আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শুধু ভাষা দিবস বলে কাটিয়ে দেওয়া উচিত হবে না জেনেও আমরা কাটাচ্ছি। যেমনটা করে থাকি আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের বেলায়। কেউ আবার হেসে বলে দিতে পারেন ঐ হল, নারী ও মাতৃভাষা, এদের সম্বন্ধে যত সংক্ষেপে বলা যায় আর কী!
আসলে দুই দিবসই আর একটু প্রাপ্য মর্যাদা চায়। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবীতে তাই অলংকার ও ফেয়ার এন্ড গ্লো-র তুমুল বিজ্ঞাপন দেখলে রাগ হয় (কার ওপর জানি না), মাতৃভাষা দিবসে শুধু একবার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান বাজিয়ে নেটফ্লিক্সে বসে পড়লে কেমন যেন নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছি বলে মনে হতে থাকে।
মাতৃভাষার আদর নেই যে দেশে সেখানে ভ্রূণ হত্যার মত আকছার ভাষা হত্যা হতে থাকবে সে আর আশ্চর্য কী! অন্তর্জালে ঢুকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখতে পাব স্বাধীনতার পর ১৯৬১-র মধ্যেই হারিয়ে গেছে ২২০টি। আগের তো কোনো হিসাবই নেই। পরেরও না। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তো জনগণনা বন্ধ। মানুষের খবরই কেউ রাখছে না, তার আবার ভাষা!
জনজাতির ভাষাগুলিই মরছে বেশি। একে তো মানুষ কম, তার ওপর নিরন্তর ক্ষমতায়নের রাজনীতির সামলে অন্য ভাষার আগ্রাসন সামলান কী চাট্টিখানি কথা! পুরুলিয়ার বিরহররা টিকে আছেন মাত্র ২১৪ জন। পাশের রাজ্যে যদিও এই সংখ্যা ২০০০-এর আশেপাশে। তার ওপর বিরহরি ভাষার কোনো স্ক্রিপ্ট বা লেখ্যরূপ নেই। চারপাশে সাঁওতাল গ্রাম দিয়ে ঘেরা বিরহর গ্রামের শিশুরা তাই অপ্রথাগত বিদ্যালয়ে অলচিকি লিখতে শেখে। সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, সাঁওতালি। ভাগ্যিস শিশুরাই পারে অনেকগুলো ভাষা একসঙ্গে শিখতে।
বিরহরি শিশুর জন্য মাতৃভাষার মাধ্যম খুব জরুরি, নাহলে তার পড়ালেখাই বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ তথাকথিত 'সভ্যতা' থেকে বহুদূরে তার অবস্থান, টিভি, রেডিও, সিনেমা, খবরের কাগজ, এমনকি পড়ে বোঝার মত বইয়েরও খুব আকাল তার জীবনে। তার কচি মাথায় কিছু ঢোকাতে হলে ব্যবহার করতেই হবে চেনা ভাষা, চেনা উপমা, চেনা প্রতিবেশ।
বিরহর শিশু কেবল একটি উদাহরণ। প্রমিত বাংলার 'করাল-গ্রাসে'র কারণে কত শিশু রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে হয়ে গৃহত্যাগ করে, আমরা খবর রাখি না। ভাষার জগতে বড় মাছের ছোট মাছকে গিলে খাওয়া অহরহ ঘটছে ফলে জনজাতির ভাষাই খুব সহজ শিকার হবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
কিন্তু প্রত্যেকটি জনজাতির ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বনস্থলী হতে আহরিত জ্ঞানভাণ্ডার, তার পশুপাখি, ফুলফল, ওষধি এবং অবশ্যই সংস্কৃতি। এই সোনার খনিগুলি হারিয়ে যেতে যেতে পড়ে থাকবে শুধু উদার অর্থনীতির নিজের হাতে বানানো ছাঁচ!
কী করলে এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু রুখে দেওয়া যায়? পেরেছেন তো গোন্দ, ভিল, মিজো, গারো, খাসি এবং করবরক ভাষাভাষীরা। একটু একটু করে বাড়ছে এইসব ভাষার চর্চা। যারা শিক্ষালাভ করেছেন, তারা নিজের ভাষায় লেখালিখি চালাচ্ছেন। নাটক করছেন। ফিল্ম হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডে অসুর ভাষায় মোবাইল রেডিও চালু হয়েছে। তাতে শুধু অসুর ভাষাতেই সম্প্রসারিত হচ্ছে নানা কিছু।
পুরুলিয়াতে বলরামপুর ব্লকে বিরহরদের জন্য সপ্তর্ষি বৈশ্য এবং আরো অনেকের মিলিত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে মৈত্রেয় পাঠশালা। নরেন হাঁসদার সিদো কানহো মিশনে চারটে ভাষা শিখে বড় হচ্ছে জনজাতির অনাথ শিশুরা।শবরদের জন্য চলছে স্বপ্নের পাঠশালা। আমার জানার বাইরেও এইরকম বহু প্রচেষ্টা থেকে থাকবে।
কোনো আশা নেই শুধু আমার মত সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যাদের কোনো দায় নেই মাতৃভাষার কাছে। চর্চা তো অনেক দূরের ব্যাপার।