কাফকা কেন এখনও প্রাসঙ্গিক, এবং পূর্বইউরোপেও ভীষণভাবে সমসাময়িক, তা নিয়ে কুন্দেরা একদা একটি লম্বা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সে পূর্ব ইউরোপ অবশ্য আর নেই। কুন্দেরাও আর নেই। তাই এবার আমাদের লেখার সময়। ওইসব পুরোনো পুরোনো লেখা, যার বহুলাংশই সোভিয়েত-যুগ নিয়ে লেখা, সেসব কি আদৌ প্রাসঙ্গিক আর? মার্কেজ, কুন্দেরা আর একো, এই তিনজন আমাদের যৌবনের বিদেশী হিরো ছিলেন, হলিউডি ক্লিন্ট ইস্টউড যেন, কিন্তু সেটা তো কুন্দেরা পড়ার কোনো কারণ হতে পারেনা। সেই সোভিয়েত নেই, সেই বার্লিন পাঁচিল নেই, সেই লৌহ-যবনিকা আর নেই, এমনকি প্রাহার সেই বসন্তও আর নেই। তাই, কেন কুন্দেরা?
কারণ, কাফকার মতো কুন্দেরাও জানতেন রসিকতার মানে। রসিকতা তো রসিকতা নয়, সে এক আক্রমণ, তার জন্য কী মূল্য চোকাতে হতে পারে, রক্তমাংস হাড়মজ্জা দিয়ে টের পেয়েছিলেন। তাঁর উপন্যাস, সম্ভবত প্রথম উপন্যাস, তার নামই হল 'রসিকতা'। লুদভিগ তার নায়ক। কলেজে পড়ার সময় গ্রীষ্মের ছুটিতে তার বান্ধবী তাকে মার্কসবাদের সূর্যকিরণে উজ্জ্বল যুবকদের কথা লিখেছিল। আশাবাদ এবং স্বপ্নের কথা লিখেছিল। এক মনোরম চিঠিতে। আবেগভরে। আর তার উত্তরে, কিছু লোকের যেমন ইয়ার্কি করার স্বভাব, সরলরেখা দেখলেই ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে, সুরের দেখলেই বিবাদী স্বর লাগাতে ইচ্ছে হয়, লুদভিগ লেখে, আশাবাদ হল মানবজাতির আফিম। অন্ধজনের মদ, বোকামির আরক। ত্রৎস্কি জিন্দাবাদ। লুদভিগ গান ভালবাসত।
এ সবই অনন্ত ক্যাওড়ামি। পশ্চিমী বারোক এবং ধ্রুপদী যুগের মধ্যে যাত্রাপথের মধ্যে গুঁজে দেওয়া বক্ররেখা। কিন্তু পৃথিবী তো ওভাবে চলেনা। তাই এসবের ফল ভালো হয়না। বান্ধবী সেই লিখিত চিঠির বক্তব্য জানায় পার্টিকে। একে তো মার্কসকে ভ্যাঙচানো, তদুপরি ত্রৎস্কি। অতএব পার্টিতে বসে কমিশন। এই ভীষণ রাজনৈতিক-ভাবে-বেঠিক মন্তব্য, যা আসলে প্রতিক্রিয়াশীল শয়তানি, তার জন্য সে দোষী সাব্যস্ত হয়। কলেজ এবং পার্টি, দুই জায়গা থেকেই বিতাড়িত হয়ে, যোগ দিতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনীতে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রমশিবিরে। খুব সম্ভবত শোধরানোর জন্য। মোরাভিয় লোকগানের পুনরুত্থানের কথা ভেবেছিল যে ছেলেটি, তার জীবনের বহু বছর কেটে যায় শ্রমশিবিরের শৃঙ্খলায়। ইত্যাদি প্রভৃতি।
তা, এসব পড়ে শিউরে উঠতে হলেও, কথা হল, এ প্রাসঙ্গিক কেন? এ তো সোভিয়েত জমানার গপ্পো। প্রায় স্পার্টাকাসের আমলের। সবাই জানে লোকে খেতে-পরতে পেলেও, তখন বাক-স্বাধীনতা ছিলনা। আমাদের এখন খাবার-দাবার এবং বাক-স্বাধীনতা আছে, স্মার্টফোন-শপিং মল আছে, ফেসবুক-টুইটার আছে। কিন্তু যা আমরা ভুলে যাই, যা সোভিয়েত আমলেও লোকে ভুলে যেত প্রায়ই, যে, আমাদেরও অ্যাম্ফিথিয়েটার আছে, যুদ্ধের তোড়জোড় আছে, সরলরেখা আছে, এবং সর্বোপরি সঠিকত্বের সৈনিকরা আছে।
আজ, ১২ই জুলাই, ২০২৩, কুন্দেরার মৃত্যুর ঠিক পরের দিন। আজ থেকে বছর আট আগে, এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কোরিয়ায় মহিলা-বিজ্ঞানী এবং সাংবাদিকদের জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সেখানে একটি রসিকতা করেছিলেন। বলেছিলেন, কী কান্ড, আমার মতো একজন শভিনিস্ট পাষণ্ডকে মহিলাদের সভায় ডাকা হয়েছে দেখে আমি আশ্চর্য। মহিলাদের নিয়ে আমার সমস্যাটা কি জানেন? তারা ল্যাবে এসে কেবল প্রেমে পড়ে, সমালোচনা করলেই কেঁদে ফেলে। এই শুনে সবাই হ্যাহ্যা করে হাসে, যেমন হয়তো হেসেছিল লুদভিগের বান্ধবী। তারপর বিজ্ঞানী বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, বিজ্ঞানে মহিলাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের মহিলাদের প্রয়োজন। এবং অনেক বাধা-বিপত্তি এবং আমার মতো পাষণ্ড থাকা সত্ত্বেও, মেয়েদের বিজ্ঞানসাধনাটা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
এ সবই রসিকতার মোড়কে কিছু কাজের কথা। আত্মধ্বংসী রসিকতা যাকে বলে। হুবহু না, কিন্তু মোটামুটি এইরকমই। বিজ্ঞানীর সরলরেখা ভেঙে দেবার কোনো ইচ্ছে ছিল বলে কেউ কখনও শোনেনি, কিন্তু তা না হলেও হাস্যোদীপ্ত রৌদ্রকরোজ্জ্বল হতে তো আটকায়না। কিছু লোক ফুর্তিতে থাকতে ভালবাসে। রচনাবইতে মুখ গুঁজে মুখস্থবিদ্যা আওড়াতে নয়। কিন্তু পৃথিবী তো ওভাবে চলেনা। তাই এসবের ফল ভালো হয়না। কোনো এক সাংবাদিক, আধুনিক পৃথিবীর অষ্টম বা দশম আশ্চর্য টুইটারে এই রসিকতার কিয়দংশ তুলে দেন। বিজ্ঞানী তখন বোধহয় কোরিয়া থেকে ব্রিটেন ফেরার বিমান ধরতে যাচ্ছেন। তিনি যখন আকাশপথে, তখনই দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে টুইট। একে তো মহিলাদের নিয়ে কুকথা, তদুপরি লঘুচালে 'শভিনিস্ট পাষণ্ড' ব্যাপারটাকে গৌরবান্বিত করা। পৃথিবী-জোড়া কমিশন বসে যায়। বিলেতের কর্মস্থলেও বসে নিশ্চয়ই। বিজ্ঞানী বিমান থেকে নেমে জানতে পারেন তাঁর অপরাধের কথা। বিচারও যে হয়ে গেছে, সেটাও। চাকরি যায় তাঁর। জীবনের কয়েকটা বছর কাটে অন্ধকারে। কিঞ্চিৎ পুনর্বাসনের আগে। বিজ্ঞানীর নাম টিম হান্ট।
কাফকাকে নিয়ে লিখতে বসে কুন্দেরা লিখেছিলেন, কাফকার পটভূমিকা পশ্চিম ইউরোপের হলেও, আসলে গপ্পোটা সোভিয়েত জমানারও। আর 'রসিকতা' নিয়ে লিখতে বসে, মনে হয়, গপ্পোটা আজকেরও। ১৯৬৭ থেকে ২০১৫। ৫৮ বছরের তফাত। ঠান্ডাযুদ্ধ থাকা আর না থাকার তফাত। সোভিয়েত চেকদেশ আর মুক্ত ব্রিটেনের তফাত। কিন্তু পড়লে মনে হয়না, এরকম কোনো তফাত আছে। গপ্পো এমন কিছু কথা বলছে, যা চিরন্তন। চিরন্তনতা বলে কিছু হয় কিনা আমরা জানিনা, কিন্তু প্রাসঙ্গিক এবং সমকালীন বোধহয় বলাই যায়। আজ যখন, সঠিকত্বের সাধনায় জগৎ উদ্ধার হচ্ছে, বিচার হচ্ছে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, গোমড়ামুখো ধর্মযুদ্ধের সৈনিকরা মজুদ আছেন ডাইনে-বাঁয়ে, স্রেফ আমাদের প্রথমযৌবনের নায়ক বলে না, সময়ের গুণেই তিনি প্রাসঙ্গিক। শুধু ওই বইটা না, সবকটাই। রোবটদের রাজত্ব যদি না চাই, যদি চাই এই প্রখর সাদা-কালো দুনিয়ায় কিছু ধূসরতা টিকে থাক, বেঁচে থাক রসিকতার খাপছাড়া বক্ররেখা, তাহলে প্রত্যেকের মধ্যে এক-আধ-ফোঁটা কুন্দেরা অন্তত ঢুকুক।