মোরা খাই দাই ঘুরি ফিরি
--------------------------
আজ সকালের ব্রেকফাস্টে আলুর পরোটা। সঙ্গে মাখন বা আচার - যার যেটা পছন্দ। আমি আর মেঘ তো এমনিই মাখনলাল, আজ খুশীও "নিকুচি করেছে" বলে আমাদের দলে। ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের পরে বাইরের ব্যালকনিতে পটে চা রাখা আছে, সাথে কাপ, প্লেট, চিনি, চামচ। আর সোফা। সেখানে বসে আয়েশ করে সুগন্ধ দার্জিলিং চা খেয়ে আমরা একটু হাঁটতে বেরোলাম। আমাদের গেস্ট হাউস থেকে বাঁ দিকে তাকালেই একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা। সন্দীপন বলে দিয়েছিলেন ওদিকটায় কিছুদূর গেলে রক ক্লাইম্বিং এর ব্যবস্থা আছে। আমরা সেই পথই ধরলাম। রাস্তা কোথাও পাকা, কোথাও কাঁচা। দুইদিকে অরণ্য ক্রমশঃ গাঢ় হচ্ছে। এখানে আবার চিরহরিৎ গাছেরা প্রচুর - যদিও পর্ণমোচীরা একটু হলেও সংখ্যাগুরু। ফুল খুব একটা,নেই এই জঙ্গলে - কিন্তু বৃক্ষের বিশালতা আছে, নৈঃশব্দের আওয়াজ আছে, আর আছে ঠান্ডা। জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই জ্যাকেটটা টেনেটুনে নিতে হল।
এঁকে বেঁকে চলে গেছে পাহাড়ি রাস্তা - মাঝেমধ্যে গাড়ি যায়, টায়ারের দাগ দেখা যাচ্ছে। তিন চারটে বাঁকের পরে জঙ্গলটা হঠাৎই শেষ হয়ে গেল - বা বলা ভাল, ওপর দিকে উঠে গেল। আমরা দেখলাম আবার ছোট ছোট ঘরবাড়ি। এদিকেও দুয়েকটা হোম স্টে আছে দেখা গেল। আরও খানিকদূর হাঁটার পরে একজন জানালেন রক ক্লাইম্বিং এর জায়গাটা আরও "এক কিলোমিটার"। কালকের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে, এটার মানে তিন কিলোমিটারও হতে পারে, দুশো মিটারও হতে পারে। কিন্তু এদিকে আমাদের গাড়ি আসার সময় হয়ে এসেছে। কাজেই সেই ঝুঁকি আর না নিয়ে আমরা আবার সেই জঙ্গলের পথ ধরেই ফেরত চললাম।
ঢেন্ডুপ এলেন ঠিক বেলা দশটায়। আমাদের কাল আসতে অসুবিধে হয়েছিল কি না খোঁজ নিলেন। অরুণজী কোন ভাড়া নেন নি শুনে বললেন, "ও আচ্ছা আদমি হ্যায়"। ঢেন্ডুপের গাড়িটা বোলেরো - ভিতরে প্রচুর জায়গা। আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসলাম - খুশী যথারীতি সামনে। গাড়ি ছেড়ে প্রথমেই আবার তাকদা - আসার পথে জানলা দিয়ে বারবার তাকাচ্ছিলাম, যদি পোগোকে দেখতে পাই - কিন্তু সে নেই। গতকালের মিছিলের একজনকেই শুধু চিনতে পারলাম। ফেরার পথেও আর পোগোকে দেখতে পাইনি আমরা।
তাকদায় ডিকির কাফেতে আরেক প্রস্থ কফি খাওয়া হল। মেঘ দাশিকে চটকালো একটু। তারপর রওনা। তাকদা অর্কিড হাউস আগেই দেখা হয়ে গেছে, তাই এখানে দাঁড়ালাম না। ছ মাইল থেকে পেশক রোড দিয়ে আবার জোড়বাংলো। যাবার পথে দাঁড়িয়েছিলাম একটু, যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা একটু সদয় হন - কিন্তু বৃথা। জোড়বাংলো থেকে ডানদিকে ঘুরে ঘুম স্টেশনের পাশ দিয়ে আবার নীচে নামতে শুরু করলাম। দার্জিলিং প্রিয় পর্যটকেদের এই পথও খুবই পরিচিত - একদিকে মিরিক, অন্যদিকে সুখিয়াপোখরি।
কুয়াশা এ যাত্রা আমাদের বিশ্বস্ত সফরসঙ্গী - যথারীতি আমাদের আলতো করে ছুঁয়ে দিতে দিতে সঙ্গে চলল তারাও। ঢালু বেয়ে বেশ কিছুটা নেমে আসার পর দেখি অনেক গাড়ি আশেপাশে দাঁড়িয়ে, বেশ কয়েকটা হোম স্টে। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, আমরা আসলে লেপচা জগৎ এসে পড়েছি। আমাদের ছোটবেলায় এটা কোন ট্যুরিস্ট স্পট ছিল না - এখন হয়েছে। হোম স্টে গুলো দাঁড়িয়ে আছে শান্ত পাহাড়ের বুকে ক্ষতচিহ্নের মত।
স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে হোম স্টে বানান, তাতে আমি খারাপ কিছু দেখি না। এতে তাঁদের জীবন জীবিকারও সুবিধে হয়, যারা বেড়াতে যান, তাদেরও মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটে, পরিবেশ রক্ষিত হয়। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা সেরকম মনে হল না। বেশীরভাগ হোম স্টের মালিক বাঙালি বা মারোয়াড়ি। এরা হোম স্টে নাম দিয়ে আদতে গাদাগুচ্ছের হোটেল খুলে বসেছে, এক কাপ দুধ চায়ের দাম নিচ্ছে তিরিশ টাকা, আর পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে, কারণ স্বভাবতই এখানকার বাস্তুতন্ত্র নিয়ে এদের কোন ধারণাই নেই।
এসব ছাড়িয়ে স্থানীয় মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে একটু ওপরের দিকে উঠলে আছে ভিউ পয়েন্ট - এখান থেকে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে দার্জিলিং শহর এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা - দুইই দেখা যায়। আজ অবশ্য সবই কুয়াশাবৃতা। কিন্তু জায়গাটা ভারী সুন্দর। জঙ্গল আর কুয়াশার নিজেদের মধ্যে এক অন্যরকম রসায়ণ। ক্ষণে ক্ষণে ম্যাজিক তৈরী হয়। বেশী বকবক করলে সেই ম্যাজিক ধরা দেবেনা, জঙ্গলে এসে নিস্তব্ধ হতে হয়।
পাবলিক টয়লেটটা একেবারে আলাদা লেভেলের নোংরা। ব্যবহার করা তো দূর, ধারেকাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। অগত্যা আমরা এ পারের একটা খাবারের দোকানে ঢুকলাম। মেঘ ঢুকল না, সে আবার চারপেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঢেন্ডুপও এলেন না, মেঘের সাথে তিনিও ব্যস্ত। আমরা এখানে এক কাপ করে কফি খেলাম, বাথরুম সারলাম। তারপর বেরিয়ে আবার রওনা। পরবর্তী স্টেশন - নেপাল সীমান্তে পশুপতি।
গত বছর অবধিও পর্যটকেরা চেকপোস্ট পেরিয়ে পশুপতিনাথের মন্দির অবধি ঘুরে আসতে পারতেন, এ বছর কোভিডের কারণে সেটি বন্ধ - অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমরা গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে ভারতীয় প্রান্তে দোকানগুলোয় একটু ঘোরাঘুরি করলাম - তেমন কিছু পেলাম না। তারপর চেকপোস্ট পেরোনো। ভারতীয় পক্ষ বেশ কড়া - বলে দিলেন ওই তোরণটুকু অবধি যাওয়া যাবে - তার বেশী এক পা ও নয়। নেপালী পক্ষ অবশ্য বেশ সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহারই করলেন। বললেন ছবি তুলুন যত খুশী শুধু আমাদের ফ্রেমে আনবেন না। এদিকের বাজারটা ছোট, কিন্তু এখানে বেশ পছন্দসই কিছু উপহারসামগ্রী পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমাদের খিদে পেয়ে গেছে, কিন্তু ঢেন্ডুপের পাত্তা নেই। অগত্যা আমরা তিনজনেই ঢুকলাম নেপালের দিকেরই একটি পাইস হোটেলে। মালকিনের নাম নীলা - দার্জিলিং এর মেয়ে। এখানে হোটেল চালাচ্ছেন প্রায় কুড়ি বছর হল। বললেন চিকেন পাওয়া যাবে।
ভাত, কালি ডাল, একটা ভাজি, স্কোয়াশের তরকারি আর চিকেন - জম্পেশই হল। রান্নায় একটু ঝাল বেশী, কিন্তু প্রচন্ড টেস্টি। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষের পথে, এমন সময় দেখি ঢেন্ডুপ। তাকে ডেকে এনে বসানো গেল - উনি বললেন, "আপ পর্ক নেহি খায়ে?" শুনে আমরা তো আকাশ থেকে পড়ি - নীলা যে বললেন শুধু চিকেন পাওয়া যাবে? অতঃপর বোঝা গেল, বাটুরা (বাঙালি টুরিস্ট) শুধু পর্ক খায় না বলেই না, অনেকেই পর্ক পাওয়া যায় শুনলে সেই হোটেলেই আর খেতে চায় না। তাই ওঁরা চট করে বাঙালিদের কাছে পর্কের কথা তোলেনই না।
ঢেন্ডুপের খাওয়া হতে হতে আমি দুটো বীয়ার সাঁটালাম। ঢেন্ডুপ গাড়ি চালাবেন তাই নিলেন না। তারপর নীলা আমাদের একটা প্যাকেটে বেশ অনেকটা পর্ক কষা বেঁধে দিলেন। সেসব বেঁধে ছেদে নিয়ে বেরোনো গেল। বাইরে নেপালি সেনাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা হল। আমি ভাঙা ভাঙা নেপালি বলতে পারি বলে ওঁরা যে কী খুশী হলেন! মেঘকে বললেন, তোমার বাবা চাইলে আরো ভিতর থেকে ঘুরে আসতেই পারেন - কিন্তু তুমি গেলেই আটকে দেবে। আর জানালেন, আগামী বছর ওঁদের কলকাতা আসার ইচ্ছে। ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেন।
সীমান্তের এপারে এসে আরেকটু চা পাতা কিনে গাড়িতে উঠলাম। এই সময়ে একটা অবাঞ্ছিত ব্যাপার ঘটল। কয়েকজন পুলিশ এসে হঠাৎ ঢেন্ডুপকে বলল, এখানে পার্কিং নেই, গাড়ি কেন রেখেছ? ঢেন্ডুপ বললেন, এতক্ষণ থাকল গাড়িটা, কিছু বললেন না - এখন তো বেরিয়েই যাচ্ছি, এখন কেন বলছেন যে এখানে পার্কিং নেই? এই নিয়ে কিছুটা তর্কাতর্কি হবার পর গাড়ি ছাড়ল। ঢেন্ডুপ বললেন ওরা পরের পোস্টে ফোন করে দেবে ঠিক।
ইতিমধ্যে ফেরার রাস্তায় কিছুটা যেতে না যেতেই কুয়াশা এত ঘন হয়ে গেল যে গাড়ির হেডলাইট জ্বেলেও দু হাত দূরের পথও অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্যদিক থেকে আসা গাড়িও আমাদের মত হর্ন বাজাচ্ছে - চোখের বদলে কানের ভরসায় গাড়ি চলছে শম্বুকগতিতে। বন্ধ কাচের মধ্যে থেকেও টের পাচ্ছি হাড় কাঁপানো ঠান্ডার প্রবল দাপট।
তিন চারটে বাঁক পেরিয়ে আসার পর কুয়াশা একটু হালকা হতে শুরু করল। আবার একটু একটু করে ফিরে আসছে পরিচিত পৃথিবী - গাছপালা, পিচরাস্তা, গাড়ির আলো। আর দুটো বাঁক যেতে না যেতেই ঝট করে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। চোখ ধাঁধানো রোদ। তারে নতুন করে পাব বলে হারাই নিরন্তর।
যেমন আশঙ্কা করা গেছিল, সুখিয়াপোখরিতে পুলিশ হাত দেখিয়ে থামতে বলল আমাদের। ঢেন্ডুপ আমাদের বসতে বলে গাড়ির কাগজপত্রের ফাইলটা বের করে নিয়ে গম্ভীরমুখে নেমে তাদের সঙ্গে থানার দিকে হাঁটা লাগালেন। আমরা একটু টেনশনই করছিলাম - আমাদের নিয়ে এসে ভদ্রলোক আবার কী বিপদে পড়েন কে জানে।
প্রায় মিনিট পনেরো পরে ঢেন্ডুপ ফিরলেন, মুখে মুচকি হাসি। বললেন, ওখানকার পুলিশেরা এখানে রিপোর্ট করেছিল। কিন্তু থানার ইন্সপেক্টর ওঁর সাথে কথা বলে বিষয়টা বুঝেছেন এবং ওঁর সামনেই ওখানকার চেকপোস্টে ফোন করে ওদের ধমকও দিয়েছেন। হাসির কারণ সেটাই। মমতাদিদি এই সিভিক পুলিশদের চাকরি দিয়েছেন, কিন্তু কোন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন নি - এই মর্মে কিছু অভিযোগ করলেন - যদিও কথায় কথায় বুঝলাম উনি তৃণমূলকেই ভোট দেন। বিজেপিকে বেশ অপছন্দ করেন - অধিকাংশ প্রাক্তন সৈনিকের মতই। সিপিএম সম্বন্ধে বিশেষ কোন ধারণা নেই - খায় না মাথায় দেয়।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ঢেন্ডুপ প্রাক্তন সৈন্য - গোর্খা রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে ছিলেন। দশ বছর হল অবসর নিয়েছেন। ওঁর এক ছেলে, এক মেয়ে - ছেলে থাকে প্যারিসে, মেয়ে কলকাতায় ছিল, এখন পুনেতে। আগামী মাসে (মে) ওদের ছেলের কাছে যাবার কথা ছিল - সেটা সম্ভবতঃ বাতিল করতে হচ্ছে, প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে। এসব কথা অবশ্য কিছু আগের শোনা, আর ওই যাওয়া ক্যান্সেলের ব্যাপারটা গত সপ্তাহে ফোনে জেনেছি। ডিকির সাথে মেঘের কথা হয় প্রায়ই, ভিডিও কলে।
এরপর রাস্তায় আর তেমন কিছু ঘটেনি। ফেরার পথে কুয়াশা ঢাকা ঘুম স্টেশনের একটা ছবি তুললাম। তাকদায় ফিরে আবার একপ্রস্থ চা, আর সেই সঙ্গে পশুপতি থেকে আনা শুয়োরের ভর্তা খাওয়া হল সবাই মিলে। ইতিমধ্যে ঢেন্ডুপের ব্যাঙ্কে একটা সমস্যা হওয়ায় ওঁকে ছুটতে হল সেখানে। ওঁদের দোকানের একটি ছেলে আমাদের গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিল ওই গাড়িতেই।
সন্ধেবেলা আমাদের গেস্ট হাউসের মালিক দিলীপ গুরুং এর সাথে আলাপ হল। ওঁরা এই এলাকার প্রতিপত্তিশালী পরিবার। বলছিলেন, নেটওয়ার্কের সমস্যায় অনেক গেস্টের সাথেই ঠিকমত যোগাযোগ রাখতে পারেন না - কিন্তু এই অঞ্চলে টাওয়ার বসুক, সেটাও ওঁরা চান না। শুনে ভাল লাগল, কেউ কেউ অন্ততঃ এটুকুও ভাবেন। বেড়ানো শেষ হয়ে এল। পরের দিন ফেরার পথ ধরব।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।