প্রত্যাশা একটি ভেক্টর রাশি, কেননা এর মান এবং দিক দুই-ই আছে। মান নির্ভর করে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যবোধের ব্যাকরণে আর তার ভিত্তিতেই দিকও দুমুখো—হয় তা প্রাপ্তির দিকে নয় প্রত্যাখ্যানের দিকে। আপাতত জনজীবনে প্রত্যাশাই মূল স্রোত, আমরা এখনও নিহিলিস্ট হয়ে যাইনি। প্রত্যাশাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে—তা ঈশ্বরের প্রতিই হোক কিংবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি। করোনার দাপটে বিশ্বচরাচর যখন এক ‘নতুন স্বাভাবিকতা’র দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে, তখন বাতাসে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কমার ইঙ্গিত যেন সবুজ সভ্যতার ‘বেবি ওয়াকার’ (Baby Walker)। এমনিতেই বহু বছর ধরে পরিবেশবিজ্ঞানীরা বিশ্ব-উষ্ণায়ণ, জলবায়ু-পরিবর্তন এবং গ্রিন-হাউস গ্যাস ইত্যাদি বিষয়ে শুধু সতর্ক করাই নয়, আন্দোলন ও দাবিদাওয়া নিয়ে হাল না ছেড়ে, সজোরে কণ্ঠ মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন বিশ্বনাগরিকদের সঙ্গে। এখন করোনা ভাইরাসের নয়া সংস্করণের প্রতি রাষ্ট্রনায়ক বা নায়িকাদের কিছুকালব্যাপী কিঞ্চিৎ সম্মান প্রদর্শনে পরিবহণ, কারখানাজাত উৎপাদন বন্ধ থাকায় জীবাশ্মঘটিত কার্বন-ডাইঅক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ নাকি কমছে। এই দাবি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণায় প্রতিভাত। চিনের উহান দেশ থেকে প্রথম ফ্লু-তে আক্রান্ত্রের খবর আসার দিন থেকে অতিমারি ঘোষণার দিন অবধি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি অঞ্চলে থাবা বসিয়েছিল করোনা ভাইরাস। এরপরে ভারতেও আক্রান্ত্রের খবর পাওয়া যায়। ফলে বিশ্বশৃঙ্খল অপরিবর্তিত রেখেই প্রথমে আন্তর্জাতিক, তারপরে প্রাদেশিক এবং শেষে জাতীয় স্তরে লকডাউন ঘোষিত হয় অমোঘ কণ্ঠে।
এই নিবন্ধের বিষয় যখন ভেবেছিলাম, তখন পাক্কা দু-মাসের লকডাউন পূর্ণ হয়েছিল। এখন পরিবেশপ্রেমী থেকে কিশোর টিকটকার, সকলেই লকডাউনজনিত কারণে জনব্যবহারে শক্তির সীমাবদ্ধতার জন্য CO2 নির্গমন হ্রাসের প্রত্যাশী। কেউ কেউ সবুজ পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেয়ে উঠছেন, “বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই”। কিন্তু বঞ্চিত করে বাঁচানোর কথা তো বিজ্ঞান বলছেই না, বরং উলটো সুর—এ যে প্রাপ্তির জয়গান। ১৭% নির্গমন কমেছে, লাবডুব অক্সিজেনময়। বিজ্ঞানীরা কনফাইনমেন্ট ইনডেক্স বা সীমাবদ্ধতা সূচকের (যাকে ০ থেকে ৩-এর স্কেলে সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং এমন কিছু ডিগ্রি বরাদ্দ করা হয় যেখানে সাধারণ দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের অংশ সমস্ত জনসংখ্যার জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। স্কেল ০ ইঙ্গিত করে যে, কোনো পদক্ষেপ ছিল না, স্কেল ১ সংক্রমণের বহনকারী ব্যক্তিদের ছোটো ছোটো দলগুলিকে লক্ষ করে নীতিগুলি ইঙ্গিত করে, স্কেল ২ সমগ্র নগর বা অঞ্চলগুলিতে লক্ষ্যপূর্ণ নীতিগুলিকে নির্দেশ করে যা সমাজের প্রায় ৫০%কে প্রভাবিত করে এবং স্কেল ৩ জাতীয় নীতিগুলিকে নির্দেশ করে যা উল্লেখযোগ্যভাবে মূল কর্মী ব্যতীত সকলের প্রতিদিনের রুটিন সীমাবদ্ধ) সাহায্যে বিভিন্ন দেশের নিয়মানুবর্তিকাকে বিচার করার চেষ্টা করেছেন, যার ফলস্বরূপ CO2–র পরিমাণগত প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। মূলত শক্তি, শিল্প, পৃষ্ঠতল পরিবহন, পাবলিক বিল্ডিং এবং বাণিজ্য, আবাসিক ও বিমানব্যবস্থা, যা বিশ্ব-জীবাশ্মঘটিত CO2 নির্গমনে ৪৪.৩%, ২২.৪%, ২০.৬%, ৪.২%, ৫.৬% এবং ২.৮% অংশদারিত্ব রাখে, তাদের পরিবর্তনের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী এই কার্বন-ডাইঅক্সাইডের অবনমনকে বিচার করা হয়েছে। এখন পৃথিবীর জলবায়ু ফিরে গেছে ২০০৬ সালের অবস্থায়। স্প্যানিশ ফ্লু, গ্রেট ডিপ্রেসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় তৈল অভিঘাত, সোভিয়েত পতন এবং ২০০৮-২০০৯-এর গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসের সময়েই যা এই ঊর্ধ্বগমনকে সামান্য ব্যাহত করেছিল, সেখানে বর্তমানের অবস্থা অপ্রত্যাশিত চন্দ্রলাভ বলা যায়। দেখা গেছে, বিমানব্যবস্থায় ৭৫% হ্রাস যা সর্বাধিক, পৃষ্ঠতল পরিবহনের দরুন ৫০%, শিল্প ও পাবলিক সেক্টরে ৩৫ % ও ৩৩ %, শক্তিক্ষেত্রে ১৫% এবং আবাসিক ক্ষেত্রে ৫% হ্রাস বেশ আনন্দদায়ক।
তবে, অতীতের বিচারেই বলা যায়, অর্থনৈতিক চাহিদা বৃদ্ধির চেষ্টায় শক্তি, রাষ্ট্রের কার্যকলাপ এবং নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ২০১০ সালে ৫.১% নির্গমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেটা দীর্ঘমেয়াদি গড়ের থেকেও বেশ উপরে ছিল। নির্গমন শীঘ্রই আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছিল। এখন যদি একটি সংবেদনশীল অবস্থার ধারণা প্রস্তুত করা যায়, তাহলে যেটা দেখা যাচ্ছে যে, নিম্ন সংবেদন স্তরের (অর্থাৎ, লকডাউন পরবর্তী সময়ে যদি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে সময় নেয় ছয়-সপ্তাহ) জন্য চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে এবং ভারতে এই হ্রাসমানতার অন্তরাল থাকবে ২.৬%, ৬.৭%, ৫.১%, ও ৫.২% এবং উচ্চ সংবেদন স্তরে (অর্থাৎ, লকডাউন পরবর্তী সময়ে যদি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে সময় নেয় বারো-সপ্তাহ এবং কিছু কিছু স্থানে পরীক্ষামূলক লকডাউন বা সীমাবদ্ধতা বজায় রাখা হয়) এটাই হবে যথাক্রমে ৫.৬%, ১১%, ৮.৫%, ও ৮.৭%। এই অনুমান আইএমএফ ও ইআইএ-এর ভবিষ্যতবাণীর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যেখানে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, জাপান CO2 নির্গমনে সর্বাধিক অবদান রাখে, সেখানে তারা সাইক্লিং এবং হাঁটার ও বিদ্যুতিন পরিবহনে—যেখানে নির্গমনের পরিমাণ প্রায় শূন্য—জোর দিচ্ছে। ফলে সবুজ পৃথিবীর স্বপ্নকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখানোর জন্য প্রয়োজন ‘গ্রেট লকডাউন’ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রনায়ক বা নায়িকাদের সচেতন ও জোরালো পদক্ষেপ।
কিন্তু ট্রাম্প সাহেব ট্যুইটে জানিয়েছেন, “আমরা কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস শিল্পকে হতাশ হতে দেব না। আমি জ্বালানি সেক্রেটারি এবং ট্রেজারি সেক্রেটারিকে একটি পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি যা তহবিল সরবরাহ করবে যাতে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলি এবং চাকরিগুলি ভবিষ্যতে দীর্ঘকালীন সুরক্ষা পায়”। অন্যদিকে কার্বন নির্গমনের পথ সুগম করতে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষেও সওয়াল করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, কেননা তিনি মানেন না যে জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা থাকতে পারে। ইপসোস মোরির (Ipsos MORI) একটি জনমত সমীক্ষায়, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে (পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও) ভারতীয়রা সর্বাধিক আগ্রহ প্রকাশ করেছে ৬৩%, যেখানে মার্কিন মুলুকের অধিবাসীদের ৪৭% ও চিনের মানুষজনের ৩৮% আগ্রহ দেখা গেছে। সবুজ অর্থনীতির পক্ষেও আবার ভারতের রায় সর্বাধিক ৮১%, যেখানে চিনে ৮০% ও সর্বনিম্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৭%। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনকে কোভিডের সমান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিতে সর্বাধিক আগ্রহী চিন দেশের নাগরিকরা ৮৭%, ভারতের ৮১% ও সর্বনিম্ন মার্কিনিরা ৫৯%। মার্কিন মুলুকের অবস্থান ট্রাম্পের কথারই প্রতিফলন যেন।
তবে, জাতিসংঘ ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ স্লোগানে বিশ্বজুড়ে অতিমারি-উত্তর দুনিয়া পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে, আরও বেশি টেকসই, স্থিতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করার এই সুযোগটিকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছে। আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “বর্তমান সংকট একটি নজিরবিহীন জেগে ওঠার ডাক। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য, সঠিকভাবে কাজ করার জন্য আমাদের করোনা-উত্তর পুনরুদ্ধারকে সত্যিকারের সুযোগে পরিণত করা দরকার।” তিনি ছয়দফা প্রস্তাব অবধি পেশ করেছেন। এক, করোনা ভাইরাস থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে তা যেন অবশ্যই একটি পরিষ্কার, সবুজ দুনিয়াতে রূপান্তরিত হবার মাধ্যমেই নতুন কাজের এবং ব্যাবসার সংস্থান হয়। দুই, যেখানে করদাতাদের অর্থ ব্যাবসা বাঁচাতে ব্যবহৃত হয়, সেখানে অবশ্যই সবুজ কাজ এবং টেকসই বৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে আবদ্ধ থাকতে হবে। তিন, ফিসকাল ফায়ারপাওয়ারকে ধূসর থেকে সবুজ অর্থনীতিতে স্থানান্তর করতে হবে। চার, জনগণের তহবিল ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগে ব্যবহার করা উচিত, অতীতের জন্য নয় এবং অবশ্যই টেকসই খাতে এবং সেই প্রকল্পগুলিতে যা পরিবেশ এবং জলবায়ুকে সহায়তা করে। জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি অবশ্যই শেষ করতে হবে এবং দূষণকারীদের অবশ্যই তাদের দূষণের জন্য জরিমানা অর্থ দিতে শুরু করতে হবে। পাঁচ, জলবায়ু ঝুঁকি এবং সুযোগগুলিকে আর্থিক ব্যবস্থার পাশাপাশি জননীতি নির্ধারণ এবং কাঠামোগত দিকে সংহত করতে হবে। ছয়, সকলকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে একসঙ্গে কাজ করানো দরকার।
মনে রাখা দরকার, কোভিড কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এগুলো কিন্তু আসলে দুনিয়াব্যাপী বাজার-অর্থনীতির পন্থায় পালটে যাওয়া জলবায়ুর ফলাফল। অর্থাৎ, রোগের সিম্পটম্স্ মাত্র। লকডাউন হোক, অতিমারির কারণের বিরুদ্ধে, সিম্পটম্স্ বা ফলাফলের বিরুদ্ধে নয়। পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্বরক্ষার জন্য মানবজাতিকেই আবার ভাবা প্রাকটিস করতে হবে। সুতরাং, তিনমাসের থমকে থাকা সভ্যতার গতির মধ্যে যখন দীর্ঘ প্রত্যাশিত প্রাপ্তির ভাঁড়ার পূর্ণ হতে শুরু করেছে, তখন ক্ষমতাবানদের সঙ্গে এঁটে ওঠার লড়াইয়ে কে বিজয়ী হয় সেটাই দেখার—সবুজ-নীল বাসযোগ্য পৃথিবী নাকি তমসাচ্ছন্ন বাজার-অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত দুনিয়াদারি।