“বিভিন্ন শ্রেণি যাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ পরস্পর বিরোধী , তারাই হচ্ছে সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব ঃ এই দ্বন্দ্বরত শ্রেণিগুলি যাতে নিষ্ফল সংগ্রামে নিজেদের ও গোটা সমাজকেই ধ্বংস করে ফেলতে না পারে তার জন্যই এমন একটি শক্তির প্রয়োজন ঘটে যাকে আপাতদৃষ্টিতে সমাজের ঊর্ধ্বে বলে প্রতীয়মান হয় ; শ্রেণিসংঘাতকে প্রশমিত করে শৃঙ্খলার গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই যার প্রধান উদ্দেশ্য ... এই শক্তিই হল রাষ্ট্র”।
-ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস
শোনা যায়, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী পরিণাম দেখে বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । হিংসার পরিবর্তে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা, করুণা এবং শান্তির মনোভাবের । প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যায় ও সমতার স্তম্ভ এবং একটি ধর্মচক্র । স্বাধীন ভারতবর্ষ এই অশোক স্তম্ভটিকে রাষ্ট্রের শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে এবং চক্রটিকে প্রগতির স্মারক হিসেবে গ্রহণ করেছিল । নিচে লেখা হয়েছিল, ‘সত্যমেব জয়তে’ অর্থাৎ, সামগ্রিক রাষ্ট্রে যা কিছু সত্য, সেটারই উদযাপনে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা । এর জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সংসদ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যম । যেন রাষ্ট্রস্তম্ভের সিংহ, হাতি, ঘোড়া এবং ষাঁড় । এই চারটির একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার কথা । টি এন শেষনের মতে, “তা সে সংসদই প্রশাসনকে সংযত রাখুক বা বিচারব্যবস্থা সরকারি ক্ষমতার হাত থেকে সাধারণ নাগরিকের অধিকারকে রক্ষা করুক কিংবা সংবাদমাধ্যমসমূহ প্রকাশ্য আলোয় টেনে আনুক সংসদীয় ভ্রষ্টাচার ও অন্যায়গুলিকে”- যেভাবেই হোক এই চতুর্স্তম্ভকে নিজের দায়িত্বে নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা বজায় রাখতেই হবে । তবেই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভারসাম্য টিকে থাকবে ।
তাই প্রাথমিকভাবে বেশিরভাগ সময়ে সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়েই আলোচনা করা হয়ে থাকে । সেটার অন্তর্বলয়েই আছে গণতন্ত্রের মূল অনুরণন । মানুষের সহজাত মনোভাব হল সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী, ক্ষমতাকামী, দুর্নীতিপরায়ণতা, ও অনিরপেক্ষতা । আর এই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে যে সর্বকল্যাণকামী মানদন্ড প্রতিষ্ঠিত হবে বলে ধরা হয়, তা গঠনে সরকারই সর্বপ্রধান পুরোহিত । কেননা সরকারের অবস্থান ব্যক্তিনিষ্ঠ নয়, বস্তুনিষ্ঠ । যাতে করে গণতন্ত্র কেবলমাত্র সংসদীয় প্রাকারে সংকুচিত না থেকে একটি সংঘবদ্ধ জীবনের সাকাররূপে সামাজিক সম্পর্কগুলির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রাজ্ঞতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় । সর্বশেষে ভ্রাতৃত্ববোধের সংবেদনশীলতা উচ্চতম অবস্থানে পৌঁছে রক্ষা করে, “ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে” গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ।
প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিশ্রুতিকে আর রক্ষা করা যাচ্ছে না । “উত্তর-আধুনিক গণতন্ত্র এবং আমি, তুমি ও সে”- তে, প্রথাবাদী বনাম প্রগতিশীলতার দ্বন্দ্বের কথা বলেছিলাম । এখানে সেই সূত্রেই, প্রথাবাদের বিবিধ সরঞ্জামের কথা বলব যা সামাজিক উপকরণগুলিকে একাত্ম করে দমনমূলক অস্ত্র হিসেবে এখন আত্মপ্রকাশ করেছে । যেমন, ধর্মগত রক্ষণশীলতাকে ব্যবহার করে ধার্মিক মুখোশের আড়ালে দলভারি করার প্রবণতা ও ক্ষমতালাভের কার্যসিদ্ধি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । কেউ প্রকটরূপে করছে, কেউ প্রচ্ছন্নরূপে, করছে সবাই । এগুলো সাফল্যও পাচ্ছে চমৎকারভাবে । ফলে রাষ্ট্রচরিত্র যা হবার কথা তার বিপরীতে গিয়ে এগুলোকে অনুমোদনও করছে । তাতেই নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও সাহচর্যের গরমিলের আবর্তে পাক খেতে খেতে সাধারণতমের অন্তরে সঞ্চিত হচ্ছে হতাশা । অভিজাততন্ত্রের আদিম-বীজ শাসকশ্রেণী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায়িত অন্যান্য শ্রেণিগুলির মধ্যে হিংসাকাণ্ডকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে । এসব ফুলে ফেঁপে উঠেছে ক্রমাগত । অন্তে, গণতন্ত্র কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবের মাটিতে আর কিছু থাকছে না । এই অদ্ভুতদর্শন প্লেটোনিক গণতন্ত্র আবির্ভূত হয়েছে আজ । সেখান থেকে না যাওয়া যাচ্ছে সামনের দিকে, না পশ্চাতধাবমানতাকে গ্রহণ করা সম্ভবপর হচ্ছে – একে আমি বিভ্রান্তিমূলক গণতন্ত্র (Confused Democracy) বলে আখ্যায়িত করতে চাইব ।
এই স্থবিরতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল বলে কিংবা আর্বান নকশাল বলে । সেখানে জনসমর্থনের অভাবও হচ্ছে না, যেন মৌনং সম্মতিং লক্ষণম । এর কারণ ব্যক্তিগত সুবিধাবাদের প্রাচীরে আঘাতের সম্ভবনা না হলে, সকলেই উদাসীন এবং প্রতিক্রিয়াহীনভাবে থাকতেই পছন্দ করে । গোটা দুনিয়া চুলোয় গেলেও প্রায়শই কারও কোনও মাথাব্যথা দেখা যায় না । ভাবটা এমন যে, গণতন্ত্রের মত ব্যাপারখানা থাকলেও ভাল, আবার না থাকলেও ভাল - যতক্ষণ না সেই না থাকাটা আমার ব্যক্তিস্বার্থের প্রকট পরিপন্থীরূপে আত্মপ্রকাশ করছে । কিন্তু কেউ এই ব্যাপারটা বুঝতেই চাইছে না যে, সামগ্রিকতায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোন না কোন দিন তাকেও ছুঁয়ে ফেলবে এই অগণতান্ত্রিকতার আগ্রাসন । আজকের উদাসীনতার মূল্য সেদিন চোকাতে হবে, তাও বহুগুণ বেশি দামে । সরকার এই অবস্থায় জাতীয়তাবাদের অস্ত্র প্রয়োগ করেছে, যেন, ‘Patriotism is the last refuge of the scoundrel’ এবং একটা মগজধোলাইয়ের নিক্তি রক্ষিত হচ্ছে ।
এই ব্যবস্থায় যে কারও সুবিধা হচ্ছে না, সবই অসুবিধা - তা নয় । হচ্ছে, তবে তা মুষ্টিমেয়র । আর সেটাকেই ফলাও করে দেখানো হচ্ছে । সার্বিক বলে প্রচার চালানো হচ্ছে । এসব কারও অজানা নয়, মানুষ এত বোকা নয় । মানুষ নিজে জানে যে সে শোষিত হচ্ছে । আর তাই সে নিজের ক্ষমতাবলয়ে আরেকটি মুষ্টিমেয় দলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে । ভাবছে, এভাবে সে কিছু অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বঞ্চিত হবার পরিপূরক হিসেবে উসুল করবে অন্তত আট আনা । সে শোষণের বিরুদ্ধে না গিয়ে এইভাবে নিজেকে শোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে । আসলে এটা একটা অবুঝ আত্মপ্রতারণা । যেদিন মানুষ বুঝবে যে এর দ্বারা আসলে সে নিজের দোষেই তার ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলোকেও হারাচ্ছে (অর্থাৎ, বাকি আট আনাও তারই প্রাপ্য), সেদিন সে এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে । সমস্যাটা হল, এই বোধ একই সঙ্গে একই সময়ে সকলের মধ্যে জাগ্রত হবে না । অর্থাৎ লিঙ্কনের কথাটির মত, ‘সব মানুষকে সব সময় বোকা বানানো যাবে না’ ঠিকই কিন্তু ‘সব’ কথাটা এখানে বড়ই বেমানান । সবাই একদিন না একদিন খেলাটা বুঝবে, তবে সেই ‘একদিন’টা যে নির্দিষ্ট নয় , আলাদা আলাদা । আর সেই আলাদা আলাদা দিনগুলির পরেই সংসদীয় নির্বাচনের সুযোগও থাকে না । স্বভাবতই বিস্মৃতিপ্রিয় মানুষ ব্যস্ত হয়ে যায় জীবনের অন্যান্য সমস্যার সমাধান করতে । ভুলে যায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগঠিত করার নাগরিক কর্তব্যের কথা ।
আজকের গণতন্ত্র হল, বেশিরভাগ মানুষকে বেশিরভাগ সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার মানদণ্ডে সংসদে অধিষ্ঠিত হওয়া । অনেকে বলতে পারেন, তাহলে সরকার পরিবর্তন হচ্ছে কী করে ? হচ্ছে, কেননা যে পক্ষ যখন সফলভাবে মানুষকে বোকা বানাতে পারছে তখন তার দিকে পালাবদলও হচ্ছে । এখানে বোকা বানানোটা আসল, কে বানালো, কীভাবে বানালো সেটা বড় কথা নয় । মাঝে মাঝে তো সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের দলগুলির মধ্যেও রফা হয়ে যায়, তারা একা না পেরে উঠলে একত্রে বোকা বানানোর পরিকল্পনা করে । এটা কিছুটা ধূমপান-মদ্যপান কিংবা টেলিভিশনের মত ব্যাপার। সকলেই জানে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর কিন্তু তবুও সেটাই এদেশের জিডিপি নির্ধারক । সকলেই জানে টিভি বোকাবাক্স, তবুও সে সন্ধ্যেবেলার বৈঠকী আকচা-আকচির মধ্যে নিজের সুবিধাবাদের পক্ষ নির্বাচনে আত্মসমর্পণ করবে । বড় মুখ করে বলবে, গণতন্ত্র উদযাপনের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কী আছে যেখানে বিরোধীরা এসে খোলাখুলি তুলোধুনা করতে পারছে সরকারকে। সে বুঝবেই না, যারা পারছে তাদের মধ্যে সে নিজে পড়ে না । ভাববে না, কেন পড়ে না ? সে শুধু জানে, তার অংশগ্রহণে বিপদ আছে । আর এই নাকচ করতে না পারাটাই আজকের গণতন্ত্রের বৃহত্তম বিপদ ।
সকলে নিশ্চয় এবং নির্ঘাৎ জানে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অতীত কীর্তির দলিল এবং চরিত্র । জানে যে, আগামি পাঁচবছর ধরে ঘৃণা ছাড়া দুইপক্ষের কারও কাওকে কিছু দেবার নেই । তবুও উভয়পক্ষই নিস্পৃহ ও নিরুত্তাপ । ভোটারদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রার্থীদের এই অবিশ্বাস ও ঘৃণার সম্পর্কের সমীক্ষার খতিয়ান দেখে ইপসোস মোরির (Ipsos MORI) গিডন স্কিনার বলেছিলেন, “These results show once again the disconnect that exists between voters and their perception of the political elite. Rebuilding trust in our political system is a challenge that faces all parties”। পারস্পরিক এই অনাস্থার আবহে সিন্ডিকেটের জঞ্জাল এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে আমাদের দু-তরফকেই । ব্যাপারটা ঠিক ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’-এর গ্রিম্পেন মায়ারের মত । বাইরের দিক থেকে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র আর ভেতরের দিকে কর্দমাক্লিষ্ট স্যাঁতস্যাঁতে ঘিঞ্জি জীবনযাত্রা । এটাই জনমনের যা কিছু স্বতঃস্ফূর্ততা ও আনন্দ-উচ্ছ্বাস সবকিছুকে গিলে খেয়ে ফেলে নিশ্চল করে রেখে দিচ্ছে । আমরা এক হতাশাক্লীন্ন জাতে পরিণত হচ্ছি ।
দলবদল, মিথ্যাচার, নেতৃত্বের অযোগ্যতা, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদির প্রভাব সর্বব্যাপী । কারণ এখানে সংবাদমাধ্যম কেনা-বেচার সুযোগ আছে । সবাই ভুলে গেছে যে, হিউমের সহকারী হিসেবে এককালে সাংবাদিক-সম্পাদকেরাই বিট্রিশ সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে টিকিয়ে রেখেছিল । আর আজ সে নিজের দেশের পূর্ণস্বাধীনতার আবহাওয়াকেও বজায় রাখতে পারছে না ‘পেইড-নিউজের’ বদান্যতায় । ফলে, জনগনও এর অংশীদার হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে – সরকারি অফিস-কাছারি থেকে বাস-ট্রেনে জায়গা দখল করে রাখা, লাইনে ধাক্কাধাক্কি থেকে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা – সব জায়গাতে একই ধরনের মনোভঙ্গি দেখা যায় - যেনতেনপ্রকারেণ সুযোগসন্ধানী ক্ষমতাপ্রতিষ্ঠা । অর্থনৈতিক অসাম্যের জেরে অস্তিত্বের সংগ্রামই এখন জীবনের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় যে, মহান জীবনাদর্শ নিয়ে ভাববার মানসিকতা এখন আর নেই । এক অসাড় বোধশক্তির ঘুণপোকা ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছে আমাদের আত্মশুদ্ধির বিকল্পগুলিকেও । অশোকস্তম্ভ ভেঙে পড়ছে, অশোকচক্রের রঙ বদলে যাচ্ছে, সত্যমেব জয়তে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে । সংবিধান অব্দি পালটে দিয়ে সাধারণের মনে ন্যায়বিচার পাবার আশা ক্রমে ক্ষীণ করে দেওয়া হচ্ছে এবং সকলকে বিশ্বাস করানো হচ্ছে যে, এ অবস্থা আর কখনোই বদলাবে না ।
অগণতান্ত্রিকতার ভিতের ওপরে গণতন্ত্রের সাতমহলা যে সত্যিই দাঁড়াতে পারে না । ১৯৪৭ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্থির হয়েছিল গণনির্বাচন ব্যতিরেকে । এখানে যোগ্যতা বা অযোগ্যতার কথা নেই, প্রশ্নটা পদ্ধতিতন্ত্রের । গণপরিষদে সংবিধানের প্রস্তাবনার খসড়া ছিল, ছিল ১৯৫০ সালে তার লাগু হওয়া । তবুও রীতি মেনে পাঁচ বছর লেগেছিল ভারতের প্রথম নির্বাচন আয়োজন করতে । রামচন্দ্র গুহ এই নির্বাচনকে, ‘Democracy’s biggest gamble’ বলে অভিহিত করেছিলেন । ৮৫% অশিক্ষিতের দেশে রঙিন কাগজের ব্যালটে ৫৩টি বিরোধী দলের ভোটযুদ্ধে অসামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নেহেরু নির্বাচিত হয়েছিলেন । সেখানে উত্তরাধিকার হিসেবে আজকে যা ঘটছে তা কি একেবারে অপ্রত্যাশিত ? অর্থগৃধ্নতা, লাম্পট্য ও অসংবেদনশীল আচরণবিধিতেই যে নিমগ্ন ছিল এবং আছে আমাদের চিরকালীন ব্যবহারিক গণতন্ত্র । আজকে এসেই যে গণতন্ত্রের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ক্রমাবনতির পথ ধরেছে, এটা অসত্য । এটা জেনেও উলটো কথা বলা পাপ । অথচ, আজ যেটা বলার তা হল জনগণের অখণ্ড নিরুপায়ভাব । নায়কোচিত একজন নেতার আবির্ভাবের পথ দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় তার নেই । আত্মশক্তি উপলব্ধির ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে যে জনগণ তাকে নিতান্ত নাচার – পঙ্গু ছাড়া আর কীইবা বলা যায় ! তাই উত্তরাধুনিক গণতন্ত্রে সমতা(equality) নয়, ন্যায়সঙ্গত সমতার(equity) কথা ভাবার সময় এসেছে । টি এন শেষন আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, “অনেকে ভুল করে মনে করে গণতন্ত্র মানে নির্বাচন, সংসদে বিতর্ক, বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ করা । গণতন্ত্র বলতে আরও অনেক কিছু বোঝায় । প্রথমত, গণতন্ত্রের অর্থ সংসদের কড়া নজরদারি - প্রশাসনের ওপর, কোনও ব্যক্তি অথবা দল যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার না করে, সরকারি অর্থ যাতে ঠিকভাবে ব্যয় করা হয়- সেদিকে । কিন্তু আমি ভাবি, এ কি কখনও হবে ? প্রশাসনকে দিয়ে কাজ হয় না, আমলাতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমসমূহের তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই, সংসদ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, বিচারব্যবস্থা দীর্ঘসূত্রী । তার ওপরে জনগণের প্রত্যাশা বেড়ে চলেছে । তাদের অর্ধেকের বেশি এখন দারিদ্রসীমার নিচে । তারা তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য পাচ্ছে না । বছরের পর বছর শুধুমাত্র ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের আশা-আকাঙ্খা মেটাবার চেষ্টা চলছে” । সুতরাং, ভাবা প্রাকটিস করুন ।