এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • আগস্ট -গণতন্ত্রের জন্মসুখ নাকি দুটি ঐহিক সমাধির স্মৃতি ? (পর্ব ১)

    অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৬১৬ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
    উত্তর-আধুনিক গণতন্ত্র এবং আমি, তুমি ও সে

    “Political democracy cannot last unless there lies at the base of it social democracy. What does democracy mean? It means a way of life which recognizes liberty, equality and fraternity which are not to be treated as separate items in a trinity. They form a union of trinity in the sense that to divorce one from the other is to defeat the very purpose of democracy. Liberty cannot be divorced from equality, equality cannot be divorced from liberty. Nor can liberty and equality be divorced from fraternity.”
    -Dr. B.R. Ambedkar

    ঘড়িতে তখন ৫ টা বেজে ১৭ মিনিট, স্থান বিড়লা হাউস । ‘আজ আপনার বড্ড দেরি হল যে’ । উত্তরে গান্ধীজী বললেন, ‘হ্যাঁ’ । তারপরে সশব্দ তিনটি গুলি চলল, বিদীর্ণ হৃদপিন্ড থেকে চলকে উঠল রক্তধারা । মিনিট চল্লিশের অপেক্ষা, ব্যস । ৩০ শে জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল । পরাধীন ভারতের বিদেশি জাতি নয়, স্বাধীন ভারতের এক স্বাধীন নাগরিক হত্যা করেছিল তাঁকে। ঘটনাটা ঘটেছিল স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পাঁচ-মাসের মাথায় । সেদিন তাঁর মৃত্যুশয্যার আবহে “বৈষ্ণব জন তো, তেনে কাহিয়ে জে/ পিড় পারায়ে জানে রে/ পর দুঃখে উপকার তোয়ে/ মন অভিমন না আন রে” গুঞ্জরিত হয়েছিল কিনা জানা নেই । তবে সাম্প্রতিককালে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলির এক্সিকিউটিভ এডিটর অনিকেত আলম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা লিখেছেন । তিনি বলছেন, “when we say that Hindutvawadis attack Gandhi and despise Gandhi, we should not forget that he was intensely disliked by many others and some of these traditions continue in India today. They were not complicit in his murder but they would be equally happy to destroy his historical reputation and his political legacy” ।

    বহু মানুষের এই ঘৃণার অধিকার ও উত্তরাধিকারকে গণতন্ত্র কী চোখে দেখে সেটা বলা যায় না । তবে ঐতিহাসিক সত্যতার খাতিরে একে অস্বীকার করা সহজ নয় । একথাও মেনে নিতে হবে যে, গান্ধীজীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না । তাঁর ছিল একজন সৎ-নির্ভীক হিন্দু সন্তের মনোভাব । এবং তাঁর হিন্দুত্ব ছিল ‘অহিংসা’রূপে প্রতিভাত। বোঝা যায় তাঁর গীতা আগলে রাখা দেখে । গীতাতেই ‘অহিংসা’র কথা বলা হয়েছে ব্যক্তিগত আচরণের দৃষ্টান্তে, রাজনৈতিকভাবে নয় । ফলে, রাষ্ট্রগত ভালোমন্দ কিংবা পরিচালনার ব্যাপারে কূটনীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত । তিনি শুধু রিপুজয়ী ও অহিংস মানুষগঠনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন । এ কারণে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন গণতন্ত্রের বিভিন্ন মতামতের সঙ্গে তাঁর আদর্শের ঠোকাঠুকি লাগা ছিল স্বাভাবিক ।

    পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের ভিত-প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অগণতান্ত্রিকতার মন্ত্রে । স্বাধীনতার শর্তে দেশভাগের ঘোষণা ছিল জনমতের বিপরীতে গৃহীত একটি ব্যক্তিগত অহং পরিতৃপ্তকারী সিদ্ধান্ত। তাই নিরীহ মানুষের রক্তগঙ্গার বিনিময়ে এসেছিল র‍্যাডক্লিফ-লাইন। একদিকে হিন্দু-শিখ-মুসলমানের লাশের পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সেদিন উত্তোলিত হয়েছিল ত্রিরঙা পতাকা, বর্ষিত হয়েছিল রক্তমাখা ফুল। ‘মহাত্মা গান্ধী কি জয়’ চিৎকারে ধ্বনিত হয়েছিল আকাশ-বাতাস । অন্যদিকে, গান্ধীজী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর একটি প্রস্তাবের উত্তরে বলেছিলেন, “চতুর্দিকে লোকে না খেতে পেয়ে মরছে । এই ভয়াবহ দুর্দশার মাঝখানে আপনি উৎসবের আয়োজন করতে চান?” সুতরাং, ঠোকাঠুকি লেগেছিলই শুরুতেই । আসলে, যে কোনও অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা গণতন্ত্রমতে চলতে পারে না ।

    সেজন্য তিনি, কড়া হাতে দাঙ্গা দমনের ব্যাপারে রাজনেতাদের দৈনিক-আশ্বাসে আর আস্থা অর্পন না করে, অনড় অনশনে বসেছিলেন । হিন্দু-মুসলমান বিরোধ মেটানোর সংকল্প হিসেবে বলেছিলেন, “My first condition is that all Muslims who have been compelled to leave Delhi because of these attacks by Hindus and Sikhs would be invited to come back and they must be resettled in their own homes” । স্বয়ং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই দাবি সম্বন্ধে লিখেছেন, “This was a fine and noble gesture, but I knew it was not a practical proposition” । আর সর্দার পটেল বলেছিলেন, “Gandhiji is not prepared to listen to me. He seems determined to blacken the names of the Hindus before the whole world. If this is his attitude, I have no use for him” । এবং এভাবেই গান্ধীজী কংগ্রেস অভ্যন্তরস্থ দ্বন্দ্বটিকে উন্মুক্ত করেছিলেন কংগ্রেসের বাইরের দলেও, সাধারণ্যেও । সৃষ্টি হয়েছিল, ‘আমি’, ‘তুমি’ ও ‘সে’ ।

    সুতরাং, গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের ব্যাপারে ধর্মকে টেনে এনে তিনটি গুলির জবাব যেমন সেদিন অপরাধ হয়েছিল, তেমনই যদি, ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্রকে অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে শুদ্ধ করার গান্ধীয়-প্রথাকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা হয়, তবে সেটাও কি অন্যায় হবে না ? গান্ধীজীর মৃত্যু দেশবাসীর চোখে অঝোরধারা নিয়ে আসে, আসবেই । কিন্তু যে সব অযুত-সহস্র মানুষ আপনজনের ছিন্ন-বিছিন্ন মৃতদেহের রক্তধৌত ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখছিল রোজ এবং প্রতিক্রিয়ায় গান্ধীজীর অনশনভঙ্গের ধর্মভিত্তিক ছ’টি শর্তের উচ্চারণ শুনছিল, তাঁরা কি সেই বন্দুকধারীর অন্তিম বক্তব্য শুনে দু-ফোঁটা অশ্রুপাতও করতে পারে না, করলে কি তা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঘাত করে ? তাহলে পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু মদনলালের ২০শে জানুয়ারি বোমা ছুঁড়ে গান্ধীহত্যার ব্যর্থ চেষ্টাকে কী বলা যায়, কিংবা বিড়লা হাউসের সামনে উদ্বাস্তুদের ‘গান্ধী মরুক’ স্লোগান ? এসবের বিচার ঐতিহাসিকরা করবেন নিশ্চয় । আমরা শুধু ভেবে দেখব, গণতন্ত্রের অধিকারের বিষয়টা । যেটা আজও গান্ধী বনাম গডসে দুই মতাদর্শের ইতিহাসকেই জনসমক্ষে বিচারের জন্য ফেলে রাখার কথা বলে। অধিকার দিতে চায় ‘গান্ধীহত্যা’র বিচারের ফাইল সংক্রান্ত আরটিআই রুজু করার । এখন, গডসের প্রচার করতে গিয়ে গান্ধীবাদকে কালিমালিপ্ত করাও যেমন অগণতান্ত্রিক, তেমনই গান্ধীবাদকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠা করে গডসের লেখাপত্র সন্ধানকারীকে হিন্দু-মিলিট্যান্ট বলে দাগিয়ে দেওয়াও এর ব্যতিক্রম নয় । ফলে দুয়ের অধিকারই যাতে কোনমতেই লঙ্ঘিত না হয় সেটা দেখাই হোক ৭8’তম আগস্টের অঙ্গীকার । আমার মতামতের চরম বিরোধী হলেও, যদি কেউ তোমার কন্ঠরোধ করে, তবে ‘সে’জনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীব্র প্রতিবাদ বেরোবে আমার তরফ থেকে – এটাই হোক গণতন্ত্রের শেষ কথা ।

    আসলে, গণতন্ত্র হল ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’-এর মত গভীর আত্মোপলব্ধির অভিধা । গণতন্ত্র শুধু ভোটাধিকার নয় । কিংবা, একটি সরকার ভালো না মন্দ তার নির্ণায়ক হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দ্রব্যমূল্যের উত্থান-পতনের তালিকাও নয় । এই মনোভাবে আবদ্ধ হলে একটি ত্রুটি দেখা দেয় । আর তা, আমলাতন্ত্র ও ঠিকেদার সর্বস্ব আরেকটি গণতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং শেষে ‘গণ’কেই আলাদা করে দেয় সামগ্রিক ব্যবস্থা থেকে । তাই বহুধাবিস্তৃত গণতন্ত্রের বিবিধ পরিসরে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের একটা গুরুত্ব আছে । এর সর্বব্যাপী উন্মেষই দেশের গণতন্ত্র রক্ষার দায়-দায়িত্ব নির্ধারিত হয় ।
    ভারতবর্ষ পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ধাঁচে নির্মিত হলেও, তার মানসিক ভিত্তি হল সনাতনী। ফলত, ভারতীয় গণতন্ত্রের অভ্যন্তরে রয়ে গেছে একটি সহজাত বিবাদ । দৈহিক সারাংসারের সঙ্গে বিরূপ মননতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। গনেশ দেবতার স্মরণে বলা যায়, মানব প্রাকারে হস্তিমুখের সাযুজ্যই যেন আমাদের গণতন্ত্র । স্বাধীনতার পরে বিশ্ব-অর্থনীতির ঘূর্ণাবর্তে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার মানসিক প্রভাব কেটে ওঠার আগেই ভারতের মননে আছড়ে পড়েছিল মার্কিন-জীবনরীতি । ফলে দ্বন্দ্ব আরও জটীলরূপে আবর্তিত হয়েছিল, হচ্ছেও । ব্যক্তিস্বাতন্ত্রও যেমন নিজেকে অহরহ পালটে ফেলছে, তেমনই সংখ্যাগরিষ্ঠতার সহায়তায় গণতন্ত্রের সঙ্গে নিজের ধ্রুপদী সম্পর্ককেও বদলে দিতে চাইছে রাষ্ট্র। বহু যাচিত ব্যবস্থার পরে, গণতন্ত্র বলে যাকে দুনিয়াব্যাপী মান্যতা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যেও যে অজস্র গলদ রয়ে গেছে সেকথা মিথ্যে নয় । তাই পরিবর্তনই কাম্য । কিন্তু তার অভিমুখকে উপেক্ষা করা যায় না । যেহেতু এই মুহূর্তেই আমাদের কাছে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের কোনও ধারণা নেই, তাই অনন্যোপায় আমরা একেই স্বীকৃতি দিয়েছি । কিন্তু অবশ্যই এর দোষত্রুটিগুলি নিয়ে প্রশ্ন-সংপ্রশ্ন-আন্দোলন থাকতে হবে । তবেই আমরা উন্নততর গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ খুঁজে পাব । অন্যথায়, উন্নততর গণতন্ত্রে যাবার পরিবর্তে পিছিয়ে গিয়ে এমন এক ব্যবস্থায় পৌঁছব যে তা হবে চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক । এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয় । সুতরাং, যুগধর্মগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের সঙ্গে আজ গণতন্ত্রকেও পাল্লা দিতে হবে, প্রায় সমানে সমানে ।

    প্রকৃতপ্রস্তাবে, প্রত্যেকটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের অন্তিম অক্ষরগুলির সাবলীল প্রকাশে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সার্বিক চেতনা লুক্কায়িত থাকে। এখানে একপক্ষের প্রচেষ্টাহীনতা কিংবা অন্যপক্ষের মহৎ সদিচ্ছা, ব্যাপারটাকে এই দ্বিমূলে দেখা বেঠিক । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রের আঙিনায় সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে মাত্র । কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন মানেই তো গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ অজস্র মতামতের বিলুপ্তি ঘটা নয় । বরং বিদ্যমানতার দ্যোতনাতেই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব । এখানেই আছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের মূল দ্বন্দ্ব বনাম রাষ্ট্রনীতি । ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে প্রথাবাদী রক্ষনশীল মনোভঙ্গি ও যুক্তিবাদী প্রগতিশীলতার দ্বন্দ্বে একটি প্রজন্মভিত্তিক সহজাত ও অন্যটি চর্চার দ্বারা অর্জিত । ফলে অনায়াস অগ্রগণ্যতায় রক্ষণশীলতা প্রচার পায় । আর সংখ্যার বিচারেও প্রায় কোনরকমের ঝঞ্ঝাট তাকে পোয়াতে হয় না । গণতন্ত্রে এইখানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলের থেকে রাষ্ট্র-শাসককে আলাদা হয়ে যেতে হয় । যদি সেটা না হয় এবং দিব্যু একপেশে কিছু মতামতকে আইনের মাধ্যমে বলবৎ করতে শুরু করে রাষ্ট্র, তবে সে আদতে আঘাত করে অন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধগুলিকে ও শেষে গণতন্ত্রকে । হাস্যকর ব্যাপারটা হল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ থেকে রাষ্ট্রশাসকে উত্তরণের এই কাঠামোটি প্রাথমিকস্তরে প্রগতিবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও, পরবর্তীকালে তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সর্বাধিক । যার চূড়ান্ত ফল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা অবিসম্বাদি কলহ – গায়ের জোর বনাম বৌদ্ধিকতা । যেন, বিসর্জন এসে প্রতিষ্ঠাকে অস্বীকার করেছে এবং নিরুত্তর প্রতিষ্ঠা হা-খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবল নিজেকেই ভাসিয়ে দিয়েছে তাই-ই নয়, কিছুক্ষেত্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সমস্ত সম্ভবনাকেও হরিহর আত্মার মত জড়িয়ে ধরেছে ।

    সেজন্য গণতন্ত্রের ধারণায় নৈতিকতাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে । যাতে রাষ্ট্রের তরফে স্বাধীনতা ও সুযোগের বন্টন হয় নিরপেক্ষভাবে । যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহংকারে একনায়কের মত করে আচরণ করতে না পারে । অর্থাৎ, গণতন্ত্রের বদলে যাতে প্রতিষ্ঠিত না হয় একটি আদল, যা বাইরে থেকে সর্বাত্মক কল্যাণকামী কিন্তু প্রায়োগিকস্তরে তা অন্তঃসারশূন্য। যাতে ক্ষমতাসীন থাকার অভিপ্রায় বিবেকবোধকে খেয়ে না ফেলে । কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র একাত্ম হয়েছে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে । তাল মিলিয়েছে বিরোধীরাও । আর এর শুরু হয়েছিল সেই প্রথম ১৫ই আগস্টে, একদিকে অগণতান্ত্রিক দেশভাগ অন্যদিকে গণনির্বাচন ব্যতিরেকে প্রধানমন্ত্রীত্বের পাঁচবছরের অধিকারপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে । আর এই প্রবহমান অবক্ষয়ে গণতন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে, মন্দের ভালোকে বাছাই করা । ‘আমি’ আর ‘তুমি’র মধ্যে থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের আরেকটি অংশ ‘সে’ কবেই হারিয়ে গেছে । ‘সে’ এখন সুবিধাবাদের ভিত্তিতে দলবদলে আস্থাশীল। অর্থাৎ, ‘সে’ও বিস্মৃত হয়েছে, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির ঊর্ধ্বে আছে সংবিধানের অধিকার । সেটা কিন্তু ভালোর মন্দকে প্রত্যাখান করার উপায় হিসেবে রচিত হয়েছিল । যাই হোক, আমাদের গণতন্ত্র একটি ত্রিস্তরীয় বৈরিতায় আটকে গেছে । এই চক্রব্যুহ থেকে একমাত্র রক্ষা করতে পারত, পারে ‘আমি’, ‘তুমি’ ও ‘সে’–এর অভ্যন্তরীণ কণ্ঠস্বর যাদের আমরা বিদগ্ধজন বলি । সমস্যা হল, এই কন্ঠস্বরও এখন বৈদগ্ধের সঙ্গে জীবিকাকে যুক্ত করে বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছে । ফলে তাকে বেছে নিতে হয়েছে হয় ‘আমি’ নয় ‘তুমি’কেই । সেখানে ‘সে’ বলে কেউ নেই । এ কারণেই আজ, প্রতিভাবানের আর কিংবদন্তি হবার আশা নেই ।

    দেখা গেল, গণতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের তিনটি রূপ বর্তমান – ক্ষমতাসীন আমি, ক্ষমতাপ্রত্যাশী তুমি এবং একটি মধ্যমপন্থী দোদুল্যমান সে । যুগধর্মের কারণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের তৃতীয়টি বহরে ক্রমবর্ধমান । আর সেখানে স্বীকৃত গণতন্ত্র পাল্লা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে রোজ । সুতরাং, বহুত্ববাদের মধ্যে সুস্থির ও সামঞ্জস্যরক্ষাকারী একটি নতুন পদ্ধতিতন্ত্রের প্রয়োজন । যেটা সমাজ-প্রগতি ও সামগ্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের দ্বন্দ্বকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে এবং দেশের সংহতি ও শান্তি বজায় রাখতে একটি মানদন্ড প্রতিষ্ঠা করবে । সেটাই হবে নয়া-গণতন্ত্র । উলফ তাঁর ‘Some Psychological Aspects of Industrial Reconstruction’ নামক আলোচনায় বলেছিলেন,
    “Democracy holds, (1) that every individual is an end in himself; (2) that no individual is to be regarded primarily as a means to a fulfillment of the purposes or desires of any other individual; (3) that no class or group of individuals is to be regarded primarily as a means to the interest of another class as end; (4) that opportunity, and, so far as opportunity is dependent upon them, material wealth and income, should be distributed to individuals in proportion to capacity and willingness to use them for the collective good; (5) that the collective good will be highest when opportunity, which at best is limited in quantity and quality, is distributed so that each individual is enabled to develop his potential powers and capacities in like proportion to the development of these potentialities in every other individual; (6) that the means to the utilization of individual happiness can be found only in the willing, fair-minded co-operative work of individuals and groups, all of whom accept and live up to the foregoing principles” ।

    গণতন্ত্র যে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি নয়, এর একটা ব্যক্তিতান্ত্রিক অস্তিত্ব আছে সেটা প্রথমে বুঝতে হবে । জনগণের শাসনের অর্থ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে একটা প্রধান মুশকিল হল, সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনই সত্যকে স্বীকার করে না, যেমন করেনি গ্যালিলিওর বেলায় তেমনই করেনি বিদ্যাসাগরের বেলাতেও । তাই, আপাতত একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের মধ্যেও যদি সত্য থাকে, তাকে অনুসন্ধান করে প্রকাশ করার পূর্ণ স্বাধীনতার নাম হোক উত্তর-আধুনিক গণতন্ত্র ।



    ( চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • আলোচনা | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৬১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন