আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন আর ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিসের প্রশাসন প্রথম দিনই হোয়াইট হাউস প্রেস ব্রিফিং রুমের দরজা খুলে দেন, যা গত চার বছর হামেশাই তালা বন্ধ থাকত। নতুন প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকির দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করায় এবং তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দেখে আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ওপর আবার ভরসা ফিরছে। সদ্য পরাজিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত চার বছর ধরে আমেরিকার গণতন্ত্রের ওপর চালিয়েছিলেন নিরলস আঘাত, যার শুরু সংবাদমাধ্যমকে গণশত্রু (enemy of the people) আখ্যা দেওয়া থেকে। সংবাদ মাধ্যমকে গণশত্রু বলা ফ্যাসিজমের প্রথম পদক্ষেপ। সংবাদ মাধ্যমকে আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার অন্যান্য গণতান্ত্রিক স্তম্ভগুলোর ওপরও আঘাত আসছিল।
গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে তিনটি প্রধান স্তম্ভের ওপর: একজিকিউটিভ, লেজিস্লেটিভ আর জুডিশিয়াল। আমেরিকার একজিকিউটিভ ব্রাঞ্চ হল আমেরিকার প্রেসিডেন্সি, ভারতের যেমন প্রাইম মিনিস্টার অফিস। আমেরিকার লেজিস্লেটিভ, কংগ্রেস আর ভারতবর্ষের লেজিস্লেটিভ, সংসদ। আমেরিকার কংগ্রেসে সেনেট আর হাউস, ভারতের সংসদ লোকসভা আর রাজ্যসভা। জুডিসিয়ারি দু দেশেই এক; দেশের আদালত। এই তিনটে স্তম্ভ গণতন্ত্র রক্ষা করছে কি না তার কৈফিয়ত দেবার জন্য আছে - ফ্রি প্রেস বা স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, যা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই জেন সাকির অঙ্গীকার, “বাইডেন-হ্যারিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে প্রেস ব্রিফিং সপ্তাহে পাঁচদিন হবে” ---- এমন একটি অতি সাধারণ বিবৃতিও চার বছর পর আজ অসাধারণ মনে হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ের দ্বিতীয় দিন জনৈক ভারতীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, “প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভারত-আমেরিকা পলিসি কী?” প্রশ্নের সঙ্গে মন্তব্যও জুড়ে দেন, “আমেরিকা একটি প্রাচীনতম গণতন্ত্র, আর ভারতবর্ষ একটি বৃহত্তম গণতন্ত্র”। এমন সস্তা লাইন ব্যাবহারের প্রয়োজন বা যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, সব রকম প্রশ্ন করার অধিকারই সংবাদ মাধ্যমের গণতান্ত্রিক অধিকার। সস্তার লাইন হলেও লাইনটা সত্যি। আমেরিকা সত্যিই প্রাচীনতম গণতন্ত্র, আর ভারতবর্ষও সত্যিই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। জেন সাকি এ প্রশ্নের যে উত্তর দেন, তা চমৎকার। তিনি বলেন, জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ভারতীয় (এবং জামাইকা) বংশোদ্ভূত, অতএব ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক দৃঢ়।
একা গুডম্যান রক্ষা করে গণতন্ত্রের ঘর:
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অনেক কাজ। মাত্র দশ মাসে বর্ণবাদী মিথ্যাপ্রবণ বিজ্ঞান বিরোধী অকর্মণ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের দৌলতে প্রায় চার লক্ষ আমেরিকান মৃত, আরও মারা যাবেন। চার বছর ধরে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আমেরিকার গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন মিথ্যেকে মিথ্যে না বলে “অল্টারনেটিভ ট্রুথ” নাম দিয়ে। নির্বাচনে পরাজয়ের পর নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে মিথ্যে প্রচার নির্বাচনের আগেই শুরু করেন এই বলে, “আমি যদি জিতি তাহলে নির্বাচন সঠিক, আমি যদি হারি তাহলে নির্বাচন অবৈধ।” এমন অগণতান্ত্রিক বক্তব্য একমাত্র ফ্যাসিবাদের নায়করাই বলেন। এরপরও তিনি প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভোট পান। জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিস ৮০ লক্ষ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন। তবে আমেরিকার নির্বাচন ইলেক্টরাল কলেজের ওপর নির্ভয়র করে। সেখানে বাইডেন-হ্যারিস পান ৩০৬ আর ট্রাম্প-পেন্স পান ২৩২। ঠিক একই ব্যবধানে চারবছর আগে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ট্রাম্প জিতেছিলেন। অথচ এবারের ঐ একই ব্যবধানের হার মানতে নারাজ ট্রাম্প। নির্বাচনের আগেই নির্বাচন নিয়ে মিথ্যে প্রচার চলছিল। নির্বাচনের পর তার ভোল্টেজ বেড়ে চলল প্রতিদিন।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হবার মাত্র দু সপ্তাহ আগে নতুন বছরের গোড়ায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ডাকে এবং উস্কানিতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা চড়াও হল আমেরিকার গণতন্ত্রের উচ্চতম স্তম্ভ ক্যাপিটাল হিলের ওপর যেখানে সেই সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক কাজ কর্ম করছিলেন। আমেরিকার সংবিধান অনুসারে সেদিন বহির্গামী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স আনুষ্ঠানিকভাবে আগত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের জয় খাতায়কলমে লিপিবদ্ধ করছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স কিন্তু প্রাক্তন প্রেসিডেন্টেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট। দুজনেই দু মাস আগে পরাজিত হয়েছিলেন বাইডেন-হ্যারিসের কাছে। মাইক পেন্স জানতেন নির্বাচনে কোন কারচুপি হয়নি। তিনি জানতেন, বাইডেন-হ্যারিস জিতেছেন সুষ্ঠুভাবেই। তাই তিনি জানুয়াররির ৬ তারিখ তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছিলেন ক্যাপিটাল হিলে। ট্রাম্পের উস্কানিতে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী “হর হর ট্রাম্প” বলতে বলতে লাঠি, ট্রাম্প ফ্ল্যাগ, লোহার পাইপ ইত্যাদি নিয়ে চড়াও হয় ক্যাপিটাল হিলের ওপর। ভাঙচুর করা থেকে শুরু করে থুতু, মল-মূত্র পরিত্যাগ করে গণতন্ত্রের প্রতীককে অপবিত্র করে। এই হানায় মৃত্যু হয় পাঁচ জনের যার মধ্যে দুজন ক্যাপিটাল পুলিশ। দাঙ্গাকারীদের মুখে স্লোগান “হ্যাং মাইক পেন্স (মাইক পেন্সের ফাঁসি চাই)” কারণ মাইক পেন্স তাঁর সাংবিধানিক কর্তব্য যথাযথ পালন করেছেন। এই তাঁর অপরাধ। দাঙ্গাকারীরা মাইক পেন্সের খুব কাছে চলে আসে।
এক পুলিশ কর্মীর উপস্থিত বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয় উন্মত্ত শ্বেতাঙ্গ দাঙ্গাবাজের দল। পুলিশ কর্মীর নাম ইউজিন গুডম্যান। একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ অফিসার। সত্যিই একজন গুড ম্যান। দাঙ্গাবাজের দল তাড়া করছে গুডম্যানকে। ভায়েস প্রেসিডেন্টের ঘরের থেকে তারা মাত্র কয়েক ফুট দূরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে দাঙ্গাবাজেরা। শোনা যাচ্ছে “হ্যাং মাইক পেন্স” বুলি। একবার যদি এরা মাইক পেন্সের ঘরে ঢুকে পড়ে কি করবে কে জানে। অফিসার গুডম্যানের হাতে একটা লাঠি গোছের কিছু। বন্দুক আছে কিন্তু মত্ত হামলাকারীর ওপর গুলি চালালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই লাঠিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পিছুপা হচ্ছেন ইউজিন গুডম্যান। এসে পড়লেন একটা সিঁড়ির ধাপে।
বাঁ দিকে সেনেট, অর্থাৎ বাঁদিকে মাইক পেন্সের ঘর। আড়চোখে একবার বাঁদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলেন সেদিকে কোন পুলিশ নেই। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ডানদিকে ঘুরে পিছোতে থাকেন। দাঙ্গাকারীরা ইউজিন গুডম্যানকে অনুসরণ করে ডানদিকে ঘুরে যায়। একেই কি বলে একা কুম্ভ রক্ষা করেন মাইক পেন্সের ঘর?
হয়ত একা গুডম্যান রক্ষা করেছেন গণতন্ত্রের ঘর, সেই গণতন্ত্র যা ইউজিন গুডম্যানের পূর্বপুরুষকে হাতে পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে দাস করে রেখেছিল প্রায় ২০০ বছর।
গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম:
১৭৭৬ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভিনব যুগের সূত্রপাত। আমেরিকান রেভলিউসন রাজতন্ত্রকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের। ১৭৭৬এ লেখা আমেরিকার সংবিধানের প্রথম লাইনে লেখা হয়, “We the people”। জন্ম হয় আমেরিকান রিপাব্লিক। অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র। গল্প আছে যে একজন নাকি বেন ফ্রাঙ্কলিনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি ধরনের সরকার তাঁরা তৈরি করলেন। বেন ফ্রাঙ্কলিন নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “একটা রিপাব্লিক, যদি আক্ষুন্ন রাখতে পারেন (a Republic, if you can keep it)।” গণতন্ত্র রক্ষা করা সহজ কাজ নয়। নানান উত্থান পতনের মধ্যেদিয়ে এগিয়ে চলেছে গণতন্ত্র। ১৭৭৬এ ডেক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্সে লেখা “all men are created equal” কিন্তু “men” বলতে গোটা মানবজাতীর কথা বলেনি, “men” বলতে তখন কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ পুরুষের কথাই বলা হয়ছিল কারণ কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে এবং নারীজাতিকে তখন মানুষ হিসাবে গণ্য করা হত না। নির্বাচনে ভোট দেবার অধিকারও তাদের ছিল না। ১৮৬১ সালে দাসপ্রথার পক্ষে থাকা আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলি নিয়ে তৈরি কনফেডারেসি দাসপ্রথার বিপক্ষে থাকা উত্তরের প্রদেশগুলি নিয়ে তৈরি ইউনিয়নের সঙ্গে বাধে যুদ্ধ, যা আমেরিকার গৃহ যুদ্ধ বা সিভিল ওয়ার নামে খ্যাত। প্রায় পাঁচ বছর চলে সেই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৫ এব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে কনফেডারেসিকে পরাজিত করে ইউনিয়ন জয়ী হয়। যুদ্ধশেষে এব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথার ইতি টানেন। দেন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ যা Emancipation of Declaration বা মুক্তির ঘোষণা নামে পরিচিত। যুদ্ধের পর শুরু হয় আমেরিকার পুনর্গঠন। ১৮৭০সালে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা ভোটাধিকার অর্জন করেন। মেয়েদের ভোটাধিকার আসে আরও পরে, ১৯১১র সাফ্রজেট আন্দোলনের পড়। তবে গৃহ যুদ্ধের ঠিক পরেই এক শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীর হাতে এব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যা আমেরিকার পুনর্গঠনে ভাঁটা টানে। ১৮৭০এ কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ভোটাধিকার পান বটে, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই দাসপ্রথা আর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্তবাদের জন্মস্থল আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে শুরু হয় “জিম ক্রো”। ভোট দেবার সাংবিধানিক অধিকার থাকলেও, নানা ছলচাতুরী করে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ভোট দেওয়া প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বজ্রকঠিন অথচ শ্বেতাঙ্গদের জন্য অতি সহজ লিটেরারি টেস্ট তৈরি হয়, গরিব কালো মানুষদের জন্য পোল ট্যাক্সের আয়োজন হয়। নানান রকম নিয়ম, যাকে বলা হয় “জিম ক্রো ল”, তৈরি করে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ভোট দমন করা হয়। তার সঙ্গে শুরু হয় বর্ণভিত্তিক বিভাজন, চলে কৃষ্ণ দেহের হত্যা আর লিঞ্ছিং। বহু রক্তক্ষয়ের পর, বহু আন্দোলনের পর অবশেষে ১৯৬৫তে গান্ধীপ্রেমী ডঃ মারটিন লুথার কিং এর অহিংস আন্দোলন নিয়ে আসে ভোটাধিকার বিল (voting rights bill of 1965)। কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ভোটের রেজিস্ট্রেশান ৭% থেকে এক লাফে ৫৯% হয়ে যায়।
ভোটের মূল্য:
আজও দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে কালো মানুষদের ভোট দেওয়ার রাস্তায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। জর্জিয়া আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলির মধ্যে একটি এবং আজও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের স্বর্গরাজ্য। যদিও জর্জিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সংখ্যা আমেরিকার অন্যান্য অনেক রাজ্যের চেয়ে বেশি, ভোটার দমন নীতিগুলো এখানে সবচেয়ে বর্বর যা কালো ভোটারদের, বিশেষ করে কালো মহিলা ভোটারদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে ব্যাবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিবাহের পর অনেক মেয়ে, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মেয়েরা নিজের পদবী আর স্বামীর পদবী দুটোই ব্যাবহার করেন, মাঝে একটা হাইফেন দিয়ে। জর্জিয়ার ভোটার তালিকায় কেউ যদি হাইফেনটা দিতে ভুলে যান তাঁর সম্পূর্ণ ফর্মটাই বাতিল হয়ে যায়। আমেরিকার নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস শুধু নারীই নন, কৃষ্ণাঙ্গও। তাই তিনি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের চক্ষুশূল।
এই নির্বাচনে বাইডেন-হ্যারিসের ১১,৭৭৯ ভোটে জেতা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বর্ণবাদী ট্রাম্প সম্প্রদায়। এদের নাটেরগুরু ট্রাম্প তো জর্জিয়ার নির্বাচনী অফিসারকে ফোনে ১১,৭৮০ ভোট খুঁজে দিতে বলেন, যা বাইডেন-হ্যারিসের ভোটের চেয়ে এক বেশি। ফোনে হুমকিও দেন। অফিসারটি ট্রাম্পের নিজের পার্টির হওয়া সত্তেও এমন সংবিধান বিরোধী কাজে সাহায্য করেননি। ট্রাম্প বা পার্টির চেয়ে দেশ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। মাইক পেন্সকে সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করেন ইউজিন গুডম্যান, কিন্তু গণতন্ত্রকে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে রক্ষা তিনি একা করেননি। করেছেন আমেরিকার অসংখ্য কৃষ্ণকায় মানুষ যাদের মধ্যে দুটি নাম উল্লেখযোগ্যঃ জিম ক্লাইবার্ন এবং স্টেসি এব্রাম। আর এঁদের সকলের ওপর আছেন নাগরিক অধিকার এবং মানবআধিকার আন্দোলনের আইকন সদ্য প্রয়াত কংগ্রেসম্যান জন লুইস। এঁরা সকলেই আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সদস্য। এঁরা এঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন ভোটাধিকারের লড়াইয়ে। জিম ক্লাইবার্নের নেতৃত্বে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় বিপুল ভোটে জয়ী করেন বাইডেন-হ্যারিসকে। স্টেসি এব্রামের নেতৃত্বে অগণিত স্বেচ্ছাসেবী গত দু বছর ধরে জর্জিয়ার ঘরে ঘরে, বিশেষ করে জর্জিয়ার কালো মানুষদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাঁদের ভোটের তালিকাভুক্ত করেন। নির্বাচনের দিনগুলিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের ভোট দিতে উৎসাহ দেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেককে, যাঁদের গাড়ি নেই বা হেঁটে যাবার ক্ষমতা নেই বা বাসে ট্রেনে গিয়ে ভোট দেবার সামর্থ্য নেই, তাদের ভোট কেন্দ্রগুলিতে নিয়ে যাওয়া, ভোটের পর তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদির ভার নেন স্টেসি এব্রামের কর্মীরা। বহু মানুষ স্টেসি এব্রামকে আর্থিক সাহায্য পাঠান, যা দু বছর আগে নিজে জর্জিয়ার গভর্নর পদপ্রার্থী হবার সময়ে পাননি। অনেক লড়াইয়ের পর গভর্নরের পদে হেরে গিয়েছিলেন। জর্জিয়া নির্বাচনে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে হারিয়ে বাইডেন-হ্যারিসের জিতের পেছনে রয়েছে স্টেসি এব্রামের অক্লান্ত পরিশ্রম আর রয়েছে তাঁর নির্নিমেষ ঐকান্তিকতা। স্টেসি এব্রামের অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা শুধু বাইডেন-হ্যারিসেরই নয়, জর্জিয়ায় এনেছে আরও দুটো অভাবনীয় জয়। জর্জিয়ার দুটো সেনেট আসনের দুটোই এতদিন কেবল শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের কব্জায় ছিল। গত নির্বাচনে তার একটা জয় করেন কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় থেকে আসা রেভারেন্ড রাফায়েল ওআরনক। আর অন্যটা জয় করেন ইহুদী সম্প্রদায় থেকে আসা জন ওসফ।
রেভারেন্ড ওআরনক সারা জীবন প্রচার করেছেন ব্ল্যাক লিবারাশন থিওলজি। তাই তাঁর শ্বেতাঙ্গ প্রতিপক্ষ ওনাকে “র্যাডিকাল লিবারেল রাফায়াল ওয়ারনক“ বলে সম্বোধন করতেন। জর্জিয়ার সাদা ভোটারদের কাছে “র্যাডিকাল লিবারেল” শব্দ দুটি নিন্দাসূচক। নাগরিক ও মানবাধিকার অর্জনের আন্দোলনের কিংবদন্তী পুরুষ ডঃ মারটিন লুথার কিংকেও শ্বেতাঙ্গ সমাজ এককালে “র্যাডিকাল” বলেই তুচ্ছ করত। ডঃ মারটিন লুথার কিংও জর্জিয়ার সন্তান ছিলেন। উনিও, রেভ অয়ারনকের মতোই সেই একই বিখ্যাত ব্ল্যাক চার্চ, Ebenezer Baptist Church, এ যাজক ছিলেন। বলতেই হয় আনক্যানি কইন্সিডেন্স বা ভুতুড়ে সন্নিপাত! জন ওসফ তদন্তকারী সাংবাদিকই। আইসিসের নৃশংসতা কামেরাবন্দি করেছিলেন ওসফ। জন ওসফ ডঃ মারটিন লুথার কিংয়ের উত্তরসূরি, ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনের আর এক কিংবদন্তী পুরুষ জন লুইসএর কাছে অহিংসা আন্দোলনের হাতেখড়ি নিয়েছিলেন। জর্জিয়ার এই তিনটি জয়ের রচয়িতা স্টেসি এব্রাম আর তাঁর ডাকে উদ্বুদ্ধ অগণিত কৃষ্ণাঙ্গ জর্জিয়ান। ভাবলে অবাক হতে হয় যে যাঁদের পূর্বপুরুষদের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা শত শত বছর ভোটাধিকার তো দূরের কথা, মানবাধিকারও দেয়নি তাঁদের গণতন্ত্রের ওপর এমন অগাধ আস্থা। পুলিশের জল কামান, কুকুরের তাড়া, বিলি ক্লাবের আঘাত, রবার বুলেট, এমনকী আসল বুলেটও টলাতে পারেনি তাঁদের গণতন্ত্রে বিশ্বাস।
গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের সবচেয়ে সহজ অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ভোট দেওয়া। যদি ডঃ কিং, জন লুইস, স্টেসি এব্রাম আর অসংখ্য কালো দেহের বলিদান গণতন্ত্রে অংশগ্রহণে আমাদের উদ্বুদ্ধ না করে তবে “আমেরিকা একটি প্রাচীনতম গণতন্ত্র, আর ভারতবর্ষ একটি বৃহত্তম গণতন্ত্র” আওড়ে বা ডঃ আম্বেদকারের হাতে গড়া ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দলিল নিয়ে গর্ব করার অধিকার আমাদের থাকতে পারে না। গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ না করলে যে ফ্যাসিবাদ অবশ্যম্ভাবী সেটা ২০২১ এর ৬ই জানুয়ারী আমাদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। নবযুগের কবি ২২ বছরের অ্যামান্ডা গরম্যান তাঁর সদ্য রচিত “The Hill We Climb” কবিতায় গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব নিতে বলছেন। গণতন্ত্রের রাস্তা ভঙ্গুর, কিন্তু সে রাস্তা আলোর দিশারী। অ্যামান্ডা আমাদের আশার আলো দেখিয়েছেন। আলো হতে বলেছেন।
“…For there is always light,
if only we're brave enough to see it
If only we're brave enough to be it”
(...আলো আছে, আলো থাকবে
আমরা নির্ভীক হলে সে আলো দেখতে পাব
আমাদের অভীক হয়ে সেই আলো হতে হবে)
"অল্টারনেটিভ ফ্যাক্ট" হবে। "অল্টারনেটিভ ট্রুথ"এর জায়গায়।