মেগান মারকেল (Meghan Markle) যখন ওপরাকে (Oprah) দুঃখ করে বললেন যে লালটুকটুকে রাজপুত্র হ্যারি (Prince Harry) আর বাদামি রঙের অনভিজাত মেগানের সন্তানের গায়ের রং কী হবে সে নিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবার বিচলিত হয়েছিল, তা শুনে বিশ্বজুড়ে হইহই পড়লেও বাঙালি গৃহবধূদের কাছে এ এমন কিছু নতুন কথা নয়। “দুধে একটু হলুদ দিয়ে খেলে বাচ্চা ফরসা হয়” ----- শ্বশুরবাড়ীর কারও মুখ থেকে এ কথা শোনেনি এমন মেয়ে ভূ ভারতে পাবেন বলে মনে হয় না, বাংলায় তো নয়ই। একটু বড়লোক শ্বশুরবাড়ি হলে দুধে হলুদের বদলে স্যাফরন বা জাফরান গুলে খেতে বলার রেওয়াজ আছে। বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে ফরসা মানে সাদা চামড়া। বাঙালিরা সবাই ফরসা হতে চায়। কালো বাবা-মাও চায় ফরসা রঙের সন্তান, না হলে শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখানো দায় হয়ে ওঠে। ফরসা ছেলে আর কালো বউ হলে তো কথাই নেই, দুধে জাফরান-স্যাফরন না মিশিয়ে, জাফরান-স্যাফরনে দুধ মিশিয়ে খেতে বলেন শাশুড়ি, ননদ, জা’রা। হলুদ আর জাফরান খাবারে দিলে রং সাদা হয় না। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, হলুদ হয়। তবু বাঙালি ভদ্রসমাজে হলুদটাই সাদার কাছাকাছি। ব্লিচ অবশ্য সাদা করে, কিন্তু ব্লিচ দুধে গুলে তো খেতে বলতে পারে না! চক্ষুলজ্জা না থাকলেও, হাজত ভয় তো আছে! ব্লিচ মাখা শুরু হয় জন্মের পর থেকে। গায়ের রং ফরসা করার প্রতিযোগিতা শুরু হয় জন্মের আগে জাফরান-স্যাফরন খেয়ে। জন্মের পর সে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে ব্লিচ মেখে। সব প্রতিযোগিতার মতো এই খেলাও শেষ হয় চিতায়। চিতা বললাম বলে আবার হিন্দু পক্ষপাতিত্বের কলঙ্কে কলঙ্কিত না হতে হয়।
বর্ণবাদ হিন্দু সমাজের কলঙ্ক হলেও চামড়ার রঙের তারতম্যে উচ্চনীচ বিচারের রোগ যাকে ইংরিজিতে কালারিজম (colorism) বলা হয় তা মহারানি ভিক্টোরিয়ার থেকেই সংক্রামিত হয়েছে ভদ্রলোক সমাজে, ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। ভিক্টোরিয়ান প্রবাদবাক্য, “কাজ হল পূজা (work is worship)” থেকে শুরু করে কোনটা শ্লীলতা আর কোনটাই বা অশ্লীল তার পাঠ পড়িয়ে ব্রিটিশরাজ যে বাবু সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিলেন তারই পরম্পরা বাঙালি ভদ্রলোকরা আজও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। ভিক্টোরিয়ান প্রথানুসারে শ্লীলতা-অশ্লীলতার বোঝা বহনের দায় কেবল মেয়েদেরই। কম কথা বলা শ্লীল; বেশি কথা বললেই “বাচাল মেয়ে”র তকমা লাগানো বাঙালি ভদ্রসমাজের দৈনন্দিন কাহিনি। মেয়েদের বোবা হয়ে থাকার বিধান অবশ্য সেই উপনিষদের যুগ থেকে চলে আসছে। যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীকে থামিয়ে দিয়ে বলছেন, “অতি প্রশ্ন করো না”। মেগান মারকেলকেও ঠিক এক কথা শুনতে হয়েছে রাজপরিবারের সদস্যদের থেকে। এ যেন ডিজনির মৎস্যকন্যার রূপকথা লিটল মারমেড (Little Mermaid)। জলের মৎস্যকন্যা এরিয়েল (Ariel) পড়েছে স্থলের রাজপুত্রের প্রেমে। কিন্তু এরিয়েলের তো পা নেই। নৃত্যে রাজপুত্রের সঙ্গে যোগ দেবে কেমন করে এরিয়েল? উপায় কী? “উপায় আছে” বললো ডাইনি। দু জোড়া পা দেবে ডাইনি, কিন্তু একটা শর্ত আছে। এরিয়েল পা পাবে, নাচতে পারবে, গাইতেও পারবে কিন্তু কথা বলতে পারবে না, তবেই পাবে রাজপুত্র আর অর্ধেক রাজত্ব। এরিয়েলের গল্প ট্রাজেডি। মেগানের নয়।
হ্যারি আর মেগান বিয়ে করেন নিজেরাই। কিন্তু রাজপরিবারে সে বিয়ে কবুল নয়। ঘটা করে তাদের আবার বিয়ে হয় রাজপরিবারের নিয়ম কানুন মেনে। গোটা দুনিয়া দেখে সেই আড়ম্বর। বাহবা আসে দেশ বিদেশ থেকে। ইচ্ছে না থাকলেও রাজপরিবারের কথা মেনে দুজনেই আনন্দে যোগ দেন সেই আড়ম্বরে। সমস্ত পৃথিবীর সামনে মেগানকে গ্রহণ করে রাজপরিবারের সদস্যরা। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় শ্বাসরোধকারী নিয়মের বেড়াজাল। মেগানের যেখানে সেখানে কথা বলা বারণ, ইচ্ছে মত বাইরে যাওয়া বারণ। রাজপুত্রকে বিয়ে করে রাজকন্যা হতে হলে গেলে শুধু নীরব নির্বাক হলেই চলবে না, নানান নিয়মও পালন করতে হবে। কেমন করে বসতে হবে, কখন হাঁচতে হবে, কখন হাসতে হবে তার লম্বা তালিকা আছে। বাকিংহাম প্যালেসে সেই লিস্ট আছে। আর আছে বাঙালি ভদ্রলোকেদের ড্রইংরুমে। বাকিংহাম প্যালেসে থেকে সোজা ভদ্রলোকেদের ড্রইংরুমে কার হাত ধরে সেই নথি হাজির হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস জানা না থাকলেও লিস্ট যে বাঙালি ঘরে ঘরে হাজির তা বাঙালি গৃহবধূদের চেয়ে ভাল আর কেউ জানেন না। আর জানেন; রাজপুত্তুররা। তবে রাজপুত্তুররা বেশিরভাগই কাপুরুষ। কটা রাজপুত্তুরের সাহস, সুযোগ আর ক্ষমতা আছে নিজের রাজপরিবারের শাসন নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার? হ্যারি পেরেছেন, চার্লস (Charles) পারেননি, বা হয়ত চেষ্টাও করেননি। চার্লসের কাপুরুষতার বলি হয়েছিলেন হ্যারির মা ডায়ানা (Diana)।
কাপুরুষের অমিতাভ রায় নষ্ট করেছিল করুণা গুপ্তর জীবন। করুণা অবশ্য অমিতাভর মত কাপুরুষ ছিলেন না। তাই অমিতাভর কাপুরুষতা করুণার জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট করতে পারেনি, শুধু ঘুমটা নষ্ট করেছিল । হ্যারির কাপুরুষতার বলি মেগান হতে পারত। কিন্তু হয় নি। দুজনেই পেরেছিলেন দেশ পরিবার ছেড়ে রাজপ্রাসাদের মরচেধরা লৌহ কপাট ভেঙে বেরিয়ে পড়তে। সমুদ্র পেরিয়ে প্রথমে চলে যান ক্যানাডায়, কারণ ক্যানাডা এখনো কমনওয়েলথের মধ্যে পড়ে। এর পর ক্যানাডার সীমানা পেরিয়ে চলে আসেন এমন একটা দেশে ঘর বাঁধতে যেখানে রাজতন্ত্রের দৌরাত্ম্য অনুপস্থিত। হ্যারি আর অন্তঃসত্ত্বা মেগান অতিথি হিসেবে ঠাঁই পান ব্ল্যাক-অ্যামেরিকান লোকহিতৈষী টাইলার পেরির (Tyler Perry) বাড়ীতে। ব্রিটেনের রাজপরিবার ততদিনে হ্যারির মাসোহারা বন্ধ করে দিয়েছে। মেগানের আকুতি সত্ত্বেও হ্যারির সুরক্ষা ব্যবস্থা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। টাইলার পেরি আতিথেয়তার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারির সুরক্ষার ব্যবস্থাও করেন। চার্লস আর অমিতাভ কি সত্যি কাপুরুষ ছিলেন, নাকি রাজপরিবার বা সমাজের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যতখানি স্বাবলম্বী হতে হয় তা হয়ে উঠতে পারেননি? হ্যারি স্বাবলম্বী কারণ রাজপরিবার হ্যারির মাসোহারা এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করলেও হ্যারির জন্য ডায়ানা যথেষ্ট অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। ডায়ানা হয়ত এমন একটা কিছু তাঁর ছেলেদের কারও হতে পারে তা অনুমান করেছিলেন। ডায়ানার রেখে যাওয়া অর্থ ছাড়াও টাইলার পেরির মত বন্ধু ছিল মেগানের। তবু কতটা স্বাবলম্বী হলে তবে পারিবারিক বা সামাজিক অচলায়তনের ভিত আন্দোলিত করা যায় তার কি কোন সঠিক হিসেব আছে? করুণা মনে করেননি আছে। করুণা অমিতাভকে বলেছিলেন, “তোমার যেটার অভাব সেটা তো সময় নয়, অন্যকিছু।” সেই অন্যকিছুর অভাবই মানুষকে কাপুরুষ করে। চার্লস আর অমিতাভ কাপুরুষ, করুণা, হ্যারি আর মেগান মহাপুরুষ না হলেও কাপুরুষ নন।
ভাল লাগল।
এইটা এখন হট টপিক। এক ইন্টারভিউ তেই রাজ পরিবারের ইমেজ অনেকটা টাল খেয়েছে। লেখাটা ভালো লাগল।
বেশ বেশ। ভালই লিখেছিস রাজা।
শুধু বাঙালী কে দোষ দিয়ে আর কি হবে! কোথাকার গল্প নয় এটা!! কিছু প্রত্যান্ত উপজাতি ছাড়া বোধহয় প্রত্যেকটা সমাজ সে সাদা কালো খয়েরি হলুদ যাই হোক না কেন- এই সমস্যায় ভুগছে। কিছু কম আর কিছু বেশি। অনেক পথ চলা বাকি আছে।
এই ‘হট টপিক’টিকে যেভাবে আমাদের ঘরের মধ্যের গল্পের পরিসরে নিয়ে আসা হয়েছে তার জন্য লেখককে অভিনন্দন। কৃষ্ণকলি আর শ্যামলী বঙ্গললনাদের এইজাতীয় অভিজ্ঞতা যে কতখানি বেদনাময় আর অপমানের, তা লেখাটির মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও প্রচারিত হোক । লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
মেগান হ্যারির নয় পুত্র আর্চির সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর অভিযোগ উইলিয়াম, কেট এবং শ্বশুর মশায়ের দিকে নির্দেশিত , রানি বা ফিলিপের দিকে নয় । কর্মে মুক্তি কথাটি ব্যবহার করেছেন - এটি একটু করে দিলো . ১৯৩৩ সালের পরে এটি খুব শোনা যায় অন্য দেশে (Arbeit macht frei )
আশা করি সে অর্থে আপনি বলেন নি । ডায়নার সঙ্গে খুবই মিলে যায় - তফাত শুধু পতি দেবের আচরণ
একটু বাদ পড়ে গেছে - কর্মে মুক্তি কথাটি ব্যবহার করেছেন -এটি একটু অবাক করে দিলো ! আপনি নিশ্চয় সেই অর্থে লেখেন নি
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য,
বাইরে দূরে, হ্যারির সুরক্ষা কেড়ে নিয়েছে রাজপরিবার। আমি আর্চির কথা কোথাও লিখিনি কারণ সে এখনো শিশু। ওকে ইচ্ছে করেই বাদ রেখেছি। নামও লিখিনি।
কর্মে মুক্তি ইত্যাদি কোথা মানি না কারণ এগুলো ব্যাবহার করে ওয়ার্কার্স রাইটস সহজে কাড়া যায়। গীতাতেও এইধরনের প্রো-কর্পোরেট আর আন্টি-ওয়ার্কার শ্লোক রয়েছে। কাজ করো ফলের আশা কোরোনা ইত্যাদি। :)