আমাদের প্রথম গল্পের শুরু—যখন গল্পের নায়ক—অঙ্গে তার বিজাতীয় পোষাক—পিতৃপুরুষের শূন্য, পরিত্যক্ত ভিটেয় দাঁড়িয়ে। শৈশবে, যুদ্ধের পরেই—হয় পলায়ন, নয় ধর্মান্তর—এই দ্বিধার মুখে তারা সপরিবারে দেশত্যাগ করেছিল। প্রবাসে তার মা আর ভাইকে হারিয়েছে সে। যে দেশকে ফেলে গিয়েছিল, তাকে আর চেনা যায় না। সামনে সমুদ্র, অস্তগামী সূর্যের মধ্যে নিজের সংস্কৃতির রূপক খুঁজে পাওয়া যায় মাত্র।
সে গল্প পরে। আগে পটভূমি।
সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এক ভূখণ্ড ছিল—উর্বর, শ্যামল। বহু কাল আগে, বাইরের দেশ থেকে আরবি ঘোড়ায় চড়ে আসা মুসলিম ঘোড়সওয়াররা সেই দেশ দখল করেছিল। তারা খাওয়ার আগে হাত ধোয়; শুয়োর খায় না, অন্য প্রাণীর মাংসও—বিশেষ কায়দায় না মারলে খায় না; জন্মের পরে খৎনা আর মৃত্যুর পরে গোর দেওয়ার নিয়ম পালন করে; তাদের পুরুষরাও হাতে-পায়ে রঙিন হেনা পরে—যার ফলে অন্যের চোখে তাদের ‘মেয়েলি’ মনে হয়। সব মিলিয়ে—এক অদ্ভুত, বিজাতীয় সংস্কৃতি।
কিন্তু ক্ষমতা তাদেরই হাতে। আদি অধিবাসীরা ক্ষমতা হারিয়েছে। বহিরাগত মুসলমানেরা এসে সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলেছে রীতিমতো। ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত রাজ্যগুলো জয় করে নতুন দেশ গড়েছে। নতুন প্রভুদের হাতে অর্থও অনেক, তারা ফুল-ফল—নানারকমের ব্যাবসা জাঁকিয়ে শুরু করেছে—অনেকের তাতে চোখও টাটাচ্ছে। দখলের প্রাথমিক ঝাঁঝ কেটে যাওয়ার পর শান্তি স্থাপিত হয়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের থেকে জিজিয়া আর মুসলিমদের থেকে জাকাত কর নেওয়া শুরু হয়। সরকারে অন্য ধর্মের লোক নিযুক্ত করা স্বাভাবিক হয়ে যায়। লম্বা শান্তির সময়ে শিল্প-বিজ্ঞান—নানা ক্ষেত্রে চোখ ধাঁধানো কাজকর্ম শুরু হয় এই সময়ে।
এইভাবেই বছর-দশক-শতাব্দ পেরোয়, সমুদ্রে ঢেউ ওঠে-পড়ে, দখলের স্মৃতি ভুলে যায় মানুষ। নতুন প্রজন্মের মুসলমানরা, নিজেদের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি—সব ধরে রেখেও—এই দেশের বাসিন্দাই মনে করতে থাকে নিজেদের। একটা সময় আসে, যখন চারপাশে অন্য সমস্ত দেশ ‘এক ধর্ম’—‘এক সংস্কৃতি’—‘এক লোকাচার’-এর চর্চায় ব্যস্ত, আর এই দেশের জনসংখ্যার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ শুধু মুসলিম তা-ই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও এখানে অবাধ বিচরণ।
কিন্তু সময়ের চাকায় আজ যা ওপরে, কাল তা আবার নীচে নামবেই। সেই পুরোনো বিজয়ের পর অনেক বালি উড়ে গেছে সাহারা থেকে আমাজ়নে। সেই প্রাচীন ক্ষমতার বোল-বোলাও আর নেই। সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে, এক কোণে এক ক্ষুদ্র অংশে—নামেমাত্র জায়গায় এসে ঠেকেছে। এ অঞ্চলে মুসলিমরা আর প্রভু নয়, সংখ্যালঘু। দেশের-অংশ-হয়ে-যাওয়া, কিন্তু নিজেদের-স্বাতন্ত্র্য-ধরে-রাখা এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জমতে শুরু করেছে ক্ষোভ। অনেকটা তার অসূয়া—এদের হাতে অঢেল পয়সা আসলে—কিন্তু বাকি ক্ষোভের পুরোটাই, ওই ‘অন্যরকম’-দের প্রতি, মনের কালো অতল থেকে উঠে আসা অবিশ্বাস।
সেই পালে হাওয়া দেয় অন্য ধর্মের হোতা আর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা। ইতিহাসের পুরোনো অধ্যায়গুলো খুলে বিশেষ অংশ দাগিয়ে যুক্তি দেয় নিজেদের আগ্রাসনের। সেই নামেমাত্র টিকে থাকা মুসলিম দেশটির বিরুদ্ধে শেষমেশ যুদ্ধ ঘোষণা করে চারপাশের ভিনধর্মাবলম্বী দেশগুলো। যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হেরে যায় মুসলিম শাসকের বাহিনী। সংখ্যাগুরুর ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
ঝেড়ে কাশা যাক।
এ গল্পের সময়: পঞ্চদশ শতাব্দী — ১৪৯২ সালের পরবর্তী সময়,
স্থান: গ্রানাডা—অধুনা স্পেন—উমেইদ খিলাফতের শেষ দুর্গ। গল্পের সময়ে এই মুসলিমদের বলা হত মূর (শব্দটি যে খুব কঠিনভাবে সংজ্ঞায়িত, তা নয়; মনে থাকতে পারে—ভেনিসবাসী, কালো চামড়ার ওথেলোকেও মূর বলেছেন শেক্ষপীর)।
পাত্রপাত্রী: কিছু কাল্পনিক, কিছু বেজায়রকম সত্যি।
যে উপদ্বীপের কথা হচ্ছে এখানে—আইবেরিয়ান পেনিন্সুলা, তার নানা নগররাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র গ্রানাডাই, ১৪৯২ অবধি কোনোক্রমে নিজের ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ তকমা বাঁচিয়ে রেখেছিল। মুসলিম রাজত্বের তুঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার প্রসার কিন্তু গল্পকথা নয়। এই গল্পের সময়ের কয়েক শতাব্দী আগে, মুসলিম-শাসিত কর্ডোবায়, বছরে যখন ৬০ হাজারের ওপর পাণ্ডুলিপি লেখা ও পুনর্লিপিকরণ হত, তখন খ্রিস্টান ইউরোপের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিগুলোয় ৬০০ বইও ছিল কিনা সন্দেহ।
মূর (নামান্তরে সারাসেন) আর ইহুদিদের (মনে রাখা দরকার, এই স্পেনেই একসময় গোটা ইউরোপের সবথেকে বড় ইহুদি জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল) দুরবস্থা যে গ্রানাডা-র মালিকানা বদলের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। স্পেনের প্রতিটি নগর-রাষ্ট্রে মেনে নেওয়া হত, “যেখানে মূর, সেখানে সোনা”। চোখ-টাটানো তো ছিলই, ওই ‘বিজাতীয়’ তকমাটিও যন্ত্রণার কারণ। চার্চের প্রচ্ছন্ন উস্কানির ফলে মাঝেমাঝেই উন্মত্ত জনতা চড়াও হত মুসলিমদের ওপর। সমস্ত খ্রিস্টান গুরুই একটা ব্যাপারে একমত ছিলেন—উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা ‘বহিরাগত’ মুসলিমরা যদি স্পেনের বড় অংশ ‘দখল’ করে থাকে, তবে খ্রিস্টানদের পবিত্র কর্তব্য কি তা ‘পুনর্দখল’ করা (রিকনক্যুইস্তা) নয়? দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই পুনর্দখল প্রক্রিয়ার ফলেই, সেই ত্রয়োদশ শতকেই, সারা স্পেন থেকে সরে এসে গ্রানাডায় শেষ ঘাঁটি গেড়েছিল মূর-রা।
রিকনক্যুইস্তা সম্পূর্ণ হল, যখন গ্রানাডার শেষ সুলতান বোয়াবদিলকে যুদ্ধে হারিয়ে অবশেষে বিজয়ী হলেন আরগনের রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ, আর তাঁর স্ত্রী, ক্যাস্তিলের রানী ইসাবেল। ১৪৯২ – ইসাবেলের পতাকা হাতে এই বছরেই অতলান্তিক পাড়ি দিয়েছেন আর এক স্প্যানিয়ার্ড★—ক্রিস্টোফার কলম্বাস—ভারত-বিজয়ের লক্ষ্যে। এই ঘটনা যে ঠিক কতটা যুগান্তকারী—তা তো আর কেউ তখন জানত না—গ্রানাডা-জয়ই ছিল সেই বছরের ব্রেকিং নিউজ। যদিও সেই রঙিন গল্প আমাদের আজকের বিষয় নয়।
রাজা-রানী দু-জনেই ঘোর ক্যাথলিক, কিন্তু গ্রানাডার আত্মসমর্পণের সময় তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন— “একজন মূরকেও ধর্মান্তরিত হতে হবে না”। আমাদের গল্পের নায়ক, ‘আলমানসর’-এর জন্ম এই সময়েই।
দুই বন্ধু- আলি আর আবদুল্লা। আলমানসর-কে জন্ম দিতে গিয়ে আলির স্ত্রী মারা যান। একইরকম সময়ে আবদুল্লা-র স্ত্রী জন্ম দেন এক খুকিকে, নাম তার জ়ুলেইমা। শিশু আলমানসরকে দেখলেই স্ত্রী-র কথা মনে পড়ে আলির—মাথা ঠিক রাখতে পারে না সে। বন্ধুর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের সদ্যোজাত কন্যাটিকে আলির কাছে রেখে আলমানসর-কে নিয়ে বাড়ি আসে আবদুল্লা। এই বদলের কথা জানতে পারে খুব কম লোক। সময়ের সঙ্গে দুই কচি খোকা-খুকুর মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়, আর এই সম্পর্ককে ‘প্রেম’ ঘোষণা করার আগেই আসে রাজকীয় এবং চার্চের নির্দেশ—হয় সমস্ত বিধর্মী খ্রিস্টান হও, নয় দেশ ছাড়ো।
গ্রানাডা-জয়ের পরের কয়েক বছর ঘোষিত খ্রিস্টান নীতি ছিল, ধর্মান্তকরণ করো, তবে ধীরে। মূরদের বোঝাও—শান্তির পথে পরিবর্তন আসুক। কিন্তু কে না জানে, যুগে যুগে এই ঢপ দিয়ে এসেছে ধর্ম-নেড়েরা আর তেতো পাচন গেলার মতো করে সে সব হজমও করেছে ‘চির আশাবাদী’, শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ। ফার্দিনান্দ আর ইসাবেলা, যুদ্ধজয়ের ঠিক পরেই, যে ব্যবস্থা চালু করলেন—তা আসলে ধর্মীয় আদালত। সঙ্গে তাল দিলেন তৎকালীন কার্ডিনাল মেন্ডোজা, অর্থাৎ ক্যাথলিক চার্চ। এ জিনিস পৃথিবীর ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে স্প্যানিশ ইনক্যুইজ়িশন নামে।
এই ইনক্যু... ব্যাপারটা কী? আর কিছুই না, বিধর্মী দমন করো, চলতি আইন লঙ্ঘন না করে। ক্যাথলিক চার্চের যদি মনে হয়—আপনি মনে মনেও বিধর্মী—তাকে অপরাধ সাব্যস্ত করে ক্যাঁক করে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর? আপনার কপাল। মোটা জরিমানা থেকে শুরু করে আপন কল্লাটিও হুজুরের খিদমতে নামিয়ে আসতে হতে পারে (খেয়াল রাখুন--এ সবই, শুধুই খ্রিস্টানদের জন্যে প্রযোজ্য)। লক্ষ্য—এই আইবেরিয়দের (পড়ুন: ধর্মান্তরিত মুসলিম আর ইহুদি) মুক্তকচ্ছ জীবন আর কলুষিত মন পবিত্র জলে ধুয়ে যদি আবার তাদের প্রভুর কল্যাণময় ছায়াতলে নিয়ে আসা যায়।
১৪৯৯ সালে ইনক্যুইজ়িশনের আদালতের সঙ্গে গ্রানাডায় এসে পৌঁছলেন গনগনে গ্রান্ড ইনক্যুইজ়িটর সিসনেরোস। মূরদের সঙ্গে নরমসরম উতুপুতু ব্যবহার তাঁর মোটেই পোষালো না। যিশুর বাণী দিয়ে খ্রিস্টধর্মে ‘উৎসাহিত করা’ আবার কী? বললেন, “এ তো শুয়োরের গলায় মুক্তোর মালা!” শুরু করলেন ঘাড় ধরে ধর্মান্তকরণ। নির্দেশ দিলেন—সব আরবি পাণ্ডুলিপি পোড়াও ধরে ধরে (শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত পাণ্ডুলিপিগুলো ছাড় পেয়েছিল, ভাগ্যিস!)। সরকারি হিসেবে (অর্থাৎ নেহাতই কম), অন্তত ৫০০০ পাণ্ডুলিপি পোড়ানো হয় এই সময়। ছাপা বই নয় কিন্তু! হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি!
মূরদের সবচেয়ে ধাক্কা দিয়েছিল তাদের পবিত্র কোরান পোড়ানোর ঘটনা। বিদ্রোহ হয়, তবে বড় দেরিতে। অতঃপর নির্মম বিদ্রোহ দমন, আর সেই নির্দেশ—হয় ধর্ম, নয় দেশ বদলাও।
যা হওয়ার তা-ই হল, অধিকাংশ নিজের ধর্ম পাল্টালেন, কিছু দেশ ছাড়লেন। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে সিসনেরোস ঘোষণা করলেন—শহরে আর একটিও মুসলিম নেই, আর সমস্ত মসজিদ এখন চার্চ হয়ে গেছে।
আলি দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মূলত নিজের সদ্য-ধর্মান্তরিত মেয়ে জ়ুলেইমার (তার খ্রিস্টান নার্স নাকি এই ধর্মান্তকরণের কাজটি করেছিল) মুখ চেয়ে। আবদুল্লা শুধু যে দেশত্যাগ করলেন তা-ই নয়, একবুক ক্রোধ সঙ্গে নিয়ে গেলেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বন্ধুর প্রতি।
কিন্তু সে সব তো আমাদের আজকের গল্প নয়!
আলমানসর তার বাল্যপ্রেমকে রেখে গিয়েছিল দেশে। আজ এতদিন পরে, এই ভিটেয় দাঁড়িয়ে তার কথাই ভাবছে ছেলেটা। সেই মেয়ে এখন যুবতী, অনেক পাণিপ্রার্থীর মধ্যে থেকে এক খ্রিস্টানকে বাগদানও করে ফেলেছে সে। তা কোনো সমস্যা নয় আলমানসরের মনে—দোষ তো কিছু করেনি—আমাদের নায়ক ছিল কোথায় এত বছর? সমস্যা তো অন্য... জ়ুলেইমা তো খ্রিস্টান! তার প্রতি যত ভালোবাসাই থাক, তার আচরিত ধর্মের প্রতি তো কেবল ঘৃণাই বরাদ্দ আছে আলমানসরের মনে!
আবদুল্লার পরিবারের পুরোনো ভৃত্য হাসান—গ্রানাডার আত্মসমর্পণের সময়, বিপ্লবীদের সঙ্গ নিয়ে পাশের পাহাড়ি অঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিল। এই পোড়ো ভিটেয় তার সঙ্গে দেখা হল আলমানসরের। তাদের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম অতীত আর বর্তমানের নানা খবর। কথায় কথায় আলমানসর হাসানকে বললো, শুনেছি গ্রানাডার বাজারের মধ্যিখানে হিমেনেস (সিসনেরোস) নাকি কোরান পুড়িয়েছে?
হাসান উত্তর দেয়,
“পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত—যেখানে বই পোড়ানো হয়, সেখানে একদিন মানুষও পোড়ানো হবে।”
এর পরে ঠিক কী হয়েছিল—আলমানসর-জ়ুলেইমার মিলন হয়েছিল কিনা; খ্রিস্টধর্মের প্রতি ঘৃণা আলমানসরের কমেছিল, নাকি ইসলামের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছিল; আলমানসর তার মনের মধ্যে চলা আদর্শ-ভালোবাসা আর ধর্মের দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান খুঁজে পেয়েছিল কিনা; গল্পের শেষ আনন্দের, না দুঃখের—সেইসব নিয়ে আরো অনেক কিছু বলাই যেত, কিন্তু সে সবও তো আমাদের আজকের গল্প নয়।
আমরা বরং যাই আরো অনেক শতাব্দী পেরিয়ে, অন্য এক দেশে...
ইউরোপেরই অন্য এক দেশ। সেদেশের মধ্যিখানে বইছে এক নদী আর তাতে এসে মিশেছে অসংখ্য উপনদী। এরা সকলে মিলে যে সবুজ উপত্যকার জন্ম দেয়, তার সঙ্গে গ্রানাডার মিল খুব একটা নেই। তবু, আমাদের গল্পের পরের অংশ, এখানেই।
বহু বহু যুগ আগে, রোমান সৈন্যদের সঙ্গে ওই নদী বেয়ে এসে এই অঞ্চলে থানা গেড়েছিল একদল ইহুদি। গোটা মধ্যযুগ এই ইহুদিদের ইতিহাস সুখের নয়—চার্চের বিষনজর তো নিয়ত ছিলই, প্লেগের সময় তাদের বিরুদ্ধে কুয়োর জল বিষাক্ত করার অভিযোগ ওঠে আর তারপর শুরু হয় তাদের দলে দলে কোতল করা—তারা কখনো এদেশ-কখনো ওদেশে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়। তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। সমস্ত দেশেই তাদের ওপর চাপানো হয়েছিল নানারকমের নিয়মকানুন—বিশেষ ব্যাজ বা পরিধেয় দিয়ে নিজেদের খ্রিস্টানদের থেকে আলাদা দেখানো থেকে শুরু করে, আলাদা কর চাপানো, বিশেষ কিছু ব্যাবসা করতে না পারা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে না পারা, এমন কি আদালতে সাক্ষী দিতে এলে বিশেষ একধরনের লজ্জাজনক শপথ পাঠ করানো [১] (নইলে বিধর্মীর সাক্ষ্যকে কী করে বিশ্বাস করা যায়?)—কী না হয়েছে ইহুদিদের সঙ্গে? শেক্ষপীরকে ডাকুন আবার। শাইলক ঠিক কেন ভিলেন—তা আর বুঝতে অসুবিধে হয় না, তার সংলাপের অন্য অর্থ খুঁজে পায় আজকের দুনিয়া[২] ।
এমনি করেই যায় যদি দিন—তাতে আনন্দ বিশেষ নেই। কিন্তু আলো ফোটে আবার। ফ্রান্সে শুরু হয় বিপ্লব। তার একটি ফলাফল—সেদেশের ৪০ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যক ইহুদিকে সমানাধিকার ও নাগরিকত্ব দেওয়া হল। নেপোলিয়ন সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করার ফলে, সেই মুক্তির হাওয়া বইল ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। সর্বত্র কি সমানভাবে? মোটেই না। আসছি সেই গল্পে, তার আগে আমাদের এই গল্পের নায়কের সঙ্গে কিছু আলাপচারিতা সেরে ফেলা যাক।
আমাদের এই নদীর নামটি রাইন। রাইন-তীরের এক শহর—ডুসেলডর্ফ-এ, এক ইহুদি বংশে জন্মানো নিতান্ত অপোগণ্ড এক বালক—না তার ব্যাবসায়ে মতি, না ওকালতিতে মন। কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে তার শহর ছিল নেপোলিয়নের রাজত্বাধীন। ছেলের বয়স যখন আঠেরো, তার বাপ ব্যাবসা ডুবিয়ে, নিজের ভাই—অর্থাৎ ছেলেটির কাকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাতে কী? ছেলে চৌখশ। প্রতিপত্তিশালী কাকার মেয়ে—নাম এমিলি (আমেলি)—তার একতরফা প্রেমে পড়ে ছোকরা। যৌবনের ফরাসী রাজত্ব আর তার ‘স্বাধীনতা’র প্রভাব সারাজীবন ছিল ছেলেটির জীবনে। এতটাই, যে, জীবনে মোট খানদশেক ডুয়েল-এ অংশ নিয়েছিল এই আপাত শান্ত কবি-কবি ছেলে। যা হোক, এইসব যৌবনের আচার-অনুষ্ঠান চলাকালীন, ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ন পরাজিত হলেন, আর আমাদের নায়কের জন্মভূমি—রাইনল্যান্ড—প্রাশিয়া-সাম্রাজ্যের দখলে গেল। ভিয়েনা কংগ্রেসে, নেপোলিয়ন-পরবর্তী ইউরোপের ভাগ্যনির্ধারণের সময়, ইয়োহান স্মিট নামের এক ব্যক্তি—ইহুদি-অধিকারের বয়ানে মাত্র একটি শব্দের পরিবর্তন করে গুচ্ছের জার্মান রাজ্যকে আবার ইহুদি-পৃথকীকরণের সুযোগ করে দিলেন।
সমাজের ঠিক কোন অংশে ইহুদি-বিদ্বেষ কাজ করছিল? অশিক্ষিত জনগড্ডলে? চাষাভুষোদের মধ্যে? শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্তরা নিশ্চয়ই এসব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন? জ্যাকব ফ্রেড্রিক ফ্রাইস নামক এক কান্ট-পদানুসরণকারী দার্শনিক ১৮১৬ সালে একটি নিবন্ধ রচনা করেন। “ইহুদিদের কারণে জার্মানরা আজ বিপন্ন” (‘Ueber die Gefährdung des Wohlstandes und des Charakters der Deutschen durch die Juden’)—এই ছিল তার মূল কথা। সেখানে তিনি লেখেন, কীভাবে জার্মানদের থেকে আলাদা দেখাতে ইহুদিদের বিশেষ পোষাক পরা উচিত; কীভাবে ‘ওদের’ কারণেই সমাজে টাকা বাড়ছে, আর তার ফলে মূল্যবোধের ঘচাঘচ অবক্ষয় হচ্ছে; কেন ওদের ঝাড়েবংশে জার্মান সমাজ থেকে নির্মূল করা উচিত। এই লেখা, পরবর্তী প্যামফ্লেট আর নিবন্ধ সংগ্রহে তিনি ডাক দেন জার্মান যুবসমাজকে ‘জেগে ওঠার জন্যে’, আর নির্দেশ দেন, যেন—ইহুদিদের, জার্মান জনজীবন থেকে পুরো অদৃশ্য করে দেওয়া হয়।
ইনি লোক ফেলনা ছিলেন না, অন্তত প্রভাবের দিক থেকে দেখলে। নেপোলিয়নকে হারিয়ে জার্মান দেশভক্তির পারদ তখন তুঙ্গে। ছাত্রসঙ্ঘ বার্জ়নশাফ্ট তার ক’দিন আগে থেকেই স্লোগান তুলেছে ‘স্বদেশ, সম্মান, স্বাধীনতা’। ফ্রাইস এদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁর বিলি করা প্যাম্ফলেট সেইসব আঁচের সঙ্গে ইহুদি-বিদ্বেষেও হাওয়া দিল। ফ্রাইস কোনোভাবেই ছাত্র নন কিন্তু—তবে কবে আর ছাত্ররাই ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করেছিল, বৃহৎ পরিসরে! সে যাক, এইসব হাঁকাহাঁকির ফলে ১৮১৭য়, শ’পাঁচেক প্রোটেস্টান্ট ছাত্র মিলে ভার্টবুর্গ (ওয়ার্টবার্গ) শহরের কেল্লায় উৎসবই করে ফেললেন একখান। মার্টিন লুথারকে মনে আছে? সেই যে, এই উৎসবের ঠিক তিনশো বছর আগে, ক্যাথলিক চার্চের ক্রমবর্দ্ধমান বিলাস-ব্যসনের সমালোচনা করে (৯৫টি পয়েন্ট সম্বলিত একখানা বোমা) যিনি চার্চের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, আর খ্রিস্টান চার্চে প্রথম ভাঙন ধ’রে প্রোটেস্টান্ট সংশোধনী তৈরি হয় যাঁর জন্যে। চার্চ থেকে ‘বহিষ্কৃত’ হয়ে লুথার এসে এই কেল্লায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর বাইবেলের অনুবাদ আধুনিক জার্মান-ভাষার ভিতও শক্ত করে। সব মিলিয়ে, প্রবল জাতীয়তাবাদী রসে চোবানো সেই উৎসবে অন্যান্য অনেক স্লোগানের মধ্যে এমন দাবিও উঠলো, যে, কোনো ‘বহিরাগত’ (পড়ুন ফরাসী বা ইহুদি) ছাত্রকে কোনো জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশাধিকার দেবে না। ব্যতিক্রম একমাত্র হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, কারণ তারা তো পুরাই ‘ইহুদি’।
ঠিক কী করে প্রোটেস্টান্ট, জার্মান জাতীয়তাবাদ মিশে যায় ইহুদি-বিদ্বেষের সঙ্গে? ইহুদি-প্রশ্নে খ্রিস্টানদের কী করা উচিত—সমাধান দিচ্ছেন মার্টিন লুথার, Von den Jüden und iren Lügen (ইহুদি ও তাদের মিথ্যাচার) নামের বইয়ে:
“ওদের স্কুল আর সিনাগগ-গুলো জ্বালিয়ে দাও, অন্তত ঈশ্বরের কাছে নিজেদের খ্রিস্টান প্রমাণ করার জন্যে…, ওদের বাড়িঘর দখল করো, ধ্বংস করো… সমস্ত প্রার্থনার বই আর পৌত্তলিকতা, মিথ্যা, গালিগালাজ আর অধার্মিক কথায় ভর্তি তালমুদ নিয়ে নাও ওদের থেকে… ওদের র্যাবাইরা যদি শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে, অঙ্গ বা জীবনহানির ভয় দেখাও… রাস্তা-ঘাটে ইহুদিদের জন্যে কোনো সুরক্ষার দরকার নেই, ওদের এদেশের জমিতে কী কাজ?... ওদের টাকাপয়সা, সোনাদানা নিয়ে নাও, মহাজনবৃত্তি যেন ওরা আর না করতে পারে… ওদের শক্তপোক্ত যুবক-যুবতীদের হাতে কোদাল, কুড়ুল, কাস্তে ধরাও—যাতে ঘাম ঝরিয়ে ওরা নিজেদের পেট চালাতে পারে… যদি ওদের হাতে আমাদের প্রাণহানির ভয় হয়, তবে ফ্রান্স, স্পেন, বোহেমিয়ার মতো দেশগুলো যে স্বাভাবিক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে নিজেদের দেশ থেকে ওদের বিতাড়িত করেছে, সেই বুদ্ধির পরিচয় আমাদেরও দিতে হবে…”
ক্যাথলিক চার্চের হিরো—ইংরেজ—থমাস মোর ছিলেন লুথারের সবচেয়ে বড় সমালোচক। ইংল্যান্ড-অধীশ্বরের নির্দেশ না মেনে তিনি আবার শহীদ হয়েছিলেন, পরে সন্ত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্যাথলিক-বিরোধীদের অত্যাচারও করিয়েছেন। তাঁর মতে, তৎকালীন স্পেন ছিল “অবিশ্বাসী ইহুদি আর সদ্য-ধর্মান্তরিত মূর”-দের দেশ।
ইহুদি-বিদ্বেষের ব্যাপারে ছোটকত্তা-বড়কত্তা তফাত ছিল না। যেন এইসব মিলিত আপত্তির ফলেই, সপ্তদশ শতকের শুরুতে স্পেনের রাজা ফিলিপ, ৩ লক্ষ ধর্মান্তরিত ইহুদি ও মূরকে—যাদের ‘মোরিস্কো’ নামে চেনে ইতিহাস—দেশ থেকে বিতাড়ন করেন। হ্যাঁ, আবার। খ্রিস্টধর্মগ্রহণও তাদের বাঁচাতে পারেনি। অবশেষে ‘পরিচ্ছন্ন’ হল স্পেন। ‘স্বচ্ছ’ হল—বলা যায় কি?
গল্পে ফিরি—সেই যে ছাত্রসংগঠনের করা ‘ভার্টবুর্গ উৎসব’, তাতে, উৎসাহের আতিশয্যে, পোড়ানো হল বেশ কিছু এমন বইয়ের ‘নকল’ কপি, যাদের ঐক্যবদ্ধ জার্মানির স্বপ্নের অন্তরায় মনে করা হত।
এই ঘৃণার উদ্গার চাপা ছিল না। সবে সারা ইউরোপে ধীরে ধীরে ইহুদিদের ‘নাগরিক’ মনে করা শুরু হয়েছে, এখনো সেই অনভ্যাসের ফোঁটা তীব্র চড়চড় করছে সম্মিলিত ইউরোপীয় কপালে, রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে আছে আলঙ্কারিক বারুদ। বই পোড়ানো-উৎসবের ঠিক দু-বছর পর, বার্জ়নশাফ্ট-সদস্য কার্ল স্যান্ড, রক্ষণশীল লেখক আগুস্ত ভন কৎজ়বুকে হত্যা করেন, বাভারিয়ায় ইহুদি পেটানো শুরু হয় (হেপ-হেপ দাঙ্গা), ছড়িয়ে পড়ে ডেনমার্ক আর লাটভিয়ায়, বার্জ়নশাফ্ট-কে নিষিদ্ধ করা হয়, আর এই সবের মধ্যেই, আমাদের নায়ক এসে পৌঁছন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইন পড়তে।
ছোকরা তেজি উদারপন্থী। ওদিকে কাকার মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু, এদিকে ইহুদি নিয়মনিষ্ঠায় বিন্দুমাত্র বিশ্বাস না রেখেও, নিজের ধর্মের ওপর নিপীড়নের ইতিহাসের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আইন পোষায় না, সাহিত্য আর ইতিহাস টানে। আর টানে এমিলি। কবি-খ্যাতি ছড়াতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিখে ফেলে দুইখান ট্র্যাজেডি—গ্যাদগেদে, যৌবনের উত্তাল অথচ উদ্বায়ী রোমান্সে ভরা, বাস্তব-বিবর্জিত। প্রথমটার নাম ‘আলমানসর’। বিষয়, ইহুদি নয়, মুসলিম নিপীড়ন। ‘এক দুজে কে লিয়ে’-র মত একখান প্যাতপেতে গল্প, তারই এক চরিত্র হাসানের মুখে বসায় সেই সংলাপ, যা বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক উদ্ধৃত বাক্যগুলোর একটা:
“Das war ein Vorspiel nur, dort wo man Bücher Verbrennt, verbrennt man auch am Ende Menschen.”
(“এ তো সবে ভূমিকা ছিল—যেখানে বই পোড়ানো হয়, সেখানে একদিন মানুষও পোড়ানো হবে”)
কবি হাইনরিশ হাইনা-র জীবনের বাকি দিকগুলো নিয়ে আমরা গপ্পো চালিয়ে যেতেই পারতাম, আলোচনা করতে পারতাম তাঁর চরিত্রের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে, যা তাঁকে কখনোই কোনো দল-জাতি-ধর্মের প্রতি পুরোপুরি অনুগত করতে পারেনি। নিদেন আমরা সেই গল্পও করতে পারতাম—যখন গটিঞ্জেনে পড়াকালীন, ইহুদি-বিদ্বেষের স্বীকার হয়ে মাথার ওপর ছাদ হারানো হাইনরিখ জানতে পারে: তার প্রেম—এমিলি—অন্যের বাগদত্তা। এ গল্পে অ্যাকশনও থাকতো প্রচুর—ডুয়েল, কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার।
কিন্তু, সে সব তো আমাদের গল্প নয়।
আমরা বরং এক শতাব্দী এগিয়ে যাই?
আমাদের এই গল্পের নায়কের জন্ম বর্তমান পোল্যান্ডে—প্রোটেস্টান্ট স্কুলে পড়াশুনো করা, প্রথমে দর্শন আর ভাষার ইতিহাস, পরে চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র এই উদ্যোগী ভ্রমণপিপাসু লোকটির সঙ্গে আমাদের যখন দেখা, ততদিনে তার অতলান্তিক-পারের শিকাগো ঘুরে আসা হয়ে গেছে, দুনিয়াজুড়ে সমকামিতার স্বরূপ নিয়ে চিন্তা-লেখাপড়া করে সে নিজের কিছু থিয়োরিও তৈরি করে ফেলেছে। নিজের চিকিৎসাধীন সমকামী রোগীদের আত্মহত্যায় লোকটি একটাই চিন্তাগ্রস্ত, যে, সব ছেড়ে সেই বিষয়ে পড়াশুনোই তার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছে। একদিকে ইংল্যান্ডে অস্কার ওয়াইল্ডের বিচার চলছে—“নোংরামো” করার অপরাধে, অন্যদিকে আমাদের নায়কের চিকিৎসাধীন এক অবসাদগ্রস্ত যুবক সেনা-অফিসার নিজের সুইসাইড নোটে লিখে গেছে, যে, অন্য পুরুষদের ভালোলাগা, আর সে কথা নিজের বাবা-মাকেও বলতে না পারার গ্লানি আর সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহননের পথ বেছে নিল। আমাদের গল্পের নায়ক তখন আঠাশ বছরের তরুণ।
১৮৯৭ সালে সে তৈরি করলো ‘বিজ্ঞানধর্মী ও মানবতাবাদী কমিটি’। লক্ষ্য, সমকামিতা ও অন্যান্য সামাজিক ট্যাবু নিয়ে জড়তা আর ভুল ধারণার অবসান। এর অনেক আগে, সে যখন ছাত্র মাত্র, জার্মানিতে পাশ হয় প্যারাগ্রাফ ১৭৫—দুই পুরুষের মধ্যে যৌনতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ (এই আইন রদ করা হয়েছে এই ১৯৯৪ সালে—এই লেখার লেখকের বয়স যখন ১০)। তার তৈরি কমিটি পরিচালন, জনসংযোগ, ডাক্তারি—ব্যস্ত খোকা ছিল আমাদের এই নায়ক। তবে, এ তো সবে শুরু।
গত শতাব্দীর মাঝখানে আমেরিকায় ভার্জিনিয়া জনসন আর উইলিয়ম মাস্টার্স নিজেরাই উদ্যোগ আর যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে যৌনতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন, পরে যা বিশ্ববিখ্যাত হয়। তার আগে যৌনতা নিয়ে গবেষণা হয়নি—তা কিন্তু নয়। ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত বার্লিনে একখান ‘যৌনতা-বিষয়ক গবেষণা-প্রতিষ্ঠান’ (Institut für Sexualwissenschaft) ছিল। লিঙ্গ, যৌনতা, সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা—সবই ছিল তাদের গবেষণার বিষয়-তালিকায়। সাধারণ্যের জন্যে সেখানে ব্যবস্থা ছিল মদের নেশা ছাড়ানো, গর্ভনিরোধ, বৈবাহিক ও যৌন-সমস্যার কাউন্সেলিং, যৌনতা-বাহিত রোগের চিকিৎসা, যৌনতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে শিক্ষা দেওয়া—এক কথায় সমাজে যা কিছু নিয়ে গুজগুজ চলে, নিজের কপাল পোড়ার আগে অবধি—সেইসব দরকারি, কিন্তু ‘লোকে কী বলবে’ বিষয়ের। এসব কেবল দেখনদারি ছিল না কিন্তু—প্রতিষ্ঠানের প্রথম বছরেই, সাড়ে তিন হাজার মানুষ মোট ১৮ হাজারবার পরামর্শ নিতে আসেন এখানে। সঙ্গে একখান মিউজিয়ামও ছিল, যুগপৎ শিক্ষা আর বিনোদনের কথা মাথায় রেখে তৈরি। আর ছিল বিরাট এক লাইব্রেরি—গবেষণাপত্র, বই-দুয়েরই। অন্য দেশের নেতারাও এসে দেখে যেতেন এই আশ্চর্য বিল্ডিং। ম্যাগনাস হির্শফেল্ড—আমাদের এই গল্পের হিরো—ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত এই ইন্সটিটিউট খোলা ছিল।
ম্যাগনাসের জীবন ঘটনাবহুল, শিক্ষনীয়, মনে রাখার মতো। নিজেই নিজের চরিত্রে সিনেমায় অভিনয় থেকে শুরু করে নিজের মতাদর্শের জন্যে রাস্তায় মার খাওয়া— রোমহর্ষক গল্পের অভাব নেই হির্শফেল্ডের জীবনে। কিন্তু তা তো আমাদের গল্প নয়।
আমাদের মূল গল্প শুরু ১৯৩৩ সালের ৮ই এপ্রিল, যেদিন ডয়েচে শ্তুডেন্টেনশাফ্ট (জার্মান ছাত্রসংগঠন) দেশজোড়া ‘অ-জার্মান মূল্যবোধ’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দেয়। মানুষ তো বটেই, সেই সংগ্রাম ছিল বইপত্র, লেখালেখি, শিল্প—সব কিছুর বিরুদ্ধে। আসলে মতামতের বিরুদ্ধে। দেশ ‘পরিচ্ছন্ন’ করার তাগিদে ইহুদি, আধা-ইহুদি, কম্যুনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, অ্যানার্কিস্ট, লিবারাল, শান্তিকামী, যৌনতাবিশারদ—সবার কাজ ধ্বংস করার ডাক আসে। মার্টিন লুথারের ৯৫ পয়েন্ট থিসিসের নামের নকলে ‘বারোটি থিসিস’ প্রকাশ করে সংগঠন। পোপের নির্দেশ যেভাবে পোড়ানো হয়েছিল, আর ভার্টবুর্গ উৎসবে যেভাবে প্রতিকী বই পোড়ানো হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা টেনে এই সব ‘জার্মান আত্মার বিরোধী’ বই পোড়ানোকে পবিত্র কর্তব্য স্থির করা হয়।
৬ই মে ম্যাগনাসের প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়। ইহুদি, সমকামী, সর্বোপরি যৌনতা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলা ম্যাগনাস সেদিন সেখানে থাকলে মারা যেতেন। যাননি। বদলে, অন্তত ২০ হাজার বই, পত্রিকা রাস্তায় টেনে এনে ফেলে পোড়ানো হয়। ডোরা রিখটারের তখন অপারেশন চলছিল সেখানে—প্রথম রূপান্তরকামী মহিলা, যাঁর সেক্স-রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি হয়। তিনি সম্ভবত সেই আক্রমণে নিহত হন। ১০ তারিখ অপেরা-স্কোয়ারে পোড়ানো বইয়ের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়ায়। গোয়েবল্সের উল্লসিত কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে যায় রেডিওয়—ইহুদি আর বুদ্ধিজীবিদের নোংরা সাফ করে জার্মানি এখন ‘পরিচ্ছন্ন’। কেউ ছাড়া পাননি — হেলেন কেলার, এরিখ মারিয়া রেমার্কে, হেমিংওয়ে, মার্ক্স, এঙ্গেলস, হাক্সলি, জেমস জয়েস, গোর্কি, তলস্তয়, বেবেল, কাফকা, ওয়েলস…
যা পোড়ানো হয়নি, তা এরপর ব্যান হয়েছিল। আমরা সেই আলোচনা করবো না। ম্যাগনাসের পিছু ধাওয়া করে ফ্রান্সেও যাবো না। গোয়েবল্সের সঙ্গ নিয়ে তার দীক্ষাগুরু হিটলারচন্দ্রের সঙ্গে দেখাও করবো না। হালকা হলেও, আবছা হলেও, এর পরবর্তী নরমেধ যজ্ঞের ধোঁয়ার গন্ধ এই শতাব্দী ছাপিয়েও আমাদের নাকে পৌঁছয়।
আমরা আপাতত মনে রাখি, সেইসব অগ্নিকুণ্ডে যে সমস্ত লেখক-কবির বই পোড়ানো হয়েছিল, তাতে হাইনরিশ হাইনা-ও ছিলেন।
আজ সেই অপেরা স্কোয়ারে মিশা উলম্যানের বানানো স্মারক রাখা রয়েছে। ফাঁকা লাইব্রেরি। শুধু শূন্য তাক দেখা যায় কাচের মধ্য দিয়ে। কয়েক ফুট দূরের ফলকে লেখা সেই স্মারকের নাম—‘লাইব্রেরি’, সঙ্গে হাসানের সেই উক্তি—“যেখানে বই পোড়ানো হয়, একদিন মানুষও পোড়ানো হবে”।
আমাদের শেষ গল্প আরও এক শতাব্দী পরে। গল্প পরে, আগে পটভূমি।
সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এক ভূখণ্ড ছিল—উর্বর, শ্যামল। বহু কাল আগে, বাইরের দেশ থেকে আরবি ঘোড়ায় চড়ে আসা মুসলিম ঘোড়সওয়াররা সেই দেশ দখল করেছিল। তারা খাওয়ার আগে হাত ধোয়; শুয়োর খায় না, অন্য প্রাণীর মাংসও—বিশেষ কায়দায় না মারলে খায় না; জন্মের পরে খৎনা আর মৃত্যুর পরে গোর দেওয়ার নিয়ম পালন করে…
নাহ্, মশকরা করবো না। ভারতের কথা হচ্ছে। আজকের ভারত।
রাম নবমীর মিছিল হচ্ছে। অস্ত্র হাতে। পুরোনো ক্ষত খুঁড়ে উত্তেজনা বাড়ানো হচ্ছে। সব জানি আমরা। দেখছি। বিরুদ্ধ মতাবলম্বীকে জেলে পোরা হচ্ছে, চুপচাপ লুকিয়ে পড়ছে সংখ্যালঘু। কতকিছুই তো আমরা জানি। বিজ্ঞান, ইতিহাস—নতুন করে লেখা হচ্ছে। ‘পরিচ্ছন্নতা’র ডাক উঠছে দিকে দিকে। হিন্দুরা ‘বিপন্ন’ বোধ করছে, বুদ্ধিজীবিরা ভীত।
এরই মধ্যে বিহারে, ২০২৩-এর বিহারে, মাদ্রাসা পুড়িয়েছে রাম নবমীর মিছিল করা ১ হাজারের ওপর হিন্দু। সাড়ে চার হাজার বই পুড়িয়েছে। ঠিক দুশো বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আলমানসর’, তার প্যানপেনে গল্প আর গায়ে কাঁটা দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে।
ইতিহাস নাকি বোঝা যায় না, ইতিহাস নাকি বড় দুর্জ্ঞেয়?
কে জানে বাবা…
[১] “একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে শুয়োরের চামড়ার উপর দাঁড়িয়ে, মাস্টার মোজেসের পাঁচটি বই সামনে নিয়ে এবং ডান হাত কব্জি পর্যন্ত বইয়ের উপর রেখে, যিনি শপথ-অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন, উদ্দিষ্ট ইহুদিটি তাঁর কথা শুনে পুনরাবৃত্তি করবে:
তোমার বিরুদ্ধে যে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযোগ এসেছে, তুমি তার সম্পর্কে কিচ্ছু জানো না এবং সেটি না তোমার কাছে আছে, না কখনো ছিল। তোমার কোনো সিন্দুকে সেটি নেই, মাটিতে পুঁতে দাওনি, তালাবন্ধ করেও রাখোনি।
তা যদি না হয়, তবে, যে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন স্বর্গ, পৃথিবী, উপত্যকা, পাহাড়, কাঠ, গাছ ও ঘাস, সেই ঈশ্বরের দিব্যি; যে আইন ঈশ্বরসৃষ্ট, তাঁর নিজের হাতে লেখা এবং যা তিনি সাইনাই পর্বতে মোজেসকে দিয়েছিলেন, সেই আইনের দিব্যি এবং মোজেসের পাঁচটি বইয়ের দিব্যি, যেন ভবিষ্যতে নিজের কাপড়চোপড় নোংরা না করে তুমি খাবারের এক দলাও গলাধঃকরণ করতে না পারো, ঠিক যেমন হয়েছিল ব্যাবিলনের রাজার।
সদোম ও গমোরা শহরের উপর দিয়ে যে গন্ধক এবং পিচ প্রবাহিত হয়েছিল, সেই একই গন্ধক ঢেকেছিল ব্যাবিলনকে; তার দুশো গুণ গন্ধক ও পিচ তোমার ঘাড়-মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হোক এবং যেভাবে ধরিত্রী দ্বিধা হয়ে ডেথান এবং আবিরমকে গিলে ফেলেছিলেন, সেভাবে তোমাকেও গিলে ফেলুক।… তোমার সেইরকম কুষ্ঠরোগ হোক, যেমন হয়েছিল নামন ও গেহজ়াইয়ের, এবং ইস্রায়েলীরা মিশরের যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পালিয়েছিল, তা তোমার ওপর বর্ষিত হোক। তোমার ধর্মের লোক যেভাবে ভগবান যিশু খ্রিস্টকে অপমান ও নির্যাতন করেছিল এবং বলেছিল, “তাঁর রক্তপাতের দায় যেন আমাদের ও আমাদের সন্তানদের ওপর বর্তায়।”, সেইরকম অবিরাম রক্তপাত হোক তোমার শরীর থেকে…।”
— ফ্রাঙ্কফুর্ট কোর্টের ইহুদি শপথ, ১৩৯২
[২]“I will buy with you, sell with you, talk with you, walk with you, and so following, but I will not eat with you, drink with you, nor pray with you.”
অথবা,
“… He hath disgraced me, and hindered me half a million; laughed at my losses, mocked at my gains, scorned my nation, thwarted my bargains, cooled my friends, heated mine enemies, and what’s his reason? I am a Jew. Hath not a Jew eyes? Hath not a Jew hands, organs, dimensions, senses, affections, passions? Fed with the same food, hurt with the same weapons, subject to the same diseases, healed by the same means, warmed and cooled by the same winter and summer, as a Christian is? If you prick us, do we not bleed? If you tickle us, do we not laugh? If you poison us, do we not die? And if you wrong us, shall we not revenge?... ”
★ : খুব বাজে ভুল। ভাগ্যিস হীরেনবাবুর চোখে পড়লো! কলম্বাস স্প্যানিয়ার্ড ছিলেন না, ইতালিয়ান ছিলেন।
অন্যান্য লিঙ্ক: এক, দুই, তিন