“আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (মায়ার খেলা)
২১ জানুয়ারি - সুশান্ত সিংহ রাজপুতের জন্মদিন। গতবছর তাঁর মৃত্যুর ঘটনা সারা ভারতবর্ষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তরতাজা একটি স্বপ্নের অবসান ঘোষণা করেছিল এই মৃত্যু। আসমুদ্রহিমাচল স্তব্ধবাক হয়েছিল। সুশান্ত ছিলেন বিহারের ভূমিপুত্র। এই সুবাদে বিহার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশ তখন গণমাধ্যমের দৌলতে এক অদ্ভুত আখড়াঘরে পরিণত হয়েছিল। সিটিজেন শুধু নয়, নেটিজেনদের মধ্যেও এই আবেগের আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ চলছিল। তবে ব্যক্তিগতস্তরে এই মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করেনি, তাই এর প্রায় কোনও প্রতিক্রিয়াই আমি দিইনি, একটি ব্যতিক্রম ব্যাতিরেকে।
এর কারণ এই নয় যে, এগারো বছর বয়সে, এক অষ্টমীর সকালে আমি গায়ে আগুন লাগিয়ে একটি নারীকে ছুটে যেতে দেখেছিলাম জানালার ফাঁক দিয়ে। সেই দৃশ্যস্মৃতি আমার চেতনায় উজ্জ্বল হলেও আসল ঘটনাটা হল, গতবছরের মে মাসের ২১ তারিখেই আমি নন্দীদাকে হারিয়েছিলাম। স্বরভানু নন্দী, আমাদের নন্দীদা। ঝাঁ চকচকে মুম্বই শহরের একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্র থেকে সদ্য ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে মাত্র দু-মাসের চাকুরিজীবন তাঁর। চাকুরিসূত্রে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে বদলি হয়েছিল এবং অফুরান আনন্দে ছিলেন। ২৩ মে আচমকা জানা গিয়েছিল তাঁর আত্মহত্যার ঘটনা। মনে আছে, কয়েকবছর আগেই এক বর্ষাকালীন সন্ধেয় ক্যম্পাসের ডাইনিংয়ে আলাপ হয়েছিল নন্দীদার সাথে। মাত্র দু’দিন আগেই আমি ইনস্টিটিউট জয়েন করেছি। নন্দীদা তখন পিএইচডির শেষের দিকে। প্রথমদিনের সখ্যই আমাদের মধ্যেকার সিনিয়র-জুনিয়র প্রাচীর ভেঙে দিয়েছিল। বাঙালি-বাঙালি আদিখ্যেতা নয়, নিখাদ মানুষে-মানুষে বন্ধুত্ব। তারপর থেকে বহুদিনের বহু ঘটনা জানান দিয়েছে, স্বরভানু নন্দীর মত ওরকম উদার ভালোমানুষ, আমোদপ্রিয়, ভোজনরসিক ও অনাবিল জীবনীশক্তির অধিকারী কাউকে এই মক্কেল দেখেনি, অন্তত আজ পর্যন্ত। অথচ, সেও কিনা আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। এ ঘটনাটা আমাকে শুধু অঝোরে কাঁদিয়েছে তাই-ই নয়, ভাবিয়েছে আরও বেশি।
এই নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন সারা পৃথিবীজুড়ে করোনা অতিমারীতে মৃত্যু হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। দুনিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত। রোজ চাকুরি হারাচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ। CMIE-এর তথ্য বলছে ১ কোটি ৮৯ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। অথচ কেউ জানেন না, অর্থনীতির এই অনন্ত অন্ধকারেই রচিত হচ্ছে আরেকটি অতিমারীর পটভূমি। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে যে, গড়ে প্রতি বছরে আত্মহত্যার কারণে আমরা হারাই ৮ লক্ষ মানুষকে। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার জনই ভারতীয়। রাজ্যের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান তালিকার শীর্ষেই। আর এই আত্মহননকারী প্রবণতা সর্বাধিক দেখা যায় ১৫-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এবং মহিলাদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। দেহসৌষ্ঠব সম্পর্কিত সমস্যা, হুমকির ভয়, যৌনাচার সংক্রান্ত নানা আশঙ্কা ও গ্লানি, লিঙ্গ পরিচয়, পরীক্ষার চাপ, পেশা নির্বাচন, সম্পর্কের জটিলতা, অনুপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, নেশা, অশ্লীল আসক্তি, পিতামাতার সমস্যা ইত্যাদি নানা কারণে জন্মায় মানসিক চাপ। আর সেগুলোই পরবর্তীকালে আত্মহননে ইন্ধন জোগায়। শুধুমাত্র তাই-ই নয়, ২০১৪ সালের একটি রিপোর্টে আত্মহত্যার সংখ্যা ও কারণের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং তাতে দেউলিয়া বা ঋণগ্রস্ততা, বিবাহ সম্পর্কিত সমস্যা, যৌতুকের সমস্যা, বিবাহ অতিরিক্ত বিষয়, বিবাহবিচ্ছেদ, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, প্রতিবন্ধী জীবন বা বন্ধ্যাত্ব, পারিবারিক সমস্যা, অসুস্থতা, প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু, মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও আসক্তি, সামাজিক খ্যাতিতে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা, মতাদর্শগত কারণ, প্রেম, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সম্পত্তির বিরোধ, অবৈধ সম্পর্ক, অবৈধ গর্ভাবস্থা, শারীরিক নির্যাতন (ধর্ষণ ইত্যাদি), পেশার সমস্যা ও অজানা অন্যান্য কারণগুলিকে দেখানো হয়েছে। আর এখন, লকডাউন ও করোনা-উত্তরকালে এই সমস্যাগুলির ব্যাপকতা বাড়বে বৈ কমবে না। ফলে আমরা হয়তো আত্মহত্যার আরেকটি অতিমারীর সাক্ষী হব।
কিন্তু ভয়ের কারণ অন্য। ভারতবর্ষের মত দেশে আত্মহত্যা একটি সামাজিক অপমান। ফলে যে তথ্য প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়, তার চেয়েও ঢের বেশি করুণ এই অবস্থা। শুধুমাত্র তাই-ই নয়, এই দেশে যতগুলি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ঘটে আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ঘটনা। আসলে, সব প্রচেষ্টাই তো আর সফল আত্মহত্যায় রূপান্তরিত হয় না। আর এই প্রত্যেকটি প্রচেষ্টার অন্তরালে থাকে একটি দীর্ঘ অবসাদের ইতিহাস। বহু কিংবদন্তী আত্মহত্যার পক্ষে ও বিপক্ষে বহু যুক্তি পেশ করেছেন। প্লেটো থেকে হিউম অবধি সকলেই প্রায় নানা আঙ্গিকে আত্মহত্যার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আত্মহত্যার মনস্তত্ত্বের দিকটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। যুগে যুগে আত্মহত্যার আশ্রয় নিতে দেখা গেছে এমন বহু মানুষকে যাদের জীবনে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবগুলির প্রতিকূলতা প্রায় কিছুই ছিল না। তবুও, তাঁরা সে পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুতরাং, আত্মহত্যার অন্তরালে যে কারণের বৈপরীত্য, ব্যাপকতা ও দ্বন্দ্বময়তা দেখা যায় তা শুধুমাত্র মনস্তত্ত্বের আঙ্গিকেই সুবিচার লাভ করে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল মনস্ত্বাত্ত্বিকই আত্মহননকে মানসিক বৈকল্য হিসেবেই ব্যখা করেছেন। আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সাইকোলজি অনুসারে বলছে, “Suicide is the act of killing yourself, most often as a result of depression or other mental illness”। এবং অন্যদিকে শিবরাম ভারমবলি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট (NIMHANS)-এর সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক, বলেছেন, “ideas of suicide have definitely gone up among the disadvantaged sections of the society”। সুতরাং, জীবনের জটিল এবং বহুস্তরীয় ধাঁধায় নিউরোবায়োলজি ও সমাজ-সংস্কৃতির অবস্থানই যে আত্মহত্যায় সর্বপ্রধান সেটা মেনে নিতেই হবে। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেকের কাছেই আত্মহনন প্রাধান্য পায়, অনেকের কাছে পায় না। যাদের কাছে আত্মহননের অভিধা প্রকট তাদের আবেগপ্রবণতা, ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার অভিঘাত যে নিদারুণ, তা বলাইবাহুল্য। এছাড়া অনেকে, আজকাল বিশেষ করে, দুনিয়ার আকর্ষণ পাওয়ার মরিয়া পন্থা হিসেবে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ফেসবুক লাইভ করে আত্মহত্যার ঘটনাও আর বিরল নয়।
যে কোনও মৃত্যুই দুর্ভাগ্যপূর্ণ এবং যন্ত্রণার। রোগভোগের কারণে কিংবা স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু পরিবার-বন্ধুজনের কাছে যতটা বেদনার সৃষ্টি করে, আত্মহত্যার মর্মান্তিক পরিণতি সে তুলনায় অনির্বচনীয়। ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়, জহরব্রতের মত একটা অমানবিক প্রথা, যা আত্মহত্যারই নামান্তর, এই দেশে এক সময় প্রচলিত ছিল। মাত্র ৩৩ বছর আগে সতীপ্রথায় বিশ্বাসী রূপ কানোয়ারের মৃত্যুর ঘটনা আজও সংবাদমাধ্যমকে আলোড়িত করে। এসব ছাড়াও, সফল সৃষ্টিশীল মানুষ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সকলের আত্মহত্যার ঘটনার সাক্ষী মানবসমাজ। সাহিত্যক্ষেত্রে জন ব্যারিম্যান, মায়াকোভস্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, অ্যানি সেক্সটন, ভার্জিনিয়া উলফ, সিলভিয়া প্লাথ, ফোস্টার ওয়ালেস, ইউকিও মিশিমা, এডগার অ্যালান পো সকলেই আত্মহত্যা করেছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পল লাফার্গ, হিটলার, লর্ড ক্লাইভের আত্মহত্যার ঘটনা বহুল প্রচলিত। তাছাড়া কার্ল মার্ক্সের দুই মেয়ে, এলিয়েনর মার্ক্স, লরা মার্ক্স পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। গল্পে উপন্যাসে – কী বিদেশে কী এদেশে – সর্বত্র আত্মহত্যার প্রচেষ্টা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনার মাধ্যমে বহু চরিত্র অমরত্ব লাভ করেছে। যেমন, শেক্সপিয়রের রোমিও এবং জুলিয়েট, ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াস, ওথেলো, ওফেলিয়া, অন্যদিকে টলস্টয়ের আনা কারেনিনা আত্মহননেই পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যেও, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রজনী-বিষবৃক্ষ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শুভদা-বিলাসী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র-চতুরঙ্গ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মীরার দুপুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা, অমলেন্দু চক্রবর্তীর যাবজ্জীবন, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হলদে গোলাপ ইত্যাদি নানা বিখ্যাত সাহিত্যে আত্মহত্যার নানা আবহ ও আঙ্গিকের সম্মুখীন হই আমরা। ভুলতে পারিনা, কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার ঘটনা। এছাড়া আত্মহত্যার মনস্তত্ত্বে কলঙ্কভাগী হওয়ার সম্ভাবনা যেমন থাকে তেমনই কিছুক্ষেত্রে থাকে শহিদের অমরত্ব প্রাপ্তি। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চন্দ্রশেখর আজাদ, প্রফুল্ল চাকী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ভঞ্চিনাথা আইয়ার ইত্যাদি বহু বিপ্লবীর আত্মহত্যার ঘটনা স্বাধীন ভারতের ইতিহাস রচনা করেছে। কিছু আত্মহত্যা যেমন আসে মহানুভব আত্মত্যাগের আদর্শে, নিয়ে আসে অমরত্ব; তেমনই কিছু আত্মহত্যা আসে ব্যক্তিগত গ্লানির মুক্তিপথ হিসেবে, নিয়ে আসে পরাজয়ের অপমান। সুতরাং, আত্মহত্যা যেন এক মায়াবী মৃগ। বর্ণে স্বর্ণ কিন্তু অভ্যন্তরে যেন বন্দিত্ব ও দ্বিখণ্ডিত ধরণীর ভবিতব্য ধারণ করে থাকে বুকে।
নিবন্ধের অন্তিমে যেদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব তা হল, ডাক্তার ও গবেষকদের মধ্যে থাকা আত্মহত্যার প্রবণতা বিষয়ে। এই করোনাকালে কমপক্ষে দশজন ডাক্তারের আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই তিরিশ বছরের কম বয়সি। আর এটা আজকের সমস্যা নয়। আমাদের মনে আছে, রমাপদ চৌধুরীর অভিমন্যুর কথা – তপন সিনহার এক ডক্টর কি মৌত – সর্বোপরি ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা। এই করোনাকালে যেহেতু ডাক্তারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে, মিডিয়ার আশীর্বাদধন্য হয়েছেন তাঁরা, তাই এগুলো সামনে আসছে। পুনের সেন্টার ফর মেন্টাল হেলথ ল অ্যান্ড পলিসির পরিচালক সৌমিত্র পাথারে ‘দ্য ওয়্যার সায়েন্স’কে জানিয়েছেন, “When I went to medical school in Mumbai in the 1980s, each batch would graduate with one or two student suicides during the five-year course. Very exceptional batches, maybe one in five or six batches, would have no suicides. That’s a very high rate compared to the general population”। চণ্ডীগড়ের স্নাতকোত্তর ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪৪৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৩০% হতাশাগ্রস্ত ছিলেন এবং প্রায় ১৭% তাদের জীবন শেষ করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। ডাক্তারদের জীবনযাপনে প্রথমত যেভাবে ডিগ্রি অর্জন করতে হয়, অন্যদিকে সেভাবেই কর্মবিরতিহীন দীর্ঘ সময় কাটানো, পরিবারের থেকে দূরে থাকা, রোগী পক্ষের আক্রমণ এবং সামর্থ্যের তুলনায় অতিরিক্ত শুধু নয়, বহু বহু অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলানো এই আত্মহনন প্রবণতার পক্ষে কাজ করে। উল্লেখ্য যে, আমার বহু বন্ধু এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। তাঁদের কাছ থেকেও শুনেছি যে, জীবনে একটা সময়ে তাঁদের মধ্যেও নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মনোভাব প্রকট হয়েছিল। কোনভাবে সেটাকে সামলানো গিয়েছিল তখন, অথচ হলফ করে বলছি, এঁদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগই রোগীর সেবার ব্রতে নিয়োজিত হবার স্বপ্ন দেখেছিল এবং এমনকি এমারজেন্সির দায়িত্ব আছে এমন বিষয়ে মাস্টার্স করেছিল।
অন্যদিকে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরের তথ্য বলছে যে, ২০১৮ সালে ১০,১৫৯ জন, ২০১৭ সালে ৯৯০৫ জন এবং ২০১৬ সালে ৯৪৭৮ জন্য ছাত্র আত্মহত্যায় মারা যায়। যেটা আমাদের আরও চমকে দেয়, তা হল গবেষকদের মধ্যে হতাশাজনিত আত্মহত্যার প্রবণতা। ১৩ নভেম্বর ২০১৯ সালে প্রকাশিত নেচারের একটি গবেষণা “PhDs: the tortuous truth”- এ দেখা গেছে যে, প্রশিক্ষণ, কর্মজীবনের ভারসাম্যহীনতা, উপবৃত্তি ও ফান্ডিং-এর সমস্যা, গাইড এবং সহকর্মীদের দ্বারা হুমকি ও হয়রানির ঘটনা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা প্রভৃতি কারণে ৩৬% হতাশাগ্রস্ততার শিকার হয়েছিলেন যাদের চিকিৎসাজনিত সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল। একটি সম্পাদকীয় “The mental health of PhD researchers demands urgent attention”-এ লেখা হয়েছিল, “the truth is that the system is making young people ill and they need our help. The research community needs to be protecting and empowering the next generation of researchers. Without systemic change to research cultures, we will otherwise drive them away”। অনেকের ধারণা শিক্ষার সঙ্গে আত্মহত্যার সম্পর্ক বৈরিতার; শিক্ষা স্বাবলম্বন দেয় ও আত্মহত্যার প্রবণতা দূর করে। কিন্তু বাস্তব উলটো কথা বলে। ১৮৮০ সালে এনরিকো মরসেলি দেখিয়েছিলেন যে, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহননের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ১৯৫১ সালে দুরখেইম বলেছিলেন যে, এর সম্ভাব্য কারণ বোধহয় প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতা। কয়েক বছর আগে ২০১২ সালের একটি গবেষণাপত্র বলছে যে, “Individual with higher educational achievement may be more prone to suicide risk when facing failures, public shame, and high premorbid functioning”। রোহিত ভেমুলার নাম কি আমরা ভুলতে পারব কোনদিন?
সুতরাং, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশেই ভবিষ্যতের সমৃদ্ধিলাভ। সরকারের তরফে অনেকগুলি হেল্পলাইন নম্বর যেমন আছে, তেমনই, সরকার আইনগত দিক থেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবার একটা প্রচেষ্টা শুরু করেছে। ফলস্বরূপ, ২০১৭ সালে আত্মহত্যাকে অপরাধের তকমা থেকে মুক্তি দিয়ে ২০১৮ সালে মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট লাগু করে। শেষে বলতেই হয়, ভারতবর্ষে আত্মহননের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে, সুশান্তের মৃত্যু শুধুমাত্র তার শিকার। এই দেশের চলতে থাকা কৃষকের আত্মহত্যা আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। যেমন পারিনা এমন বহু স্মৃতিও। সুতরাং, তাকে লালিত না করে, সেই পরিবেশকে শেষ করাই উদ্দেশ্য হওয়া নৈতিকতার স্মারক। নইলে, একদিন আত্মহত্যার অতিমারীতে উজাড় হয়ে যাবে এই দেশ, নিঃশব্দে, শুধু ফিসফিসানিটুকু রয়ে যাবে,
“শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ”।
অর্ধেন্দুর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পর্শময় ন্যারেটিভের বিন্যাস দেখিয়ে দেয় এ এক আশ্চর্য গোলকে আমাদের অসংলগ্ন যাপন যেখানে দুই বিপরীত লব্জের টানাপোড়েন আমাদের নির্লিপ্তিকে লালন করেছে, করছে। আশৈশব কানে শোনা লক্ষ্মীর পাঁচালির পাঠে - "আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন"। ছদ্মবেশী লক্ষ্মী দেবীর নিজস্ব উপদেশ। লক্ষ্মীর বার্তা মানে সেতো সমাজেরও বার্তা। সেই সমাজই রূপ কানোয়ারের সতীত্বকে গ্লোরিফাই করে। যে স্ট্যাটিসটিকস এবং বিশ্লেষণকে কেন্দ্রে রেখে লেখকের স্ব-হননের নৈরাত্ম সন্ধান সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় রক্তে খেলা করা 'বিপন্ন বিস্ময়' কি তবে শুধুই প্রবল পার্থিব যন্ত্রণার ছদ্ম আবরণ ! নাকি ব্যক্তি এবং চারপাশের সহ্যাতীত মিথষ্ক্রিয়ার দর্শন! মনে পড়ে লুই আলথুসারকে কিংবা কানু সান্যালকে - যা "দ্বিখণ্ডিত ধরণী"র ( শ্রীযুক্ত অর্ধেন্দুর শব্দবন্ধ) চালচিত্রকে নিমেষে স্থাপন করে অমল প্রতিমার সামনে।