এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলকে প্রথম প্রতিক্রিয়ায় অবিশ্বাস্য বলেই বর্ণনা করতে ইচ্ছে করছে এবং এই ফলাফলের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য আরো বেশ কিছু সময় আবশ্যক। এখানে ম্যাক্রো লেভেলের পরিসংখ্যানগুলি থেকে উঠে আসা কিছু কথাই কেবল বলা সম্ভব।
তবে নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণের আগে নির্বাচনী প্রচারের দিকটি নিয়ে দু একটি কথা বলে নেওয়া আবশ্যক। ২০১৪ র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারে উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলিতে অনেকটা জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ এ বিজেপির প্রচারের মূল জোর উন্নয়ন কর্মসংস্থানের মত দিকগুলি থেকে অনেকটাই সরে যায় নানা ধরনের বিভেদের রাজনীতিতে। খুব খোলাখুলিভাবেই তোলা হয় এন আর সি এবং নাগরিকত্ব আইনের মতো বিষয়গুলিকে। একদিকে বাংলাদেশ সহ আশেপাশের দেশগুলি থেকে আসা বহিরাগত বা ঘুষপেটিয়া শব্দটি বারবার শোনা যেতে থাকে এবং অন্যদিকে বহিরাগতদের মধ্যেও মুসলিম অমুসলিম এই স্পষ্ট বিভাজন করে নেওয়া হয় প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব বিল এর সূত্রে। বাস্তবে দুটো মিলিয়ে যেটা দাঁড় করানো হয় সেটা হল মুসলিম বহিরাগতদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে, কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ শিখ খ্রীষ্টান প্রমুখ অমুসলিম যারা বাংলাদেশ সহ প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে এসেছেন তারা শরণার্থীর মর্যাদা নিয়ে সসম্মানে ভারতে থেকে যেতে পারবেন।
এন আর সি এবং নাগরিকত্ব বিলের জোড়াফলাটি অবশ্য খুব সাম্প্রতিক বিষয় ছিল না এবং অনেকদিন ধরেই সেটি বলা হচ্ছিল। এই প্রচারের উগ্র বিভাজন স্বত্ত্বেও সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে বিজেপির ধারাবাহিক পরাজয় ঘটছিল। এই সাম্প্রতিক নির্বাচনের পরাজয়গুলি বিরোধীদের মধ্যে আশা তৈরি করছিল এবং তারাও নির্বাচনী অঙ্কের বাস্তবতা মেনে অতীত বৈরিতা ভুলে অনেকটা কাছাকাছি আসছিলেন। এই জোট অনেক জায়গাতে নিজস্ব বৈরিতাকে অতিক্রম করতে পারে নি - যেমন পশ্চিমবঙ্গ বা দিল্লিতে আবার অনেক জায়গাতে পেরেওছে। যেমন কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে উত্তরপ্রদেশে। তবে প্রাক নির্বাচনী সার্বিক জোট হোক বা না হোক - প্রায় সকল অ এন ডি এ দলই একটি অবিজেপি সরকার তৈরির বিষয়ে একসঙ্গে থাকার, পোস্ট পোল সমঝোতার বার্তা দিয়েছিল। কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ১৯ এ জানুয়ারীর মহাসমাবেশ থেকে এই সমঝোতার বার্তা ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে উঠতে থাকে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের আরো কিছু সমাবেশ বৈঠক যুক্ত কর্মসূচী লাগাতার চলতে থাকে। বিভিন্ন এন ডি শরিকও মাঝেমাঝেই বেসুর বাজতে থাকেন এবং নীতীশের কিছু ভিন্ন সুর থেকে শিবসেনার নানা বিষয়ে প্রকাশ্য বিষোদগার একেবারে সামনে চলে আসে।
এই প্রেক্ষাপটে দেখলেই এবারের নির্বাচনী ফলাফলকে খানিকটা বিষ্ময়কর ও চমকপ্রদ মনে হয়। এই বিষ্ময় গোটা দেশ নিয়ে যেমন আছে তেমনি আছে আমাদের রাজ্যের ফলাফল নিয়েও।
কীভাবে মোদি জমানার সম্পর্কে ওঠা নানা প্রশ্ন - তা সে জি এস টি হোক বা নোটবন্দী বা ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের সংকট, সংখ্যালঘু দলিতদের ওপর লাগাতার আক্রমণ হোক বা যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড, শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দর ব্যাপক কাটছাঁট হোক বা বেকারত্মর রেকর্ড সংখ্যক বৃদ্ধি, কৃষকদের না মেটা লম্বা দাবিদাওয়া হোক বা বিভিন্ন শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী আইন/বিল বা এরকমই আরো অনেক অনেক কিছু প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ও এন ডি এ তথা বিজেপিকে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা দিল - তার উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পুলওয়ামা - বালাকোট পরিঘটনা এবং তাকে ঘিরে উগ্র জাতিয়তাবাদী আবেগ ও সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত প্রচারের বিষয় করে তোলাই পাঁচ বছরের সব ক্ষতকে ঢেকে দিল, কেউ কেউ এমনটা বলার চেষ্টা করছেন। কেউ বা বলছেন শক্তিশালী সরকারের পক্ষে এই জনাদেশ যা কর্মসূচীহীন পাঁচমিশালী বিরোধী খাপছাড়া জোটপ্রচেষ্টাকে মানতে চায় নি। এই যুক্তিগুলি আংশিক সত্য হতে পারে, কিন্তু মোদি সরকারের ব্যাপক বিজয়ের পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ আছে যা আমাদের নানাভাবে আগামীদিনে খোলা মনে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
যা তথ্য পরিসংখ্যান এসেছে এই ভোটের তা থেকে একটা জিনিস পরিস্কার গোটা দেশের কয়েকটি হাতে গোণা রাজ্য ছাড়া সর্বত্র বিজেপির পক্ষে ভোট হয়েছে এবং দ্বিধা দ্বন্দ্ব না রেখে বিজেপিকে ভোটাররা জয়যুক্ত করেছেন।
কয়েকটি রাজ্য, যেমন কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব বিজেপিকে এই দেশজোড়া গেরুয়া ঝড়ের মধ্যেও প্রায় শূন্যহাতে ফিরিয়েছে। অন্যান্য জায়গায় বিজেপিকে শত চেষ্টাতেও আটকানো যায় নি। উদাহরণ হিসেবে বিহারের মহাজোট বা উত্তরপ্রদেশের জোটের কথা বলা যায়।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার অবশ্য যে সব রাজ্যে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে বিজেপির পরাজয় বা বড়সড় ধাক্কার মধ্যে দিয়ে তার সম্ভাব্য পতনের একটা সম্ভাবনার কথা বিবেচিত হচ্ছিল, সেই সমস্ত রাজ্যগুলিতেই বিজেপির অপ্রত্যাশিত ভালো ফল করেছে। গুজরাট, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় বা রাজস্থানের ফলাফল সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনগুলির ঠিক বিপ্রতীপ চেহারা এত দ্রুত কীভাবে নিল, তার নানামাত্রিক বিশ্লেষণ দরকার।
যে গ্রামীণ গুজরাট বিজেপিকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছিল, সেখানে এবার গুজরাটে সবকটি আসনেই, ২৬টিতে ২৬টিই বিজেপি জিতেছে, কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধীরা খাতাই খুলতে পারে নি। কমাস আগে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির গড় তথা মোদি শাহর নিজেদের রাজ্য গুজরাটে কংগ্রেস প্রায় অর্ধেক আসন জিতেছিল।
গুজরাটের মতোই আশ্চর্যের কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের নির্বাচনী রায়। এগুলির অনেকগুলিতেই সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যের শাসনভার থেকে বিজেপিকে অপসারিত হতে হয়েছিল। কর্ণাটকে ২৮ টার মধ্যে ২৬ টা, মধ্যপ্রদেশে ২৯টার মধ্যে ২৭ টা, রাজস্থানে ২৫ টায় ২৫ টা এবং ছত্তিশগড়ে ১১ টির মধ্যে ৯ টি আসনে বিজেপির অতি বিপুল বিজয়ের সাথে সদ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের ছবিটির বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ আরো নানা তথ্য পরিসংখ্যান ও মাইক্রো লেভেল অবজার্ভেশনের মধ্যে দিয়ে এর ব্যাখ্যা আগামীদিনে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।
এইসব রাজ্যগুলির যেগুলিতে তারা ক্ষমতায় নেই, সেগুলির প্রায় সর্বত্র বিজেপি এবার বিধানসভা দখল নেওয়ার জায়গাতেও হয়ত চলে যাবে, কিছু কিছু বিধায়কের দল বদলের মধ্যে দিয়ে।
বিজেপি গতবার লোকসভায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য পেলেও রাজ্যসভায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা তার ছিল না। ফলে অনেকক্ষেত্রে তাকে কিছুটা ধীরে চলতে হয়েছিল বা কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট এ যেতে হয়েছিল। এবার দুই কক্ষেই কিছুদিনের মধ্যে তার হাতে গরিষ্ঠতা চলে আসবে এবং নিজেদের পছন্দের আইন তৈরিতে সে বল্গাহীন গতিতে ছুটতে পারবে।
পশ্চিমবঙ্গে ভোট শতাংশ ও আসনসংখ্যার দিক থেকে বিজেপি তৃণমূলকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে এবং ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের অনেক আগেই যে তৃণমূলের ঘর অনেকটা ফাঁকা হয়ে যাবে, তেমন অনুমানের যথেষ্ট কারণ আছে। পালাবদলের সমস্ত ইঙ্গিৎ স্পষ্ট হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে এবং আসন ও ভোট শতাংশের হিসেবে তৃণমূলের এখনো সামান্য এগিয়ে থাকার সংখ্যাগত গুরুত্ব সামান্যই।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের যে ৪৪ শতাংশ ভোট ব্যাঙ্ক এখনো অটুট দেখাচ্ছে সেটার অধিকাংশই শাসক হিসেবে তার নিরঙ্কুশ আধিপত্যের সুবাদে হাসিল করা। নিরঙ্কুশতার চমকানি ধমকানি এবার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করা মাত্র, পুলিশ প্রশাসনের আগামী ইঙ্গিৎ পেয়ে নতুন ভূমিকায় যাওয়া শুরু করা মাত্র দেখা দিতে শুরু করবে এই ভোটের বিপুল ক্ষয়।
মমতা মোদিকে "গণতন্ত্রের থাপ্পড়" মারতে চেয়েছিলেন এই নির্বাচনে। এটা কতটা তিনি দিতে পেরেছেন আর কতটা তিনি খেয়েছেন সেই হিসাব কষার সময় তিনি নিশ্চয় এটাও হিসাব করবেন পশ্চিমবঙ্গে বাম কংগ্রেসের স্বাভাবিক বিরোধী রাজনীতি করার জমিটুকু কেড়ে নিয়ে তিনি তাদের পাশাপাশি নিজেরও কি মারাত্মক সর্বণাশ ডেকে আনলেন। বামেরা ২০১১ য় ক্ষমতা থেকে চলে যাবার পর একের পর এক বাম বিধায়ক সাংসদ নেতা মন্ত্রীদের, বাম কর্মী সমর্থকদের ওপর তিনি হামলা চালিয়ে গেছেন ও স্বাভাবিক রাজনীতি করার পরিসরটাই অনেকটা বন্ধ করে দিয়েছেন। রেজ্জাক মোল্লাদের মত অনেককে প্রথমে হাসপাতালে বা জেলে পাঠিয়ে, তারপর পার্টিতে ঢুকতে বাধ্য করার যে রাজনীতি তিনি চালিয়ে গেছেন তার প্রয়োগ কংগ্রেসের ওপরেও হয়েছে। সব ই আমার চাই - এটা ততদিনই তাকে সাফল্য দিয়ে গেছে যতক্ষণ না আরো বড় দাদাগিরির ভ্রুকুটি ও কেন্দ্রীয় সরকারের চমকানি ধমকানি তাকে বাস্তবের মাটিতে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছে।
সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল মমতা ও তৃণমূলের চমক ধমকের চূড়ান্ত পর্ব এবং তারপরই সম্ভবত রাজ্যের গরিষ্ঠ সংখ্যক তৃণমূল বিরোধী চুপচাপ ফুলে ছাপ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং পদ্মতে এবার ছাপ দেন। বামভোট যে একধাক্কায় ২৭ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নেমে এল, সেটা বাম রাজনীতির দিক থেকে একদিকে যেমন নজিরবিহীন সঙ্কটের ব্যাপার, তেমনি তৃণমূলের জন্যও তা এক বড় সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়াল। অন্যদিকে কংগ্রেসও ৪ টি লোকসভা আসন থেকে যে ১/২ এ নেমে আসল এবং জঙ্গীপুর, রায়গঞ্জ, মালদা, মুর্শিদাবাদ সবেরই দখল নিতে গিয়ে মমতা কংগ্রেস এবং প্রকারান্তরে নিজেরও ক্ষতি করলেন এবং কেবল বিজেপিই এর দ্বারা লাভবান হল। মমতা ও তার দল হয়ত এবার এই রাজনীতির ভালোমন্দের বিশ্লেষণে যাবেন, তবে বোধহয় বাংলার রাজনীতি আগামী বেশ কিছুদিনের জন্য এক নতুন ই - রিভার্সেবল গতিপথ নিয়ে নিয়েছে। রাজনীতির সমস্ত অসম্ভাব্য বাঁকের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই এই ই-রিভার্সেবল ট্রেণ্ড টেন্ডেন্সির কথা মাথায় আসছে।
বামেদের ভয়াবহ বিপর্যয় যে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই হল তা নয়, কেরলেও বামেরা পর্যদুস্ত হলেন এবং সেটা রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় আসীন থেকেই। কেরলে বিজেপি একটিও আসন জিততে পারে নি অর্থাৎ সেখানে সিপিএম তথা বামেদের পরাজয় গেরুয়া ঝড়ের কাছে হয় নি, হয়েছে কংগ্রেসের হাতে। কেরালায় নজিরবিহীনভাবে এবার ২০ টির মধ্যে ১৮ টি আসন তারা পেয়েছে এবং এটা গোটা দেশে তাদের মোট জেতা আসনে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি।
সিপিএম এর বাইরে অন্যান্য যারা বিহার ঝাড়খণ্ডে খানিকটা আশা জাগিয়েছিলেন তারাও বিজেপি ঝড়ের সামনে জিততে ব্যর্থই হলেন। সি পি আই এর কানহাইয়া কুমার বেগুসরাইতে হারলেন। আরজেডির সমর্থনের পরও আরায় জিততে পারলেন না লিবারেশনের রাজু যাদব। আর বিহারের সিওয়ান বা ঝাড়খণ্ডের কোডার্মায় লিবারেশন তাদের প্রথাগত ভোটও বিজেপি ঝড়ের মুখে ধরে রাখতে সক্ষম হন নি। সাম্প্রতিককালে কৃষক আন্দোলন ও লং মার্চের রাস্তার লড়াই যে উদ্দীপণা মহারাষ্ট্র রাজস্থানে তৈরি করেছিল, তা বামেদের না এই রাজ্যগুলিতে, না তাদের প্রথাগত শক্তির জায়গাগুলিতে নির্বাচনী সাফল্য দিতে পেরেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এরকম নজিরবিহীন বিপর্যয় বামেদের আর আসে নি। এই বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ করে পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে কি কি করার আছে, তা নিয়ে অবশ্যই আগামীদিনে খোলামনে আলাপ আলোচনায় বসতে হবে বামেদের।