কয়েকদিন আগে হোয়াটস অ্যাপে একটি বার্তা বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে বলা হয়েছিল আমাদের সমাজ এক আশ্চর্য সমাজ যেখানে ‘পাঠশালা বন্ধ আর মধুশালা খোলা’। এমনিতে যুক্তির নিরিখে দেখলে মধুশালায় যাতায়াত ব্যক্তিগত ইচ্ছা্র ব্যাপার, কিন্তু পাঠশালা ঠিক তেমন নয়, একটা নিয়মের বিষয় - তাই এই তুলনা খুব যথার্থ নয়। কিন্তু এখানে যুক্তির চেয়েও, ধ্বনিসাম্যের নিরিখে দুটি শব্দের চয়নের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল অন্য একটা প্রশ্ন – লকডাউন শিথিল করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব কোথায় দেব?
যখন মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হল তখনো এসেছিল একটা প্রতি তুলনা। কেউ কেউ বলেছিলেন যে নির্বাচন আয়োজনে যে গুরুত্ব দেওয়া হল, উচিত ছিল সেই গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনের বদলে পরীক্ষার আয়োজন করা। এমনকি নির্বাচনের পর অতিমারী যখন তুঙ্গে তখনো এই কথা উঠেছিল যে পরীক্ষা একেবারে বাতিল না করে অপেক্ষা করা হোক। অতিমারীর ঢেউ খানিক মন্দীভূত হলেই দরকারে জরুরি পরিষেবা ছাড়া অন্য সব কিছু দু সপ্তাহ বন্ধ রেখে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়ার দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। কারণ বিশ লক্ষেরও বেশি পরীক্ষার্থীর দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ এর সঙ্গে জড়িত।
আমরা জানি এই সব আলোচনার কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত সরকার মানেন নি। কিন্তু এগুলি যে পাড়ার মোড়ের বা চায়ের দোকানের চর্চা শুধু নয়, হোয়াটস অ্যাপের ক্যাজুয়াল ফরওয়ার্ডিং বা ফেসবুক পোস্ট এর ব্যাপার নয়, বিশ্বের সামনের সারির বিভিন্ন নীতি নির্ধারক সংস্থারও চিন্তাভাবনা, তাও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে জেনেছি।
অল্প কয়েকদিন আগেই ইউনিসেফ জানিয়েছে যে বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারি নীতি দেখা যাচ্ছে সবার আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করো আর সবার শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলো। ইউনিসেফ এর মতে হওয়া দরকার ঠিক এর বিপরীত। জরুরি প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হলে তা করতে হবে সবার শেষে আর পরিস্থিতি স্বাভাবিকতার দিকে খানিক মোড় নিলে সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে খুলে দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ভারতবর্ষের মতো প্রথাগত শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়ে থাকা এই দেশের জন্য এই চেতাবনি খুবই জরুরি। এমনিতেই অবহেলিত শিক্ষা এই অতিমারীর সময়ে অবহেলার দিকে আরো বেশি গড়িয়ে গেল, তা আমরা সবাই গত দেড় বছরে প্রত্যক্ষ করছি।
তবে এবার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় – সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি সমাজের মধ্যে থেকে ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এখনো অনেকে সংশয়ী নন তা নয়, কিন্তু সাবধানতা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে জনমত ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। স্কুল খোলা নিয়ে যে সমস্বর উঠেছে শিক্ষক অভিভাবক সমাজের ভেতর থেকে, ইউনিসেফ থেকেও এসেছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব - সেই ভেতর বাইরের বক্তব্যের নিরিখে সরকার হয়ত এবার স্কুল খুলে দেবেন।
ফলে অনলাইন ক্লাস এর ওপর একমাত্র নির্ভরতা অনেকটাই কমবে। কিন্তু মহামারী আগামীদিনে কোন বাঁক নেবে, থার্ড ওয়েভ ফোর্থ ওয়েভ ইত্যাদি ঢেউ আসতেই থাকবে কিনা, আসলে তার ব্যাপকতা কতটা হবে – এই সবই অনিশ্চিত। ফলে অনলাইন ক্লাস নিয়ে চিন্তাভাবনাকেও স্কুল কলেজ খোলার উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ক্লাসরুম শিক্ষার পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিকেও তৈরি করে রাখতে হবে, যাতে প্রয়োজনে তাকে আরো অনেক ভালোভাবে, অনেক পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায়। এমনকি স্থান সংকুলানের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হয়ত রোটেশান পদ্ধতি নিতে হবে। এতে ক্লাসঘরের শিক্ষার সময় কমবে। সেই ক্ষতিপূরণের জন্য ক্লাসঘরের শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষাকেও চালিয়ে যেতে হতে পারে।
অনলাইন ক্লাস ইস্কুলের বিকল্প হতে পারবে না কোনওভাবেই - তা প্রথম থেকে জানা ছিল। কিন্তু অনলাইন ক্লাস যতটা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল গত পনেরো ষোলো মাসে - ততটা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবারও বোধহয় কথা ছিল না।
বিশেষ করে যত ঘরে স্মার্ট ফোন আছে, ইন্টারনেট ডেটা প্যাক যতটা সস্তা হয়েছে আগের চেয়ে তার হিসাব নিকাশ করলে মনেই হয় যে অনলাইন ক্লাস যতটা সীমাবদ্ধ হয়ে থেকেছে, তার চেয়ে প্রসারিত হতে পারত।
কেন অনলাইন ক্লাস আরো খানিকটা প্রসারিত হতে পারল না সেই আলোচনা একটা স্বতন্ত্র বিষয়। সেখানে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেটের ডেটা প্যাক, কানেকশান ও গতির সহজলভ্যতা এসবের প্রশ্ন আছে, ছোটদের মনঃসংযোগের প্রশ্ন আছে, শিক্ষাদপ্তরের পরিকল্পনার খামতি নিয়েও প্রশ্ন যে একেবারেই নেই তাও নয়।
কেন এতদিনেও বিভিন্ন শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক ক্লাস মেটেরিয়াল এক জায়গায় রাখার একটা ওয়েব সাইট ও অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ তৈরি করে ফেলা গেল না, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সময় সুযোগ মত ঢুকতে পারত আর দেখে নিতে পারত তাদের পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও ভিডিও, ছবি, চার্ট, ম্যাপ, গ্রাফ, লেখা ইত্যাদি তা বোঝা দুষ্কর।
ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন রাখার আর উত্তর পাওয়ার জায়গাও সেখানে রাখা যেতে পারত, ওয়েব পোর্টালটিকে ইন্টার্যাকটিভ করে তোলার অনেক সুযোগ তো প্রযুক্তি করেই দিয়েছে। তবুও সেই সুযোগকে ব্যবহার করে নেবার দিকে শিক্ষা দপ্তর এগোলেন না।
এই অতিমারীকে মোকাবিলা করে এই সময়ে শিক্ষাকে কিছুটা হলেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা যে এক একটি বিদ্যালয় ও তার শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের বিষয় নয়, সেই উদ্যোগ যতই আন্তরিক হোক না কেন শেষ পর্যন্ত একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো এই বিপুল সমস্যার মোকাবিলায় জরুরি - তা শিক্ষা দপ্তর বুঝে উঠতে পারেন নি বলেই মনে হয়।
এই সমস্ত নানা ধরনের বিষয় ছাড়াও অনলাইন ক্লাস সংক্রান্ত সমস্যাটা অনেকটাই অর্থনৈতিক।
এমনিতেই সরকারি স্কুলে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশ দরিদ্র প্রান্তিক পরিবারের। বিশেষত শহর মফস্বলে। আর এই পুরো বা আধা লকডাউনে এই পরিবারগুলির জীবিকা সঙ্কট মারাত্মক জায়গায় পৌঁছেছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর জন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে যতটা খরচ তারা যোগাতে পারতেন, কষ্ট করে একটা কম দামি নতুন স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে বা বেশি ডেটা প্যাক রিচার্জ করে - এই পরিস্থিতিতে তারা সেটা পারেন নি।
অনেক ছাত্রছাত্রীকে আবার বাবা মার সঙ্গে কাজে নামতে হয়েছে, পড়াশুনোতে ইতি টানতে হয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে এই ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় অনলাইন ক্লাসকে আরো সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। ফলে স্কুল খোলার দাবি সর্বস্তরে আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি এখন।
নতুন কোনও ঢেউ বিপর্যস্ত করে না দিলে বোধহয় এবার চলবে প্রত্যক্ষ ক্লাসরুমের পড়া। কতগুলি ক্লাস নিয়ে আর কতটা রোটেশনে সেগুলি ক্রমশ সামনে আসবে।
কিন্তু মানসিকভাবে বোধহয় এভাবেই সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে যে স্কুল খোলা বন্ধের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আরো ফ্লেক্সিবল হতে হবে সংক্রমণের গোটা পর্বটি জুড়ে। যা বেশ কয়েক বছর বা দশকও স্থায়ী হতে পারে।
সংক্রমণ বাড়লে সাথে সাথে বন্ধ করা আর ঢেউ স্থিমিত হলে দ্রুত খুলে দেওয়া - এই অভিযোজন ছাড়া বোধহয় গতি নেই।
করোনা বিষয়ে সাধারণ মানুষ দূর অস্ত, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষকরাও অনেকটাই অন্ধকারে এখনো। ফলে খোলা মনে এগিয়ে পিছিয়ে পথ চলা ছাড়া অন্য উপায় বোধহয় নেই।
স্কুল খোলার সময়ে আমাদের সকলকেই অনেক বেশি সতর্ক, দায়িত্ববান, সংবেদনশীল ও আন্তরিক হতে হবে। নতুন সময়ের ও পরিস্থিতির দাবিতে যে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষিকা ভীষণভাবেই সাড়া দেবেন, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, উৎসাহ ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন - এটা আশা করাই যায়।
সতর্কতা ও আন্তরিকতা মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা আমরা যে অনেকটাই করে উঠতে পারব - এরকম বিশ্বাস না রাখার কোনও কারণ নেই।
সকলে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবেন আশা করতে অবশ্যই মন চায়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আমাদের শিক্ষব্যবস্থার খোলনলচে বদলে ফেলা। আমাদের পড়ানোর আর পরীক্ষার পদ্ধতি। যে ব্যবস্থায় স্নাতকোত্তর স্তরেও একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতি বছর করা যায় , সেখানে নতুনকে গ্রহণের আগ্রহ কার? কে পরিশ্রম করে মেটেরিয়াল তৈরি করে ওয়েবসাইটে দেবে? কজন শিক্ষক ছাত্রের প্রশ্ন শুনে নিজে ভাবতে বা আরো শিখতে আগ্রহী ? বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডিং মেটেরিয়াল দেখুন আর আমাদের বস্তাপচা ক্লাসনোট।
স্কুল স্তরে সমস্যার স্বরূপ হয়তো আলাদা , কিন্তু মানসিকতা বোধহয় আদতে একই। বদলাতে হবে আমাদের শিক্ষকদের। অনলাইন ওয়েবিনারের ফ্যাশন কাটিয়ে এই মাধ্যমটির উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করতে হবে।