যদি বাড়াও হাত
------------------
আজ আমাদের বড়া মাঙ্গোয়া ছেড়ে যাবার পালা। তিনচুলে থেকে গুরুংজী ফোনে জানতে চেয়েছিলেন, গাড়ি পাঠাবেন কি না - কিন্তু সন্দীপন জানালেন, উনিই আমাদের ছেড়ে দিয়ে আসবেন। তার আগে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা গেলাম ওদের পশুখামার দেখতে। এখন অবশ্য পোষ্য বেশী নেই - তিনটি গরু, কয়েকটি মুরগি, গোটা দুয়েক ছাগল। ঘাস কাটার ঘরে একটা যন্ত্র রাখা। সন্দীপন বললেন প্রথম তিন বছর এই ঘরটাতেই উনি থাকতেন। একটা চৌকি ছিল, এখন নেই। কিছু মৌমাছিও দেখলাম, তবে মৌমাছি ওরা চাষ করেন না।
ফেরার পথে ওদের সীমানা দেখাচ্ছিলেন সন্দীপন। বেড়া টেড়া নেই, বাঁশঝাড় আছে। এদিকে এক চিলতে ছোট চা বাগানও করা আছে - দেড় দুশো গাছ সাকুল্যে। বললেন, চা চাষের চেষ্টা সফল হয়নি নো হাউ এর অভাবে। একটা কমলা গাছ। আর ইতস্তত অজস্র গাছের গেরস্থালি। জায়গাটায় কেমন মায়া জড়ানো। মানুষগুলোও। ছেড়ে যেতে ইচ্ছেই করছিল না কারুর। আসার দিনও ভাবিনি এই অচেনা জায়গাটা এভাবে টান দেবে। ঢোলু, ক্যামব্রে আর টাইসনও বোধ হয় বুঝল, চলে যাচ্ছি। আমাদের পায়ে পায়ে চলে এল গাড়ির স্ট্যান্ড অবধি। দোকান থেকে চা খেলাম আরো একবার - তারপর রওনা।
এই পথটা পুরোটাই পরশুদিন এসেছি। ইস্কুলবাড়িটায় আরেকবার নামলাম, ঘুরে দেখে নিলাম। ছোটা মাঙ্গোয়ার মোড় এবার ডাইনে। মিনিট চল্লিশের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তিনচুলে। গুরুং গেস্ট হাউস। বেশ বড়সড়, ছড়ানো ছিটানো। গুরুংজী ছিলেন না - বেরিয়েছিলেন। আমরা চেক ইন করলাম। সন্দীপন আমাদের সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে বিদায় নিলেন - ওর গন্তব্য এখান থেকে দার্জিলিং - সেখান থেকে শিলিগুড়ি হয়ে দুদিন বাদে ফিরবেন। এই সফরে এরকম একজন বন্ধু পাব, ভাবিনি। আবার দেখা হবে নিশ্চই।
তিনচুলের উচ্চতা সাড়ে পাঁচ হাজার ফিট। ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম - কিছু হোম স্টে আর গেস্ট হাউসের কল্যানে এখন ট্যুরিস্ট স্পট। তিন কিলোমিটার দূরে তাকদা শহর - এখানকার মহকুমা শহর। আমাদের গেস্ট হাউসের ব্যালকনি থেকেও কালিম্পং দেখা যায়, তবে বড়া মাঙ্গোয়ার সাথে এর ফারাক হল, ওখানে নীচ থেকে ওপরে তাকাতে হত, এখানে উলটো - কালিম্পং নীচে। দৃষ্টি সরিয়ে কাছে আনলে এই পাহাড়েরই কিছুটা নীচে দেখা যায় ছোটা মাঙ্গোয়া গ্রাম। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের মধ্যে এই গেস্ট হাউস, নয়নাভিরাম।
দুটো জিনিষ আবিষ্কার করলাম - ঠান্ডা বেশ ভালই আছে, আর নেট নেই। গেস্ট হাউসের একটা ওয়াই ফাই আছে বটে, কিন্তু সেটাও না থাকারই মত - মাঝে মধ্যে কোন কোন স্পটে দাঁড়িয়ে হয়তো একটু কানেক্ট হল - এরকম ব্যাপার। অগত্যা শুধু পাহাড় আর আমরা। স্নান টান সেরে ডাইনিং হলে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম। তারপর বেরোলাম হাঁটতে। ক্যাশ টাকা সব শেষ, তাকদায় এটিএম পাব, তাই ঠিক হল, এখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে তাকদা যাব, তারপর যদি দেখি পারছি, তাহলে হাঁটতে হাঁটতেই ফিরব, আর না পারলে কোন গাড়ি ধরে।
কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আর মেঘ কুকুর আনে। যেখানেই যাক, ঠিক ওর আশেপাশে কয়েকজন মক্কেল জুটে যায়। এখানেও যথারীতি রাস্তায় বেরোনোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিন চারজন জুটে গেল। তাদের নামধাম জানার উপায় নেই, কিন্তু তারা সদলবলে চললেন আমাদের সাথে মার্চ করে। কিছুদূর যেতে যেতে আরো জনা দুয়েক ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা মিছিলে যোগ দিলেন। এদের মধ্যে সবার শেষতমজন কারো বাড়ির পোষ্য সম্ভবতঃ - কান ঝোলানো, গলায় বকলস, পরিষ্কার লোম। হাইব্রিড - ল্যাব্রাডরের সাথে পাহাড়ি কোন জাতের মিশ্রণ বলেই মনে হল। ইনি পলাতকা কী না জানিনা, কিন্তু পায়ে পায়ে সঙ্গ নিলেন ইনিও।
বেশ কিছুদূর যাবার পরে এই সারমেয় বাহিনী একজন, দুজন করে মিছিল থেকে সরে পড়তে লাগলেন। যখন তারা দুজনে ঠেকেছে, এক জায়গায় অন্য দুটি কুকুর তাদের চ্যালেঞ্জ করায় একটি সরে পড়ল, কিন্তু ওই পোষ্যটি, মেঘ তার নাম দিয়েছে পোগো, বোকার মত আরও এদিকে সরে এল - ফিরে যাবার পথে বিপক্ষ সৈন্য অপেক্ষমান। সে আমাদের সঙ্গে এগিয়েই চলেছে। এবার আমরা একটু ভয় পেতে শুরু করেছি। একা একা মেয়েটা ফিরতে পারবে না। এদিকে আমাদের সঙ্গে গেলে রাস্তায় আরো কেউ আক্রমণ করতে পারে। মারামারিতে এ খুব একটা দড় বলেও মনে হচ্ছে না। আর উনি তখন নিশ্চিন্তমনে আমার পায়ে পায়ে চলছেন - ভাবটা, কিছু হলে আমিই বাঁচাব।
এইসব দোনামনা নিয়েই হাঁটছি। যাকেই জিজ্ঞেশ করি তাকদা বাজার আর কতটা, বলে এক কিলোমিটার। আমি পরে ভেবে দেখলাম, দু কিলোমিটার দূরের লোকটাও এক কিলোমিটার বলেছে, আড়াইশো মিটার দূরের দিদিও তাই। যাই হোক, তাকদা পৌঁছে দূর থেকে দেখলাম স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম, খোলাই আছে। ওদিকে দুখানা কুকুর থাকায় মেঘ পোগোকে কোলে তুলে নিয়েছে তখন। আমি তড়িঘড়ি এটিএম এ ঢুকে দেখি, ও হরি! তিনি অসুস্থ - টাকা দিতে পারবেন না। কারো একটা কার্ড মেশিনে ঢুকে ফেসে আছে, বেরোচ্ছে না। অগত্যা বাইরে বেরিয়ে দেখি অদূরে একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বলল, তাকদায় আর কোন এটিএম নেই - এই একটিই সবেধন নীলমণি। ল্যাও এবার কী করবা করো!
এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করা যায় ভাবছি - সমস্যা অনেকগুলো। হাতে ক্যাশ একদমই নেই, অথচ এদিকে প্রায় কোথাওই কার্ডের কারবার নেই, তিনচুলেতে তো নেটওয়ার্কই নেই। কান্নার ইমোজি দিয়ে ফেবু জনতাকে ম্যানেজ করা যায়, আসল জনতা ক্যাশ না পেলে কান্না আর ইমোজিতে আটকে থাকবে না। এদিকে পোগোবাবু আমাদের সাথে সাথে আগচ্ছন্তি - এখন তাকে ভালয় ভালয় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে হয়। এতখানি হেঁটে এসে আমরাও টায়ার্ড - আবার হেঁটে ফিরতে হবে ভাবলে কান্না পাচ্ছে। এদিকে টাকা যা আছে, তাতে একটা প্রাইভেট গাড়ি, যত কমই নিক, কুলোবে না, পাবলিক গাড়িতে পোগোকে নিয়ে ওঠা যাবে না সম্ভবতঃ।
এই সময়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের জটলা থেকে একটু বয়স্ক একজন বেরিয়ে এলেন - এঁকে দেখতে এদের মধ্যে সবথেকে বেশী মঙ্গোলিয়ান। বললেন, "আপনার কি ক্যাশ লাগবে?" আমি হ্যাঁ বলাতে উনি জানালেন উনি হাজার দশেক ক্যাশ দিতে পারেন, ওনাকে টাকাটা জি পে করে দিতে হবে, প্রতি দু হাজারে পঁচিশ টাকা ওনার চার্জ। এটা কম না বেশী ভাবার অবস্থা আমার ছিল না, বলাই বাহুল্য। আমি রাজি হয়ে টাকাটা ওনার নম্বরে জি পে করলাম - ভাগ্যক্রমে নেটওয়ার্ক ছিল। ভদ্রলোকের নাম ঢেন্ডুপ ভুটিয়া - জাতে তিব্বতি। ওঁদের ভাষায় ঢেন্ডুপ মানে সৌভাগ্য। ভুটিয়া ওদের গোত্রনাম। ওঁর কাছেই জানলাম, ভুটিয়া পদবী ভুটানীদের নয়, তিব্বতিদেরই হয়।
ঢেন্ডুপ আমাকে পাশে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন - ডিকি'জ কাফে বলে। ডিকি ওনার স্ত্রীর নাম। তাঁর সঙ্গেও আলাপ হল। তিনি আমাকে ক্যাশ টাকা এনে দিলেন। ঢেন্ডুপ আমাদের কফি খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন - তখন ওঁকে আমাদের কুকুর জনিত সমস্যার কথা জানালাম। উনি পাত্তাই দিলেন না - বললেন এখানে নিয়ে আসুন আগে ওটাকেও - তারপর দেখছি। অতঃপর স-সারমেয় আমরা এসে বসলাম ডিকিদিদির ক্যাফেতে।
একতলায় কিছু নেই, দোতলায় ক্যাফে, তিনতলায় ওদের রেসিডেন্স আর চারতলায় একটা হোম স্টে। ভাড়া বেশ কম, রুমগুলি বেশ ভাল। ডিকি আমাদের দারুন সুস্বাদু কফি এবং মোমো খাওয়ালেন, এবং হাজার অনুরোধেও তার দাম নিলেন না। ওদেরও একটি ছোট স্প্যানিয়েল আছে, তার নাম দাশি। সেও এসে পোগোকে দেখে গেল, একটু নাকও কুঁচকালো, কিন্তু দুজনেই যথাক্রমে ডিকি ও মেঘের কোলে থাকায় অশান্তি আটকানো গেল।
ঢেন্ডুপ জানতে চাইছিলেন, আমরা কী কী ট্যুর করেছি, আগামীকাল কী প্ল্যান? প্ল্যান সত্যি বলতে কি, তেমন কিছু ছিল না। ওঁর সাথে বসে পরের দিনের একটা ট্যুর প্ল্যান ছকা হল, ওঁর গাড়িতেই যাব অবশ্যই। তারপর ঢেন্ডুপ বেরিয়ে গেলেন জরুরী কাজে। আমরা মোমো কফি শেষ করে ফেরার তোড়জোড়ে লাগলাম। ডিকি প্রথমে বলেছিলেন, একটু ওয়েট করুন - একটা বাস আসবে, সেটা এখানেই প্রায় খালি হয়ে যাবে, তার ড্রাইভারকে বলে দেব, আপনাদের কুকুর সমেত নামিয়ে দেবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল সেই ড্রাইভার আজ আসেন নি - অন্য যিনি এসেছেন তাঁর সাথে ডিকির পরিচয় নেই। উনি তখন মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আরেকটা ছোট অল্টো গাড়ির সাথে কথা বললেন। সেই ভদ্রলোক, অরুণ (অর্জুন?) লেপচা, আমাদের কুকুর সহ তুলে নিলেন।
যেতে যেতে কুকুরটির আমাদের সাথে চলে আসার গল্প শুনলেন উনি। বললেন, ওকে তো ছেড়ে দেবেন, ও কিন্তু আপনাদের মনে রাখবে। আমাদের ট্যুরের গল্পও শুনলেন কিছুটা। তারপর কুকুরটা যে জায়গা থেকে আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল, সেটা মোটামুটি আন্দাজ করে ওকে নামিয়ে দিলাম। সে আমাদের একটু চেটেপুটে দিল। গাড়ি ছাড়ার পরেও বেশ কিছুটা রাস্তা ছুটতে ছুটতে এল গাড়ির পিছনে। তারপর এক জায়গায় বোধ হয় হাঁপিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়িটা বাঁক ঘুরে যেতেই পোগোকে আর দেখতে পেলাম না। ফিরে গেল কি ওর ঘরে? নাকি অন্য কোন ঘর খুঁজে নেবে, সে প্রশ্নের উত্তর অজানাই রয়ে গেল।
আমাদের গেস্ট হাউসের সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন অরুণবাবু। সসঙ্কোচে জিজ্ঞেশ করেছিলাম, কত দেব। উনি বললেন, দেবেন না প্লীজ। আপনারা একটা জীবের জন্য এতটা করলেন, আমাকে একটু করতে দিন। এ কথার কোন উত্তর হয় না। একদিনে কতগুলো অচেনা মানুষ এবং না-মানুষ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন, ভাবতে ভাবতেই ফিরে এলাম রুমে। শুধু প্রাণই এক আশ্চর্য সম্পদ, এক মৃত্যুহীন আশা, এক ক্ষয়হীন মর্যাদা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।