আমি কলকাতা আসছি কয়েকদিন হয়। এই কারণে গুরুতে লেখা হচ্ছে না। এর আগে কলকাতায় আসার পরেও লেখা চালিয়ে গেছি। এবার আসার পরেই আমার ল্যাপটপটা গেছে। মনের দুঃখে আমার অবস্থা কাহিল। আজকে কেন লিখতে বসলাম? কারণ আজকে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। তার জন্য ভাঙা ল্যাপটপেই বসলাম লিখতে! আবার কবে লেখতে পারব জানি না। আজকের গল্পটা শুনেন আগে।
আজকে যা হয়ে গেল তাকে কী দিয়ে ব্যাখ্যা করব বুঝতেছি না। একটা লাইন মাথায় আসছে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশন! এ ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না।
এর শুরু জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। সেই ১৯৭১ সালে চলে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কোটি শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য তখন খুব সস্তা। হাজার হাজার মানুষ নিমিষেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ কিছুদিন যাওয়ার পরে এই শরনার্থী শিবির গুলোতে নানান সাহায্য আসা শুরু হয়। কেউ খাবার দিচ্ছে, কেউ চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। ভারত জুড়ে ত্রান-সাহায্য তোলা হচ্ছে। যে যা পারছে সে তাই দিয়েই এগিয়ে আসছে। কত শিশু কিশোর আসছে, তাদের জন্য কি করা যায়? এদের খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা একভাবে হচ্ছে। কিন্তু এদের পড়াশোনা? শিক্ষা? এইটা ভাবার সময় কই তখন? স্বাভাবিক ভাবেই এগুলা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় নাই কারও।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মিলে একটা ফান্ড জোগাড় করার চেষ্টা করে। শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। সেখানে তখনকার নামকরা সব শিক্ষক দান করেছেন। তারা তাদের এই ফান্ড জোগাড়ের পরিধি বৃদ্ধি করেন। সারা ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দান করে এই ফান্ডে।
এ তো হল। তার সাথে আজকের কাহিনীর যোগ সূত্র কই? বলছি, আমি কিছুদিন আগে একটা বই কিনি, ইউপিএল প্রকাশনীর, নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ ঢাকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। এই বইয়ে ছোট্ট একটা তথ্য পাই, সেখানে একটা দোকানের নাম দেওয়া। তারা শরণার্থী শিবিরে খাতা কলম, পেন্সিল দিয়েছে! এইটা আমার কাছে দারুণ একটা বিষয় মনে হয়েছে। অন্য সবাই তো দিচ্ছেই সব কিছু। এরা দারুণ একটা উদ্যোগ নিয়েছে বলতে হয় না? কে খাতা কলম পেন্সিল নিয়ে ভাবছে তখন?
এইটা পড়ার পরে আমি ওই প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। আরে, দিব্যি এখনও আছে এই প্রতিষ্ঠান। সম্ভবত কলকাতার বাহিরেও তাদের দোকান আছে। আমি ঠিকানা টুকে রাখলাম। চিন্তা করলাম সামনে কলকাতা গেলে এদের দোকানে যাব। দুই একজনকে বলার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কত দারুণ। কেউ বুঝল না বা আমি যেভাবে চিন্তা করছি সেভাবে চিন্তা করল না। আমি বলছিলাম যদি এখান থেকে দারুণ একটা গল্প বের হয়ে আসে তাহলে এইটা নিয়ে বই লিখে ফেলা যাবে। অত দূর চিন্তা কেউই করল না। আমিও দ্বিধায় পড়ে রইলাম।
এবার আসেন আজকের গল্পে। যাকে আমি স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশন বলছি সে গল্পে। আজকে কলকাতায় প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমি বের হয়েছি নাখোদা মসজিদের উদ্দেশে। জুম্মার নামাজ পড়ব। কিন্তু আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে অনেক দূর। আর আমিও ঘড়ির গণ্ডগোল করে ফেলছি। আমি জানি নামাজ দেড়টায় হয়। এখানে যে একটায় হবে নামাজ এইটা আমার মাথায় নাই। আমার বন্ধু তাড়া দিল আমাকে, বলল তুই ওই মসজিদে নামাজ পড়তে চাইলে দৌড় দে, না হয় নামাজ পাবি না। আমি বের হলাম আর বৃষ্টিও প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। এদিকে উবারে গাড়িও পাচ্ছি না, মোটর সাইকেল নিয়ে যখন রউনা দিলাম তখন টুপটাপ করে পড়ছে বৃষ্টি। এই লোক কত ঘুরপাক দিয়ে আমাকে নামাজ ধরায় দিবে এমন আশ্বাস দিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ঝুম বৃষ্টি। শেষে নাখোদা মসজিদে যাওয়া আর হল না। নামাজের সময় শেষ হয়ে আরও বহু সময় পার হয়ে গেছে। আমি চিন্তা করলাম কলেজ স্ট্রিটেই চলে যাই। ওইখানে যাওয়ার কথা ছিল আমার। গেলাম। কফি হাউজে ঢুকে আগে কফি খেলাম। তারপরে ঠিক করলাম কী করব। তখন পর্যন্ত ওই দোকানের নাম আমার মাথায় নাই। কিন্তু বের হয়েই দেখি, এ কি! এই যে দোকান! সামনে দিয়ে একটু পাকাপাকি করলাম। গুরুর দোকানটা খুঁজলাম, দেজ পাবলিশিং খুঁজলাম। পাইলাম। কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে ওইখানে। ধুর, বলে সোজা ঢুকে গেলাম দোকানে। সামনে একজন কর্মচারী দাঁড়ান। আমি তাকে বললাম আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি। একটা বইয়ে পড়ছি মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দোকান থেকে শরণার্থী শিবিরে খাতা কলম পেন্সিল দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টা আমার কাছে খুব ইউনিক লাগছিল। এখন এখানে এসে আপনাদের দোকান দেখে ভাবলাম দেখে যাই। আমার একটা সমস্যা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার গলার স্বর কেঁপে যায়, গলা ধরে আসে, কান্না এসে যায়। এইটা কোন গুন না, এইটা দোষ। এত আবেগ ভালো না। এখনও তাই হচ্ছিল প্রায়। তিনি অত খেয়াল করেন নাই, কী শুনছে কী বুঝছে জানি না। তিনি বললেন, একটু দাঁড়ান। বলে ভিতরে গেলেন, কার সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে দেখছি। উনি ওইখান থেকে হাতের ইশারায় ডাক দিলেন। আমি জুতা পরা ছিলাম, ইশারায় দেখলাম জুতা? উনি ইশারা দিয়ে বললেন চলে আসুন। আমি ঢুকলাম দোকানের ভিতরে।
বয়স বুঝা যায় না এমন লোক একটা টেবিলের পাশে বসা। আমি কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। উনি হাতের ইশারায় বসতে বললেন। দোকানে তখন অন্য খদ্দের ছিল। তার সাথে আলাপ করতে লাগলেন। আলাপ শেষ করে বললেন কী ব্যাপার? আমি আবার প্রথম থেকে বলা শুরু করলাম। উনি কিছুই বুঝলেন না। বললেন আমরা তো বই ছাপাই না! আমি বুঝলাম ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি আরও ভেঙ্গে বললাম কেন আমি আসছি। তিনি আমাকে জানালেন ওই সময়ের কিছু বলার মতো কেউ নাই। মুক্তিযুদ্ধের আলাপ শেষ। এরপরে আমাকে জিজ্ঞাস করলেন বাড়ি কই? ঢাকায়? বললাম না, তবে আমি লম্বা সময় ঢাকায় ছিলাম, আমার জন্মও ঢাকায়। তিনি এরপরে জিজ্ঞাসা করলেন, তাইলে কই বাড়ি? বললাম শেরপুর। উনি জিজ্ঞাস করলেন শেরপুরে কই? আমি একটু হোঁচট খেলাম, শেরপুরেই কেউ চিনে না এই লোক শেরপুরে কই জিজ্ঞাস করছে? আমি বললাম সদরেই। উনার আবার প্রশ্ন, সদরে কই? আমি তখন ধরেই নিছি উনি বগুড়া শেরপুরের সাথে আমাদের শেরপুরের প্যাচ লাগিয়ে ফেলছে। কারণ শেরপুরকে শেরপুরের বাহিরে চেনানো খুব কঠিন কাজ। আমি বলতে যাব যে বগুড়া শেরপুর না কিন্তু, জেলা শেরপুর, এর মধ্যেই তিনি বোম ব্রাস্ট করলেন, নয়ানী বাজার থেকে কোনদিকে! আমার চোয়াল হা হয়ে গেল! নয়ানী বাজার? তিনি বলে চলছেন, নয়ানী বাজার আছে না? তিনানি বাজার? মাধবপুর? জিকে স্কুল? আমি হতভম্ব অবস্থায় বললাম আমি জিকে স্কুলের ছাত্র! উনি হাসতে হাসতে বললেন আমি ভিক্টোরিয়া স্কুলের! আমার মাথা তখন ঘুন্নি খাচ্ছে প্রবল ভাবে! এইটা সম্ভব? কাকতালীয়ের একটা লিমিট থাকা উচিত না? বললেন, চা খাবা? আমি এক পায়ে রাজি, বললাম হ্যাঁ দাদা, চা খাব। চা আসল, বিস্কুট আসল। আমার ঘোর কাটে নাই তখনও। উনি বললেন চকবাজারে আমার এক বন্ধু আছে, আর না হলে আর কোন যোগাযোগ নাই কারও সাথে। চকবাজারে বন্ধু? কে? কর পরিবার চিন? চিনে মানে? বিজু কর, মতিশ করকে চিনে না আবার কে? বললাম আমারা সব ভাই বোন বিজু স্যারের কাছে পড়ছি! বিজু কর উনার বন্ধু! আমার মনে হল সম্পদের কথা বলি। বললাম চকবাজারের মনোরঞ্জন সাহা চিত্তরঞ্জন সাহাকে চিনতেন? বলল হ্যাঁ, চিনতাম তো! মনোরঞ্জন মারা গেছে? আমি বললাম না, উনার বড় ভাই চিত্তরঞ্জন মারা গেছে। এরপরে মাধবপুরে উনার এক আত্মীয় আছে বললেন। এগুলা কী হচ্ছে তা মাথায় যাচ্ছে না আমার। সত্যই কলেজ স্ট্রিটের এই দোকানে বসে এগুলা শুনছি আমি? পারলে চিমটি কাটতাম একটা।
আমার কথা জিজ্ঞাস করলেন। বললাম এখানের একটা ব্লগে নিয়মিত লেখি। আমার যে নতুন একটা পরিচয় হয়েছে তাও বললাম। বললাম এখান থেকে একটা বই বের হয়েছে আমার। উনি তাই না কি বলে উল্লাস প্রকাশ্য করলেন। সাদা কাগজ দিয়ে বললেন তোমার সব কিছু এখানে লিখে দিয়ে যাও। দেশের মোবাইল নাম্বার, নাম ঠিকানা সব, বইয়ের নামটাও দিয়ে যাও। আমি সব লিখলাম, পাশে আমার বড় ভাইয়ের নামও লিখে দিলাম। কারণ শেরপুর শহরে আমারে যে কেউ চিনে না এইটা আমি জানি। সেই তুলনায় আমার বড় ভাইকে চিনে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর, তাই ওর নামও লিখে দিলাম।
সম্পদ সাহা আমার সাথে ভারত আসছে। ও কলকাতায় আসলে ওকে নিয়ে আবার উনার দোকানে যাব এই কথা বলে বের হয়ে আসলাম। ফুরফুরা লাগছিল তখন। আমি চিন্তা করছিলাম যে এইটা কী হল! এরপরে বই কিনলাম এত গুলা। এবং তখনই মাথায় আসল আরেকটা পরিকল্পনা। আমি আমার বইটা কিনলাম, লিখলাম পথে পাওয়া এক অচেনা দাদাকে শরিফ! লিখে আবার গেলাম দোকানে। গিয়ে বললাম দাদা আছে ভিতরে? বলল আছে, জান। ওরা আমাকে চিনে ফেলছে ততক্ষণে। ভিতরে গিয়ে দাদাকে বললাম এই যে দাদা আপনার জন্য আমার বই! উনি এমন তাজ্জব খুব কমই হয়েছেন বোধ করি। আরে করছ কী! তোমার বই? আমাকে আবার চা খেতে বললেন। আমি না করলাম। আমার হাতে বই গুলা দেখে তিনি বললেন তুমি বই কিনবা আমাকে বলতা। আমি একটা স্লিপ লিখে দিলে অনেক দোকানে কম রাখে দাম। আর কম দাম! যা পেয়েছি আজকে এইটা আমার কাছে পরম পাওয়া! আবার বললেন মনোরঞ্জনের ছেলে আসলে নিয়ে আইস কিন্তু! বললাম নিয়ে আসব।
আমি যে গল্পের জন্য গিয়েছিলাম তা পাইনি। কিন্তু যা পেলাম তার কোন মাপজোক সম্ভব? তিনি আমাকে বললেন তিনি ১৯৭১ সালেই এসেছিলেন। আমি যে জন্য গিয়েছি তার কোন ডাটা তাদের কাছে নাই আর আগের কেউ বেঁচেও নাই। উনি পুরোপুরি আমাকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেন নাই। আমি যখন প্রথমে গেলাম তখন কার্ড চেয়েছিলাম, উনি আমাকে বলছিলেন কার্ড থাক, আমিই তোমার সাথে যোগাযোগ করব। আমি আর কী বলব? চলে আসছি, আসার আগে বললাম একটা সেলফি তুলি? উনি হাসি দিয়ে রাজি হলেন। দ্বিতীয় বার যখন আমি আমার বই নিয়ে গেলাম তখন তাঁর সমস্ত দ্বিধা চলে গেছে। তিনি তখন নিজেই কার্ড দিলেন আমাকে আর বললেন, একটু দাঁড়াও, তোমার একটা ছবি তুলে রাখি! আমি হাসি মুখে একটা ছবি তুলতে দিলাম উনাকে।
অবিশ্বাস্য এই কাণ্ড করে আবার কফি হাউজে বসে কফি খেতে খেতে লিখা শুরু করেছিলাম। পরে মনে হল এইটা এখানে লিখলে জমবে না। আপাতত একটু বলে পরে বাসায় গিয়ে লিখব পুরো গল্প। এখন বন্ধুর বাসায় বসে বসে লিখলাম এই মহা কাণ্ড। কী মনে হয়? ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশন বলে কী ভুল বলেছি না কম বলে ফেলছি?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।