চলে গেলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হরিশংকর বাসুদেবন। শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্বের বামপন্থা তথা কমিউনিজমের ইতিহাসচর্চায় তিনি এক বিরাট স্তম্ভ বলে পরিগণিত হতেন। ২০১৭ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করে “হিস্ট্রি অব কমিউনিজম” নামের তিন খণ্ডের বিখ্যাত বইটি। সেখানে বিশ্বের অন্যান্য কৃতবিদ্য পণ্ডিতদের পাশে লিখেছিলেন হরি বাসুদেবনও। ভারতের কমিউনিজমের ইতিহাস লেখার ভার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকেই অর্পণ করেন।
অধ্যাপক বাসুদেবন কেমব্রিজের ক্রাইস্টস কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু বিদেশে না থেকে দেশের ইতিহাসচর্চাকে সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে নিয়ে ফিরে আসেন ভারতে। অধ্যাপনা শুরু করেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন খুব জনপ্রিয় এক শিক্ষক। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল রুশ ইতিহাস, বিশ্বের ইতিহাসে রুশ সমাজতন্ত্রের প্রভাব, রুশ – ভারত সম্পর্ক ও বিশ্বরাজনীতি। ভারত ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সামরিক প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে হরি বাসুদেবনের গবেষণা গোটা পৃথিবীতেই এই সংক্রান্ত বিশিষ্ট কাজের উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত সমাদৃত। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ওপর রুশ বিপ্লব কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাই নিয়ে ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রিভিউতে তাঁর লেখা প্রবন্ধ বেশ আলোড়ন তুলেছিল। রাশিয়ার পাশাপাশি চিন সংক্রান্ত চর্চাতেও তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট পণ্ডিত। ২০১৫ সাল থেকে আমৃত্যু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিনা সেন্টারের ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। ছিলেন কোলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের বর্তমান সভাপতিও।
রুশ বিপ্লবের শতবর্ষে আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁ একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি রুশ বিপ্লব ক্যু ছিল কিনা সেই সংক্রান্ত বিতর্ক প্রসঙ্গে বলেন, “যখনই একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী তুমুল সংঘাত ছাড়াই অন্য একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখনই এই ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াটিকে আমরা ক্যু বলে থাকি। কিন্তু সেই দিনে রাশিয়াতে আরও অনেক কিছু ঘটেছিল, যা নিঃসন্দেহে ক্যু-এর অধিক। এক, শুধু পেট্রোগ্রাডে নয়, সেই দিন মস্কো এবং রাশিয়ার অন্যান্য বহু শহরে এই ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আঞ্চলিক সোভিয়েট কমিটিগুলি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিদের কোণঠাসা করে এবং আঞ্চলিক প্রশাসনের ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় বলশেভিক প্রশাসকরা নিজেদের ভিতর সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পন্ন করে। দুই, ৮ নভেম্বরই পেট্রোগ্রাডেই দেশের সব ক’টি সোভিয়েট কমিটি এক বিরাট সম্মেলনে মিলিত হয়। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সব প্রতিনিধি দেশ জুড়ে বলশেভিক সোভিয়েটের কার্যক্রমের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। এই সর্বাত্মক প্রক্রিয়াটিকে স্মরণে রেখেই অনেক ইতিহাসবিদ বলেছেন, যা ঘটেছিল, তা হল একটি বিরাট অভ্যুত্থান”।
মৃত্যুদণ্ড থাকা উচিৎ কি উচিৎ না এই সংক্রান্ত বিতর্ক আজকের দিনের একটি বড় বিতর্ক। রাশিয়ায় কিন্তু বিপ্লবের পরেই এই মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছিল। যা সেকালে ছিল অতীব ব্যতিক্রমী। পরে লেনিনকে বারবার হত্যার চেষ্টা, শ্বেতসন্ত্রাস প্রভৃতির মুখে পড়ে আবার কেন তাকে ফিরিয়ে আনতে হয় সেই ইতিহাস জানিয়েছেন হরি বাসুদেবন, “ক্ষমতা দখলের পর বলশেভিকরা মৃত্যুদণ্ড রদ করে। কিন্তু এই অবস্থান থেকে তারা সরে আসতে বাধ্য হয় যখন স্বয়ং লেনিনকেই বিরুদ্ধবাদীরা হত্যা করার চেষ্টা চালায়। বলশেভিকরা তখন বলেছিল, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড চালু থাকবে। মনে রাখতে হবে, ১৯১৮ থেকেই, অর্থাৎ পেট্রোগ্রাড অভ্যুত্থানের কয়েক মাস পর থেকেই রাশিয়ায় শুরু হয় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ। রাশিয়ার কমিউনিস্টরা খুবই অনিচ্ছা সহকারে মৃত্যুদণ্ড চালু রেখেছিলেন”। রবীন্দ্রনাথ ও সোভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্কটিকে অধ্যাপক বাসুদেবন পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েট ইউনিয়নে যান ১৯৩০ সালে। তখন দেশ জুড়ে চলেছে সমগ্রীকরণের প্রক্রিয়া। সেই বিরাট, ব্যাপক, বিস্তৃত কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রভূত উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হন। কিন্তু ‘রাশিয়ার চিঠি’-র সমাপ্তি অংশে তিনি লেখেন, জনসাধারণকে কেন্দ্র করে বিপুল সার্বিক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু এই কর্মযজ্ঞে ব্যক্তিমানুষের স্বপ্ন, অভিলাষ, নিজস্বতা যেন তার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যা কিছুটা বিস্ময়কর, তা হল, সোভিয়েট ইউনিয়নের সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে তিনি সে রকম কিছু লেখেননি। সেই উত্তাল সময়ে অসিপ ম্যান্ডেলস্টাম-এর মতো কবি, বুলগাকভ-এর মতো কথাশিল্পী রাশিয়াতেই তাঁদের সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এঁদের সঙ্গে মিলিত হলে আমরা বেশ কয়েকটি হৃদয়ী সংলাপ হাতে পেতাম। তবে সোভিয়েট ইউনিয়নের অগ্রযাত্রাই ‘রাশিয়ার চিঠি’র বৃহদংশ জুড়ে। এই অগ্রযাত্রার সঙ্গেই দেশের দুরবস্থার তুলনা করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, বেদনাবিদ্ধ হয়েছিলেন”।
রুশ বিপ্লবের অবদানকে চুম্বকে ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক বাসুদেবন বলেন, “লেনিন ও তাঁর সহযোগীরা দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেন। রুশ অর্থডক্স চার্চের ডানা ছাঁটা হয়, প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমিয়ে আনা হয়, এমনকী চার্চটির বিস্তীর্ণ ভূসম্পত্তির কিছুটা বাজেয়াপ্তও করা হয়। এই ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আইন-নির্ভর বিবাহের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য সামন্ততান্ত্রিক রেন্ট ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। যে ফরমান এ ক্ষেত্রে জারি করা হয়, তা নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক; কৃষকদের বলা হয়, যে জমি আপনারা চাষ করছেন, তার মালিকও আপনারা। অর্থাৎ এক কথায়, লাঙল যার, জমি তার।তৃতীয়ত, দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সুতরাং আমরা দেখছি, একটা দ্বিমুখী অভিযান চালু করা হয়েছিল। এক দিকে, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের জমিপ্রদান, অন্য দিকে শহরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ। চতুর্থত, যে আঞ্চলিক সোভিয়েটগুলি স্থানীয় কলকারখানার মালিকানা হাতে নিয়েছিল, তাদের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। জাতীয়করণের বিরাট সূচনা এখান থেকেই। লক্ষণীয়, মাত্র দেড় মাসের মধ্যে গ্রামে-শহরে এই ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করা হয়। এগুলিকে স্মরণে রেখেই আমরা অনায়াসে দাবি করতে পারি, রাশিয়ায় সর্বাত্মক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, ৭ নভেম্বর পেট্রোগ্রাড দখলে যার সূচনা”।
৪ মে তারিখে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে থাকার পর অবশেষে ৯ মে শনিবার অধ্যাপক হরি বাসুদেবন প্রয়াত হলেন। মাত্র আটষট্টি বছর বয়সে তাঁর এই অকাল প্রয়াণ সাধারণভাবে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এবং বিশেষভাবে বামপন্থার ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এক বিরাট ক্ষতি।