অভিজিত মজুমদারের লেখায় আর অর্চন মুখার্জির আলোকচিত্রে তৃতীয় পরিসরের মানুষের জমাট নৈঃশব্দের এই উদযাপন বাংলা প্রকাশনার মূল ধারায় বিরল, হয়তো পথিকৃৎও। ২০১৮-য় প্রকাশিত বইটি নিয়ে লিখলেন প্রতিভা সরকার।
অনেক বয়স অব্দি এসব আমি কিছুই জানতাম না, যেমন এখনও অসংখ্য মানুষ জানে না অথবা ভুল জানে। জানতাম না মনের ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারে আরেকটা মন, শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর। লুকিয়ে থাকা মন আর শরীরের কথা বলা ভীষণ অন্যায়। এতো অন্যায় যে সমাজ আর তোমার চারদিকে ঘিরে থাকা মানুষ, রক্তের সম্বন্ধ, বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী, সবাই তোমাকে নখে দাঁতে ছিঁড়ে ফেলবে। আসন্ন করে তুলবে তোমার শরীর ও মনের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। ফলে আর যাই হও, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ো না, মনে মুখে যেন থাকে সমুদ্র-যোজন ফারাক। তুমি আকুল হয়ে কাঁদতে পার, কিন্তু সে কান্না যেন কেউ না শুনতে পায়!
কিন্তু সে কোন শরীর, কোন মনই বা? সে এক মিঠে স্বভাবের নরম মেয়ে, আমার স্নেহের আধার, বন্ধুও বটে, স্থির প্রত্যয়ে আমায় বলেছিল, মারতে পারে, কিন্তু মরবে শুধু বাইরেটা, বাইরের মন, বাইরের শরীর। আসলে আমি যা, আমার আসল সত্তা, তাকে কেড়ে নেয় কার সাধ্যি ! আমি মনেপ্রাণে নারী হয়ে জন্মেছি, মরব যখন তখনও একজন নারীর মৃত্যু হবে।
তার সঙ্গে অনেক কথা, তার কাছ থেকে এই সংক্রান্ত অনেক বই পড়ার জন্য পাওয়া, তার সূত্রে অনেক সমমনা বন্ধু লাভ, এইসবই আমাকে শিখিয়েছিল তথাকথিত নারী পুরুষের বাইরে তৃতীয় পরিসরকে নিয়ে ভাবতে। আমার সুপ্ত দৃষ্টি আর অনুভব উন্মোচনের জন্য আজও তার কাছে বড় কৃতজ্ঞ হয়ে আছি।
আর কৃতজ্ঞতা গুরুচন্ডা৯ প্রকাশনাকে। এই বৃহত বঙ্গে তারা এক বিরল ঐতিহ্যের অনুসারী। কে জানে, বোধহয় তারাই পথিকৃৎ। তাত্ত্বিক লেখা, ক্ষেত্র সমীক্ষা ইত্যাদির বাইরে, লেখায় ছবিতে মানুষগুলোকে সুযোগ করে দেওয়া অকুন্ঠ আত্মপ্রকাশের, এটা বাংলা প্রকাশনা জগতে আর হয়েছে কি? হ্যাঁ এবং না-কে দুধারের পাল্লায় চাপিয়ে মাঝখানে শিব সওদাগরের মতো হাঁ করে বসে থাকি, হাতে থাকে নৈশঃব্দের পত্রগুচ্ছ। কী তার অঙ্গসৌষ্ঠব, কী তার ছবি আর লেখা! অব্যর্থ আর অমোঘ শব্দ, শব্দের পর শব্দগুচ্ছ যা জন্ম নিতে পারে কেবল গভীর নৈঃশব্দের মধ্যে আর তাকে রঙে রূপে সাকার করা ছবির পর ছবি। এই যুগলবন্দীর পেছনে যাদের মনন আর শিল্পচেতনা তারা আমার থেকে তো বটেই অনেকের থেকেই অনেক বড় মাপের সৃষ্টিশীল মানুষ, একথা স্বীকারে আমার কোনো লজ্জা নেই। অর্চন মুখার্জির তোলা সব অসাধারণ ফোটোগ্রাফ বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়ে তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তা যে এমনি এমনি নয়, নৈশঃব্দের শব্দগুচ্ছে পাতার পর পাতায় তার অকাট্য প্রমাণ। ভাবনা পরিকল্পনাও তার। আর কথা? নিচের উদ্ধৃতি টুকু পড়ুন। তৃতীয় পরিসরের মানুষের গোটা জীবন কতো অল্প কথায়, কী অপরিসীম ব্যঞ্জনায় বিধৃত হয়ে আছে অভিজিত মজুমদারের কলমে !!
" লেখার পাতাগুলো হারিয়ে গিয়েছিল বহুবছর আগেই, ঝুলধরা বইয়ের র্যাকের পোকাধরা কোণায় / হারায়নি মায়ের মারের স্মৃতিটা!/
ঝরা পাতার বাজারে কিশলয়ের দিনগুলো তার সকল উপেক্ষা নিয়ে পড়ে আছে /
বইয়ের ফাঁকে চটকে যাওয়া শুকনো গোলাপ, বাবুল কাকুর অবাধ্য হাত, ডানাভাঙা প্রজাপতি উদাসীন একলা ঘরের কোণ/
এখনও কোনো নতুন গোগোল সব ঠাট্টা সহ্য করে গলির মোড়ে এক্কাদোক্কা খেলে।"
ভাগ্যের কথা এখন অনেক মা-ই প্রহার সংবরণ করেন। তাদের সংখ্যা আরও বাড়ুক। কারণ মায়ের সন্তানঘাতী হওয়া পশুসমাজেও বিরল। প্রকৃতির দেওয়া প্রবণতার কারণে পক্ষপুটের আশ্রয় যেন বধ্যভূমিতে না পরিবর্তিত হয়। কিছুটা পড়াশুনো, একটু মেলামেশা, কিঞ্চিত দরদী দৃষ্টি এই সমস্তই পারে মানুষের মধ্যে এই শুভবোধটি জাগিয়ে তুলতে। আর তাতে ব্যাপক সহায়তা করে নৈশঃব্দের পত্রগুচ্ছের মতো বই।
জুন মাস গর্বের মাস, রামধনু-রঙের সময়, প্রাইড মান্থ, মানুষকে মানুষ ভাবার কাল। প্রয়াত ডাক্তারবাবু স্মরজিত জানার ডাকে তৃতীয় পরিসরের এক সমাবেশে উপস্থিত থাকবার সৌভাগ্য হয়েছিল কয়েক বছর আগের এই সময়ে। তাতে নারীস্বভাব পুরুষ, পুরুষস্বভাব নারী দুইই ছিলেন। খুব কাছের জনের হাতে তাদের হেনস্থার যে মর্মান্তিক বিবরণ শুনেছিলাম তা এখনও ভয়ের শিহরণ জাগায়। সবক শেখাবার জন্য ধর্ষণও জায়েজ! উঠে এসেছিল পিঙ্কি প্রামাণিকের প্রথমে থানায়, পরে মোবাইলে মোবাইলে অন্তহীন হেনস্থা হয়ে যেতে থাকার বাস্তব কাহিনি।
জুনমাস এইসবের অন্ত আনুক। সমস্ত মানুষকে ভালবাসার অকুন্ঠ অধিকার দিক। প্রাইড মান্থের মিছিলে যখন পা মেলাবেন হাতে থাকুক নৈঃশব্দের পত্রগুচ্ছ। এ তো শুধু বই নয়, বিজয়ের নিশানও বটে !