এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  মনে রবে

  • মিলান কুন্দেরা ও প্রাগ বসন্ত সম্পর্কে দু চার কথা

    সৌভিক ঘোষাল
    পড়াবই | মনে রবে | ১৭ জুলাই ২০২৩ | ১১২৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)


  • লুডভিগ যখন কলেজে পড়ত তখন তার এক বান্ধবী তাকে বলেছিল আশাবাদী তরুণেরা মার্কসবাদ থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করতে থাকে। লুডভিগ রসিকতা করে সেই বান্ধবীকে এর জবাবে লিখেছিল, "Optimism is the opium of mankind! A healthy spirit stinks of stupidity! Long live Trotsky!" সেই বান্ধবীর থেকে এই কথাটা ক্রমশ নানা জায়গায় ছড়াল।

    সেটা ১৯৫০ এর দশক। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ এ চেকস্লোভাকিয়া এসেছে কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে। এই ধরনের রঙ্গতামাসা কর্তৃপক্ষ খুব একটা পছন্দ করলেন না। তারা লুডভিগকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তো তাড়ালেনই। তাড়িয়ে দিলেন কলেজ থেকেও। লুডভিগকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হল। যেতে হল লেবার ক্যাম্পে। খনিতে কঠোর পরিশ্রমের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল।

    অনেক বছর পরে লুডভিগ মোরাভিয়াতে ফেরে। তার নিজের শহরে। ততদিনে সে সফল এক বিজ্ঞানী। যদিও অতীতের নানা অভিজ্ঞতায় তার মন তিক্ত। এক রসিকতার জন্য তার তারুণ্যের দিনগুলো কীভাবে তিক্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা সে ভুলতে পারে না। জেমেনেক বলে যে তাকে পার্টি বিরোধী অবস্থানের জন্য দেওয়া শাস্তির অন্যতম হোতা ছিল, তাকে লুডভিগ নানাভাবে শাস্তি দিতে চায়। জেমেনেকের স্ত্রী হেলেনার সঙ্গে সে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে, তাকে জেমেনেকের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু জেমেনেকের কাছে এটা শাস্তি না হয়ে সুবিধে হিসেবে দেখা দেয়। হেলেনা ডিভোর্স নিয়ে নেওয়ায় সে তার প্রেমিকার সঙ্গে নির্বিঘ্নে দিনযাপন শুরু করে।

    ১৯৬৫ সালেই লুডভিগ বলে চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে মিলান কুন্দেরা তাঁর ‘দ্য জোক’ উপন্যাসটি লিখে ফেলেছিলেন। তবে রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের আওতায় তা তখন প্রকাশিত হয় নি। ১৯৬৭ সালে সেটি প্রকাশিত হল। অনতি পরেই অবশ্য সেটি আবার নিষিদ্ধ হয়ে যায় চেকস্লোভাকিয়ায়। পরবর্তীকালে মিলান কুন্দেরাকে দেশও ছাড়তে হয়। আশ্রয় নিতে হয় প্যারিসে। আমৃত্যু সেটাই ছিল তাঁর শহর। একসময় তিনি চেক ভাষায় লেখালিখিও ছেড়ে দেন। লেখার ভাষা হিসেবে বেছে নেন ফরাসী।

    চেক কমিউনিজম ও কুন্দেরার সম্পর্ক নানা পর্বে ওঠানামা করেছে। যে কুন্দেরা কমিউনিস্টরা চেকস্লোভাকিয়ায় ক্ষমতায় আসার আগেই নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ, কমিউনিস্টদের চেকস্লোভাকিয়ার ক্ষমতা দখলের লড়াইতে ছিলেন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, তিনি অচিরেই এর বিরোধী হয়ে উঠলেন। এতটাই কড়া সমালোচনা শুরু করলেন কমিউনিস্ট পার্টির যে ১৯৫০ সালেই তাঁকে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হতে হল ? ১৯৫৬ সালে আবার তাঁকে পার্টিতে ফেরানো হল। ১৯৬৭ – ৬৮ র পালাবদলের সময়ে তিনি হয়ে উঠলেন পার্টির এক প্রধান বুদ্ধিজীবী লেখক। তৎকালীন সংস্কার কর্মসূচীর পক্ষে চলল তাঁর সওয়াল ও লেখালিখি। কিন্তু সংস্কারকে যখন আবার আটকানো হল, কুন্দেরা আবার চলে গেলেন কালো তালিকায়। তাঁকে আবার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হতে হল। নিষিদ্ধ হল তাঁর উপন্যাসও। কুন্দেরার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ এর বিলম্বিত প্রকাশ, সাময়িক সাফল্য ও পুনরায় রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের আওতায় পড়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চেকস্লোভাকিয়ার রাজনীতির নানা পালাবদল। বিশেষ করে ১৯৬৮ র প্রাগ বসন্ত। প্রাগ বসন্তের সেই ইতিহাস বাদ দিয়ে কুন্দেরা, তাঁর লেখালিখি পড়াই সম্ভব নয়। বোঝা সম্ভব নয় কুন্দেরার রাজনৈতিক দর্শনকেও।

    প্রাগ বসন্তর সময়কালটা ১৯৬৮। সেই বছরেই শুরু হবে প্যারিসের বিখ্যাত ছাত্র আন্দোলন৷ তার রেশ গোটা পৃথিবীতেই ছড়াবে। নানা জায়গায় দেখা দেবে ছাত্র আন্দোলন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সে সবের আগেই প্রাগে শুরু হয়ে গিয়েছিল বদলের জন্য লড়াইটা। ১৯৬৩ সালে চেকস্লোভাকিয়ার লিবলিসে একটি বিভিন্ন মার্কসবাদী সাহিত্য বেত্তাদের উদ্যোগে একটি সাহিত্য সম্মেলন হয়, যা পরে রাজনৈতিকভাবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চেকস্লোভাকিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক ফ্রাঞ্জ কাফকার মূল্যায়ন কীভাবে হবে, তাঁর রাজনীতির বৈশিষ্ট্য কী – সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তাঁর সাহিত্যকে কীভাবে দেখা দরকার – এই নিয়েই এই সম্মেলনে আলোচনা হয়। উপলক্ষ্য ছিল কাফকার আশিতম জন্মবার্ষিকী। এই সম্মেলন সাহিত্যবিচারেই শুধু উদারতার কথা বলে নি, সামগ্রিকভাবে সমাজ রাষ্ট্রের মধ্যেই খোলা হাওয়ার কথা বলেছিল। এই খোলা হাওয়ার পক্ষে মতামত ক্রমশ বাড়তে থাকে চেকস্লোভাকিয়ার অন্দরে।

    চেকস্লোভাকিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি তথা রাষ্ট্রপ্রধান আন্তোনিন নোভোৎনি ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন। তিনি ছিলেন ক্রুশ্চেভ অনুগামী ও চেকস্লোভাকিয়ায় নিস্তালীনিকরণ কর্মসূচীর রূপদানকারী। কিন্তু আর্থিক সংস্কার বা গণতান্ত্রিক সংস্কারের বদলে স্তালিন জমানার নেতৃত্বকে ক্ষমতা থেকে সরানো ও নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা ছাড়া তিনি বিশেষ কিছু করেন নি। খোলা হাওয়ার পক্ষে ওঠা মতামতকে গ্রাহ্য না করে তিনি সিনেমা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার রাস্তায় হাঁটলেন। এসবের ফলে সমাজ রাষ্ট্রে তো বটেই, পার্টির ভেতরেও নানা অসন্তোষ দেখা দেয় তাঁকে নিয়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি চেকস্লোভাকিয়ায় ডেকে আনলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ব্রেজনেভকে। ব্রেজনেভ এসেও আঁচ পেলেন নোভোৎনি বিরোধী ক্ষোভের, বুঝলেন ক্ষমতার বদল দরকার। নোভৎনিকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হল। ১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি চেক কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন দুবচেক। চেকস্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি বেছে নিলেন লুদভিক সাবোদাকে।

    প্রাগ বসন্তের মূল কারগর এই দুবচেকই। অবশ্য সমাজ ও ক্ষমতাবৃত্তের একটি অংশও তখন পরিবর্তন চাইছিল। চাইছিল পশ্চিম ইউরোপের মতো আরো বেশি ব্যক্তি স্বাধীনতা, খোলা বাজার অর্থনীতি, ভোগ্যপণ্যের আধিক্য। চাইছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচন। এগুলিকে ভাষা দিলেন দুবচেক ও তাঁর নতুন মন্ত্রীসভার অনেকে। পার্টি প্রশাসনের একাংশও পরিবর্তনের পক্ষে থাকল। এইসময়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দুবচেক নোভৎনিনের অনেক নীতির বিরুদ্ধে খোলাখুলি কথা বললেন। নীতি বদলের কথা বলে তরুণ সমাজকে স্বপ্ন দেখালেন গণতন্ত্র আর খোলা বাজার অর্থনীতির। নতুন চেকস্লোভাক সরকার বেশ কিছু নীতি পরিবর্তনের দিকে হাঁটার কথা বলল। এর নাম দেওয়া হল ‘মানবিক মুখের সমাজতন্ত্র’, ‘সোশ্যালিজম উইথ এ হিউম্যান ফেস’। এই নীতিমালার মধ্যে থাকল সংবাদমাধ্যমের আরো অনেক বেশি স্বাধীনতার কথা। থাকল বাক স্বাধীনতার কথা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকারের কথা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথা বলা হল। তার অন্যতম ভোগ্যপণ্য তৈরির ক্ষেত্রে জোর বাড়ানো। চেক ও স্লোভাক – চেকস্লোভাকিয়ার দুই অংশকে সায়ত্তশাসন দেবার নীতিও গৃহীত হয়।

    নীতি বদলের যে দিকটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তৈরি হয় তা হল আগামী দশ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে কিছু পরিবর্তন এনে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নির্বাচন আর হয় নি চেকস্লোভাকিয়ায়। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলি রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারে নি। দুবচেকের আমলে একদিকে যেমন সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এল, নানা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা শুরু করতে শুরু করল অপেক্ষাকৃত স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি, তেমনি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি – এদেরও পুনরুত্থানের ইঙ্গিৎ দেখা গেল।

    সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বন্ধুরাষ্ট্রগুলি চেকস্লোভাকিয়ার এইসব পরিবর্তন, বিশেষ করে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথাবার্তাকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখল। চেকস্লোভাকিয়ার সঙ্গে তারা বৈঠকে বসল। ২৩ মার্চ পূর্ব জার্মানীর ড্রেসডেনে প্রথম বৈঠক বসল। চেকস্লোভাক প্রতিনিধি দলের পাশাপাশি এই বৈঠকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানী, হাঙ্গেরি, পোল্যাণ্ড, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্র ও পার্টি প্রধানরাও হাজির ছিলেন। চেকস্লোভাকিয়ার প্রস্তাবিত সংস্কার কর্মসূচী সম্পর্কে হাঙ্গেরী ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। পোলিশরাও এই সংস্কারের পক্ষেই ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ধরনের সংস্কার সম্পর্কে ঘোরতর আপত্তি জানায়। গণতন্ত্রের পক্ষে যাত্রা সংক্রান্ত কথাবার্তাকে তারা সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি সমালোচনা হিসেবেই দেখেন। চেকস্লাভ সংবাদমাধ্যম নতুন পরিস্থিতিতে যে ধরনের লেখালিখি করছে তার উশকানিতে ১৯৫৬ র অক্টোবর নভেম্বরে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত প্রভাবাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে যেমন হয়েছিল, তেমন ধরনের 'প্রতিবিপ্লবের পরিস্থিতি' তৈরি হতে পারে ভেবেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

    ১৯৬৮ র মে মাসেই চেকস্লোভাকিয়ার বিভিন্ন গণতন্ত্র সমর্থক সংগঠনগুলির মধ্যে কেজিবির চরেরা ঢুকে পড়ে ও খবর সংগ্রহ করতে শুরু করে। ২৯ জুলাই থেকে ১ অগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চেকস্লাভ নেতাদের মধ্যে চেক সোভিয়েত সীমান্ত অঞ্চলে এক বৈঠক হয়। ব্রেজনেভ, কোসিগিন, দুবচেক - দু পক্ষের শীর্ষনেতারাই এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এইসব আলাপ আলোচনার মাধ্যমে রফাসূত্র বের করা সম্ভব হল না। নানা গোপন রিপোর্ট থেকে পাওয়া প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান থেকে চেক সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার কথা বলে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশভুক্ত জোটের সেনাবাহিনী চেক প্রজাতন্ত্রে পৌঁছল ২০ অগস্ট ১৯৬৮ র মধ্যরাতে। সেনার সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখেরও বেশি। সঙ্গে কামান, ট্যাঙ্ক, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। পরের দিনই সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সেনা চেক কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর সহ প্রাগ শহরের দখল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। চেক রেডিওতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব জনগণকে সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে কোনও আগ্রাসী নীতি না নিয়ে শান্ত থাকার পরামর্শ দিলেন। দুবচেক গ্রেপ্তার হলেন। তাঁকে মস্কোয় নিয়ে আসা হল। সোভিয়েতের দেওয়া মস্কো প্রোটোকলের সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে সইসাবুদ করার পরেই তিনি ফিরতে পারলেন চেকস্লোভাকিয়ায়। এরপরের কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার দুবচেককে মস্কোয় হাজিরা দিতে হয়েছে। সোভিয়েত নেতৃত্ব না খুশি হতে পারছিলেন দুবচেক সরকারের ওপর, না তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন। দুবচেকের পক্ষেও পরিস্থিতি ছিল বেশ কঠিন। একদিকে পুরনো পথে চলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরন্তর চাপ, অন্যদিকে দেশের ভেতরে পুরনো কট্টরপন্থী ও নতুন পরিবর্তনপন্থীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এসবের মাঝে সমাধানসূত্র বের করা দুবচেকের পক্ষে ক্রমেই অসম্ভব হতে থাকে। ১৯৬৯ এর এপ্রিলে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকের পদ থেকে দুবচেক পদত্যাগ করেন। নতুন সম্পাদক হন গুস্তাভ হুসাক। সোভিয়েত চাপের কাছে নত হয়ে হুসাকের নেতৃত্বে চেকস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার প্রাগ বসন্তের ঘোষণাগুলি থেকে সরে এসে প্রাক দুবচেক আমলের নীতিতে চলতে শুরু করে। কিছুদিন পরে পার্টিতে শুরু হয় বহিষ্কারের পালা। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পার্টি সদস্য, যারা প্রাগ বসন্তের নীতিমালার দিকে ছিলেন, তাঁদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। যে কোনও ধরনের প্রতিবাদকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য পুলিশের হাতে আরো অনেক বেশি ক্ষমতা দেবার জন্য চেকস্লোভাকিয়ার সংসদে গৃহীত হয় নতুন ‘ব্যাটন আইন’।

    নতুন জমানায় কুন্দেরার দ্য জোক উপন্যাসটি চেকস্লোভাকিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। চেকস্লোভাকিয়ায় থাকাকালীন তাঁর আর কোনও উপন্যাস এখান থেকে প্রকাশিত হয় নি। কুন্দেরার দ্বিতীয় উপন্যাস - লাইফ ইজ এলসহোয়ার ফরাসী ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। এর চেক সংস্করণ বেরোয় তার ছ বছর পর, ১৯৭৯ সালে। এর আগেই, ১৯৭৫ সালে, কুন্দেরা চেকস্লোভাকিয়া ছেড়ে ফ্রান্সে দেশান্তরী হয়েছেন। ফ্রান্সে থাকাকালীন তাঁর প্রথম বই ‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যাণ্ড ফরগেটিং’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। এতে একইসঙ্গে রয়েছে উপন্যাস ও ছোটগল্প।

    প্রাগ বসন্তের দিনকাল এবং তার ওপর নেমে আসা আগ্রাসন নিয়ে কুন্দেরা ১৯৮২ সালে লেখেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’। এটি চেক ভাষায় লিখলেও এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ফরাসী ভাষায়। লেখার দু বছর পর ১৯৮৪ সালে। সে বছরেই মূল চেক পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে বেরোয় এর ইংরাজী অনুবাদ। মূল চেক ভাষায় উপন্যাসটি বেরোয় পরের বছর, ১৯৮৫ সালে। এই উপন্যাসের পটভূমিও প্রাগ বসন্ত। এর প্রধান চরিত্র পাত্ররা হল টমাস, তার স্ত্রী টেরেজা, টমাসের প্রেয়সী সাবিনা, সাবিনার আর এক প্রেমিক ফ্রানজ। শুধু এই চরিত্র পরিচয়গুলো থেকেই আঁচ করা যায় বিবাহ সম্পর্কের বাইরের খোলামেলা দিকটি এই উপন্যাসে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধান চরিত্র টমাস সত্যিই মনে করে স্ত্রী টেরেজার প্রতি তার ভালোবাসা এবং অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক তৈরি করার মধ্যে কোনও স্ববিরোধ নেই। দুটিই একইসঙ্গে সম্ভব। টেরেজাও স্বামীর বহুগামিতার কথা জানে। সে এই বহুগামিতার জন্য চিন্তিত নয়। তার শুধু ভয় সেও না স্বামীর কাছে ভালোবাসার মানুষের বদলে কোনওদিন শুধু এক নারী শরীর হয়ে ওঠে। উপন্যাসের আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সাবিনা একইসঙ্গে ভালোবাসে টমাস এবং ফ্রানজকে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নীতিমালার গণ্ডীকে সে কিছুতেই মানতে রাজী নয়। কমিউনিস্ট অনুশাসনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের ভাষাকে সে রূপ দেয় তার আঁকা ছবিতে। অন্যদিকে টেরেজাও প্রাগ বসন্তের দিনগুলিতে ঝুঁকি নিয়ে চিত্র সাংবাদিকতার কাজ করে যায়। ক্যামেরায় ধরে রাখে সোভিয়েত সেনার আগ্রাসনের মুহূর্তগুলো। উপন্যাসের আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ফ্রানজ লেখালিখি এবং পড়াশুনোর জগতের লোক। কিন্তু সমাজ রাষ্ট্রের ক্ষতচিহ্নগুলোর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে সে প্রতিবাদ করে। তা সে দেশের ভেতরেই হোক বা বাইরে। ব্যাঙ্ককে এমন এক পরিস্থিতিতেই সে প্রাণাত্মক আঘাত পায়।

    উপন্যাসের নায়ক টমাস পেশায় একজন শল্য চিকিৎসক। প্রাগ বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে চেকস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ গোষ্ঠীর সেনাবাহিনী হানা দিলে সে তার স্ত্রী টেরেজাকে নিয়ে সুইজারল্যাণ্ডের রাজধানী জুরিখে চলে যায়। টেরেজা অবশ্য বিদেশের পরিবেশে ক্লান্তিবোধ করতে থাকে ও ফিরে আসে প্রাগে। কিছুদিন পর টমাস দেখে স্ত্রীকে ছেড়ে তারও প্রবাসে ভালো লাগছে না। সেও প্রাগে ফেরে। ততদিনে প্রাগ বসন্তের সমাপ্তি ঘটেছে। দুবচেকদের বদলে শুরু হয়েছে গুস্তাভ হুসাকের জমানা। এসেছে কঠোর দমনমূলক ব্যাটন আইন। চলছে পার্টি সদস্যদের গণহারে বহিষ্কার। সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশিকায় ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলছে প্রাগের চেকস্লোভাক সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি। এই অবস্থায় প্রাগের জীবন অসহ্য বোধ করে প্রাগ ছেড়ে চেকস্লোভাকিয়ার গ্রামাঞ্চলেই চলে যান টমাস টেরিজা দম্পতি। সেখানে তারা সুখের অন্য মানে খুঁজে পান। টমাস বেরিয়ে আসেন এক নারী থেকে অন্য নারীতে শরীরী গমনের অভ্যাস থেকে।

    এই উপন্যাসের পরিণতি অংশ পড়তে পড়তে আমাদের কৌতূহল তৈরি হয় এই নিয়ে যে অভিবাসী জীবনে কুন্দেরা নিজেও কি যন্ত্রণাদগ্ধ ছিলেন? তাঁর উপন্যাসের নায়ক নায়িকা টমাস টেরিজার মতো? এই জল্পনা আরো বাড়ে যখন ২০০০ সালে সত্তর পেরনো অভিবাসী কুন্দেরা লেখেন তাঁর ‘ইগনোরেন্স’ উপন্যাসটি। উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছে আটষট্টির প্রাগ বসন্তের সময় চেকস্লোভাকিয়া থেকে দেশান্তরী হওয়া দু জন মানুষ। আছে তাঁদের নতুন করে জীবনকে দেখা, আছে ফেলে আসা জীবনের জন্য মায়া ও যন্ত্রণা।

    কিন্তু উপন্যাসে অভিবাসী জীবনের যে যন্ত্রণাই থাকুক না কেন, বাস্তবে ব্যক্তি মানুষ কুন্দেরা কি এর দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন? তিনি তো আজীবন প্যারিসেই থেকে গেলেন। এমনকী নব্বইয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য সব দেশের মতো যখন চেকস্লোভাকিয়াতেও কমিউনিস্ট জমানার অবসান হল, তখনও তো ফিরলেন না দেশে। শুধু তাই নয় লেখালিখির ভাষা হিসেবেও ত্যাগ করলেন মাতৃভাষা চেককে। শেষদিকে লিখে গেলেন কেবল ফরাসীতেই। এজন্যও কোনও আক্ষেপ কি ছিল না তাঁর?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ১৭ জুলাই ২০২৩ | ১১২৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Somenath Guha | ১৮ জুলাই ২০২৩ ০০:০৯521375
  • কুন্দেরার ভাবনা, স্টাইল জটিল। সেসবের পাশ কাটিয়ে এটা বেশ একটা সোজাসাপটা সরল লেখা! 
  • TANJAN BOSE | ১৮ জুলাই ২০২৩ ১৩:৫০521390
  • বাহ৷ ওঁর বইগুলো নিয়ে পরে আরো বিস্তারিত ভাবে লেখার অনুরোধ রইল৷ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন