পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারতের রাজনীতি অল্প কয়েকদিনে খুব দ্রুত গতিতে বদলাতে শুরু করেছে। প্রায় অর্ধ শতাধিক জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনা দেশবাসীকে শোকে বিমূঢ় করে তুলেছিল, কিন্তু অচিরেই শুরু হয়ে গেল সেই ঘটনার নানা বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া। একদিকে যেমন মত পথ নির্বিশেষে অজস্র মানুষ নিহত সেনা ও শহীদদের পরিজনদের জন্য সমব্যথী হলেন, তেমনি আবার অন্যদিকে শুরু হল এই শোককে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের নোংরা খেলা।
এত বড় ধরনের জঙ্গি হানা কীভাবে ঘটতে পারল,সেনা চলাচলের সময় সমস্ত সুরক্ষাবিধি ঠিকমত মানা হয়েছিল কীনা - এই সমস্ত প্রশ্নকে আমল না দিয়ে শাসক দলের দিক থেকে বেছে নেওয়া হল যুদ্ধোন্মাদনা তৈরির পথ। সেনাবাহিনীর প্রতি দেশবাসীর বৃহত্তর অংশের আবেগ এবং পাকিস্থানের প্রতি দীর্ঘলালিত বৈরিতার মনোভাবকে পুঁজি করে যুদ্ধের আবহ গড়ে তোলা হল।সার্জিকাল স্ট্রাইক -২ থেকে শুরু করে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে চায়ের দোকান থেকে ফেসবুকের ওয়াল, ট্যুইটার হ্যান্ডেল থেকে নামজাদা টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজরুম – সর্বত্র ব্যাপক উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা শুরু হয়ে গেল। অচিরেই শত্রুর তালিকা বাড়তে শুরু করল এবং পাকিস্থানের পাশাপাশি কাশ্মীরী আম জনগণকেও শত্রু তালিকায় ঢুকিয়ে ফেলা হল। কাশ্মীরী ব্যবসায়ীদের পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হল, কাশ্মীরের মানুষজনকে দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে রাজ্যে ফিরে যাবার হুমকি দেওয়া হল। আমাদের কোলকাতা শহরেও হুমকির মুখোমুখি হলেন এক কাশ্মীরী চিকিৎসক, যিনি বহুবছর এই শহরে ডাক্তারী করছেন। বিভিন্ন রাজ্যে কাশ্মীরী মেলা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কাশ্মীরের ছাত্র সহ বিভিন্ন মানুষদের হেনস্থা নিগ্রহ করা হচ্ছে – এরকম উদ্বেগজনক ভিডিও আমরা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পেতে শুরু করলাম। আমাদের আশ্চর্য করে মেঘালয়ের মত দেশেরই এক রাজ্যের রাজ্যপাল তথাগত রায় তাঁর ট্যুইটে অন্য এক রাজ্য কাশ্মীরের অধিবাসীদের পণ্য বয়কটের ডাককে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে দিলেন। পাকিস্থান এবং তারপর কাশ্মীরের জনগণকে শত্রুর তালিকায় বসিয়েই শত্রু নির্ধারণের কাজটা শেষ হয়ে গেল না। মুসলিমদের, বামপন্থীদের, এমনকী সাধারণভাবে যারা ঘৃণা, যুদ্ধোন্মাদনার বিরুদ্ধে শান্তি সংহতির কথা বলছেন – তাদেরও আক্রমণ করা শুরু হল।
জয় শ্রী রাম আর ভারতমাতা কি জয় ধ্বনি দিয়ে এলাকায় এলাকায় দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল গেরুয়া বাহিনী। সোশ্যাল মিডিয়ার লেখালেখিকে কেন্দ্র করে তারাই গণ আদালত বসাল। নিজেরাই আইন, নিজেরাই বিচারক, নিজেরাই শাস্তিদাতার ভূমিকা গ্রহণ করল। অশালীনতম শব্দ ব্যবহার, হুমকি, শারীরিক নিগ্রহ কিছুই বাদ থাকল না। দেশপ্রেমের স্বঘোষিত ঠিকাদাররা নিজেদের মতো করে দেশপ্রেমিক আর দেশদ্রোহী ছাপ্পা মারতে শুরু করে দিল। এল আই সির এক কর্মীকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। কোলকাতার এক নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – ডানলপের দিল্লি পাবলিক স্কুল থেকে একটি ফেসবুক পোস্ট এর জন্য বরখাস্ত করা হল সেখানকার শিক্ষক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মী চিত্রদীপ সোমকে। তিনি তার আগের দিনই প্রবলভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন একদল উন্মত্ত জনতার হাতে, তার বাড়িঘর তছনছ করা হয়েছিল। পুলিশ প্রশাসন এই উন্মত্ত অরাজকতার সামনে কোথাও নীরব দর্শক, কোথাও প্রচ্ছন্ন সমর্থক হয়ে রইলো। এটা এদের সাহস ও কর্মকাণ্ডকে ছড়াতে সাহায্য করল।
এরা শুধু ভিন্ন মতের ওপর তাণ্ডবই চালালো না। কোন কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে আর কোন কোন বিষয়ে চুপ করে থাকতে হবে – এই নয়া গেস্টাপো বাহিনী অচিরে তার তালিকাও পেশ করল।
দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের দিক থেকে - কৃষক, শ্রমজীবী, বেকার বা আধা বেকার যুবকদের মধ্যে থেকে উঠে আসা জ্বলন্ত প্রশ্নগুলিকে থামিয়ে বলা শুরু হল - এখন গণতন্ত্র শিকেয় তোলা থাক, কৃষক শ্রমিকের দাবি শিকেয় তোলা থাক, কর্মসংস্থান বেকারত্বের প্রশ্ন শিকেয় তোলা থাক - পাকিস্থানকে শিক্ষা দেবার ব্যাপারেই আমরা কেবল মনযোগী হই। অর্থাৎ যে সব প্রশ্নগুলি, বুনিয়াদী দাবিগুলি মোদি সরকারকে বিব্রত করেছে সবচেয়ে বেশি, আবার ভোটে জিতে আসার প্রশ্নটিকে প্রবলভাবে সমস্যা সঙ্কুল করে তুলেছে, সেই জ্বলন্ত প্রশ্নগুলিকেই তারা মুছে দিতে আগ্রহী। রক্ষণাত্মক অবস্থান ছেড়ে তারা ক্রমশই আগ্রাসী হয়ে উঠছেন এবং তাদের দিকে ধেয়ে আসা প্রশ্নগুলিকে আড়াল করেই তারা ক্ষান্ত নন। নানাভাবে মোদি বিরোধী শিবিরকে তারা মনগড়াভাবে অভিযুক্ত করে চলেছেন এবং জনগণকে তার স্বপক্ষে আনার চেষ্টা করে চলেছেন। এজন্য ফেক নিউজ ছড়ানো থেকে শারীরিক হামলা চালানো পর্যন্ত সমস্ত পন্থাকেই তারা ব্যবহার করে চলেছেন।
মোদি বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তারা যথেষ্ট জোরেসোরে যুদ্ধের কথা বলছেন না বলে, তারা যথেষ্ট রাষ্ট্রবাদী নন। বামপন্থীদের তো অনেকেই তুলোধনা করা শুরু করেছেন। তাদের স্লোগান নাকী ভারত তেরে টুকরো হোঙ্গে ইনসাল্লাহ ইনসাল্লাহ ইত্যাদি। বিখ্যাত গায়ক সুরকার সোনু নিগমের একটা ভিডিও দেখলাম। সেখানে তিনি তীব্র ব্যঙ্গে বলছেন এই হত্যাকাণ্ডের পরেও রাষ্ট্রবাদী হয়ে বন্দেমাতরম বলার দরকার নেই, ভারত তেরে টুকরো হোঙ্গে স্লোগান দেওয়া যাক। কথা শেষে নমস্তে না বলে লাল সেলাম বলা যাক ইত্যাদি।
এসব দেখলে বোঝা যায় পাকিস্থান বিরোধী ক্ষোভকে প্রসারিত করে দেওয়া হচ্ছে দেশের ভেতরের বিরোধী রাজনীতির দিকেও, বিশেষ করে নিশানা করা হচ্ছে বামপন্থীদের। একদিন শিয়ালদহ স্টেশনে জঙ্গী হানার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল এ বি ভি পির কিছু ছেলেমেয়ে। দেশ বাঁচাও এর পুনরাবৃত্ত স্লোগানটির আগে আরো কিছুর সাথে যেটা সবচেয়ে বেশি করে বলা হচ্ছিল সেটা হল লাল হটাও।
এভাবেই আমরা দেখছি লালেদের, বামেদের, কমিউনিস্টদের দিকে নিশানা সরিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু কেন? বামেদের সমস্ত আন্দোলনই তো এই সময় ঘনীভূত হয়েছে কৃষকের লং মার্চকে ঘিরে, শ্রমিকের ধর্মঘটকে ঘিরে। ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবি আর শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির দাবিই তো তুলেছেন বামেরা। দেশের মধ্যে অসাম্য বৃদ্ধির কথা তুলেছেন। তাহলে কেন এই আক্রমণ?
বোঝা যায় যে রাষ্ট্রবাদ বামেদের আক্রমণ করে নিজেকে দেশপ্রেমিক দেখাতে চায়, সেই রাষ্ট্রবাদে, দেশপ্রেমের সেই ধারণায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন জীবিকা নেই। কৃষকের শ্রমিকের চাওয়া পাওয়া নেই। চিন যুদ্ধের পরের জয় জওয়ান জয় কিষাণের স্লোগানের যে বদল ঘটেছে সেখানে জয় কিষাণ স্লোগানটা মুছে ফেলে জয় জওয়ানটাকেই একমাত্র করে তোলা হয়েছে। অথচ আজও ভারতীয় সেনার সবচেয়ে বড় অংশটা যায় কৃষক পরিবার থেকে, ক্ষেতমজদুর বা গ্রামীণ মজদুর পরিবারগুলি থেকে। অন্নদাতা কৃষকের ফসলের দাম নিয়ে উদ্যত প্রশ্নকে থামিয়ে রেখে জওয়ান প্রেম বা দেশপ্রেম দেখানো এক সুপরিকল্পিত রাজনীতিরই অংশ।
দেশ বলতে শুধু মানচিত্রকে যতদিন বোঝা হবে আর দেশের শ্রমজীবী মানুষের দাবিগুলিকে উপেক্ষা করা হবে, দেশ বলতে কেবল সেনাবাহিনীর ভারী বুটের কুচকাওয়াজকে যতদিন বোঝা হবে আর কৃষকের খালি পায়ের লং মার্চকে উপেক্ষা করা হবে - ততদিন বামপন্থীরা লড়বে দেশপ্রেমের এক অন্য সংজ্ঞাকে প্রতিষ্ঠিত করার নাছোড় লড়াই। ইতিহাস জানে রক্ত ঝরলেও বামপন্থীরা এই লড়াই থেকে সরে আসার মানুষ নন। প্রতিকুল স্রোত বইলেও তারা ভেসে যাওয়ার মতো দুর্বল নন। দেশের মানুষের রুটি রুজি শিক্ষা স্বাস্থ্য জীবনযাপনের মানোন্নয়নের প্রশ্নকেই দেশপ্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার রাস্তায় সবচেয়ে প্রত্যয়ী, সবচেয়ে নাছোড় সৈনিক হিসেবে তারা জনগণের সঙ্গে পথ হাঁটবেন।