

হাজারীবাগ জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, আই এ এস অফিসার অন প্রোবেশান কাজে যোগ দিয়ে দেখেন মুন্ডা ওঁরাও প্রমুখ জনজাতি বহুল হাজারীবাগের চরডিহা অঞ্চলে পঁচিশটার মত কুয়ো মঞ্জুর হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের এক প্রকল্পে, কিন্তু প্রকল্প আর জলভরা কুয়োর মধ্যে অলঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে অজস্র গলিঘুঁজিওলা সরকারি আইন। নতুন অফিসার খোঁজ নিয়ে দেখেন নিয়মানুযায়ী প্রথম কাজটা করাতে হবে ঠিকাদারকে নিজের পয়সায়, টাকা যে নিজেও হত দরিদ্র। এরপরে অপেক্ষা, জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার এসে কাজ মেপে রিপোর্ট দিলে, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের অনুমোদন সাপেক্ষে কিস্তির টাকা মঞ্জুর করবেন অ্যাকাউন্টেন্টবাবু এবং সেই টাকা দেবেন ক্যাশিয়ারবাবু। তো, ইঞ্জিনিয়ারবাবু যদিও বা দুই তিনখানা কুয়োর কাজ মেপে উঠতে পারেন, বাকী দু’জনকে আর পাওয়া যায় না। অতএব সিকিভাগ খোঁড়া কুয়ো পড়ে থাকে যেমন কে তেমন, এলাকার জলকষ্টও চলতে থাকে, দিন মাস করে করে দেড় বছর।
নতুন অফিসারটি সমাধানের উপায় বাতলান, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউনট্যান্ট, ক্যাশিয়ারসহ প্রত্যেক কুয়োর জমিতে উপস্থিত হয়ে মাপজোক করে, খাতায় তুলে তুলে ক্যাশ মিটিয়ে আসলেই কাজ এগোয়। কিন্তু তাই শুনে আঁতকে ওঠেন অভিজ্ঞ অ্যাকাউন্টেন্ট, ক্যাশিয়ার। অফিস থেকে টাকা বেরিয়ে কুয়োতলায় উপস্থিত হবে বিতরণের জন্য! এ কি ভয়ংকর কথা। নবীন অফিসার অকুতোভয়, নিজেই চললেন ক্যাশবাক্স সহ ক্যাশিয়ারকে নিয়ে, ফাইল স্যাংশান করে, দরকারমত আপডেট করে হাতে হাতে টাকা দিতে। ইঞ্জিনিয়ার তথা ওভারসিয়ার সবকটা কুয়োর অবস্থান জানে না, যাবে কী করে? সে বাধাও দূর হল ইগনিয়াসের সাহায্যে। ইগনিয়াস যে কোনও গাড়িতে চড়ে না, বরং তার সামনে সামনে দৌড়ে যায়। ঠাসা কোঁকড়া চুলভরা মাথা আর মিটি মিটি হাসিমুখে দৌড়ে দৌড়ে মানব জিপিএস পৌঁছে দেয় প্রতিটি কুয়োর সামনে। বছর খানেক বাদে সত্যিই সবকটি কুয়োয় টলমল করে জল, ইগনিয়াস কিন্তু আর আসে না অফিসারের কাছে।
এর বেশ কয়েক বছর পরের কথা। নবীন অফিসারটি ততদিনে ডেপুটি সেক্রেটারি, হোম ডিপার্টমেন্ট ওড়িশা। তিনি দেখলেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা বেতন পায় না, পায় ভাতা। তাও অতি অনিশ্চিত। টানা কয়েক মাস ভাতা না পাওয়া খুবই স্বাভাবিক, অথচ তাদের হাতেই ভারত সরকার দিয়ে রেখেছে গুচ্ছের দায়িত্ব আর কাজ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিশুদের আনা, তাদের রান্না করে খাওয়ানো, পড়াশোনা, টীকাকরণ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের হাল হকিকত নজরে রাখা সাথে সমস্ত প্রশাসনিক খাতাপত্র আপডেট করা ছাড়াও রান্নার জ্বালানী তেল নুন মশলা ইত্যাদি যোগাড় করাও সেই মেয়েদেরই দায়িত্ব। সরকারী ভাষায় এর গালভরা নাম ‘উইথ দ্য হেল্প অব লোকাল কম্যুনিটি’ কার্যক্ষেত্রে যা স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শক্ত মুঠোর চাপ। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থেকে পঞ্চায়েত প্রধান অবধি যে কোন কর্তা আসতে পারেন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র পরিদর্শনে, আর তার মানেই হল তাঁরা উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের অভুক্ত থাকা। অনেকে এমনকি রান্নাও খুঁটিয়ে দেখতে চান, সেক্ষেত্রে তাঁদের উপস্থিতিতে রান্না করে তবে খেতে দেওয়া হয় শিশুদের।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ডেপুটি সেক্রেটারি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এই শিশুরা খায় আগেরদিন সন্ধ্যেয় বাড়িতে তেলের ডিবরি নেভাবার আগে, ফলে এই পরিদর্শনের সময় শিশুদের দুইদফা খাবারের মধ্যে তফাত হয়ে যায় ১৬-১৮ ঘণ্টা। দিল্লি থেকে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিকে নিয়ে দূরবর্তী জেলায় পরিদর্শনে গেছেন ডেপুটি সেক্রেটারি, দুপুরের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে সার্কিট হাউসে। অন্য সবাই বসার ঘরে গল্পে ব্যস্ত, তিনি এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে খিড়কির দরজার দিকে গিয়ে দেখেন বেশ কজন অঙ্গনওয়াড়ি মহিলাকর্মী বসে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। জানা গেল দুইমাস ভাতা পান নি, উপরন্তু আজকের খাওয়া দাওয়া হয়েছে তাঁদেরই থেকে সংগ্রহ করা চাঁদার টাকায়। লজ্জায় দুঃখে কোনমতে নিজের ব্যাগে যেটুকু যা টাকা ছিল বের করে ভাগ করে দেন ওঁদের মধ্যে। পরবর্তীতে অবসর নেওয়া পর্যন্ত আতিথেয়তার ভার নিজেই বহন করেছেন, আর কখনো চাঁদা সংগ্রহ করতে দেন নি মিটিঙের নামে। সেই আই এ এস অফিসার, প্রখ্যাত লেখক ও দক্ষ প্রশাসক অনিতা অগ্নিহোত্রী, পড়ছিলাম তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিকথা ‘রোদ বাতাসের পথ’।
বিহার, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, কলকাতা জুড়ে তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবন। ‘সরকারি কর্মচারী’ শব্দবন্ধেই যে অকর্মণ্য, দলবাজি করা একপাল অলস মানুষের ছবি ভেসে ওঠে আমাদের অনেকের মনশ্চক্ষে, সেই ছবিটা অনেকটাই ছিঁড়েখুঁড়ে যায় এই বই পড়লে। নিয়মের জটিল জটাজাল ভেদ করে দরিদ্রতম মানুষটির কাছে সরকারি প্রকল্প পৌঁছে দেওয়া প্রায় এক হারকিউলিসসম কাজ। তায় যদি আমলাটি হন মহিলা তো তাঁর কাজ হয়ে ওঠে আরো একটু কঠিন। মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তেই প্রমাণ করে চলতে হয় তাঁরা পুরুষদের চেয়েও একটু বেশি কর্মদক্ষ। নিজেকে সমান প্রমাণ করতে গিয়ে আসলে প্রমাণ করতে হয় সমানের দ্বিগুণ। আর এই তো মাত্র কয়েকবছর আগেও নারীসুলভ অসুবিধের কথা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশ করা ছিল ভারী লজ্জার ব্যাপার, কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি অসফল বা দুর্বল বলেও ধরে নেওয়া হত। এই বই পড়তে পড়তে অনুভব করি কাজপাগল, আদর্শবাদী অনিতা তাঁর দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে এই সমানের চেয়েও দ্বিগুণ বেশি কাজ, সমানের চেয়েও অনেকটা বেশি দক্ষভাবে করে গেছেন।
আমি নিজে কর্মজীবন শুরু করা ও পরবর্তী ১৫-১৬ বছর এই সমানের চেয়েও খানিকটা বেশি করে নিজেকে প্রমাণ করার মরীয়া চেষ্টায় কাটিয়েছি। লেখক যখন লেখেন ‘নিজের নারী অস্তিত্বের কথা মনেই থাকত না ভুতের মত খাটতে খাটতে। লিঙ্গবিহীন এক চেতনা ঢুকে গিয়েছিল রক্তের মধ্যে। ‘তখন সেটা একেবারে মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারি, আমি ও আমার মত অনেক মেয়েই ঠিক এই কারণেই নিজেদের নিরাপত্তার চিন্তামাত্র না করে শেষ ট্রেন ধরে মফস্বল স্টেশনে নেমে হেঁটে বাড়ি পৌঁছেছি, শারীরিক প্রয়োজন, ব্যথাবেদনা উপেক্ষা করে টানা ৩০ ঘণ্টা কাজ করে গেছি। এই লিঙ্গবিহীন চেতনা আর ভুতের মত খাটনির বিনিময়ে অর্জন করা জায়গাটুকু আজকের মেয়েদের জন্য পথ করে দিয়েছে নির্ভয়ে নিজের প্রয়োজনটুকু বলার। অনিতারা কিছুজন না এগোলে আমরা অনেকেই হয়ত এগোতাম না, ‘ওসব মেয়েদের জন্য নয়’ ভেবে বসে থাকতাম।
আইনের শাসন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী লেখক দেখেছেন এমনকি আইনরক্ষক পুলিশও ওসবে বিশ্বাস করে না। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কয়েক মাস আগে লেখকের কর্মস্থলে রামশিলা নিয়ে মিছিল চলাকালীন ভাবাবেগের দোহাই দিয়ে পুলিশের নির্বিকার প্রশ্রয়ে প্রায় দাঙ্গা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। অনিতা এক নিঃসঙ্গ আমলা যিনি একাই প্রশাসনের নিরপেক্ষতায় অটল থাকেন। পড়তে পড়তে ১৯৯২ ও তৎপরবর্তী ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা মনে পড়ে যেখানে এই নিরপেক্ষতার অভাবই ভারতের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়েছে, বাড়িয়েছে সামাজিক অসাম্য। দিল্লির সর্বোচ্চ স্তর থেকে দেশের একেবারে প্রত্যন্ত প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা জটিল এই আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। অধীনস্থ দেশটির প্রতিটি কোণায় নিজেদের ক্ষমতা জারি রাখার প্রয়োজনে গড়ে তোলা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু নিরপেক্ষতা, কিছু সুফল ছিল বৈকি। স্বাধীন দেশে আশা ছিল সেই আমলাতন্ত্র কল্যাণকামী রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয় নি পুরোপুরি। তবু যেটুকু যা হয়েছে, দূরতম প্রান্তের দেশবাসী যেটুকু কল্যাণের স্পর্শ পায় তা সম্ভব হয় অনিতাদেবীর মত মানুষদের জন্যই।
তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবন ছড়িয়ে আছে মহিলা কমিশন, বস্ত্রমন্ত্রক, আবাসন ও নাগরিক দারিদ্র্য উন্মীলন, বৈদেশিক বাণিজ্য দপ্তর, হাতে করে মনুষ্যবর্জ্য পরিবহনকারীদের জীবনযাত্রা উন্নয়নের রূপরেখা নির্ণায়ক দপ্তর ইত্যাদিতে। সেইসব অভিজ্ঞতা এসেছে একেবারে হাল্কা চালে। যেন এই গিয়ে অফিসে বসলাম আর টকাটক করে ফেললাম এমনই সহজ। অথচ প্রায় প্রতিটি জায়গায় মুখোমুখি হয়েছেন বিরোধিতার, কখনো তা সরকারি নিয়মের অলংঘনীয়তার দোহাই, কখনো বা উপরওয়ালা কি সহকর্মীর সক্রিয় বিরোধিতা। নিজের বিবেকের সঙ্গে, নিজের মন্ত্রকের সঙ্গে, কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গে, রাজ্যের সরকারের সঙ্গে অবিরাম লড়াই চলেছে তাঁর। কিন্তু বইটির কোথাও সে লড়াই জনিত তিক্ততার ছোঁয়া, ব্যক্তিগত অপছন্দের প্রকাশ ঘটে নি। যেমন রাজ্যে প্রশাসনের মৌখিক অনুরোধে মহিলা কমিশনের টিম পার্কস্ট্রীট ধর্ষণের পর সুজেট জর্ডনের সঙ্গে দেখা করেন নি, কারণ রাজ্যের শীর্ষ ব্যক্তি তাঁদের কথা দিয়েছিলেন যথাযথ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দায়িত্ব তিনি নিজে নিচ্ছেন। কমিশনের টিম শহর ছাড়ার আগেই ডিসিপিকে বদলী করে দেওয়া হয়, অনিতারা বুঝলেন তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। অপরিসীম লজ্জা ও বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে ঘটনার বর্ণনায়।
প্রান্তিক মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কল্যাণ হস্ত পৌঁছে দিতে অনিতার যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন তাঁর সহকর্মীরাও অনেকেই। এমনিতে আমরা তাঁদের খুব একটা দেখতে শুনতে পাই না আর সরকারি নিয়মের অচলায়তনের উপর, কর্মীদের আলস্য ও অপদার্থতার উপর তিতিবিরক্ত হয়ে থাকি। রোদ বাতাসের পথ দিয়ে এগিয়ে সেইসব সংবাদ শীর্ষে না আসা কর্মীদের কাউকে কাউকে যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। সরকারি নানা প্রকল্প, তার রূপায়ণের পথের বিচিত্র বাধা, প্রান্তিক মানুষদের অবস্থা আর এক নিঃসঙ্গ, জেদি, আইনের শাসনে বিশ্বাসী মহিলার পথচলার অসম্ভব আকর্ষণীয় কাহিনী এই বইটি। হেরে যাবার দিনে, মন খারাপের দিনে বারবার পড়ব এই বই। নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করে যাওয়ার শক্তি যোগাবে এই বই।
বই – রোদ বাতাসের পথ
লেখক – অনিতা অগ্নিহোত্রী
প্রকাশক – দেজ পাবলিশিং
দাম – ২৯৯/- টাকা
বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।
Sakti Brata | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:২৭497727
b | 14.139.***.*** | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৫৯497754
b | 14.139.***.*** | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৫৯497753
b | 14.139.***.*** | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৫৯497755
b | 14.139.***.*** | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:১৫497828
সুদীপ্ত | 115.187.***.*** | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:২৮497898
তিতি রায় | 2401:4900:234c:a1c5:1:2:a33e:***:*** | ২৫ জুলাই ২০২২ ১৭:১৬510313