রাত্তির নটায় শুয়ে পড়ার অর্থ, হাজার চেষ্টা করেও ভোর পাঁচটার পর বিছানায় থাকা যায় না। কিন্তু উঠেই বা কী লাভ! কাঞ্চনজঙ্ঘা পার্মানেন্ট ঘোমটা টেনে বসেই রয়েছে। ওদিকের কোন পাহাড়ই দেখা যাচ্ছে না। দার্জিলিং শহরে যদিও রোদের ঝিলিক। মুখ টুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার এক রাউন্ড বিছানায়। এরা রুমে চা কফির সরঞ্জাম দিয়ে রাখে, তাই দিয়ে একেক্কাপ চা খাওয়া গেল। আটটা থেকে ব্রেকফাস্ট দেবে। কিন্তু ওই সেকেন্ড রাউন্ড বিছানা বড়ই ট্রেচারাস। আমাদের তিনজনের স্নান সেরে তৈরি হতে হতেই সাড়ে নটা পার। দেরি হচ্ছে বলেই হোক বা প্রথমদিন বলেই হোক, সেদিন ব্রেকফাস্টটা ওরা রুমেই দিয়ে গেল। ইংলিশ ব্রেকফাস্ট - টোস্ট, মাখন এবং জ্যাম, অমলেট, ফলের রস, কাটা ফল - পেঁপে আর তরমুজ। পেট ভরিয়ে নিয়ে বেরোলাম দশটায়। এদিনটা আমাদের হন্টনের দিন।
রাজভবন ডাইনে রেখে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে সোজা চিড়িয়াখানা। পথে একটু চকোলেট আর চিউইং গাম কেনা গেল। চিড়িয়াখানা আর হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট একই সাথে টিকিট কাটা যায় - মাত্র ৬০/- টাকা করে। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে একজন গাইড বসেছিলেন - তাঁর নাম রুবিনা থাপা। ভারী মিষ্টি মেয়ে - মেঘের সঙ্গে অচিরেই ভাব জমে উঠল। গাইডের চার্জ তিনশো টাকা - জু এবং এইচ এম আই - দুইই ঘুরিয়ে দেখাবেন ডেমোনস্ট্রেশন সহ। গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, অধিকাংশ ট্যুরিস্টই নিচ্ছেন না দেখলাম। তিন চারজন গাইড আছেন, তাদের সারাদিনে এক দুইজন কাস্টমারই হয় মনে হল। সীজন টাইমে হয়তো আরেকটু বেশী হতে পারে। তবে এই সবই আমাদের আন্দাজ, যাচাই করিনি।
শুরুতেই দেখা গেল দুই পাহাড়ি ভাল্লুক - কুচকুচে কালো, দেখতে ভারী ভালো। জ্বর টর হয়নি, তারা বেশ ফুর্তিতেই আছেন। পাহাড়ি ভাল্লুক লাফাতে পারে না, তাই পাঁচিল খুব উঁচু না - তবে পরিখা বেশ গভীর। যতই ফুর্তি দেখাক, এরা হিমালয়ের হিংস্রতম শিকারীদের অন্যতম। তারপর পরপর ঘেসোরা - আই মীন তিনোরা - আই মীন তৃণভোজীর দল। বিখ্যাত হিমালয়ান মাউন্টেইন গোট - যারা পাহাড়ের খাঁজে চড়ায় এক্সপার্ট। হরিণ, ছাগল, মেষেদের ভ্যারাইটি দেখতে দেখতে চিড়িয়াখানার একপ্রান্তে পৌঁছাতে দেখা গেল হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের প্রবেশদ্বার। আগে এটা দেখে তারপর আবার চিড়িয়াখানার কার্নিভোরদের পালা আসবে। তার আগে এই এম আই এর মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখার পালা। রুবিনা এখানেও অসাম। সম্পূর্ণ হিমালয়ান রেঞ্জের কোথায় কোন পিক, কত উচ্চতা, সব ওর মুখস্থ। মডেল দেখিয়ে সব সুন্দর বুঝিয়ে দিল। তেনজিং এর ব্যবহৃত কিট, জর্জ ম্যালোরির হারিয়ে যাবার গল্প, বাচেন্দ্রী পালের গল্প - ইত্যাদি নানান সম্ভার।
এখান থেকে বেরিয়ে এককাপ করে কফি খেয়ে আবার চিড়িয়াখানা। স্নো লেপার্ড - ভারী আগ্রহভরে মুখ ঘুরিয়ে দেখছিল আমাদের - নাকি ছবির জন্য পোজ দিচ্ছিল, সে ই জানে। রয়াল বেঙ্গলের এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই - চিৎপাত হয়ে ঘুম দিচ্ছেন তিনি। পাহাড়ি নেকড়েরাও পোজ টোজ দিল। তারপর, এখানকার আসল আকর্ষণ - রেড পান্ডা। গাছের ওপরে এবং মাটির নীচে প্রচুর শো দিল তারা।
এসব শেষ করে রুবিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। একটু বনকুল আর আচার খেতে খেতে নীচে নেমে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে (চারটে কান্নার ইমোজি) চকবাজার পৌঁছানো গেল। লম্বাআআআ রাস্তা। ডানদিকে তাকালে দার্জিলিং শহরের অনেকটা দৃশ্যমান। সেখান থেকে আরো হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ম্যাল। থুড়ি, ম্যাল রোডে ঢোকার মুখেই, দা ওয়ান অ্যান্ড ওনলি - কেভেন্টারস। ছাদে বসে দার্জিলিং চা - ফলোড বাই দা গাবদা পর্ক প্ল্যাটার - অনেকদিনের টার্গেট। খুশীর স্বাস্থ্য বাতিক - সে চিকেন প্ল্যাটার। যতটা ক্যালোরি বার্ণ হল প্রায় ততটাই আবার ভরে গেল। মেঘের আবার ডেজার্টও চাই - কাজেই তার জন্য আইসক্রিম। আমি আইসক্রিমের ভক্ত নই, খুশী তো খাবেই না এসব (সিঙ্গল কান্না)। কেভ'স এ আর কোন ডেজার্ট ও নাই।
স্মৃতির সরণী বেয়ে
----------------------------
এবার আবার ঘুত্তান পালা। ম্যালের বাইরেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড - সেখানে একজনের সাথে পরের দিনের সাইট সীয়িং এর জন্য কথাবার্তা হল। আমরা আসার পর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কুয়াশায় ঢাকা - এক মুহুর্তের জন্যও দেখা দেয়নি - তাই আমরাও একটু অভিমান করলাম। টাইগার হিল যাব না। বাদবাকি ট্যুরের জন্য বিকাশ জীর (গারির মালিক কাম ড্রাইভার) সাথে কথাবার্তা চূড়ান্ত করে, অ্যাডভান্স দিয়ে আমরা আবার এগোলাম। লক্ষ্য জলাপাহাড়।
আমার ছোটবেলায় ম্যাল রোড দিয়ে ওপরে ওঠার সময়ে দূর থেকে চোখে পড়ত "হোটেল ব্রডওয়ে" - তার পাশ দিয়েই উঠে গেছে জলাপাহাড়ের রাস্তা। ব্রডওয়ে এখনো আছে বটে, কিন্তু তার চারপাশে এত অজস্র হোটেল হয়ে গেছে যে চট করে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। এখন আর হোটেলটাকে তেমন বিশাল বলেও মনে হল না একেবারেই। হোটেলটাই ছোট হয়ে গেছে, নাকি আমিই অনেক বড় হয়ে গেছি - জানিনা। কিন্তু রাস্তাটা একই আছে অনেকটা - শুধু দুইদিকের সেই জঙ্গল, জংলী ফুলের সমাহার আর নেই - তার জায়গায় সারি সারি সব বাড়ি। কংক্রিটের জঙ্গল। একটা বাঁক, দুটো বাঁক - সামনে একটা গেট। মন্টি ঈগল ভিলা!
আমার দার্জিলিং বাসের চারটে পর্যায়। একেবারে শুরুতে প্রায় দু মাস কেটেছে মেইন পোস্ট অফিস বিল্ডিং এর দুই নম্বর ইন্সপেকশন রুমে। তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি, দার্জিলিং নতুন জায়গা। তারপর প্রথম বাড়িভাড়া নিয়ে যাই ধোবিতলাও অনেকটা ছাড়িয়ে, ভিক্টোরিয়া ফলস, বর্ধমান রাজবাড়ি ছাড়িয়ে একটা নীচু জায়গায়। সেখানে বোধ হয় মাস ছয়েক ছিলাম, তারপর এই মন্টি ঈগল ভিলার কোয়ার্টার এ - সাত আট মাস। তারপর আবার মেইন পোস্ট অফিসের তিনতলার কোয়ার্টার। কিন্তু সে ভিলা এখন আর নেই। বৃটিশ আমলের কাঠের বাড়ি ছিল, নীল রঙের। নীচে পোস্ট অফিস, ওপরে আমাদের কোয়ার্টার। তার ঘরের মধ্যে আরামসে ফুটবল খেলা যায়। বাথরুম অবধি যেতে প্রায় দেড় দু মিনিট সময় লেগে যেত।
কিন্তু সে বাড়ি ভ্যানিশ। এখন পুরো এলাকাটা জুড়ে চারটে কি পাঁচটা চারতলা বাড়ি। মাথার ওপরে সবুজ প্যারাপেট। খালি গেটটা আছে একইরকম। ওই গেটের সামনেই খুশীর একটা ছবি তুললাম। তারপর আবার বাঁক ঘুরে ওপরে। মেইন রোডে উঠেই বাঁ হাতে একটা দোকান ছিল - সেখানে জীবনে প্রথমবার হট চকোলেট খেয়েছিলাম। সেই গল্প করতেই মেঘেরও হট চকোলেট খাবার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু দোকানটা আদৌ আছে কি না, বুঝতে পারলাম না। থাকলেও তারা হট চকোলেট আর বেচে না। অতএব মেঘকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
এখান থেকে জলাপাহাড়ের রাস্তায় ছিল হাতে গোনা বাড়িঘর। এখন সেখানে অজস্র বাড়ি, দোকান, হোম স্টে, হোটেল। অথচ রাস্তা খুবই খারাপ। জায়গায় জায়গায় সারাইও হচ্ছে, তাতে অবস্থা আরোই খারাপ হয়েছে। এসবের মধ্যে দিয়েই চড়াই ভাঙতে ভাঙতে প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট হেঁটে যেতে একটু একটু করে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল - ফিরে এল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই রাস্তা। পাইনের বন এখানে এত ঘন ছিল যে দুপুরবেলাও আবছায়া হয়ে থাকত, আর সারাক্ষণ হাওয়া গাছে শিরশির শব্দ তুলত। আমার মা বলত ফিসফিস অরণ্য - সেই বেতালের গল্পের মতন। সেই ঘন জঙ্গল এখন অনেকটাই হালকা, মঝেমধ্যেই উঁকি দিচ্ছে বাড়ি বা দোকান, তবুও কিছু তো আছে। সেন্ট পলস স্কুলের বিশাল ক্যাম্পাস সেই আগের মতই আছে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝাঁকড়া গাছ ভরা ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা। আর খাড়াই রাস্তার নৈঃশব্দ - ডীফেনিং সাইলেন্স।
চূড়ায় পৌঁছালেও, সেখানে মিলিটারি ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকিনি আমরা। বাইরেই একটু বসে, ছবি টবি তুলে আবার ফেরা - হাঁটতে - হাঁটতে - হাঁটতে - চূড়া থেকে ম্যাল ঠিক তিন কিলোমিটার। মেঘের আজকের টাট্টুর নাম প্রিন্সেস - এ ও ঘিয়ে, চেলসির চেয়ে আকারে একটু বড় - লোম কম গায়ে। আজ ফুল রাউন্ড - বাঁ দিক দিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রভবনের (ভানুভক্ত ভবন) পাশ দিয়ে রাজভবন, আমাদের হোটেলের সামনে দিয়ে মহাকাল মন্দিরকে ডাইনে রেখে ফেরা। আমরা ততক্ষণে ফুটপাথের বাজারে। জ্যাকেট, গ্লাভস, টুপি কিনতে কিনতে মেঘের রাউন্ড শেষ।
এবারে আবার খিদে পেয়ে গেছে সবার, ছ কিলোমিটার হেঁটে (কান্নার ইমোজি)। অতএব আবার চলো, গ্লিনারিজ। আমার অতিপ্রিয় গ্লেনারিজ - আমার পাউঁরুটি প্রেমের প্রথম অনুঘটক। ব্যালকনিতে বসে মেঘের হট চকোলেট, আমাদের কফি, আর অ্যাসর্টেড মাফিন, পেস্ট্রি। আজও ভাবছিলাম ওপরে বার, নীচে পাব - কোনদিকে যাই - তারপর মনে পড়ে গেল কালকের বোতলটার বেশীরভাগই এখনো রুমেই অপেক্ষমান। অতএব চালাও পানসি বেলঘরিয়া - থুড়ি - হোটেল রিট্রীট। আজ হাঁটার রেকর্ড করে ফেলেছি - এক দিনে মোট ১৩+ কিলোমিটার - জীবনে কোনদিন হাঁটিনি। নিজেকে কেমন বিলবো ব্যাগিন্স মনে হচ্ছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।