“আদিম জীবন্ত বস্তুর জাদুস্পর্শেই প্রাণহীন পাথরখণ্ডের মাটিতে পরিবর্তিত হওয়ার শুরু। মৃত শ্যাওলার গুঁড়ো, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৃত পোকাদের খোসা, এইসব জমে পাথরচূর্ণ থেকে গড়ে উঠছিল এক নতুন পরমাশ্চর্য বস্তু –মৃত্তিকা।”
—জয়া মিত্র
একা একা রাতের আকাশের দিকে তাকালে ভারী কৌতূহল জাগে—ছুঁতে ইচ্ছে হয় আলোকবিন্দু। কিন্তু মাটির মধ্যেও যে অফুরান বিচ্ছুরণের বিস্ময় গুটিসুটি বসেছিল সেটা কে জানত? শীতের আগে আগে যখন ধানের শিষে জলের বিন্দু এসে জমে, চারদিক আবছা হয়ে থাকে, মুখ থেকে ফুঁ দিলে ধোঁয়া বের হয়—এবং তাকে স্পর্শ করতেই একবুক অনন্ত স্তব্ধতার মধ্যে অন্য জঙ্গমতা নড়েচড়ে ওঠে—তখন বোঝা যায় মাটি শুধু ভূতত্ত্বের গবেষণাপত্র নয়, মাটি এক সপ্রাণ অস্তিত্ব। উদ্ভিদ তার সাম্রাজ্যবাদী চেহারা নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়লে এ পৃথিবীতে প্রাণ বলে হয়তো কিছু থাকত না। সমূল-বৃক্ষ থেকে ক্ষুদ্রকায় তৃণ—সকলেই মাটিকে বেঁধে বেঁধে রেখেছে। আর সেজন্যই আজকের উন্নততর প্রাণী মানুষের রচিত সভ্যতার এত দম্ভ দেখা যাচ্ছে যা কিনা পক্ষান্তরে বৃক্ষনাশেই প্ররোচনা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যতগুলি আশঙ্কা নিয়ে লেখালেখি কথা বলাবলি হয়েছে, হচ্ছে, সেরকম খুবই কম হয়েছে মাটির বেলাতে। অথচ দুনিয়ার আবহাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষউচ্ছেদ মাটিকে যেভাবে স্বাধীনতা দিচ্ছে নদীধৌত ভেসে যাবার, সেখানে যে বহু প্রাণও ভেসে যাচ্ছে অকাতরে, এবং যাবেও, সে দিকটা অগ্রাহ্য করার মতো ত্রুটি যেন না থেকে যায় অন্তকরণের সচেতনতায়। তবে আজ মাটির বিবর্তন নিয়ে কিংবা তার অবক্ষয়জনিত আশঙ্কা নিয়ে লিখব না। পরিবেশ সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা যে রোজ ভয়াল হচ্ছে, সে কথা সবাই জানি। তার মধ্যেও কিন্তু রচিত হচ্ছে এক অপার আশ্চর্য, আজ শুধু মন ভালো করা সেই চমক নিয়ে কিছু কথা বলব।
১৯৮৭ সাল। বিজ্ঞানী ডেরেক লভলে পোটোম্যাক নদীর তীরে এসে সন্ধান পেয়েছিলেন সেই অদ্ভুত অধিষ্ঠানের। তারপরে ১৯৮৮ সালে কেনেথ নিয়েলসন পেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিদ্যমানতার সন্ধান। এগুলি আর কিছুই নয়—কাদামাটিতে মিশে থাকা দুটি ব্যাকটেরিয়া মাত্র। কিন্তু তাতেই অনাবিল অব্যয় নিথর করে দিয়েছিল হৃদকম্পন। মানুষের জীবনের সবচেয়ে আদিম প্রশ্নটি হল, প্রাণ কী? উত্তরে সেদিন যেন অতলস্পর্শী ছুঁয়ে দিয়ে গেছিল অপলকে। আপাতত যে উত্তর জানা ছিল, তা হল, শরীরে অক্সিজেনের আসা-যাওয়ার ফলে কোশ থেকে কোশান্তরে নানা বিক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ইলেকট্রন কণিকা। সারা শরীরে সেগুলি একটা সার্কিটের মতো পাক খেতে থাকে। ঠিক যে সময়ে অক্সিজেনের জোগান বন্ধ হয়ে যায়, ইলেকট্রনের সার্কিট বা চক্রটি ভেঙে যায়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জীবন। অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে অক্সিজেন থেকে সংগৃহীত ইলেকট্রনের চক্রাকার প্রবাহই হল প্রাণ। মানুষ সাধারণত ইলেকট্রনগুলি শর্করা জাতীয় খাবার, জল থেকে সংগ্রহ করে। অন্যান্য প্রাণীও (মূলত বহুকোশী) এইভাবেই তা করে থাকে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড়ো সরবরাহ আসে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে। এই হল মোটের ওপরে পৃথিবীর জীবনের (প্রধানত বহুকোশী জীবের ক্ষেত্রে) বীক্ষা—অক্সিজেন। কিন্তু এককোশী জীবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকমেরও হয়, সেগুলিকে অ্যানেরোবস (অর্থাৎ, যেখানে অক্সিজেন নেই সেখানেও এরা দিব্য বেঁচে থাকে) বলা হয়, লিউয়েনহক প্রথম এই ধরনের ঘটনা লক্ষ করেছিলেন। লভলেও সেদিন এরকমই আর-একটার সন্ধান পেয়েছিলেন। একে যেন এলিয়েনের মতোই মনে হয় আমাদের। এও একটি জীবন যা অক্সিজেনের ওপরে নির্ভরশীল নয়, থাকে এই নীলগ্রহেই, শুধু সাধারণ্যের মানসচক্ষুর অন্তরালে। এরা ঠিক যেন মঙ্গল কিংবা বৃহস্পতি থেকে ধরণিপৃষ্ঠে নেমে আসা এক জীব, অন্তত সাধারণ মানুষের কাছে। লভলে এটাকে পেয়েছিলেন পোটোম্যাক নদী উপকূলে। নোংরা, আবর্জনা, বর্জ্যপদার্থ, তৈলকণিকা থেকে জীবনের রসদ সংগ্রহ করে থাকে এই ব্যাকটেরিয়াগুলি। এরা অক্সিজেন নেয় না তা নয়, যেখানে অক্সিজেন আছে সেখানে তাই-ই নেয় কিন্তু যেখানে নেই সেখানে এরা ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড বা লোহার অক্সাইড থেকে ইলেকট্রন সংগ্রহ করে এবং জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। অর্থাৎ, অক্সিজেন এদের কাছে ইলেকট্রনের মূল উৎস নয়। এদের একটির নাম হল জিওব্যাক্টার আর অন্যটি হল শিউয়ানেলা।
বিস্ময়ের কথাখানি কিন্তু এটা নয়। কথাটা হল এরা বিদ্যুৎ তরঙ্গ উৎপাদন ও নির্গমণ করতে পারে। ঠিক যেন পাওয়ার গ্রিড। মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে দেখা গেছে যে, প্রোটিন-নির্মিত চুলের মতো এক প্রকারের বিস্তার এদের আছে, মোটা কথায় বললে ভূমিকাটা তামার তারের মতোই। ব্যাকটেরিয়াগুলি পরস্পর সেই সুতোর মতো অংশগুলির মাধ্যমে নিজেদের সংযুক্ত করতে থাকে এবং প্রস্তুত করে ঠিক যেন এক অপূর্ব কন্ডাকটর। আর এটাই ইলেকট্রনের চলমানতায় বিদ্যুতের সুপরিবাহী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এমনকি স্থূলভাবে বললে বলা যায়, এরা ইলেকট্রন খেয়েই বেঁচে থাকে এবং ইলেকট্রন নিষ্কাশন করে। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জানা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞানী রোয়ে এরকম আরও ছয়টি মাইক্রোবসের সন্ধান পেয়েছিলেন, সেগুলি হ্যালোমোনাস, ইডিওমারিনা, মেরিনোব্যাক্টর, সিউডোমোনাস, থ্যালাসোসপিরা এবং থিয়োক্লাভা ইত্যাদি গোষ্ঠীভুক্ত ও গামাপ্রটেও ব্যাকটেরিয়া, আলফাপ্রোটেও ব্যাকটেরিয়া শ্রেণিভুক্ত। সমুদ্রের ধারের মাটিতে যদি কেউ ইলেকট্রোড দণ্ড প্রবেশ করায় এবং ইলেকট্রন নিষ্ক্রমণ ঘটায়, তবে দেখা যায় যে সেই ইলেকট্রোডটি এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আবৃত হয়েছে। লভলে বলেছেন, “One of the most interesting developments in the area of microbes eating and breathing electrons is the concept of direct interspecies electron transfer. This is when microorganisms wire themselves together to share electrons, permitting them to carry out reactions that neither would be able to carry out individually”। এমন অত্যাশ্চর্য পরমাদে কোন্ প্রাকৃতজন মুগ্ধ নয়নে স্থবির হবে না? যদিও বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাপারটা বহুদিন থেকেই পরিচিত। আসলে কোশের উৎসসন্ধানে গেলে বহু অনুমানের কথা শোনা যায়। তবে সাধারণত লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টারের কথাই ধরা হয়ে থাকে। এই ধারাতে কোশের বিভক্তিকরণে মূলত তিনটি ক্ষেত্র দেখা যায়—আরকেয়া, ব্যাকটেরিয়া ও ইউকেরিয়া। এই আরকেয়া মূলত মিথেন থেকে ইলেকট্রন সংগ্রহ করে থাকে। জানা যায় যে, এরা জারণের মাধ্যমে কার্বোনেট উৎপন্ন করে এবং তারপরে ন্যানোওয়্যারের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রন এগিয়ে দেয় ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে। সর্বশেষে ব্যাকটেরিয়াগুলি সালফেটের মধ্যে ইলেকট্রনগুলি সঞ্চিত করার কাজটা সম্পূর্ণ করে কোশের ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদন করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন এই প্রক্রিয়াতে কার্যরত ন্যানোওয়ারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনের কোডগুলিকেও শনাক্ত করে ফেলেছেন। এই ঘটনাকে মাটির মধ্যে বিস্তৃত তারের অন্তর্জাল বলা যায়। এক একটি ব্যাকটেরিয়ার দৈর্ঘ্য ৩ বা ৪ মাইক্রোমিটার হয় এবং এরা নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত হয়ে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত তারের জাল বিস্তার করে বিদ্যুৎ পরিবহণের কাজ করতে সক্ষম। মাটির ভেতরে এই অস্তিত্ব, সম্ভ্রম জাগায় বইকি। নিয়েলসন বলেছেন, “Life’s clever. It figures out how to suck electrons out of everything we eat and keep them under control”।
Geobacter – a current favourite (Source: https://www.newscientist.com/)
মাটির মধ্যে সঙ্গোপনে থাকা এই নিভৃত অন্তপুরলোকে যে অসীম আশ্চর্যের কথা বলেছিলাম, তার সবচেয়ে হতবাক করে দেওয়া সম্পদ হল, এই বিদ্যুত-প্রবাহী মৃত্তিকা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিবেশের সহায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফসিল ফুয়েলের বদলে এই মাটিই এখন উৎপাদন করছে বিদ্যুৎ যা আমাদের মোবাইল অবধি চার্জ করতে সক্ষম হচ্ছে, যদিও এর মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয়নি যে এখুনি তা সামগ্রিক দাবি মেটাতে সক্ষম হবে, তবুও ভবিষ্যতে এর প্রত্যাশা করাই যায়। একইভাবে তাই দূষণ রোধ করে অন্যান্য নানা সমস্যাকেও প্রতিহত করতে পারে এই ব্যাকটেরিয়া। বিজ্ঞানীরা এই মাটির নাম দিয়েছেন, ‘Electric Mud’। বছর এগারো আগে বিজ্ঞানী পিটার নিয়েলসন আরহুস হার্বার থেকে এই বৈদ্যুতিন মৃত্তিকা সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “Now that we have found out that evolution has managed to make electrical wires, it would be a shame if we didn't use them”।
Electric Mud (Photo: Tobias Rademacher/Unsplash)
এবং বর্তমানে অন্তরিত ন্যানোওয়্যার ও কেবলের মাধ্যমে মোবাইল এবং অন্যান্য সামগ্রীগুলিকে চার্জ দেওয়ার পদ্ধতির আবিষ্কার শুরু হয়ে গেছে। মাইক্রোস্কোপে যেমন একটি ফিল্মের মতো করে বিদ্যুতের সরবরাহ দেখা গেছিল, এটারই বৃহৎ সংস্করণ করার চেষ্টা হচ্ছে যা হয়ত সফলভাবে গ্রিড তৈরি করতে ব্যবহৃত হবে। নেচার পত্রিকা জানাচ্ছে যে এই ধরনের ফিল্মগুলি ডায়োড থেকে আলোকবিচ্ছুরণ ঘটাতে পারে এবং প্রায় ১৭টি স্মার্টফোনকে একসঙ্গে চার্জ দিতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞানী লাইংতি বলেছেন, এই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ‘renewable, green, and cheap energy’ প্রস্তুত করে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যেই এটা থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান, শিল্প, কৃষি ও পরিবেশ সবকিছুই উপকৃত হচ্ছে। সমুদ্রে জলে যে অপরিশোধিত তেল ও বর্জ্য মিশে গেছে, ব্যাকটেরিয়াগুলি সেগুলিকেও গিলে খেয়ে ফেলে সবকিছু পরিচ্ছন্ন করছে। ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক যেটি অর্থাৎ মিথেন, সেটির ছড়িয়ে পড়া আটকানো যাচ্ছে, অন্তত খুব কম হলেও। ফলে এভাবে বিশ্ব-উষ্ণায়নের পথে একটি পূর্ণচ্ছেদের পথ পরিষ্কার হতে পারে। আর এটাই সবচেয়ে আশার কথা।
চারিদিকে এখন করোনার আতঙ্ক। পরিবেশের প্রতিনিয়ত অবক্ষয় মানবজীবনকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে। এর জন্যে দায়ী মানুষই। অথচ সকলে এ বিষয়ে সচেতন হতে নারাজ, বলছে, “কই কিচ্ছু তো দেখা যাচ্ছে না”। মানুষ বুঝতে চাইছে না, পরিবেশ পরিবর্তনের কারণেই উদ্ভূত বন্যা, পঙ্গপাল, ভাইরাস, উষ্ণতাবৃদ্ধি সবকিছুই একদিন জীবনকে এ দুনিয়া থেকে নির্মূল করতে পারে। এ কথাও ঠিক যে মেরুবদল হচ্ছে পৃথিবীর। ফলে যা ছিল সবই উলটে পালটে যাবার সম্ভবনা প্রবল। মানুষের পপুলেশন যে প্রাচুর্যে পৌঁছেছে তাতে আপামর দুনিয়ার বদলে কতটা লড়াই করে নিজেকে বাঁচাতে পারবে তা নির্ভর করে সচেতনতার পরিমাপে। রাষ্ট্রনেতারা রোজই লঙ্ঘন করছেন পরিবেশের নিয়মনীতি। বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন, প্রকৃতির ক্ষমতাকে। সেখানে যদি এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের ফসিল ফুয়েলের রিপ্লেসমেন্ট হিসবে বহুল ব্যবহৃত হয়ে জীবনের সহায়ক হয় তবে তা অবশ্যই আনন্দের। মনে পড়ছে পাস্কালের একটি উক্তি, “Man is only a reed, the weakest in nature, but he is a thinking reed. There is no need for the whole universe to take up arms to crush him: a vapor, a drop of water is enough to kill him. But even if the universe were to crush him, man would still be nobler than his slayer, because he knows that he is dying and the advantage the universe has over him”।
সুতরাং, অতিথিদেবভব।
ভালো লাগলো লেখাটি,
জানতে পারলাম!