর্মীরাও এই সার্ভিস সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। এবং তাদের শোষণ বহুমুখী, রাষ্ট্রপোষিতও বটে। খদ্দের থেকে শুরু করে বাড়িউলি মাসী, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার ধারকবাহকরা তাকে নিংড়ে নেবার জন্য একপায়ে খাড়া। তার আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, ট্যাক্স দেবার দায়, সবই থাকবে, কিন্তু সাধারণ নাগরিকের অধিকার থেকে সে সদাবঞ্চিত।
এই শোষণ ও বঞ্চনা কমাবার জন্য রাষ্টের ভূমিকা খুব গুরুত্ববহ। ক্ল্যাসিকাল মার্ক্সিজমের ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্র যৌনকর্মীর সমস্ত দায়ভার গ্রহণ করতে বাধ্য। ফলে তার পেশার গুরুত্ব থাকবে না। কালে তা অবলুপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তব হল এই যে মানব সভ্যতার চাকা হাজার হাজার বছর ধরে গড়িয়ে গেলেও এই সমস্যার কোন সমাধান দেখা যায়নি। বরং এক বিপুল মানবীগোষ্ঠীর কপালে কলঙ্ক ও শোষণের রঙ গাঢ়তর হয়েছে। যতদিন অব্দি না আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠিত হয়, ততদিন কি তাকে এই দুর্বিষহ জীবনযাত্রা বহন করতে হবে ? নাকি শ্রমিক বলে স্বীকার করে নিয়ে রাষ্ট্রিক দায়িত্ব বৃদ্ধি করবার দায় নেওয়া হবে ? পুলিশি অত্যাচারমুক্ত জীবন, ছুটি ও ভাতার সাম্য, অবসরকালীন সুযোগসুবিধে কি তার প্রাপ্য হতে পারে না ? যে সামাজিক স্বীকৃতির কাঙাল সে, তার প্রথম ধাপ তার পেশার সঙগায়ণ। সে যৌনশ্রমিক। অনেকের মতে তার দেওয়া পরিষেবা নাকি সমাজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখবার পক্ষে জরুরী। কিন্তু তাতে করে শোষণ ও বঞ্চনায় ভরপুর পেশাটির ঝুঁকি কমে না। তার ঘাড়ে ঠ্যাং রেখে শ্রমের উদবৃত্ত আত্মসাতে কেউ কম যায় না। এইসবেরই বিরুদ্ধতায় সংগঠিত হয়েছিল এবারের মে- দিনের মহামিছিল।
তবে একথা ঠিক, পৃথিবীর যে যে দেশে এ পেশার পূর্ণ আইনি স্বীকৃতি আছে, সেখানেও সামাজিক স্বীকৃতি বা সুরক্ষার ব্যাপারটি খুব স্পষ্ট নয়। শারীরিক হিংসা আর আত্ম-অবমাননার যুগলবন্দী যে পেশায় তাকে কি সত্যি আর পাঁচটা পেশার সঙ্গে এক করে দেখা সম্ভব? তবু প্রত্যেক মানুষ বাঁচে তার আত্মপরিচয়ে। যে পরিচয়ে তাকে পঙ্কবদ্ধ জীব হিসেবে আরো মাটিতে মিশে যেতে হবে, অথচ সেই সমাজেই তার পেশার দোসররা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, সেই সামাজিক পরিচয়কে খানিক সহনীয়, কিছুটা মর্যাদামন্ডিত করে তোলবার এই লড়াই সমীহ আদায় না করে ছাড়ে না।
এতোখানি অসহনীয় অসাম্যের বিরুদ্ধে এই অসম লড়াইতে আপনি কাদের পাশে থাকবেন, সে ঠিক করবার দায় আপনারই।