মধ্যপ্রদেশ ভৌগোলিক ভাবে Heart of India. কিন্তু ওখানকার মানুষের সহৃদয়তার পরিচয়ও আমি বারংবার পেয়েছি।
১৯৯১-৯২ সালে আমি যেখানে এক বছর কর্মসূত্রে ছিলাম, তখন তা ছিল মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। পরে ঐ এলাকা হয়েছে ছত্তিশগড়। বিলাসপুর আর রায়পুরের মাঝে মামূলী এক স্টেশন ভাটাপাড়া। সেখান থেকে কসডৌল দিশায় ২৫ কিমি দুরে বলোদা বাজার তখন এক ছোট্ট গঞ্জ। ওখান থেকে ১৫ কিমি দুরে সোনাডি নামে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে টাটা স্টিলের সিমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মানের কাজ চলছিল তখন।
বলোদা বাজার জায়গাটা অত্যন্ত সাদামাটা। কিন্তু ওখানেই মধ্যপ্রদেশের মানুষের সহজ, আন্তরিক ব্যবহারের প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাজারে শুক্লাজীর মূদীর দোকানে মাসকাবারী জিনিস কেনা ছাড়াও মাঝে মধ্যে যেতাম। প্রথম থেকেই ওনার হাসিখুশী, অমায়িক ব্যবহার খুব ভাল লেগেছিল। বৌমনিকে শুক্লাজী একটু বেশীই খাতির করতেন। গেলে দোকানের সামনে রাখা টুল দেখিয়ে বলতেন, ভাবীজী বৈঠিয়ে। বৌমণি পান খেতে পছন্দ করে শুনে, গেলেই মিষ্টি পান আনাতেন। বছর পঁয়ত্রিশের ঘরোয়া মানুষটি যে সদ্যবিবাহিতা, মিষ্টভাষীনি এক সুশ্রী বঙ্গললনার সাথে সাময়িক বাক্যালাপে নির্দোষ আনন্দ পেতেন, সেটা আমি বুঝতাম। তবে আলাপচারিতাম কখনো ওনার মধ্যে কোন বিসদৃশ আচরণ লক্ষ্য করিনি। শুক্লাজী আমাদের সন্ধ্যা আটটার পর আসতে বলতেন। তখন স্থানীয়দের ভীড় কমে যায়। তাহলে উনি আমাদের সাথে একটু গল্প করতে পারেন।
তখন হাতে পয়সা কম। এসি তো দুর-অস্ত, একটা ডেসার্ট কুলারও কেনা হয়ে ওঠেনি। মধ্যপ্রদেশের সাংঘাতিক গরমে বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেতো। একবার কথায় কথায় শুক্লাজীকে বৌমণি এমনিই বলেছিলো, ওখানে কোনো দোকানে হাতপাখা পাওয়া গেল না। পরের রবিবার সন্ধ্যায় দোকানে যেতেই শুক্লাজী বললেন, ভাবীজী, এ লিজিয়ে আপকা পাঙ্খা।
- ওমা, কোথায় পেলেন! - বৌমণির মুখে খুশীয়াল হাসি।
- রায়পুর গ্যায়া থা কিরানা সামান লানে। ওঁহিসে লেকে আয়া আপকে লিয়ে।
- কিতনা কিমত ইসকা? বৌমণি জানতে চায়
- কিমত!? নেহী, নেহী ভাবীজী, ইসকা কোই কিমত নেহী, সিরফ্ আপকে লিয়ে লে কে আয়া। শুক্লাজী হাত জোড় করে বলেন।
- আপ বহুত অচ্ছে হ্যায় শুক্লাজী, ম্যায়নে তো এ্যাইসেহী বাতো বাতো মে কাহা থা, ফির ভি আপ ইয়াদ করকে লেকে আয়া! - বৌমণির মিষ্ট হাসিতে বিষ্ময়, কৃতজ্ঞতা, আনন্দ মাখামাখি হয়ে যায়। শুক্লাজীর মুখেও ফোটে চওড়া হাসি। বোঝা যায়, হাতপাখার পয়সা উসুল! অমন আন্তরিকতার মূল্য পয়সায় মেটানো যায়না, সে চেষ্টাও করা উচিত নয়।
কর্মজীবনে কিছু পারিবারিক ভ্রমণে এবং অবসর জীবনে একাকী ভ্রমণে মধ্যপ্রদেশের অনেক জায়গায় গেছি। তার বেশ কিছু প্রচলিত ট্যূরিস্ট সার্কিটের বাইরে। সেইসব জায়গায় ভ্রমণকালে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ভিত্তিতে বলতে পারি মধ্যপ্রদেশের সাধারণ মানুষ সহজ, অতিথিপরায়ন, হাসিখুশী, বিনয়ী, আন্তরিক। ঠকানোর মনোভাব, ওপরচালাকি, দূর্বিনীত আচরণ এখনো অবধি চোখে পড়েনি। এমন সামুদায়িক আচরণ থেকেই কোনো প্রদেশের মানুষের সমষ্টিগত স্বভাববৈশিষ্ঠ্য বোঝা যায়।
যেমন কোচিনে গিয়ে আমার মনে হয়েছে কেরালার মানুষজন বহিরাগতদের সাথে মোটেই স্বচ্ছন্দ নয়। নিজ প্রদেশের মানুষের মধ্যে মিলেজুলে থাকাই তাদের পছন্দ। ভিনদেশী মানুষকে তারা এড়িয়ে চলতে চায়। ট্রেনে আসার সময় খোলামেলা আলাপচারিতা হোলো এক কেরালিয়ান ভদ্রলোকের সাথে। তাঁর গোয়াতে রেস্টুরেন্ট আছে। আড়াই দশক ধরে বেশীর ভাগ সময় ওখানেই থাকেন। তিনি মুদ্রার দুপিঠই দেখেছেন। গোয়ায় বসবাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, নিজে মালায়ালী হয়েও, তিনি আমার পর্যবেক্ষণ, অভিমত অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করলেন।
মুম্বাইয়ের এক ট্রেকিং গ্ৰুপের সাথে ২০১২র ডিসেম্বরে গেছিলাম পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সহ্যাদ্রী রেঞ্জে তিনদিনের এক অনন্যসুন্দর ট্রেকে। আলাং-মাদান-কুলাং। সুউচ্চ, দূর্গম, তিনটি পাহাড়ী কেল্লায় প্রায় পনেরো কিমির ট্রেক। অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে ওদের পরিচালনগত দক্ষতা ও সঙ্গ ভালো লেগেছিল। তাই পরে ওদের আমন্ত্রনে ২০১৪র ডিসেম্বরে গেলাম তিনদিনের বুরহানপুর সফরে। বোহরা বা বুরহানি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থক্ষেত্র বুরহানপুর। তার থেকেই জায়গার নাম। শাহজাহানের শ্বশুরবাড়ীও বুরহানপুরে। মৃত্যুর পর ওখানেই প্রথম কবর দেওয়া হয় মমতাজকে, পরে তা স্থানান্তরিত হয় আগ্ৰার তাজমহলে। বাইশ কিমি দুরে পাহাড়ের টঙে বিশাল আসেরিগড় কেল্লা রহস্যময় সুন্দর।
এছাড়াও বুরহানপুরের বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ। দলনেতা সমীর প্যাটলের এক অফিস কলিগের বাড়ী ওখানে। খবর পেয়ে তার ভাই একদিন দুপুরে আমাদের বারো জনের গোটা দলকে নিমন্ত্রন করলো মধ্যাহ্নভোজনে। আজকাল অনেকেরই আর ভূতের বেগার খাটতে ভালো লাগেনা। বারোজনের বিরাট দলকে খাওয়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু ভাই, তার নবপরিনীতা স্ত্রী, বাবা, মা, ঠাকুমা, মিলিয়ে বাড়ীর সকলের আন্তরিক আপ্যায়ন সহকারে সেদিনের মধ্যাহ্নভোজন, আলাপচারিতার অভিজ্ঞতা, আমার কাছে লেগেছিল সেই ভ্রমনের এক অনন্য প্রাপ্তি।
আমার এক প্রাক্তন অফিস কলিগ সমীর গুপ্তাও মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসের মানুষ। ২০০৫এ আলাপ। সমীর আর ওর স্ত্রী অনুমতির আন্তরিক ব্যবহার আর ওদের বাড়ী গেলে যেরকম আদর যত্ন পেয়েছি তা তুলনাহীন। অনেক নিকট আত্মীয়ের থেকেও উষ্ণতায় ভরা। জামনগরে থাকতে ওদের সাথে গাড়ীতে গেছি চোটিলা, ভূজ, দ্বারকা, গির অরণ্যের মাঝে তূলশীশ্যাম, পোরবন্দরের কাছে ওসাম হিল। নভী মুম্বাইয়ের খারঘরে থাকতে ওরা এসেছিল আমাদের কাছে। একসাথে আমার গাড়িতে গেছি শিরডি, শনি সিংগনাপুর। সেসব ভ্রমনের স্মৃতি অত্যন্ত সুখকর।
সময়ের আড়াই বছর আগে চাকরি জীবনে ইস্তফা দিয়ে ২০১৭ জানুয়ারিতে মাইক টেস্টিং করতে একাকী ভ্রমণে গেছি দু হপ্তার জন্য। একাকী ভ্রমণের মধুর চসকা লেগে এখন তার মেয়াদ বেড়ে হয়েছে দু মাস। মনে হয় যেন তার কমে পোষায় না। সেবার শুরু করেছিলাম উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি থেকে। বাকিটা সময় কেটেছে মধ্যপ্রদেশে। স্টেশন থেকে হোটেল তিন কিমি দুরে। সকালে শেয়ার অটোয় দশ টাকায় গেছিলাম। শহরের রাস্তায় দেখলাম বিভিন্ন রুটে শেয়ার অটো চলছে। দু কিমি মতো দূরত্বের ভাড়া পাঁচ, তার বেশী হলে দশ। এমন সুবিধা পেলে ব্যাকপ্যাকার শৈলীতে কমখরচের একাকী ভ্রমণে অটো রিজার্ভ করে ঘোরার কোনো মানেই হয়না। ঝাঁসী বাসস্ট্যান্ড থেকে ওরছা ২০ কিমি। ওই রুটেও নিয়মিত শেয়ার অটো চলছে। ভাড়া মাত্র ২০ টাকা!
ওরছা নেচার রিজার্ভের বোর্ডে লেখা আছে, গোসদন গেট থেকে বেতয়া ও যামিনী নদীর (বেতয়ার ভিন্ন একটি ধারা) সঙ্গম পাঁচমারিয়া দু কিমি। চারটেয় ঢুকলাম। ফরেষ্ট গার্ড অনন্ত জানতে চায়, বাবুজী, আপ ক্যায়সে জায়েঙ্গে? বলি, প্যায়দল, কিঁউ? সে বলে, লেকিন, আভি তো বহুত দের হো গ্যয়া। পাঁচ বাজে তো গেট বন্ধ করকে ম্যায় চলা যায়ুঙ্গা, আপ বাহার ক্যায়সে নিকলেঙ্গে? আমি বলি, চার কিমি আনে যানে মে লাগে গা পৌনে ঘন্টা, পন্দরো মিনট উধার রুকেঙ্গে, তো আ যায়েঙ্গে পাঁচ কে অন্দর। অনন্ত বলে, বাবুজী, সঙ্গম ইঁহা সে লগভগ ঢাই কিমি, আনে যানে মে হী আপকো ঘন্টা ভর লাগ যায়েগা। বলি, তো ফির? বহুত দুর সে আয়া, ফির কভি আয়েঙ্গে কি নেহী, ক্যয়া পতা? নেহী দেখ পায়ুঙ্গা সঙ্গম?
অনন্ত একটু ভেবে বলে, বাবুজী, আপকো সাইকল চালানা আতা হ্যায়? বলি, হাঁ, কিঁউ? ও বলে, তো আপ মেরা সাইকল লেকে যাইয়ে, নেহী তো আপ পাঁচ বজেকা পহলে নেহী আ পায়েঙ্গে। অনন্ত ওর সাইকেলটা এগিয়ে দেয়। হাতে যেন চাঁদ পাই। সকাল থেকে ওরছাতে প্রায় পাঁচ কিমি হেঁটেছি, কিন্তু তা ছিল আয়েস করে রয়ে সয়ে ঘোরাঘুরি। এমন ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে হুরুমতাল হাঁটাহাঁটি পোষায় না। নির্জন জঙ্গলের বুক চিরে কাঁকুড়ে পথে সাইকেলেও গন্তব্যে পৌঁছতে মিনিট পনেরো লাগলো। ঠিকই বলেছিল অনন্ত, আড়াই কিমিই হবে।
পড়ন্ত বিকেল, যাতায়াতের অসুবিধা হেতু জায়গাটা জনমানবহীন। ওখানে দেখা হল আর এক ফরেষ্ট গার্ড শ্যামের সাথে। অনন্তের মতোই বছর একুশের সদ্য তরুণ। সে বলে, বাবুজী, উধার পত্থরকে উপর এক মগরমছ বৈঠা হ্যায়, দেখিয়েগা? জরুর, বলে, সাইকেলটা গাছে হেলান দিয়ে, হাঁটা দিই ওর সাথে। সুন্দর জঙ্গুলে পথে বাসায় ফেরা পাখির ডাক আর যামিনী নদীর পাথরে নেচে নেচে চলার কলকলানি ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। লালচে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নীলচে সবুজ স্বচ্ছ জলধারা। মাঝে মাঝে সাদা ফেনা। নয়ন মনোহর দৃশ্য। প্রায় পঞ্চাশ ফুট দুরে পাথরের ওপর নিশ্চুপে শুয়ে আছে একটা ছোট কুমীর। নদীর কিনারে একটা ছোট প্রাচীন বাড়ী। শ্যাম জানালো, ওটা বুন্দেলা রাজাদের শিকারগাহ্ বা শিকারের সময় বিশ্রামস্থল।
শ্যাম না বললে হয়তো ওদিকটায় যেতামই না। আসার আগে হাত তুলে নমস্কার করে বিদায় জানায় শ্যাম। কুড়িটা টাকা বখশিশ দিই। লাজুক মুখে নেয়।
পাঁচটার আগেই পৌঁছে যাই গেটে। অনন্তকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, ওকেও কুড়িটা টাকা বখশিশ দিই। প্রথমে না না করে সেও লাজুক হেসে কপালে হাত ঠেকিয়ে নেয়। ওর জন্যে অনেকটা হাঁটা বেঁচে গেল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। টিকমগড় ঝাঁসি হাইওয়ে ধরে হাঁটা দিই ওরছার দিকে। বেতয়া নদীর সেতু পেরিয়ে সোয়া কিমি গেলে পাবো ঝাঁসি যাওয়ার অটো স্ট্যান্ড। ওরছায় দিনের শেষটা অনন্ত আর শ্যাম - দুই সহজ সরল স্থানীয় তরুণ ফরেস্ট গার্ডের বদান্যতায় ভালোই কাটলো।
পরদিন ঝাঁসী থেকে বিদিশা যাওয়ার ট্রেন ছিল সকাল সাড়ে পাঁচটায়। জানুয়ারিতে ঝাঁসির বিখ্যাত কনকনে ঠান্ডায় পৌনে পাঁচটায় হোটেল থেকে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। তখনও রাতের অন্ধকার। চারপাশ শুনশান। একটা খালি অটো আসছিল। হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে বলি - স্টেশন যায়েঙ্গে? সে বলে - রিজার্ভমে যায়েঙ্গে? আমি বলি - ভাই, হম তো একেলে হ্যায়, সামান ভি ইয়ে দো স্যাক্, হো সকে তো শেয়ার মে চলো। রাস্তেমে লে লেনা কোই মিলে তো।
ঐ পথে সকালে শেয়ার অটোয় এসেছি দশ টাকায়। তখন জনা ছয়েক যাত্রী গাঁতিয়ে তোলে ওরা। নির্জন রাস্তায় তখন অন্য কোনো অটো নেই। ভোরের ট্রেন ধরার তাগিদ। সেই সব বুঝে ও যদি তখন একশো টাকাও চাইতো, দিতে হোতো। ও কিন্তু চাইলো মাত্র কুড়ি টাকা, রেগুলার ভাড়ার ওপর দশটি টাকা বেশী। কিছুটা গিয়ে আর দুজনকে পেল। স্টেশনে এসে আমি স্বেচ্ছায় তিরিশ টাকা দিলাম। ও খুশী হয়ে হাত তুলে নমস্কার করে। বহুবার এইসব দেখেশুনে মনে হয়েছে, অল্পেই সন্তুষ্ট মধ্যপ্রদেশের মানুষ। ভিনদেশী বুঝে লুটে নেওয়ার প্রবণতা এখনো অবধি চোখে পড়েনি আমার।
বিদিশাতে এসে প্রথম দিন লোকাল বাসে সাঁচী ঘুরে পরের দিন গেছিলাম উদয়গিরি। বিদিশা থেকে প্রায় আট কিমি দুরে। যাওয়া আসা এবং ওয়েটিং নিয়ে অটো চাইলো চারশো টাকা। অন্যায্যও কিছু নয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ওকে উদয়গিরিতে। কিন্তু আমি তো গেছি কম খরচে একাকী ভ্রমণে। অটো রিজার্ভ করে ঘোরা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাই গঞ্জ বসোদার বাসে দশ টাকায় চলে গেলাম পাঁচ কিমি দুরে, বেতয়া নদীর পারে উদয়গিরি মোড়ে। ওখান থেকে তিন কিমি দুরে উদয়গিরি হেঁটেই চলে গেলাম।
এজেন্সির মাধ্যমে দৈনিক মজুরীতে নিযুক্ত ASI গার্ড মাখন সিং রাজপুতের সাথে খানিক গল্প হলো। ও আমায় তালা খুলে পাথর কেটে তৈরী একটা গুহার মধ্যে কিছু আকর্ষণীয় ভাস্কর্য দেখালো। তারপর আমার সাথে চললো পাহাড়ের ওপরে। এককালে ওখানে একটা পাথরের খাদান ছিল। ও আমায় পাথরে খোদাই করা একটা সৌরঘড়ি দেখালো। খাদানের সুপারভাইজার সময় দেখার জন্য বানিয়েছিল। মাখন একটা কাঠি ধরে কিভাবে সময় দেখতে হয় দেখালো। ছায়া দেখে প্রায় নিঁখুত সময় বললো। ও না বললে জানতেও পারতাম না।
ওকে কুড়িটা টাকা বখশিশ দিতে গেলাম, হাত জোড় করে বলে, নেহী বাবুজী, আপ বঙ্গাল সে ইতনা দুর হমারা ধরোহর দেখনে কে লিয়ে আয়া, আপসে বাতচিত হুয়া, আপসে কুছ জানকারি ভি মিলা, হমে আচ্ছা লাগা। ইসি লিয়ে ইধর কে বারেমে থোড়া বহুত যো হমে মালুম থা, আপকো বতায়া। লেকিন এ মত সমঝিয়ে বাবুজী কি ম্যায়নে আপসে কুছ বখশিশ মিলনেকা উমিদসে ইয়ে সব বতায়া। বলি, আমি তা ভাবিনি মাখন। আমি খুশী হয়ে দিচ্ছি। তখন ও নিল। বলে, আপনি যখন ফিরবেন, নীচে থেকে আওয়াজ দেবেন, আমি গ্ৰামের কোন চেনা লোককে আপনাকে মেন রোডে ছেড়ে দিতে বলবো। বললাম তার দরকার হবেনা, হেঁটে যখন এসেছি, হেঁটেই চলে যাবো।
ফেরার পথে রামলীলা ময়দানের কাছে একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে বিদিশার বাসে উঠলাম। ভাড়া দিতে গেলে কন্ডাকটর নিতে চাইলো না। বললো এত কম দূরত্বে কোনো ভাড়া লাগে না। সে আবার কি! ওখান থেকে বিদিশা বাসস্ট্যান্ড প্রায় চার কিমি। বাসে উঠলে একটা নূন্যতম ভাড়া তো নেওয়াই উচিত। রামলীলা ময়দান থেকে বিদিশা বাসস্ট্যান্ড অটোতে তিরিশ টাকা চাইছিল। জোর করে দশ টাকা দিলাম কন্ডাক্টরকে।
পর দিন আবার গেছিলাম বেতয়া নদীর মাঝে দ্বীপে চরণতীর্থ দেখতে। শেষ বিকেলে রামলীলা ময়দানের কাছে গতকালের সেই দোকানে চা খেয়ে আগের দিনের মতই একটা বাসে উঠে বাস স্ট্যান্ডে এলাম। এদিন দু তিন বার বলতেও কন্ডাকটর ভাড়া নিলো না। স্ট্যান্ডে বাস থামতে নেমে চলে গেলো। অল্পবয়সী ড্রাইভার ছেলেটি জানালো এটাই এখানকার দস্তুর। ওকেই দশটা টাকা দিয়ে বলি, তাহলে তুমিই চা খেয়ো।
কিছুতেই নেবে না। জোর করে হাতে ধরিয়ে দিলাম। সারাদিন বাস চালনার ক্লান্তি মাখা মুখে ফোটে অমলিন হাসি। আবার আভাস পাই ভারতের হৃদয়ের মানুষের সহৃদয় উষ্ণতার। সেই ২০১৭ থেকে হালে ২০২৩ অবধি - মধ্যপ্রদের বেশ কিছু জায়গায় একাকী ভ্রমণে গিয়ে এমন আভাস বারংবার পেয়েছি। তাই একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রদেশ আমার সবথেকে প্রিয় জায়গা। আরো কিছু জায়গায় যাওয়া বাকি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।