গত মঙ্গলবার, পাঁচই অক্টোবর, দুহাজার একুশ, আমাদের প্রধানমন্ত্রী 'আজাদির অমৃত মহোৎসবে' এই দেশের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশের ন' লক্ষ অধিবাসীকে ভগবান রামের প্রীত্যর্থে দ্বারের সামনে দুটি করে প্রদীপ জ্বালানোর অনুরোধ করেছেন। কারা এই আঠারো লক্ষ দিয়া জ্বালাবার সৌভাগ্যবান ন' লক্ষ অধিকারী, কী কারণেই বা তাদের এই সৌভাগ্য? লখনৌতে খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীজীর ভাষণে পরিষ্কার জানা গেল যে এই দেওয়ালিতে অযোধ্যায় সাড়ে সাত লাখ দিয়া তো জ্বলবেই, উপরন্তু যে ন' লক্ষ গরীব মানুষ প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কল্যাণে নিজস্ব গৃহ পেয়েছে, তারা প্রত্যেকেই দুটি করে প্রদীপ জ্বাললে, রামজী বড়ই খুশি হবেন।
মহামতি রামজীর খুশির কথা কীভাবে মর্তে তার প্রধান প্রচারকদের কাছে এসে পৌঁছায়, জানা নেই, কিন্তু লখনৌ থেকে মাত্র ১২৯ কিলোমিটার দূরে লখিমপুর-খেরিতে যে কান্নার রোল উঠেছে তা শুনতে দরকার হয় কেবল একটি সংবেদনশীল মন, এ দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে যার অভাব বড়ই তীব্র ও প্রকট। নাহলে অভিযোগ মোতাবেক আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের সুপুত্র আশিস মিশ্র নিজের ঢাউস এসইউভি কনভয় চালিয়ে দেবার সাহস পায় কী করে? এই ঘটনার বলি চার কৃষকসহ মোট আটজন। যেখানে কান্ডটি ঘটে সেখানে রক্তের দাগ এখনো স্পষ্ট, কিন্তু সেই ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ না করে আমাদের 'সন্তপ্রতিম' প্রধানমন্ত্রী মানুষজনকে দিয়া জ্বালাবার সুপরামর্শ দিচ্ছেন! মানুষের প্রাণ কি তবে এদেশে এতোই খেলো, এতোই খোলামকুচি ? শুধু প্রধানমন্ত্রীই নয় দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কোনো বিবৃতি দেননি। উপরন্তু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক বাহুবলী 'টেনি' অজয় মিশ্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখনই নেওয়া হবে না। তার মন্ত্রীত্বও অটুট থাকবে।
প্রথমে এই ঘটনার দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল কৃষকদের ওপরেই। তারাই নাকি রে রে করে পাথর ছুঁড়েছে আশিস মিশ্রের কনভয়ের ওপরে, তাতেই বেসামাল এসইউভি, তাতেই এ-ই 'দুর্ঘটনা'। বলা হচ্ছে আশিস মিশ্র তো সেদিন ঐ কনভয়ে ছিলই না, তাজ্জব কি বাত, সেদিন তো সে গোটা দিনই কাটিয়েছে বাপ ঠাকুরদার স্মৃতি বিজড়িত গ্রামে, যেখানে তার ঠাকুর্দার নামাঙ্কিত কুস্তি প্রতিযোগিতা চলছিলো সেদিন! মুশকিল হলো, টেকনোলজি কেড়ে তো নিয়েইছে অনেক কিছু, কিন্তু তার বদলে কিছু তো দিয়েওছে। এবার এই ঘটনার ভিডিও ক্লিপিংসে ছেয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়া, তাতে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপর কিছু কৃষক একত্রিত হয়েছেন। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে এক বয়স্ক পাগড়িধারী। তাদের সবার দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ। হঠাৎ সাক্ষাৎ কালান্তক যমের মতো ধেয়ে আসে গাড়ির কনভয়। বয়স্ক সর্দারজী পেছন থেকে প্রবল ধাক্কায় সোজা আছড়ে পড়েন প্রথম গাড়িটির বনেটে। অন্যান্য কৃষকরাও ছিটকে পড়ে চারপাশে। আর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন এক এসইউভি-এর দরজা খুলে পালাচ্ছে, আর তার পেছনের চাকায় জড়িয়ে আছে এক থ্যাঁতলানো মৃতদেহ। অভিযোগ, এই কনভয় শ্রীমান আশিসের, দরজা খুলে পলায়নপর মূর্তিটিও তার, সে নাকি গন্না খেতে লুকিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে গাড়ি উলটে মারা যায় এক সাংবাদিক, দুই বিজেপি কার্যকর্তা এবং গাড়িটির ড্রাইভার। আশিস মিশ্রকে যে সেদিন ঐ কনভয়ের প্রথম গাড়িটিতে দেখা গিয়েছিল, একথা মায়ের নামে কসম খেয়ে বলছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সব কৃষক। তারা যে মিথ্যে বলছেন না, সে সাক্ষ্য দিচ্ছে ভিডিও ক্লিপিংসগুলো। এবার দুইয়ে দুইয়ে কতো হবে ঠিক করার ভার গোটা দেশের মানুষের।
এর সঙ্গে জোড়া যাক পুর্বাপরের কিছু তথ্য। "হাম উনহে সুধার দেঙ্গে", আমরা ওদেরকে শুধরে দেব ( পড়ুন কড়কে দেব ), কৃষকদের উদ্দেশ্যে এই রণহুংকার কয়েকদিন আগেই শোনা গেছিলো মন্ত্রী অজয় মিশ্রের কন্ঠে। একে সে কুলশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ-সন্তান, তার ওপর ধনাঢ্য, প্রবল প্রতাপান্বিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো এ লোকটি লখিমপুর-খেরির বিজেপি সাংসদও বটে। তার মুখের ভাষা এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু ভাইরাল বক্তব্যে কৃষকদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দানা বাঁধে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তারা। এরই মধ্যে গত তেসরা অক্টোবর উত্তর প্রদেশের ডেপুটি চিফ মিনিস্টার কেশব প্রসাদ মৌর্য লখিমপুর-খেরিতে কিছু উন্নয়নমূলক ঘোষণা করার জন্য আসবেন বলে জানানো হয়। ঘোষণা টোষণা হয়ে গেলে তিনি বনবীরপুরে অজয় মিশ্রের পৈতৃক গ্রাম পরিদর্শনে যাবেন, তাও ঠিক হয়ে যায়।
কিন্তু ঐ দিনই বেলা ২ টো নাগাদ তেকুনিয়াতে নানা জেলা থেকে আগত আন্দোলনকারী কৃষকরা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জমায়েতে সামিল হন। মৌর্য হেলিকপ্টারে আসবে জেনে তারা হেলিপ্যাড ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তাদের হাতে ছিলো কালো পতাকা। একথা জানতে পেরে মৌর্য তার প্রোগ্রাম বাতিল করে এবং অন্য রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে গন্তব্যে চলে যায়। আশিস মিশ্র তার পিতার হয়ে ডেপুটি সিএমকে স্বাগত জানাতে সদলবলে রওনা হয়ে যায় এবং অভিযোগ, ফিরতি পথ ধরা কৃষকদের মধ্য দিয়ে নিজের কনভয় ছুটিয়ে দেয়। এইভাবেই বোধহয় সে কৃষকদের শোধরাবার চেষ্টা করেছে। যে মূহুর্তে কৃষক মৃত্যুর খবর চাউর হয়ে যায়, তখন থেকেই দলে দলে আরো কৃষকেরা বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে শুরু করেন তিকুনিয়াতে। শুরু হয় ন্যায় বিচারের দাবীতে মৃত সহযাত্রীদের দেহ নিয়ে ধর্ণা।
কৃষকদের আরও অভিযোগ, এই সশস্ত্র হামলাকারীরা ভিড়ের ওপর গুলিও চালায়। একটি ভিডিওতে নাকি তাদের একজনকে রিভলবার তুলে শাসাতেও দেখা গেছে। স্থানীয় একটি চ্যানেলের হয়ে কৃষক বিদ্রোহের খবর করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন আর এক সাংবাদিক। তার দেহে নাকি দুটি গুলির ক্ষত আছে। অথচ স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে গুলির কোনো দাগ তারা খুঁজে পায়নি। দ্বিতীয় বার ময়না তদন্তের দাবী উঠেছে খুব সঙ্গতভাবেই।
লখিমপুর-খেরি বিজেপির গলায় কাঁটা হয়ে খচখচ করছে। তার কারণ দুটো। প্রথমত বিধানসভা নির্বাচন ঘাড়ের ওপর। এখন এই গন্ডগোল খুনখারাপির কারণে বিজেপি-বিরোধী জনমত আরও না দানা বাঁধে। দ্বিতীয় কারণটিও খুব গুরুতর। লখিমপুর-খেরি উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে বড় জেলা, এর অবস্থান রাজ্যের পূর্বদিকে। অতীতে এখানে কৃষক আন্দোলনের অতো বাড়বাড়ন্ত ছিল না, কিন্তু এখন হচ্ছে, তার মানে নতুন নতুন জায়গায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। এতোদিন উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশে ৩০টি জেলায় আন্দোলনটি সীমাবদ্ধ ছিল। এখন পূবেও তা যদি ছড়িয়ে পড়ে, সে দাবানল নেভাবে কে? অতএব সামনের কয়েকটি দিন লখিমপুর-খেরি বিজেপির শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থাকবে এটা একেবারে নিশ্চিত।
এমনিতেই যোগীরাজ্য সবসময় সংবাদের শিরোনামে। কখনো শিশুমৃত্যু, কখনো অতিমারির শিকার শবের সৎকার না করা স্তূপ, ধর্ষণ, নারীলাঞ্ছনা, খুন, রাহাজানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কারণের কোনো অভাব নেই। বেপরোয়া কৃষক হত্যা আবার তাকে লাইম লাইটে নিয়ে এসেছে। বিরোধী নেতা নেত্রী সবাই এখন লখিমপুর চলো মোডে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বা অখিলেশ যাদব, সবাইকে পুলিশ আটকে দিচ্ছে, শুধু আশিস মিশ্রকে জেলে ঢোকানো হলো, এইরকম কোন ঘোষণা এখন অব্দি নেই। আর নেই বিরোধী ঐক্য, যা এই মূহুর্তে সময়ের দাবি। অখিলেশ প্রিয়াঙ্কা মায়াবতী কখনো এক হবেন না, তৃণমূল আর জাতীয় কংগ্রেস কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে না। বামশক্তি কৃষক আন্দোলনের সমর্থক, কিন্তু এদেশে এখন সেই সমর্থন কতটা ফলপ্রসূ জানা নেই। তবে মৌখিক বাগাড়ম্বর শেষ হলে যেই বিরোধী ঐক্যের দাবি ওঠে, অমনি বোঝা যায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছেই তাদের নিজস্ব সমীকরণ ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলা কৃষক আন্দোলন এখনও একলা চলো রে নীতিতেই স্থিত থাকতে বাধ্য হয়েছে। তার নবতম উদাহরণ গত সাতাশে সেপ্টেম্বরে তাদের ডাকা ভারত বনধ। যেখানে শাসককে জোর ধাক্কা দিতে দরকার ছিলো একটি সার্বিক বনধ সেখানে আংশিক সাফল্য নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
ধুরন্ধর শাসকও জানে ঐক্য নেই, ঐক্যের ছিটেফোঁটারও আভাস কোথাও নেই। ফলে অকুতোভয়ে সে যা খুশি তাই করে পার পেয়ে যাচ্ছে। শুধু লখিমপুরে নয়, আসামেও কৃষক হত্যায় মেতেছে হিমন্তবিশ্বের পুলিশ। অবৈধ উচ্ছেদের নামে খুন জখম রাহাজানি চালাবে বলে গ্রামে ঢোকার আগে পুলিশ সমস্ত রাস্তা কেটেছে, ঘরে আগুন দিয়েছে, মৃতদেহের ওপর পৈশাচিক আনন্দে লম্ফঝম্প করেছে। এখনও অগুনতি মানুষ খোলা আকাশের নিচে কিন্তু কড়া প্রহরায় দিন কাটাচ্ছে। যেন নব্য কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। অথচ এদের সবার নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র আছে।
আজাদির অমৃত মহোৎসবে প্রধানমন্ত্রী 'আজাদি ৭৫' নামে এক্সপো উদবোধন করেন, আগের সরকার কোনো উন্নয়ন করেনি বলে গাল পাড়েন, আবাস যোজনার টাকায় যাদের তিনি 'লাখপতি' বানিয়েছেন বলে দাবি করেন, তাদেরকে দুটি করে দিয়া জ্বালাতে বলেন। কিন্তু ধিক্কার জানাতে ভুলে যান আসামের মৃত কৃষকের ওপর লাথি মারতে থাকা বর্বর জাতিবিদ্বেষীকে।
কথায় কথায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চোখে জল আসে। কিন্তু সে চোখ খটখটে শুকনো থাকে লভপ্রীতের খবরের কাগজে ধূলিধূসরিত বিমুক্ত-কেশ মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে। পাগড়ি খুলে কোথায় চলে গেছে, হাসপাতালের বেডে বিছিয়ে আছে তার রক্তমাখা দীর্ঘ কেশ, পিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শিখ পাগড়িতে ঢাকে লম্বা চুল, কারণ গুরু গোবিন্দ সিংহের নির্দেশ ছিলো তাই, যাতে লক্ষ মানুষের ভিড়েও একজন শিখকে তার স্বাতন্ত্র্যের কারণে চিনে নেওয়া যায়। কোথায় সেই স্বাতন্ত্র্য! নিষ্ঠুরভাবে পিষে ফেলা হচ্ছে তাকে, দেখলে না জানি গুরুদের প্রতিক্রিয়া কী হতো!
হ্যাঁ,লভপ্রীত সেই উনিশ বছরের কৃষক সন্তান, যাকে নির্দয় ভাবে গাড়ির চাকায় পিষে দেওয়া হয়েছে লখিমপুরে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অশ্রু বিসর্জন থেকে বিরত থাকতে বলার ধৃষ্টতা কে দেখাবে! আপনি শুধু দয়া করে এইটুকু সুনিশ্চিত করুন যে মানুষ বেঁচে থাকতে এবং মৃত্যুর পরও আপনার রাজত্বে যেন এইরকম বর্বরতা ও নির্মমতার শিকার না হয়।
আর রইল কিছু প্রশ্ন। আজাদির পঁচাত্তরে এ প্রশ্নগুলি তোলা অত্যন্ত জায়েজ। স্বাধীনতা পাবার পর কবে এদেশের সংখ্যলঘু সম্প্রদায়কে এবং কৃষক কুলকে এইরকম টানা নৃশংস অত্যাচার সহ্য করে যেতে হয়েছে? স্বাধীনতার ভগীরথ কি এদেশের কৃষকেরাও নন? তাদের সন্তানরা কি আজও সব প্রতিকূলতার মধ্যে দেশের সীমান্ত রক্ষায় অনলস প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে নেই?
প্রশ্নগুলো সহজ, তাই উত্তর তো জানা !