এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  প্রথম পাঠ

  • পাঠ প্রতিক্রিয়া - নৈঃশব্দের সংলাপ

    সৌভিক ঘোষাল
    পড়াবই | প্রথম পাঠ | ০৮ আগস্ট ২০২১ | ২৭১১ বার পঠিত

  • সলমন রুশদি এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন লেখক হিসেবে নিয়ত এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবার কথা। প্রতিটি নতুন লেখাকে একটা মাস্টারপিস করে তোলার চ্যালেঞ্জ। কেননা দুনিয়ায় অসংখ্য মাস্টারপিস লেখা হয়ে গেছে। প্রতিদিন একটি করে এইরকম বই শেষ করলেও সব পড়ে ওঠা যাবে না। আবার অন্য একটি সাক্ষাৎকারে ওরহান পামুক জানাচ্ছেন মাঝে মাঝে থ্রিলার এবং ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়াকে তার সময়ের করুণ অপচয় বলে মনে হয়। এরকমই একের পর এক সাক্ষাৎকার জুড়ে আমরা লেখকদের লেখা তৈরির কারখানা ঘরের গল্প শোনার পাশাপাশি তাদের পাঠক সত্তাকেও চিনতে থাকি। আর এটাও বুঝতে থাকি যে লেখার ইস্কুল নামের এক প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু একবার যে কথা বলেছিলেন, সাগরপারের এই সব দুনিয়াখ্যাত লেখকেরাও সেই কথাটাই বলেন – ভালো লেখা শেখার প্রধান উপায় ভালো পাঠক হওয়া।

    নৈঃশব্দের সংলাপ বইটি বিশ্বসাহিত্যের ২২ জন বিখ্যাত লেখকের এইরকম কয়েকটি সাক্ষাৎকারের সমাহার। এখানে লেখকেরা জানিয়েছেন তাঁরা কীভাবে লেখালেখি করেন, কী ধরনের লেখা পড়তে ভালোবাসেন, কোন কোন লেখক তাঁদের প্রভাবিত করেছেন, লেখার ক্ষেত্রে কত ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তাঁদের করতে হয় ইত্যাদি নানা বিষয়।

    বইটি শুরু হচ্ছে কানাডার নোবেল জয়ী ছোটগল্পকার এলিস মুনরোর একটি ছোট সাক্ষাৎকার দিয়ে। ২০১০ সালে মুনরো এই সাক্ষাৎকারটি যখন দিয়েছেন, তখন অবশ্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান নি। তা তিনি পাবেন আরো তিন বছর পর ২০১৩ তে এসে। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারের ঠিক আগেই সারাজীবনের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি পেয়ে গেছেন ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশানাল পুরস্কার। মুনরো সেই ব্যতিক্রমী কথাকারদের অন্যতম সারাজীবন আখ্যান লিখলেও যারা উপন্যাস লেখেন নি, মূলত ছোটগল্পই লিখেছেন। প্রশ্নকর্তা তাঁর সাক্ষাৎকারের শুরুতেই যখন জানতে চেয়েছিলেন উপন্যাসের বিরোধিতা করেই মুনরো তাঁর গল্পগুলি লেখেন কিনা, তখন লেখিকা জানান গল্পগুলোকে তিনি এমনভাবে ঘুরিয়ে দিতে পছন্দ করেন, যা ছোটগল্পের ফর্মের শৃঙ্খলাকেও ভেঙে দেয়। উপন্যাসের গতির নিয়মকেও তিনি অগ্রাহ্য করেন। অনেককাল আগে কবিতা কী সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একজন জানিয়েছিলেন বেস্ট ওয়ার্ডস ইন বেস্ট অর্ডার এর কথা। আখ্যানও যে ফর্মের কত ভাঙাচোরা আর পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে এই বইয়ে একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা তাঁদের সাক্ষাৎকারগুলিতে তা নানাভাবে জানিয়েছেন। এই ভাঙাচোরায় লেখককে সফল হতে হলে তাঁকে ভালো পাঠক হতেই হবে। মুনরো তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে তাই একটি বার্তাই দিতে চান – ‘পড়ো’। লেখকের জন্য পড়তে পড়তে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়াটা খুবই জরুরী। না পড়ে না ভেবে সে যদি শুধুই লিখতে যায়, তাহলে তার ফলাফল হবে একটি পর্বতপ্রমাণ ননসেন্স।

    সাক্ষাৎকারগুলি পরপর পড়লে আমরা বেশ কিছু আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই এই লেখকদের পছন্দ তালিকায়। দস্তয়েভস্কি একবার বলেছিলেন তাঁরা সকলেই বেরিয়েছেন গোগলের ওভারকোট থেকে। এই সময়ের বিশ্বখ্যাত লেখকদের অনেকেরই প্রিয় রচনাকারদের মধ্যে আছেন দস্তয়েভস্কি স্বয়ং। বিভিন্ন লেখকের লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে তলস্তয়, চেকভ, জেমস জয়েস, ফ্রানজ কাফকা, উইলিয়াম ফকনর প্রমুখদের কথা। এলিস মুনরোকে যখন মনে করিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে ‘আমাদের চেকভ’ বলে অভিহিত করার কথা, তখন তিনি জানান চেকভ দ্বারা তিনি কত প্রবলভাবে প্রভাবিত। শুধু তাঁকেই নন, চেকভ সবাইকেই প্রভাবিত করেছেন, শেকসপিয়রের মতো দীপ্তি ছড়িয়েছেন বলে তিনি মনে করেছেন।

    রুশদি আবার তাঁর প্রিয় লেখকদের নাম বলতে গিয়ে বলেছেন কাফকার কথা। বলেছেন তাঁর কথাবিশ্বে আমরা সবাই বাস করি। আরো বলেছেন আশ্চর্য কল্পনাশক্তি আর গদ্যের সৌন্দর্যের জন্য ডিকেন্সের প্রতি মুগ্ধতার কথা। আর অবশ্যই জয়েসের কথা। ওরহান পামুক থ্রিলার পড়লে ক্লাসিক পড়ার সময় চলে যায়, এমন একটা ইঙ্গিৎ করেছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে, রুশদি কিন্তু জানাচ্ছেন ভারতে বড় হয়ে ওঠার সময়ে আগাথা ক্রিস্টি পড়ে তাঁর আচ্ছন্ন হয়ে থাকার কথা। যে সব বইয়ের কাছে তিনি বারবার ফিরে যান সে সবের কথা বলতে গিয়ে রুশদি উল্লেখ করেছেন কাফকার মেটামরফোসিস, বোর্হেসের ফিকশন, কালভিনোর দ্য ব্যারন ইন দ্য ট্রিস, গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম, গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড ইত্যাদি বইয়ের কথা।

    এই বইয়ের একটা মজা হল আমরা যখন রুশদির কাছে শুনছি কালভিনোর লেখার প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা, তখন কয়েক পাতা পরেই পেয়ে যাচ্ছি সেই ক্যালভিনোর-ই সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাৎকারে কালভিনো জানাচ্ছেন মিলান আর তুরিন দুই ইতালিয় শহরের কোনটিকে তিনি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা বানাবেন, তাই নিয়ে দ্বিধার কথা। শেষমেষ হৈ চৈ এর মিলান ছেড়ে শান্ত তুরিন বেছে নেবার কথা। আবার আমরা অবাক হই রুশদির মতো কালভিনোও যখন বলেন তাঁর প্রিয় লেখক হলেন কাফকা, প্রিয় গ্রন্থ কাফকার আমেরিকা নামের উপন্যাসটি। আমরা বুঝতে পারি প্রকৃত অর্থেই কাফকা হলেন লেখকদের লেখক।

    কালভিনোর সাক্ষাৎকারে আমরা পাই অনেক ভেবেচিন্তে মিলান ছেড়ে তুরিনকে বসবাসের জন্য বেছে নেবার কথা। এই বইয়ে রয়েছে আর এক বিখ্যাত ইতালীয় লেখক উমবের্তো একোর একটি ছোট সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাৎকারে একো জানান মিলানের বাইরে এক গ্রামের বাড়িতে থেকে তাঁর লেখালেখির কথা। একোর বেশিরভাগ বই লেখার শুরু আর শেষ ইতালির কান্ট্রিসাইড এর নির্জনতার মধ্যেই। একো এও জানান যে তাঁর কোনও কোনও বই অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। যেমন বিখ্যাত ফুকোস পেণ্ডুলাম বইটি তিনি আট বছর ধরে নানা অবকাশ মুহূর্তে লিখেছেন।

    এই সমস্ত সাক্ষাৎকারে অনেক সময়েই উঠে এসেছে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে দাঁড়ানো লেখক সত্তাটির কথা। নিঃসন্দেহে স্যাটানিক ভার্সেসকে ঘিরে রুশদিকে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা সবার চেয়ে আলাদা। রুশদির কোনও সাক্ষাৎকারে স্যাটানিক ভার্সেস এর প্রসঙ্গ আসা প্রায় অবশ্যম্ভাবী। কীভাবে সেই সময়ের মোকাবিলা করেছিলেন সে প্রসঙ্গে রুশদি জানিয়েছেন পুরো পৃথিবীর চিৎকার সেই সময়ে তিনি যেন কানের সামনে শুনতে পেতেন। সেই সময়ে তিনি এনলাইটমেন্ট লেখকদের লেখা পড়েছিলেন। ভলতেয়ারের কাঁদিদ, দিদেরোর জ্যাকোস দ্য ফ্যাটালিস্ট, রুশোর কনফেসনস, জন স্টুয়ার্ট মিলের অন লিবার্টি এগুলো তাঁকে শক্তি জুগিয়েছিল।

    রুশদির পরিস্থিতির সঙ্গে ব্যাপ্তি ও গভীরতায় তুল্যমূল্য না হলেও বিরূপ সমালোচনা, দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্রের বিরুদ্ধ প্রচার ও আদালতের মুখোমুখি হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল ওরহান পামুককেও। অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে যে গণহত্যা নামিয়ে আনা হয়েছিল, পনেরো লক্ষ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়েছিল, তাই নিয়ে কথা বলার জন্য তুরস্কের আদালতে তোলা হয়েছিল পামুককে। সেটা ২০০৫ সালের ঘটনা। পরের বছর ২০০৬ এ নোবেল পান তিনি। তার আগেই তুরস্কের রাস্তায় তার বিরুদ্ধে মিছিল বেরোয়, তার বই পোড়ানো হয়, এমনকী তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। আজকে আমরা এরদোগানের স্বৈরশাসনের নানা চিহ্ন নিয়মিত দেখতে পাচ্ছি, পামুক অনেক আগে থেকেই সে বিষয়ে কথা বলে আসছেন। এই সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে ব্যারাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা এরদোগানের ভালো কাজ। কিন্তু এরই পাশাপাশি তুরস্কে তার আমলে যেভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খণ্ডিত হচ্ছে এবং উগ্র দক্ষিণপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তা ভয়ঙ্কর।

    কালভিনো তাঁর সাক্ষাৎকারে আবার অন্য এক ধরনের রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের গোড়ার দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু এখানে অনুভব থেকে বহুদূরের অনেক কিছু মেনে নিতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। ফলে শুধু কমিউনিস্ট জগৎ থেকেই নয়, রাজনীতি থেকেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কথা ভাবতে থাকেন তিনি।

    হোসে সারামাগো ‘গসপেল অ্যাকোর্ডিং টু জেসাস ক্রাইস্ট’ লেখার পর যথেষ্ট বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন। পর্তুগালে তখন দক্ষিণপন্থী সরকার। বইটিকে তারা ধর্মবিরোধী আখ্যা দেয়। একটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের তালিকা থেকেও এটিকে বাদ দিয়ে দেয়। সারামাগো এতটাই আহত হন গোটা ঘটনায় যে তিনি নিজের দেশ পর্তুগাল ছেড়ে বরাবরের জন্য স্পেনে পাড়ি দেন ও বাকি জীবন সেখানেই অভিবাসী হিসেবে কাটান।

    ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখালেখিকে অনেকেই ইমিগ্রান্ট ফিকশন হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। সাক্ষাৎকারে সেই প্রসঙ্গটির মুখোমুখি হলে ঝুম্পা বলেন আমেরিকান সাহিত্যের নিরিখে এইভাবে তাঁর লেখালেখিকে ব্যাখ্যা করাটা ঠিক হবে না। আমেরিকায় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লেখকেরা এসেছেন। তাঁরা বেড়ে উঠেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। এবং তারপর লেখালেখি করার সময় নিজেদের বেড়ে ওঠার সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখেছেন। কয়েকটি বইকে ইমিগ্রান্ট ফিকশান আর বাকি বইকে নেটিভ ফিকশান – আমেরিকান সাহিত্যকে এইভাবে ভাগ করা যায় না বলেই ঝুম্পা তাঁর সাক্ষাৎকারে সওয়াল করেছেন। জানিয়েছেন তাঁর ইতালিয়ান শেখার কথা এবং ইতালিয়ান ভাষার বইপত্র ধীরে ধীরে পড়ে চলার কথা। তাঁর বুকশেলফ এখন ইতালিয়ান ভাষার বইপত্রেই ভরা থাকে। প্রিয় লেখকদের নাম বলার সময় ঝুম্পা বলেছেন এলিস মুনরো, চেকভ, মোরাভিয়া প্রমুখদের কথা। তবে তাঁকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছিলেন টমাস হার্ডি। হাইস্কুলে থাকতেই হার্ডি তার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আর এখনো হার্ডির লেখার কাছে তিনি বারবার ফিরে যান। হার্ডির উপন্যাসের আর্কিটেকচার তার খুব পছন্দের।

    হোসে সারামাগো তাঁর সাক্ষাৎকারে সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিকে যেভাবে দেখেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা খানিকটা ব্যতিক্রমী। অন্যান্য নানা সাক্ষাৎকারে লেখালেখির সূত্র ধরে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা এসেছে। কিন্তু সারামাগো ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন ও সমকালীন রাজনীতি সম্পর্কে লেখালেখি নিরপেক্ষভাবেই গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেন। তিনি মনে করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে তাহলে পর্তুগালের রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব অন্য দেশের মতোই কমবে। তারা তাদের আসল চেহারায় আরো বেশি করে দেখা দেবে। সমকালীন রাজনীতিবিদেরা তাঁর মতে এজেন্ট। গণতন্ত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা বক্তৃতা এগুলো মূলত বিভ্রম তৈরি করার কৌশল। গণতন্ত্র এখন আর কাজ করছে না, কাজ করছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির এজেন্ট হিসেবে রাজনীতিবিদেরা বিশ্বকে শাসন করছে। রাজনৈতিক শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তির গাঁটছড়ার মধ্যে দিয়ে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে যা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। সারামাগো খুব স্পষ্টই জানান যে পৃথিবীতে তিনি আছেন, সেই পৃথিবীকে তিনি পছন্দ করেন না। দুনিয়া জোড়া বিপ্লব তাঁর কল্পনা। তিনি মনে করেন উন্নয়নশীলতায় পিছিয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষকে বলতে হবে তোমরা নিজেরা নিজেদের এগিয়ে নাও, ভাগ্য পরিবর্তন কর।

    গুন্টার গ্রাসের সাক্ষাৎকারটি বাঙালি পাঠককে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করবে, কারণ এখানে ১৯৯৯ এর নোবেলজয়ী লেখক তাঁর ‘জিভ কাটো লজ্জায়’ বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কলকাতা সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন।

    গার্সিয়া মার্কেজ এর কোনও সাক্ষাৎকার এই বইতে না থাকার জন্য পাঠক আক্ষেপ করতে পারেন, কিন্তু লাতিন আমেরিকান বুম এর অন্য তিন প্রধান কথাকার – হুলিও কোর্তাসার, কার্লোস ফুয়েন্তেস এবং মারিও ভার্গাস ইয়োসার সাক্ষাৎকার এখানে রয়েছে। মেহিকান ঔপন্যাসিক কার্লোস ফুয়েন্তেস তাঁর ছোট সাক্ষাৎকারটিতে জানিয়েছেন তিনি দু বছর অন্তর অন্তর ফিরে পড়েন সেরভান্তেসের দন কিহোতে। সার্ভেন্তেসের দন কিহোতেকে তাঁর প্রিয় বইয়ের তালিকায় রাখেন নোবেল বিজয়ী মারিও ভার্গাস ইয়োসাও। এছাড়াও এই তালিকায় তিনি রাখেন তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, মেলভিলের মবি ডিক, জয়েসের ইউলিসিস, উইলিয়াম ফকনারের লাইট ইন অগস্ট, কনরাডের লর্ড জিম এর মতো বইগুলি। প্রিয় কবি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন রুবেন দারিও, নেরুদা, শার্ল বোদলেয়র, টি এস এলিয়টের কথা। লাতিন আমেরিকান লেখকদের সাহিত্য প্রসঙ্গে রাজনীতির কথা আসা স্বাভাবিক। হুলিও কোর্তাসার জানিয়েছেন লাতিন আমেরিকার মিলিটারি শাসকেরাই তাঁর রাজনীতিতে সক্রিয় হবার জন্য দায়ী। মিলিটারি জুন্টা না থাকলে তিনি হয়ত কবিতা ও গল্পের জন্য আরো বেশি কাজ করতে পারতেন, রাজনীতিতে এতখানি মনোনিবেশ তাঁকে করতে হত না।

    এই বইয়ের সাক্ষাৎকারগুলি চয়নের একটা বড় আকর্ষণ নিঃসন্দেহে এটাই যে এখানে বিখ্যাত লেখকদের পাঠের জগৎটির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কামুর সাক্ষাৎকারটি থেকে আমরা জানতে পারি তিনি পাসকাল, মলিয়ের, ধ্রুপদী হিস্পানিক লেখকদের ছাড়া বিশেষভাবে পছন্দ করেন উনিশ শতকের রুশ সাহিত্য। উইলিয়ম ফকনর তাঁর সাক্ষাৎকারটিতে দস্তয়েভস্কির ব্রাদার্স কারমোজোভ আর চেকভের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন। জাপানী লেখক কাজুও ইশিগুরোও পছন্দের লেখকদের কথা বলতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা জানিয়েছেন উনিশ শতকের তিন বিখ্যাত রুশ কথাকার – দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আর চেকভ সম্পর্কে। জাপানী সাহিত্য তাঁর লেখালেখিকে সেরকম প্রভাবিত না করলেও জাপানী সিনেমা দ্বারা – বিশেষ করে ওজু, কুরোসওয়ার মত পরিচালকদের সিনেমা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হবার কথা তিনি জানিয়েছেন। জাপানি লেখকদের মধ্যে মুরাকামির লেখার প্রতিই কেবল তাঁর মুগ্ধতা তিনি ব্যক্ত করেছেন। মুরাকামির কয়েকটি সাক্ষাৎকারও রয়েছে এই সংকলনটিতে। তার একটিতে মুরাকামি জানান, তাঁর আরাধ্য লেখক দস্তয়েভস্কি। ফকনারের মতো মুরাকামিও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন দস্তয়েভস্কির ব্রাদার্স কারমোজোভ উপন্যাসটির কথা।

    এইভাবে একের পর এক সাক্ষাৎকারে লেখকদের অন্তর্জগৎ আর লেখার জগৎ, পাঠের জগৎ আর চলমান জগৎ উঠে আসতে থাকে। সাক্ষাৎকারগুলির অনুবাদ করে আমাদের উপহার দিয়েছেন এমদাদ রহমান। অনুবাদ এতটাই স্বাদু আর তরতরে যে কখনো মনেই হয় না অনুবাদে কিছু পড়ছি। প্রতিটি সাক্ষাৎকারের শুরুতে ছোট ছোট প্রাককথনে লেখকের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেন বইটির অনুবাদক তথা সম্পাদক এমদাদ। এজন্য দ্বিগুণ ধন্যবাদ তাঁর প্রাপ্য। চিরঞ্জিৎ সামন্তর ক্যালিগ্রাফি নির্ভর প্রচ্ছদটি যেমন সুন্দর, তেমনি এর মুদ্রণ সৌকর্যও চমৎকার। বিশ্বসাহিত্যে আগ্রহী বাঙালি পাঠক, বিশেষ করে তরুণ বাঙালি লেখকদের জন্য এই বইয়ের মূল্য অপরিসীম। গুরুচণ্ডা৯র এই বইটি প্রকাশের জন্য বিশ্বসাহিত্যে আগ্রহী বাঙালি পাঠকদের তরফে অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য।


    নৈঃশব্দের সংলাপ – বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার
    ভাষান্তর ও সম্পাদনা – এমদাদ রহমান
    প্রকাশক – গুরুচণ্ডা৯
    মূল্য – ২৭৫ টাকা

    প্রাপ্তিস্থান :

    অনলাইনে — কলেজস্ট্রীট ডট নেট
    বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ০৮ আগস্ট ২০২১ | ২৭১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০৮ আগস্ট ২০২১ ১৪:০০496557
  • এই বইয়ের অনুবাদ আমার জায়গায় জায়গায় বেশ আড়ষ্ট লেগেছে।  বইটার সুচীপত্র যেমন আকর্ষণীয় সে আন্দাজে অনুবাদের মান তেমন সুবিধের নয় বলেই আমার মনে হয়েছে। 

  • ঋতা রায় | 2409:4060:209a:8e65::27b6:***:*** | ০৮ আগস্ট ২০২১ ১৪:২৮496558
  • আর কতদিন লাগবে José কে বাংলায় জুজে সারামাগু লিখতে? উনি স্প্যানিয়ার্ড ছিলেন না, পোর্তুগিজ ছিলেন।

  • Somenath Guha | ১০ আগস্ট ২০২১ ০০:৪১496615
  • কার্লোস ফুয়েন্টেশ নোবেল বিজয়ী নন। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্যি।

  • প্রতিভা | 2401:4900:1048:4a8f:0:5a:e78:***:*** | ১২ আগস্ট ২০২১ ০৬:৫৪496676
  • আলোচনাটি ভালো লাগলো। গুরুচন্ডালীর এই বইটি সত্যিই লেখকদের বই। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন