মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্লাসঘরে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু ক্লাসঘরের বাইরেও তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক, আমাদের শিক্ষক। তাঁর লেখালিখির মধ্যে দিয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগটিতে যাঁরা পড়েছেন তারা সকলেই জানেন এই বিভাগের পরিবেশটি কেমন খোলামেলা। সেটা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মাস্টারমশাই দিদিমণিদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকেই হোক বা পড়াশুনোর দিক থেকেই হোক। শুনেছি বুদ্ধদেব বসু যখন এই নতুন বিভাগের পত্তন করলেন তখন থেকেই এই ধারা বজায় আছে। বুদ্ধদেব বসু প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের আকর্ষণ এমনই ছিল যে বিভিন্ন বিষয় থেকে সেখানে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসত। বুদ্ধদেব বসু ছাড়াও সেখানে মাস্টারমশাই হিসেবে ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহ, ফাদার আঁতোয়ান প্রমুখরা। পরে মানববাবু নিজে, অমিয় দেব, নবনীতা দেবসেন প্রমুখরা সেখানে যুক্ত হয়ে যান। আরো পরে যুক্ত হন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। এনাদের ক্লাসের খ্যাতি এমনই ছড়িয়ে পড়ে যে যাদবপুরের নানা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করতে চলে আসতেন তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও। যাদবপুরের বাইরে থেকেও আসতেন অনেকে। বিভাগে ছিল খোলামেলা পরিবেশ। ক্লাস করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা আসত না। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ষাটোর্ধ্ব বাদল সরকার এই বিভাগের নিয়মিত ছাত্র হয়েছিলেন রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে। তিনি যখন ছাত্র, তখন পাঠক্রমে আবার রয়েছে তাঁরই লেখা নাটক। এরকম অনেক আশ্চর্য ঘটনা প্রায়ই ঘটত এই বিভাগে।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিভাগের যে ঔজ্জ্বল্যের ইতিহাস, তাকেই ধারণ করেছিলেন এবং প্রসারিত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ইংরাজী এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষার সাহিত্যের অনুবাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। রয়েছে রুশ সাহিত্য থেকে অনেক উজ্জ্বল অনুবাদও। মানববাবু নিজেও পাস্টেরনাক অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন জুল ভের্ন, কোনাল ডয়েল বা এডগার অ্যালান পো। কিন্তু অনুবাদক হিসেবে তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য। লাতিন আমেরিকান সাহিত্য, আফ্রিকার সাহিত্য, পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যের অনুবাদ এর আগে বাংলা ভাষায় সেভাবে হয় নি। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমেই অধিকংশ বাঙালি পাঠক জেনেছে আলেহো কার্পেন্তিয়ের, হুয়ান রুলফো, সেসার ভায়েহো, ভাসকো পোপা, নিকানোর পাররা, চেসোয়াভ মিউজ, ডেরেক ওয়ালকট, মিসোস্লাভ হোলুব, পিটার বিকসেল সহ আরো অনেক অনেক সাহিত্যিককে। মানববাবু শুধুমাত্র এই সব অঞ্চলের বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের লেখার অনুবাদই করলেন না, তাঁদের সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাও করলেন। সেই মূল্যবান প্রবন্ধগুলি অচেনাকে চেনার প্রবেশক হিসেবে আমাদের সাহায্য করল।
ভারতের নানা ভাষার গল্পর পাঁচখণ্ডের একটি সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। অনুবাদ করেছিলেন বিখ্যাত মালয়লাম লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশীরের অনেকগুলি ছোটগল্প। দেশ দুনিয়ার কিশোর সাহিত্যের অনুবাদ ও সংকলন প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বাঙালি শিশু কিশোরদের মনকে প্রথম থেকেই সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তর দিকে মেলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস প্রয়াসের জন্যও তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যশস্বী অধ্যাপক বা অনুবাদক পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট কবিও। ক্রীড়া সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল। রবীন্দ্রনাথের কিশোর সাহিত্যকে নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখা বইটি অনেক নতুন চিন্তার সন্ধান দেয় আমাদের। বিশেষভাবে স্মরণীয় ভেদ বিভেদ নামে করা তাঁর দু খণ্ডের গল্প সংকলনটি। তাঁর আরেকটি অসামান্য সম্পাদনা কর্মের নিদর্শন “স্পেনের গৃহযুদ্ধ : পঞ্চাশ বছর পরে” বইটি।
মননচর্চার নানা দিকে স্বচ্ছন্দ বিহার সত্ত্বেও মানববাবুর শ্রেষ্ঠ অবদান সম্ভবত লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের অনুবাদ ও তাঁকে ঘিরে চর্চার ক্ষেত্রটিতে। ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে কয়েকজন তরুণ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকের লেখা ইউরো আমেরিকান জগতে বিশেষ সাড়া ফেলে। এই সাড়ার সূত্রে অব্যবহিত আগের পর্বের লেখকেরাও বৃহত্তর পরিধিতে পঠিত হতে থাকেন। সব মিলিয়ে এই পর্বটাকে লাতিন আমেরিকান বুম হিসেবে অভিহিত করা হয়। অব্যবহিত আগের লেখকদের মধ্যে ছিলেন বোর্হেস (আর্জেন্টিনা), মিগুয়েল আস্তুরিয়াস (গুয়েতেমালা), আলেহো কার্পেন্তিয়ের (কিউবা), হুয়ান রুলফো (মেক্সিকো) প্রমুখ। আর লাতিন আমেরিকান বুম এর তরুণ লেখকদের মধ্যে ছিলেন হুলিও কোর্তাজার (আর্জেন্টিনা), কার্লোস ফুয়েন্তেস (মেক্সিকো), গার্সিয়া মার্কেজ (কলম্বিয়া), মারিও ভার্গাস ইয়োসা (পেরু)।
গার্সিয়া মার্কেজ এর কর্ণেলকে কেউ চিঠি লেখে না বা সরল এরেন্দিরার অনুবাদ যখন মানববাবু করছেন, তখনো বাংলায় গার্সিয়া মার্কেজ অনূদিত হন নি। পরে যে গার্সিয়া মার্কেজ ও লাতিন আমেরিকান সাহিত্য অনুবাদের ঢল নামবে বাংলা সাহিত্যে, তার ভগীরথ নিঃসন্দেহে মানববাবু। শুধু গার্সিয়া মার্কেজই নন। হুয়ান রুলফো বা আলেহো কার্পেন্তিয়েরের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ত্ব মানববাবুরই। আলেহো কার্পেন্তিয়েরের রচনা সংকলনটির কথাই ভাবা যাক। এই বইটিতে মানববাবু কার্পেন্তিয়েরের দুটি উপন্যাস – এই মর্তের রাজত্ব ও মৃগয়া এবং ছটি গল্পের অনুবাদ করেছেন। আর তার পরেই এসেছে তাঁর একটি অসামান্য প্রবন্ধ – কুহকী বাস্তবতা, বাস্তবের কুহক ও আলেহো কার্পেন্তিয়ের। একইভাবে উল্লেখ করা যায় হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র বইটির কথা। লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের এই বিষ্ময়কর প্রতিভা কেবল একটি উপন্যাস ও কয়েকটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। পেদ্রো পারামো নামে উপন্যাসটিকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। মানববাবু যখন এর অনুবাদ করলেন, তখনো এই কথাকার আমাদের এখানে প্রায় অপরিচিত। এই বইয়ের শেষে তাঁর লেখা “হুয়ান রুলফোর স্থানুজগৎ” নামে যে অনবদ্য প্রবন্ধটি রয়েছে তা বাঙালি পাঠকের জন্য রুলফো প্রবেশক হিসেবে অনবদ্য। এইভাবে অচেনাকে চিনিয়ে দেবার কাজ মানববাবু সারা জীবন ধরে করে গেছেন।
আমরা আপাতত চলে আসি “এই স্বপ্ন এই গন্তব্য” নামে প্রকাশিত লাতিন আমেরিকান কবিতার অসামান্য সংকলনটির দিকে। এখানে আরহেনতিনার (যাকে আমরা জানি আর্জেন্টিনা উচ্চারণে) এল সালভাদোর, কুবা (কিউবা), গুয়াতেমালা, চিলে, নিকারাগুয়া, পেরু, মেহিকো, হাইতির বিশিষ্ট কবিদের প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতাগুলি এক জায়গায় রয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে লাতিন আমেরিকার কবিতা জগতে প্রবেশের একটি বিস্তৃত মহামূল্যবান প্রাককথন। “লাতিন আমেরিকান বিদ্রোহী কবিতা: পটভূমি ও লক্ষ্য” নামের এই অসামান্য প্রবন্ধটির সঙ্গেই আমরা স্মরণ করতে পারি ব্রাজিলের দুই বিশিষ্ট কবি এডওয়ার্ড কামাউ ব্রাফেট ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা সংকলনের ভূমিকা হিসেবে লেখা “স্তব্ধতার সংস্কৃতি” নামক প্রবন্ধটির কথা।
অনুবাদের পাশাপাশি এইসমস্ত অসামান্য প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দেখাতে থাকেন লাতিন আমেরিকার রক্তাক্ত ইতিহাস ও তার থেকে নতুন এক লাতিন আমেরিকাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন কীভাবে সেখানকার সাহিত্যে ভাষা পাচ্ছে। ভারতে বাণিজ্য করতে আসার স্বপ্নে মশগুল ক্রিস্টোফার কলম্বাস পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে পর্তুগাল থেকে বাণিজ্যতরী নিয়ে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ আমেরিকায়। এরপর স্পেন ও পর্তুগালের তরফে বেশ কিছু অভিযান চলে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলিতে। মায়া, আজটেক ও ইনকা সভ্যতার যাবতীয় চিহ্নকে প্রায় মুছে ফেলে তারা। লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসন এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়। খনি থেকে সোনা রূপো সমেত নানা সম্পদ আহরণ করাই হোক, বা চাষবাস সহ হরেক শ্রমসাধ্য কাজ করাই হোক – তার জন্য লোকের অভাব দেখা যায়। সেই অভাব পূরণ করতে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হয় হাজারে হাজারে মানুষকে। তাদের ক্রীতদাস হিসেবে জুতে দেওয়া হয় নানা কঠোর পরিশ্রমের কাজে, চলে অমানুষিক অত্যাচার। গোটা স্প্যানিশ আমেরিকা বা পর্তুগীজ শাসিত ব্রাজিলের এই শোষণের পর আসে স্বাধীনতা। এবং তারপরে আবার নয়া উপনিবেশের জমানা। এই প্রেক্ষাপটে লাতিন আমেরিকার বিদ্রোহী কবি কথাকারেরা ইউরোপীয় আখ্যান জগৎ থেকে সচেতনভাবে স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন। সেটা রচনার বিষয় ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই। তাঁদের লেখায় রয়েছে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিকতা, যা তাদের লেখার বিষয়বস্তু ও রীতিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তাঁরা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস জুড়ে যে শোষণ চলেছে ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক যুগে, তাকে ও তার প্রতিক্রিয়াকে নানাভাবে ধারণ করতে চান তাঁদের গল্প উপন্যাসে। যেমন যে লাতিন আমেরিকান কথাকার প্রথম নোবেল পুরস্কার পাবেন, সেই আস্তুরিয়াসের ‘ব্যানানা ট্রিলজি’। নয়া ঔপনিবেশিক জমানায় আমেরিকান ফ্রুট কোম্পানি লাতিন আমেরিকার বিরাট পরিমাণ জমিই শুধু নিজেদের হস্তগত করেনি, বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। শ্রম শোষণ ও সম্পদ শোষণের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রবলভাবে ও এইসূত্রেই জন্ম নিয়েছে ব্যানানা রিপাবলিক নামের এক নতুন রাজনৈতিক অভিধা। সম্পদের লুঠতরাজ, শ্রম শোষণ, স্বৈরতন্ত্র এবং সে সবের প্রতিক্রিয়াজাত দ্রোহ রাজনীতির ব্যাপারটি লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে কীভাবে উঠে আসছে অনুবাদ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে তার সাথে নিরন্তর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মানববাবু। তাকাতে শিখিয়েছেন ইউরোপ আমেরিকার বাইরের সাহিত্যের দিকে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, আফ্রিকার সাহিত্য, পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যকে আমরা যতটা চিনেছি আজ, তার অনেকটাই অবদান অধ্যাপক অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের।