এর আগে ভিয়েতনাম নিয়ে মনে হয় দুই একবার লিখেছি - খাবার বা হস্ত শিল্প নিয়ে এবং হোই-আন শহর নিয়েও। ভিয়েতনাম এমনিতে খুব সুন্দর দেশ – অনেক সুন্দর সুন্দর ঘোরার জায়গা আছে এই দেশে। তবুও যদি আমাকে দুটি জায়গা বেছে নিতে বলা হয় – আমার কাছে একটা হবে হোই-আন শহর এবং তার আশেপাশে জায়গা – আর দ্বিতীয়টি হবে হ্যালং-বে। আমার কাছে এই দুইয়ের মধ্যে প্রিয়তম বাছা বেশ টাফ্ হয়ে যাবে, তবুও যদি জোরাজুরি করেন, তো আমি হ্যালং-বে এর কথাই বলব। হোই-আন শহরের গল্প আগেই লিখেছি, তাই আজ থাক হ্যালং-বে এর কথা।
হ্যালং-বে ভিয়েতনামে উত্তরের শহর হ্যানয় থেকে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার দূরে – আজকাল হ্যানয় থেকে হ্যালং-বে যাওয়া বেশ সোজা হয়ে গেছে এক্সপ্রসওয়ের জন্য। গাড়ি করে ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। আর হ্যানয় কি করে যাবেন? সরাসরি ফ্লাইটে যেতে পারেন – এখানে বিমানবন্দর আছে এবং এশিয়ার সব বড় বড় শহরের সাথে কানেক্টিং ফ্লাইট আছে। আর যেতে পারেন ভিয়েতনামের অন্য জায়গা থেকে গাড়ি করে। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন তো বলব এমন প্ল্যান বানান যাতে আপনি হো-চি-মিন এ ল্যান্ড করেন আর হ্যানয় থেকে ভিয়েতনামকে বাই বাই করেন।
আমার মতে ভিয়েতনামের যত উত্তর দিকে যাবেন তার সৌন্দর্য্য তত খুলবে। আর সেই সৌন্দর্য্যের ব্যাপারটা চরমে পৌঁছোবে হ্যালং-বে তে গিয়ে। তো সেই ক্ষেত্রে হ্যালং-বে দিয়েই ভিয়েতনাম ভ্রমণ শেষ করা ভালো। কারণ যদি হ্যালং-বে দিয়ে আপনি ট্রিপ শুরু করেন তা হলে আপনার এক্সপেক্টেশন হয়ত এতো বেড়ে যাবে যে বাকি ভিয়েতনামে সেটা আর আপনি ম্যাচ করতে পারবেন না! বিয়ে বাড়িতে মিষ্টি জিনিস শেষ পাতে দেওয়া হয় তার একটা কারণ আছে!
অনেকে হ্যালং-বে এর আশে পাশে যে হোটেল আছে সেখানে গিয়ে জাঁকিয়ে বসেন – তবে আপনার হাতে যদি অনন্ত সময় না থাকে বা দ্বিতীয়/তৃতীয় বারের জন্য ভিয়েতনাম না যান, তাহলে তো বলব, ওই হ্যানয়-তেই থেকে যান। সেখান থেকে গাড়ি করে হ্যালং-বে – আর তারপর সেই আকর্ষণের বস্তু, বা হাইলাইট যাকে বলে। নিয়ে নিন একটা ক্রুজ হ্যালং-বে তে। নানা ধরনের ক্রুজ বোট আছে – ফাইভ স্টার থেকে শুরু করে মাঝারি মানেরও। নিজের বাজেট অনুযায়ী আগে থেকে বুক করে নেবেন আশা করি। ২ দিন ১ রাত বা ৩ দিন ২ রাত – এই ক্রুজ গুলোই জনপ্রিয়। নিজের ইচ্ছেমত বেছে নিন – তবে আগে থেকে বলে দিই, যদিও ক্রুজ কোম্পানীগুলি বেশ কিছু অ্যাক্টিভিটির আয়োজন করে, তবুও বেশীর ভাগ সময়েই জলে ঘুরে বেড়ানো তো! আপনি যদি প্রকৃতি ভালোবাসেন – বোটের ছাদে বসে নিরিবিলি উপভোগ করেন তা হলে ওই ৩ দিনের প্যাকেজ বা আরো বেশী দিনের প্যাকেজ নিতে পারেন। হাতে সময় কম থাকলে ২ দিন ১ রাতের ট্রিপটাই কাফি।
এবার দেখে নেওয়া যাক হ্যালঙ-বে আসলে কি জিনিস! হ্যালং-বে ভিয়েতনামের উত্তরের কুয়াং-নিহা প্রদেশের এক জনপ্রিয় টুরিষ্ট স্পট। ২০০০ সাল থেকে এই জায়গাটা ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে। হ্যালং এর অর্থ নাকি ‘নেমে আসা ড্রাগণ’। হ্যালং-বে মোট ১৫০০ বর্গ কিমি মত জায়গা জুড়ে আছে আর এর মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ২০০০ এর মত ছোট ছোট টিলা বা বাচ্ছা পাহাড় যেগুলো বেশীর ভাগই লাইমস্টোন দিয়ে তৈরী। এই সব ছোট ছোট টিলা বা হ্যালং-বে যে আজকের রূপে আমরা দেখতে পারছি তা নাকি প্রায় ৫০ কোটি বছর ধরে ভৌগলিক পরিবর্তনের ফল।
এই হ্যালং-বে এর নামটা কিন্তু উনবিংশ শাতাব্দীর আগে এদের লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যায় না – অন্য নামে লেখা হত এই জায়গাকে। ফরাসীরাই সর্বপ্রথম উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই জায়গাটা হ্যালঙ-বে নামে ডাকতে শুরু করে। এত সুন্দর জায়গা থাকবে, কিন্তু সেই নিয়ে কোন স্থানীয় উপকথা থাকবে না এটা তো হতে পারে না! এদের উপকথায় আছে যে বহুদিন আগে যখন ভিয়েতনাম নিজেদের দেশ গুছিয়ে তুলছে তখন সে দেশের সম্পদ লুন্ঠনের জন্য বাইরের পাবলিক আক্রমণ করত। তো এই লুন্ঠনকারীদের হাত থেকে ভিয়েতনামকে বাঁচানোর জন্য ভগবান ড্রাগন পাঠান। এই ড্রাগনরা এসে মুখ দিয়ে ধনরত্ন এবং দামী পাথর বের করতে থাকে – আর সেই দামী পাথরগুলো সমুদ্রে পড়ে ওই ছোট ছোট টিলার জন্ম দেয়। এই টিলা গুলো সাহায্য করে আক্রমণকারীদের হাত থেকে ভিয়েতনামকে বাঁচতে। এই টিলার ধাক্কা খেয়ে শত্রু জাহাজ ডুবে যায় নয়ত ডুবন্ত পাথরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজের তলা ফেঁসে যায়। এই ভাবে ভিয়েতনামকে বাঁচিয়ে ড্রাগনরা ঠিক করে হ্যালঙ-বে তেই থেকে যাবে। সেই তখন থেকেই এই জায়গাকে ‘ড্রাগন অবতরণের জায়গা’ বলে বর্ণনা করা হয়।
হ্যানয় থেকে গেলে মোটামুটি আপনার হ্যালঙ-বে পোঁছতে পোঁছতে প্রায় বারোটার কাছাকাছি হয়ে যাবে। ক্রুজ গুলো সাধারণত যাত্রা শুরু করে ‘বাই তু লঙ বে’ এরিয়া থেকে। ক্রুজে উঠেই ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস ইত্যাদি পান করে লাঞ্চ করে নেবেন পেট ভরে। এর আগেই ভিয়েতনামের খাবার নিয়ে লিখেছি, তাই আর আজ আলাদা করে কিছু লিখছি না – অপূর্ব সেই খাবার। খেয়ে দেয়ে নিজের রুমে যান বা জাহাজটায় ঘুরে ফিরে দেখুন।
বিকেল তিনটে নাগাদ জাহাজ ধীরে ধীরে একজায়গায় নোঙর করবে – রোয়িং বোটে করে চলে যান ‘লুয়ন’ গুহা দেখতে। সেই কত কোটি বছর আগের গুহা – লাইমস্টোনের নানা আকৃতির সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিন ক্ষয়ে ক্ষয়ে। খানিক ঘুরে টুরে জাহাজে ফিরে আসুন – আবার চলতে শুরু করে খানিক এগিয়ে পৌঁছে যাওয়া ‘টি-টপ’ দ্বীপে। এখানে বাকি ঘন্টা দুয়েক আপনার – যা মন চায় করে নিন। সাঁতার ভালো লাগলে জলে ঝাঁপাই দিন, কায়াকিং ভালো লাগলে তাই করুন। যদি হাঁটাহাঁটি বেশী পছন্দের হয় – তাতেও অনেক অপশন। তবে যাই করুন হাতে একটু টাইম রাখুন টি-টপ দ্বীপের পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে। সেখানে উঠে যে দৃশ্য দেখতে পাবেন হ্যালঙ-বে এর তা দেখার জন্যই বহুদূর হেঁটে আসা যায়।
এই সব করে ফিরে আসুন জাহাজে – সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসবে, দেখবেন জাহাজগুলি ধীরে ধীরে নোঙর করার দিকে এগুচ্ছে। আপনি ফ্রেস হয়ে শেফের সাথে যুক্ত হয়ে শিখে নিতে পারেন ভিয়েতনামী রান্না কিছু। একটু রাত হলে এবার ডিনারের সময়। ডিনার নিয়ে আলাদা করে কিছু লিখব না – দারুণ, রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার করে টেবিল সাজিয়ে দিয়েছিল, খাবারও দূর্দান্ত।
খাবার শেষে এবার হাতে আপনার অনন্ত সময় – জাহাজে ব্যবস্থা আছে সিনেমা দেখার বা স্পা/ম্যাসাজ ইত্যাদি নেবার। আর যদি শুধু খোলা আকাশের নীচে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে চান তার জন্য জাহাজের ছাদের ডেকে আছে অনেক সান-বেডের মত – আর পাশে খোলা আছে বার। নিজের ইচ্ছে মত ড্রিঙ্কস নিয়ে বসে পড়ুন।
আমার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা – তাই ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম ছাদে – আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে, আকাশের রঙ মিশে যাচ্ছে জালে। ছাদের ডেকে দেখলাম ‘তাই চি’ এর শেসন চলছে, কিন্তু এই জিনিসটি আমার সাথে ঠিক খাপ খায় না বলে আমি শুধুই দর্শক রইলাম। খানিক পরে ব্রেকফাষ্ট এবং তার পরে কায়াকিং করে যাওয়া হল ‘সারপ্রাইজ কেভ’ – হ্যালঙ-বে এর বুকে সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় গুহা। গুহা ইত্যাদি ঘুরে জাহাজে ফিরে এসে স্নান-টান করে লাঞ্চের জন্য প্রস্তুতি। জাহাজের এবার ফেরার পালা – ফিরতে ফিরতেই চলতে থাকবে লাঞ্চ। তারপর দুপুরের কিছু পরে অবতরণের পালা জাহাজ থেকে দু দিনের মধুর স্মৃতি এবং হয়তবা পরিচিত হয়ে ওঠা কারো কারো ফোন নাম্বার নিয়ে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।