“কাল রাতে সোমেন যখন এল তখন তার সঙ্গে চুলদাড়িওলা রাঙা এক সাহেব। বগুড়ায় ছেলেবেলায় অনেক সাহেব দেখেছেন ননীবালা, কী সুন্দর সাজপোশাক কেমন ঝলমলে চেহারা। কিন্তু এ কী একটা সাহেবকে ধরে এনেছে সোমেন? রোগা, পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, সারা গায়ে ধুলোময়লা, চোখে মুখে ভিতু-ভিতু ভাব। এসেই সোমেন বলল, মা, আজ রাত্রে ম্যাক্স আমার কাছে থাকবে। শুনে কপালে চোখ তুলেছেন ননীবালা। সাহেব মানুষরা বাংলাটাংলা বোঝে না, তাই তার সামনেই ননীবালা বলে ফেলেছিলেন, ও মা! সে কীরে, ওরা খ্রিস্টান ...। সোমেন গলা নামিয়ে বলে, ও কিন্তু বাংলা জানে।
ননীবালা সামলে গেছেন। কিন্তু ছেলের আক্কেল দেখে অবাক। হিন্দু বাড়ির অন্দরমহলে কেউ সাহেবসুবো ধরে আনে? আচার-বিচারের কথা না হয় ছেড়েই দিলেন, ঘরদোরে জায়গাও নেই তেমন, রণোর অসুখের পর খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন তেমন নেই, দু' বেলা দুটো ডালভাত কি একটু মাছের ঝোল মাত্র রান্না হয়। এ দিয়ে কি অতিথিকে খাওয়াতে আছে! বীণাও খুশি হয়নি সাহেব দেখে। কেবল নাতি-নাতনিরা খুব ঘুরেফিরে সাহেব দেখছিল।
সাহেব হলেও ছেলেটা ভালই। এ বাড়ির কেউ যে তাকে দেখে খুশি হয়নি তা বুঝতে পেরেই বোধহয় বাইরের ঘরে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। চোখে-মুখে ভারী ভালমানুষি আর ভয় মাখানো। মা-বাবা ছেড়ে কত দুরে পড়তে এসেছে। দেখেশুনে বুকের ভিতরটা 'আহা' করে উঠল ননীবালার। রান্নাঘরে তাকে আর ঢোকাননি ননীবালা, বাইরের ঘরেই সোমেনের পাশে ঠাঁই করে খেতে দিলেন। আসনপিড়ি হয়ে বসে বেশ খেল। ঝিঙেপোস্ত, মুগের ডাল আর ট্যাংরার ঝাল। কোনও আপত্তি করল না। মাঝে মাঝে নীল রঙের চোখটা যখন তুলে তাকাচ্ছিল তখনই টের পাওয়া যাচ্ছিল যে বাঙালি ঘরের ছেলে নয়, নইলে ভাবভঙ্গি সব বাঙালির মতো। এতক্ষণ কথা বলেনি, বোবার মতো চুপ করে ছিল। খেতে বসে প্রথম কথা বলল, মা, ঝিঙেপোস্ত খুব ভাল হয়েছে।
মা! ননীবালা বড় অবাক। সাহেব ছেলেটা তাঁকে মা বলে ডাকছে! ননীবালা বিস্ময়টা সামলে নিয়ে বলেন, মা বলে ডাকছ বাবা? কার কাছে শিখলে? ছেলেটা হেসে বলল, এখানে সবাই ডাকে। মেয়ে মাত্রই মা। আমার দেশে এ-রকম ডাকে না। আমি এ দেশে শিখেছি। ননীবালা নিবিষ্টভাবে রোগা ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকেন। ছেলেটা চেহারার যত্ন করে না, চুলদাড়িতে কেমন জঙ্গল হয়ে আছে মুখ। একটু যত্ন করলে গৌরাঙ্গের মতো ওর চেহারাখানা চোখ জুড়িয়ে দিত।
ননীবালা শ্বাস ফেলে বলেন, মা বলে ডেকো না বাবা, তা হলে ছেড়ে দিতে কষ্ট হবে। বলে একটু চুপ করে থেকে বলেন, মা হওয়ার জ্বালাই কী কম! সামনের জন্মে ছেলে হয়ে জন্মাব, তা হলে আর মা হতে হবে না। ছেলেটা চোখ তুলে বলে, আবার জন্ম হবে? ঠিক জানেন? ননীবালা অবাক হয়ে বলেন, জন্মাব না? কর্মফল যত দিন না কাটে - - -
ম্যাক্স দুঃখিতভাবে বলে, আমরা খ্রিস্টানরা জন্মাই না, আমরা মাটির নীচে শুয়ে থাকি। টিল দ্য ডে অব জাজমেন্ট। ননীবালা ফাঁপরে পড়ে বললেন, সাহেবরা জন্মায় না। তা হলে এত সাহেব জন্মাচ্ছে কোথা থেকে বাবা?
সোমেন বেদম হাসতে গিয়ে বিষম খেল। সঙ্গে বীণাও। ননীবালা বিরক্ত হয়ে বলেন, ওতে হাসার কী! সাহেবরা হয়তো জন্মায় না, কিন্তু আমরা হিন্দুরা ঠিক জন্মাই।
এইভাবে ছেলেটার সঙ্গে দিব্বি আলাপ-সালাপ হয়ে গেল। সাহেব হলেও নেইআঁকড়ে ভাব। দু'চোখে সব সময় কী যেন খুঁজছে, কী যেন দেখছে। সোমেন রণেন যেমন অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়া সবজান্তা ভাব, চোখের আলো নিবে যাওয়া রকম, ও তেমন নয়। ওর মনের কোনও আলিস্যি নেই।"
★★★★★★★★★★★★★★★★
আমার পরিচিত কিছু সমবয়সী বা এক দু দশকের অনুজের মধ্যেও দেখেছি সোমেন বা রণেনের মতো মিয়োনো ভাব। কারুর ভাবনায় তো আর উঁকি দেওয়া যায় না তবে তাদের অনুশীলিত সংযত প্রকাশে বোঝা গেছে তাদের মনে নিযুক্ত হয়েছে স্বেচ্ছারোপিত সেন্সরবোর্ড। কাউকে মনে হয়েছে তারা জন্মেছেই রসবোধ ও রোমান্টিক ভাবনার Short Expiry Period নিয়ে তাই মধ্যযৌবন অতিক্রান্ত হতেই বা সংসারের দায়িত্ব, সমস্যা, খিটিমিটিতে সময়ের আগেই হয়ে গেছে প্রাজ্ঞ, সংযত, উচ্ছ্বাসহীন।
একবার TOI তে প্রকাশিত আমেরিকান গায়িকা, অভিনেত্রী Haley Bennett এর একটি ছবির ওপর রসময় মন্তব্য করে কয়েকজন সমবয়সী অতীত বন্ধুদের পাঠিয়েছিলাম। প্রাপকদের মধ্যে ছিল অতীতের এক প্রিয় বান্ধবী। সে মন্তব্যটি পড়ে বলেছিল - "বাবাঃ, এই বয়সেও তোর এমন ভাবালুতা!! ভাবা যায় না"। আমি আর কিছু বলিনি তাকে। তবে মনে হয়েছিল, ও হয়তো ভাবে - বয়সের সাথে যেমন চামড়া শিথিল হয়, কর্মক্ষমতা কমে যায় কিছু অঙ্গ, প্রত্যঙ্গের, চোখে পড়ে ছানি - তেমন হওয়া উচিত ভাবনাতেও। অবশ্য দেখেওছি তেমন। একদা ছটফটে মজারু সহপাঠী এখন প্রায়ই হোয়াতে পাঠায় রামকৃষ্ণ, মা সারদার ছবিছবা সহ সুপ্রভাত বাণী। বান্ধবীর আশ্চর্য হওয়াতেও নিহিত ছিল সেই ভাবনা - পুরোনো গাড়িতে নতুন টায়ার লাগিয়ে কী লাভ! তখন আমি উনষাট।
পঁচাশিতেও হুসেন তাঁর কাছে epitome of womanhood মাধূরী দীক্ষিতকে নিয়ে বানিয়েছেন 'গজগামিনী' সিনেমা। সে ছবি বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও মাধূরী ফিদা হুসেন বিনদাস। কারণ তিনি পয়সা কামাতে সে ছবি করেন নি। ওটা ছিল তাঁর কাছে Celebration of romanticism. নারী সৌন্দর্য উপেক্ষায় মজবুর মকবুল তাই ন্যূড স্টাডির জন্য অনুরোধ করেন বিদ্যা বালানকেও। বেরসিক বিদ্যা 'ডার্টি পিকচার' করলেও মকবুলের আব্দার কবুল করেন নি। ফলে শিল্পরসিকরা বঞ্চিত হোলো একটি মহান শিল্পকর্ম দর্শনের আনন্দ হতে।
না, এসব কথা তাকে চ্যাটে লিখি নি সেদিন। জানতাম দীর্ঘ অসুখী দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করে তখন সে মানসিকভাবে ম্রিয়মাণ। আর আমি ফুরফুরে মেজাজে দীর্ঘ একাকী ভ্রমণ অন্তে বাড়ি ফিরে খাচ্ছি বৌমনির হাতের স্বাদু রান্না। কাউকে গাছ থেকে পেড়ে ও জমি থেকে কুড়িয়ে খেতে দেখলে অনেকেরই চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সে একদা প্রিয় বন্ধু হলেও। বুঝি তা।
যারা কর্মযোগী - তারা কর্মে বিশ্বাসী। যা করা যায় না তা নিয়ে ভাবাও উচিত নয়। ভাবনা এলেও তার প্রকাশ নৈব নৈব চ। অথচ তারা বোঝে না চোখ যখন দেখে না, কান যখন শোনে না (কারণ তারা কেবল গ্ৰাহক মাত্র) - যদি দৃশ্য ও শ্রুতির গ্ৰহণ, সংশ্লেষন, বিশ্লেষণ, প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ (reception, synthesis, analysis, processing and archival) হয় মগজে (মনে, স্মৃতিতে) - তাহলে রোমান্টিক ভাবনাও তাই - তার জারণ, বিজারণ সবই মনে - যার বয়স শরীরের সাথে সমানুপাতিক নয়, সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কিতও নয়। তাই কেউ হয় অকালপক্ক, কারুর আজীবন কাটেনা শৈশব, কেউ বার্ধক্যেও থেকে যায় তরুণ। তাছাড়া রোমান্টিক ভাবনা মানেই নিছক নারী পুরুষের মাখো মাখো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তো নয় - আরো গহীন, আরো মিহিন, মহিমান্বিত, কিছুটা অধরা, অনেকটাই বোধের ঐশ্বর্যময় স্তরে। তা সমাজের কুসংস্কার ও সমাজপতিদের লাল চোখের নাগালের অতীত।
ধরা যাক বাঙালির “একচেটিয়া শাব্দিক ভারী-শিল্প রবীন্দ্রনাথের কথা।” (কথাটা আমার নয় সুনীলের, তাই রেখেছি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে)। এই একটি ব্র্যান্ড ভাঙিয়ে, ভেঙেচুরে কত শত লোক যে কতভাবে করে খাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এবং এভাবেই নানাভাবে, নানা মাধ্যমে প্রতিপন্ন করতে চায় তাদের সাংস্কৃতিক উচ্চমন্নতার পরাকাষ্ঠা। যথেচ্ছ রবীন্দ্র কবিতার কোট, ভারী গলায় আবৃত্তি, খেলানো সুরে গান, নতুন বছর থেকে নানা পুজো, উৎসব উদযাপনে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন, ইউটিউবে চিত্র, গীত, রবীন্দ্র জীবনালেখ্য নিয়ে নিজভাষ্য সহযোগে প্রতিবেদন, পৌষমেলায় পিকনিক, বসন্ত উৎসবে রঙিন হুল্লোড়, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রসদনে বিদগ্ধমুখে হাজিরা দেওয়া - রবীন্দ্র অনুরাগীদের এহেন অবিশ্রান্ত রবীন্দ্র অনুরাগ প্রদর্শনে বিরাম নেই।
প্রভূত হট্টগোলের মাঝে এই মহাজীবনের কিছু নির্জন একান্ত পরিসরে একটু মন খুলে চোখ মেলে দেখা যাক। রবীন্দ্রনাথ ৫৮, রাণু ১২ - এই দুই অসমবয়েসি সত্তার মধ্যে আপামর ধারণায় অচিন্তনীয় এক অলৌকিক সম্পর্কের অঙ্কুরোদগম হয় - যা চেতনার গহীন থেকে বুড়বুড়ি কেটে মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে চিঠিপত্রে। সেটুকুই আমরা জানতে পারি। কিন্তু রাণু যখন শান্তিনিকেতনে রবির লম্বা চুলে চিরুনী চালায় তখন প্রৌঢ় রবির মনে নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর প্রতিভাস ওঠে কিনা তা জীবনীকার, ঔপন্যাসিকের ভাবনার বিষয়বস্তু।
প্রৌঢ় রবির সাথে কিশােরী থেকে ক্রমশ যুবতী হয়ে ওঠা রাণুর ছ-বছরের সেই প্রচলিত সংজ্ঞাহীন, সুষমামণ্ডিত সাহচর্যের মধুর রেণু অলখ ফাগুন হাওয়ার মায়ায় উড়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা স্থানে - জোড়াসাঁকোয়, শান্তিনিকেতনে, শিলং পাহাড়ের পাইন বনের ছায়ায়… এবং অবশ্যই মনে - অষ্টাদশী রাণুর শিল্পপতি স্যার বীরেন মুখার্জীর সাথে বিয়ে হয়ে লেডি রাণু মুখার্জীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া ইস্তক।
তারপরেও তা হারিয়ে যায় না, বরং সযত্নে রক্ষিত থাকে মনের গহনে। তাই কখনো তির্যকভাবে প্রকাশ হয়ে যায় গানের কথায়, সুরের হাহাকারে….
"পুরানাে সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভােলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভােরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়-
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
হায়, মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়-
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।"
পুরানো সেই দিনের কথা বাঙালির প্রিয় গান, কখনো পুরানো হবে না, ঘরোয়া আসরে কোরাসে গেয়েছে কিন্তু হতেও তো পারে এ গানের "মোরা" বহুজন নয়, মাত্র দুজন। যেমন নীচের বহু প্রচলিত গানটির আন্ডারলাইন করা অংশেও সেই ছোঁয়া। সবাই জানে, এটা 'শাপমোচন' গীতিনাট্যর গান, ঐ প্রসঙ্গে লেখা। তবে ভাবের ঘরে ভাবের ঘোরে কবির লেখায় কোন প্রসঙ্গে কী ভাবনা হানা দেয় কে বলতে পারে?
"সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে,
ফুলডােরে বাঁধা ঝুলনা।
সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে
যেন জাগে মনে, ভুলাে না।
সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানাে
আমারি মনের প্রলাপ জড়ানাে,
আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানাে
তােমার হাসির তুলনা।
যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে
চাদ উঠেছিল গগনে।
দেখা হয়েছিল তােমাতে আমাতে
কী জানি কী মহা লগনে।
এখন আমার বেলা নাহি আর,
বহিব একাকী বিরহের ভার—
বাঁধিনু যে রাখী পরানে তােমার,
সে রাখী খুলাে না, খুলাে না।"
বা ধরা যাক ইন্দিরাদেবীর কথা। রবির মেজদা, প্রথম ভারতীয় ICS সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদান্দিনীর কনিষ্ঠা কন্য ইন্দিরা যখন দশ বছরের বালিকা তখন তার ২৭ বছরের প্রিয় কাকুমণি রবির বিয়ে হয় ১৮৮৩ সালে। রবি মেজদার পরিবারের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শুরুতে বেশ কিছুদিন ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের সাথে ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে তাঁর 'মেডিনা ভিলায়'। তখন ইন্দিরা, সুরেন্দ্রনাথ ছোটো। এই দুটি ছিল রবির খুব প্রিয় ভাইপো ভাইজি।
পরে ভারতে এসে সিমলায় "উডফিল্ড" নামক বাড়িতে মেজদার পরিবারের সাথেও রবি দীর্ঘদিন ছিলেন। সে সময় কাকা ভাইজির মধ্যে গড়ে ওঠে (কিছুটা পরবর্তীতে রাণুর মতোই) নিবিড় সম্পর্ক। রবি ইন্দিরা, সুরেনকে সাহিত্য, কবিতা, সংগীত, চিত্রকলা বিষয়ে আগ্ৰহী করে তোলেন। ইন্দিরার সাহচর্যে রবি কাটিয়েছেন গাজীপুরে, কর্ণাটকে কারওয়ার সৈকত নগরীতে। ইন্দিরার সাথে ভ্রমণে গেছেন মুসৌরীতে। রবির গানের সাথে পিয়ানো বাজাতো ইন্দিরা।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হলিউডের জাঁকজমক ত্যাগ করে সুইডিশ অভিনেত্রী গ্ৰেটা গার্বো আমৃত্যু (৮৪তে) দীর্ঘ ৪৮ বছরের একাকী স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। সেই সময়ে তিনি মাত্র অল্প কয়েকজনের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ রেখেছিলেন। আন্দাজ ৩০ বছরে তাঁর বান্ধবী মার্সিডিজ ডি এ্যাকোস্টা ও মিমি পোলককে লেখা যথাক্রমে ১৮১/৬০ টি চিঠির কথা জানা যায়।
ইন্দিরার ১৪ থেকে ২২ বছর বয়সের মধ্যে, অর্থাৎ ২৬ বছর বয়সে ১৮৯৯ সালে প্রমথ চৌধুরীর সাথে বিয়ের চার বছর আগে অবধি (৯/১৮৮৭ থেকে ১২/১৮৯৫ এর মধ্যে) কাকা ভাইজির মধ্যে বহুল পত্রবিনিময় হয়। বেশিরভাগ চিন্তাশীল মানুষের মতো রবীন্দ্রনাথও চিঠি লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে ভালোবাসতেন। তাই বলাই বাহুল্য সেই পত্র আদানপ্রদাণে বেশিরভাগ চিঠিই লিখেছেন রবি, তাঁর আদরের ভাইঝি ইন্দিরাকে।
বহুল লেখালেখি, নানা কাজকর্ম, আরো অনেককে চিঠি লেখার মাঝেও রবি ইন্দিরাকে আট বছরে ২৫২ টি চিঠি লেখেন মানে গড়ে মাসে প্রায় তিনটি। তাই চন্দ্রিল ভট্টাচার্যর মতে, রবীন্দ্রনাথ - রবীন্দ্রনাথই - 'এক দানবীয় প্রতিভা'। ইন্দিরাকে লেখা কেবল রবীন্দ্রনাথের সেই চিঠিগুলিই সংকলিত হয়েছে 'ছিন্ন পত্রাবলী'-তে।
বিয়ের পর যুবক রবির জমিদারী তদারকিতে মোটেও উৎসাহ ছিল না। তবু পিতার আজ্ঞায় যেতেই হয়। তখন শিলাইদহতে অবস্থানকালে ইন্দিরাকে লিখিত চিঠিগুলিই 'ছিন্ন পত্রাবলী'র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। কারণ নির্জন নদীতীরে বা একান্তে বজরায় বসে লেখা সেসব চিঠিতে মানুষ রবীন্দ্রনাথের মনের অনেক গহীন ভাব, যা সাহিত্যে প্রকাশ হয় নি, হয়তো গানে বা কবিতায় তির্যক ইংগিতময়তায় রয়ে গেছে, সরাসরি ধরা পড়েছে চিঠিতে।
সেই সময় শিলাইদহ থেকে ৭-১০-১৮৯৪ তারিখে ইন্দিরাকে লিখিত ১৬০ ক্রমিক সংখ্যার চিঠিটিই 'ছিন্ন পত্রাবলী'র ভূমিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর থেকে উপযুক্ত ভূমিকা হয়তো অন্য কিছু হতেও পারতো না:
"তােকে আমি যে - সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনাে লেখায় হয় নি। তােকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনাে মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনাে কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলাে আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলােকে তুই কেবলমাত্র রচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।
যখন মনে জানি পাঠকরা আমাকে ভালাে করে জানে না, আমার অনেক কথাই তারা ঠিকটি বুঝবে না এবং নম্রভাবে বােঝবার চেষ্টাও করবে না, এবং যেটকু তাদের নিজের মানসিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলবে না সেটকু আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে গ্রহণ করবে না, তখন মনের ভাবগুলি তেমন সহজে ভাষায় প্রবাহিত হতে চায় না এবং যতটুকু প্রকাশ হয় তার মধ্যে অনেকখানি ছদ্মবেশ থেকে যায়।
এর থেকেই বেশ বুঝতে পারি আমাদের সব চেয়ে যা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সে আমরা কাউকে নিজের ইচ্ছা - অনুসারে দিতে পারি নে। আমাদের ভিতরে সব চেয়ে যা গভীরতম উচ্চতম অন্তরতম সে আমাদের আয়ত্তের অতীত ; তা আমাদের দান - বিক্রয়ের ক্ষমতা নেই। আমরা দৈবক্রমে প্রকাশ হই, আমরা ইচ্ছা করলে চেষ্টা করলেও প্রকাশ হতে পারি নে। চব্বিশ ঘণ্টা যাদের সঙ্গে থাকি তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত।
তাের এমন একটি অকৃত্রিম স্বভাব আছে, এমন একটি সহজ সত্যপ্রিয়তা আছে যে, সত্য আপনি তাের কাছে অতি সহজেই প্রকাশ হয়। সে তাের নিজের গুণে। যদি কোনাে লেখকের সব চেয়ে ভালাে লেখা তার চিঠিতেই দেখা দেয় তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে। আমি তাে আরও অনেক লােককে চিঠি লিখেছি, কিন্তু কেউ আমার সমস্ত লেখাটা আকর্ষণ করে নিতে পারে নি। তাের অকৃত্রিম স্বভাবের মধ্যে একটি সরল স্বচ্ছতা আছে, সত্যের প্রতিবিম্ব তাের ভিতরে বেশ অব্যাহতভাবে প্রতিফলিত হয়।" (১)
বর্তমান লেখার শুরুতে ছিল আমার প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দুর "যাও পাখি" উপন্যাসের অংশ। সেখানে সোমেন, রণেনের অকালে বুড়োটে মেরে যাওয়া, চোখের আলো নিভে আসা সবজান্তা ভাব দেখে তাদের মা ননীবালার খারাপ লাগে। তুলনায় বেশ কিছুদিন ভারতে থেকে বাংলা বলতে শেখা অস্ট্রেলিয়ান ভবঘুরে সাহেব ম্যাক্সকে দেখে ননীবালার মনে হয় ওর চোখ এখনও কত কী খোঁজে! ননীবালা অবশ্য জানেন না ম্যাক্স দুশোর বেশী মেয়ের সাথে মানসিক দায়বদ্ধতাহীন সহবাস করে সাময়িক জৈবিক আনন্দ পেয়ে ভুলে গেছে তাদের। এখন আর নারী শরীর ওকে আকর্ষণ করে না। তাই ননীবালাকে মা ডেকে তৃপ্তি পায়। এখন ম্যাক্স নারী শরীরে নয়, নারীত্বের মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়ায়। তাই ও রক্ষণশীল অনিমার সাথে শুতে চায় না, প্রেমে পড়ে যায় তার। এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েও আঘাত পায় না। মলিন হয় না ওর অনিমার প্রতি Enigmatic feminine আকর্ষণ।
আর সোমেন? সোমেনের সাথে অনিমা অনেকদিন ধরে সবার সামনে প্রেম প্রেম ভাব করে ইয়ারকী ফাজলামি করেছে। হঠাৎ এক রাতে আচমকা ঝোড়ো চুম্বন করে অনিমা সোমেনকে জানায় - ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে এক বাড়ি গাড়িওলা ইঞ্জিনিয়ারের সাথে - তিনমাস বাদে আগামী বৈশাখে বিয়ে। সোমেন বিহ্বল হয়ে বলে, এতদিন তো সিরিয়াস মুখ করে ইয়ারকীই করতে আমার সাথে, আজ এ কী করলে? হেঁয়ালির মতো হেসে অনিমা বলে, এটা আমি রেখে দেবো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে, জানবে তুমি, কতো অসুখী জীবন কাটাবো আমি। বিয়ের কার্ডও দিতে যাবো, কিন্তু তুমি আসবে না বিয়েতে - সব নিমন্ত্রণ রাখতে নেই। তাই সোমেন ইদানিং অসুখী। আর রণেন ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছে। সেটা অবশ্য অন্য কারণে।
কিন্তু বাস্তবে অনেকেরই ভবিষ্যতে পাঁজায় শুয়ে আগুনে সেঁকার অনেক আগেই জীবন থেকে বিদায় নেয় ফাগুন হাওয়া। যারা সোমেন বা রণেনের অবস্থায় নেই, তারাও অজান্তে বা স্বেচ্ছায় মনের ওপর লাগাম পরিয়ে হয়ে যায় রসকষহীন, সবজান্তা। উপভোগের বদলে উপেক্ষা ও বিদ্রুপ তখন তাদের হয়ে দাঁড়ায় প্রিয়। চৈতি পবনেও তাদের মনে জমাট বাঁধে পৌষালী শীতার্ততা। আমি এখনও অবধি এমন হতে চাই না। তাই এখনও আমার পৌষালী বয়সের লেখাতেও হামেশাই খেলা করে চৈতালী হাওয়া। আর সেসব দেখে কুঁচকে যায় সংস্কারী ভুরু।
পুনশ্চঃ:-
(১) রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানের অন্তর্নিহিত অর্থ তখন অনেকসময় বিদ্বৎজনেরাও বুঝে উঠতে পারতেন না, তাই সমালোচিত হয়েছেন "অস্পষ্ট ভাবের কবি" বলে। এখন তো প্রকৃত কিছু পণ্ডিত, ভাবুকজন ব্যতীত অধিকাংশ মানুষেরই সামান্য গভীরে গিয়েও উপলব্ধির অবকাশ, অভিপ্রায় কমে যাচ্ছে। তখনকার প্রেক্ষিতে এক ৩১ বছরের ভাবুক মানুষ চিঠি লিখতে শুরু করছেন ১৪ বছরের এক কিশোরীকে যে আত্মীয়তা সূত্রে ভাইঝি। ক্রমশ চিঠির ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আত্মকথনের মতো - অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের সীমারেখা, ঘুচে যাচ্ছে বয়সের প্রভেদ, উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে কোনো চিরন্তন অনুভূতি - নারীত্বের মাধূর্য - the eternal feminine enigma. আত্মীয়তা তো শুধু বংশ লতিকায় লটকে থাকার বস্তু নয় - যাকে অনুভব করা যায় আত্মার কাছাকাছি, সেও তো আত্মীয়ই।
ক্রমশ যখন ইন্দিরা হয়ে গেলেন ২২ আর রবি ৩৯ তখন ছেদ পড়লো ভাইজিকে নিয়মিত চিঠি লেখালেখিতে। কেন? আমরা তা সঠিক জানি না। কিন্তু আমি অনুমান করেছি তখন আর ভাবের ঘোরে রবি অনেক কিছু মন খুলে 'সত্যভাব' লিখে উঠতে পারছেন না - কারণ ইন্দিরা বড় হয়েছে, তখন তার মনোকাননে আনাগোনা শুরু হয়েছে অন্য ভ্রমরের - এক সুপুরুষ নক্ষত্র - প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজীতে এম.এ তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট - ভবিষ্যতে বাংলার প্রথম সার্থক লিটল ম্যাগ 'হিসেবে স্বীকৃত হয়ে ওঠা 'সবুজ পত্র' পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী। প্রমথর মেধা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও ক্ষুরধার লেখনীতে রবীন্দ্রনাথও হয়েছিলেন প্রভাবিত।
তিন বছর পর ১৮৯৮ তে ইন্দিরা যখন ২৫ তখন রবীন্দ্রনাথের পাঁচ বছরের বড় দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরাণী (ঘোষাল) প্রমথকে বলেন, "আপনি যদি ইন্দিরাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন তাহলে ও রাজী হবে"। করলেন প্রস্তাব প্রমথ, "একবার মায়ের মত নিয়ে নি?" বললো ইন্দিরা। হয়তো নিয়মরক্ষায়।
প্রকৃত গুণী হবু জামাইকে মন থেকে বিশেষ পছন্দ করতেন ইন্দিরা মাতা - রবির মেজবৌদি জ্ঞানদান্দিনী। নাই বা করলো সে দশটা পাঁচটার কলমপেশা মুটেগিরি। পরিবারে পয়সার তো অভাব নেই। পরের বছর ১৮৯৯ তে ইন্দিরা যখন ২৬ ও প্রমথ ৩১, বিয়ে হয়ে গেল ওদের। বিবাহিত জীবনের বেশ কিছু সময় প্রমথ ঘরজামাই হয়ে থেকেছেন জ্ঞানদান্দিনীর আশ্রয়ে, করেছেন ঠাকুরবাড়ির এস্টেটের ম্যানেজারী - কোনোরকম মানসিক গ্লানি ছাড়াই।
প্রমথর উজ্জ্বল পড়াশোনার রেকর্ডের জন্য তখনকার দিনে ডেকে দেওয়া হয়েছিল তাকে কোচবিহার কলেজের পাঁচশো টাকা মাইনের প্রফেসরের চাকরি। নেন নি সে চাকরি প্রমথ। শুধুমাত্র কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে, সাহিত্য চর্চা, সম্পাদনা হবে না - সেজন্য। বিলেতে তিন বছর থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেও ওকালতি করেন নি - একই কারণে - ফুল টাইম সাহিত্য সেবার নেশায়।
ইন্দিরা ও প্রমথর মতো এমন দুটি উন্নত মনের মানুষের যৌবনে তো এহেন অনুরাগ হঠাৎ হতে পারে না। প্রমথ রবীন্দ্রনাথের সাথে অনেক আগে থেকে পরিচিত, সেই সূত্রে জোড়াসাঁকোয় নিয়মিত যাতায়াত, ফলতঃ যোগাযোগ হয় রবির সুন্দরী ভাইজি ইন্দিরার সাথে। তাই ওদের পূর্বরাগ পর্ব হয়তো চলেছে বেশ কিছুদিন। ফলে প্রমথ যখন প্রোপোজ করেন ইন্দিরাকে - অনুরাগে সিক্ত জমি তখন তৈরীই ছিল বিবাহকুসুম ফোঁটার জন্য। ইন্দিরার জীবনে যতো প্রভাব পড়েছে প্রমথর, নীরবে দুরে সরে গেছেন রবি। এমতাবস্থায় ইন্দিরাকে আর নানা গহীন ভাবে ভরা চিঠিপত্র না লিখে ওকে ওর মতো ডানা মেলতে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। এমনটা আমি ভেবেছি। আমার ভাবনা ভুলও হতে পারে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।