ভারতবর্ষের ইতিহাসে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বিভেদের রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ। এবং একই সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারক ও বাহক। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। যিনি সাভারকারের ভক্ত। সাভারকার জিন্নার মত হিন্দু ও মুসলিম ভিন্ন জাতি এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। দ্বিজাতিতত্ত্বে তাঁরা সহমত হলেও দুটি ভিন্ন জাতি কীভাবে থাকবে এই বিষয়ে তাঁদের মতভেদ ছিল। জিন্না চাইতেন মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান, হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান। সাভারকারের ঈপ্সা ছিল, ভারত ভাগ হবে না। তবে স্বাধীন ভারতে হিন্দু জাতি থাকবে কর্তৃত্বে, মুসলিমরা থাকবে অধীনে, হিন্দু জাতির সঙ্গে সহযোগিতা করে। (পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশান অফ ইন্ডিয়া, বি আর আম্বেডকার)। আরএসএস-এর অবিভক্ত ভারত ও হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনা উক্ত তত্ত্বেই আবর্তিত।
কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার
আদ্যন্ত মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণা দিয়ে যদি কারও জীবন শুরু হয়ে থাকে তবে তিনি হলেন কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা, ভারতকে সম্পূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা যে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য।
তাঁর সারাজীবনে এই ঘৃণার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। এখানে তার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ থাকল। প্রসঙ্গত, তাঁর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালায় রক্ষিত উক্ত ছবি দেখে আমরা অবাক হইনি, কেননা হেডগেওয়ার নিজে ‘লিঞ্চিং’ করছেন বা করাচ্ছেন এই ঘটনার ফটোগ্রাফি না-থাকায় কাউকে দিয়ে তা আঁকানো হতেই পারে, কারণ এই ‘মহান’ কর্মটি হিন্দুত্বের স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করে যে! অবাক করেছে প্রকাশ্যে তার প্রদর্শন। অবশ্য সংগ্রহশালায় আমাদের ‘অনুপ্রবেশ’ তাঁদের ‘অনুমোদিত’ ছিল না, বলা বাহুল্য। আমাদের ‘কৌশল’ হয়তো আমাদের কাছে এই আকাঙ্ক্ষিত সুযোগ এনে দিয়েছিল।
এখন দেখা যাক, মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণার হোতা হেডগেওয়ারের কয়েকটি কারনামা, যা মূলত তাঁর জীবনী থেকে নেওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। পুনাতে লোকমান্য তিলকের সঙ্গে দেখা করার পর হেডগেওয়ার গিয়েছিলেন শিবনেরী, উল্লেখ্য শিবাজির বাল্যকাল সেখানে কেটেছে। শিবাজির জন্মস্থানের কাছেই মসজিদ ও দরগা দেখতে পান তিনি। দেখে কী মনে হল তাঁর? ‘হেডগেওয়ার জীবনচরিত’ থেকে জানতে পারছি, ‘এই সংগতিহীন দৃশ্য দেখে তাঁর বড় বেদনা হল। এরপর যখনই শিবনেরীর উল্লেখ করা হত, তখনই সেই বেদনা নতুন করে তাঁর মনকে নাড়া দিত।’
১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করতে ডা. মুঞ্জে ও হেডগেওয়ার পন্ডিচেরির উদ্দেশ্যে ট্রেন যাত্রা করেন। দুজনে একই ট্রেনে থাকলেও কামরা ছিল ভিন্ন। ডা. মুঞ্জে ছিলেন প্রথম শ্রেণিতে, হেডগেওয়ার তৃতীয়তে। মাঝেমধ্যেই মুঞ্জের কামরায় আসছিলেন হেডগেওয়ার, কিন্তু একবার ট্রেন ছেড়ে দেয়, তিনি নিজের কামরায় ফিরতে পারেন না। টিকিট চেকার ওঠে ট্রেনে, সমস্যায় পড়েন হেডগেওয়ার। দু-পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়। ডা. মুঞ্জের উঁচুগলা কালো টুপি আর লম্বা দাড়ি দেখে টিকিট চেকার তাঁকে মুসলমান ভেবে বলেন, ‘আমার ওপর মেজাজ দেখাবেন না। মনে রাখবেন এটা মুসলমানদের দেশ নয়’। এই চরম আক্রমণাত্মক কথা শুনে ডা. মুঞ্জে ও হেডগেওয়ার মনে মনে খুব খুশি হন। উপরিউক্ত বইটি থেকে সেই ঘটনায় তাঁদের উৎফুল্লতার নিদর্শন রাখছি।
‘তাঁদের মনে এক প্রকার তৃপ্তির অনুভব হল। সেই সময়ে চতুর্দিকে এই কথাই প্রচলিত ছিল যে হিন্দুস্থানে বসবাসকারী সবাই এই দেশের মালিক। কিন্তু সংঘাতের উপক্রম হলেই হিন্দু মনের দেশভক্তি কি রূপ জাগ্রত হয় এবং এই দেশ যে কেবল হিন্দুদের, এই ইতিহাস-নিষ্ঠ সত্য কেমন নির্ভীকভাবে মুখে এসে পড়ে, তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেখে তাঁদের হৃদয় আনন্দ-বিভোর হয়ে উঠলো’। পরবর্তীকালে হিন্দুদের ‘দেশপ্রেম’-এর কথা প্রসঙ্গে হেডগেওয়ার বহুবার এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
১৯১০ সালে কলকাতায় দাঙ্গা হয়। কলকাতায় ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি (এলএমএস) পড়তে হেডগেওয়ার তখন কলকাতায়। দাঙ্গাপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে কলেজের ছাত্ররা একটি শুশ্রূষা-বাহিনী গঠন করেন বলে জানা যায়। হেডগেওয়ার এই বাহিনীতে ছিলেন। একবার এই বাহিনী এক অচৈতন্য ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ তাদের সামনেই একজন হিন্দু ব্যক্তি জনৈক পাঠান (মুসলমান)–এর পিঠে ছোরায় আঘাত করে। শুশ্রূষা-বাহিনীর একজন স্বাভাবিক কারণেই উদগ্রীব হয়ে ওঠেন, বলেন, ‘এর এখুনি চিকিৎসা দরকার’। কিন্তু বাধা দেন হেডগেওয়ার, বলে ওঠেন, ‘আমাদের মধ্যে থেকে কেউ চিকিৎসা করাতে গেলে পুলিশ এসে আমাদেরই ধরে নিয়ে যাবে, কেননা আমরা সবাই হিন্দু’। চিকিৎসাশাস্ত্রের একজন ছাত্র হয়েও চরম মুসলিম বিদ্বেষ তাঁকে সেবা থেকে নিরস্ত করে। অন্যদেরও মিথ্যা আশঙ্কা দেখিয়ে নিবৃত্ত করেন তিনি।
মুসলমান মানেই গুন্ডা, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয় না, দাঙ্গা একমুখী, অর্থাৎ মুসলমানরাই দাঙ্গা করে — এই ছিল তাঁর মনোভাব। কেউ যদি কখনও তাঁর সামনে বলে ফেলত, ‘অমুক স্থানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছে’, হেডগেওয়ার তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে দিতেন, বলতেন, ‘মুসলমানের দাঙ্গা বলো, ওটাই সঠিক।’
প্রতিষ্ঠাতার এই চরম মুসলিম বিদ্বেষ দিয়েই আরএসএস-এর জন্ম। একটু পিছনে তাকান যাক। সারা দেশেই হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং কয়েক শতক ধরে সহাবস্থানের স্বাভাবিকতা কমে আসছিল। ভারতের বিভিন্ন শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হচ্ছিল। ১৯২৩ সালে ১১টি, ১৯২৪ সালে ১৮টি, ১৯২৫ সালে ১৬টি এবং ১৯২৬ সালে ৩৫টি দাঙ্গার ঘটনার উল্লেখ আছে। হয়তো এই তথ্য সম্পূর্ণ বা নিরপেক্ষ নয়। বলা হচ্ছে, এর মধ্যে বাংলা, পাঞ্জাব এবং যুক্ত প্রদেশ (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) সব থেকে বেশি হয়েছে দাঙ্গা। লাহোর দাঙ্গা, ১৯২৭-এ সবথেকে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। (পাকিস্তান — দ্য হার্ট অফ এশিয়া, লিয়াকত আলি)।
১৯২৩ সালে নাগপুরে দাঙ্গা হয়। হিন্দু মহাসভা একটি মসজিদের সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা করে, জোরালো বাজনা বাজানো হয়। মুসলিমরা এর বিরোধিতা করে, শুরু হয় দাঙ্গা। (গান্ধি ইন হিস টাইম অ্যান্ড আওয়ার্স, ডেভিড হার্ডিম্যান)। ১৯২৫ সালের কথা। দাঙ্গার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হেডগেওয়ার আরএসএস গঠন করেন। উপরিউক্ত কারণ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে নাগপুরে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধ লেগেছিল। অন্যান্য বিরোধের মধ্যে মসজিদের সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা যাওয়া নিয়ে বিরোধ ছিল অন্যতম। ১৯২৪ সালে মুসলমানদের আর্থিক বয়কটও করা হয়। এই বিরোধ মীমাংসার জন্য মতিলাল নেহরু, ডা. মহমুদ এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে একটি তদন্ত সমিতি গঠিত হয় কংগ্রেসের উদ্যোগে। এই সমিতি রায় দেয় —
ভোঁসলে পরিবার এবং জাগোবারের যে-কোনো শোভাযাত্রা মসজিদের সামনে দিয়ে যে-কোনো সময় যেতে পারবে। এদের বাদ দিয়ে অন্য শোভাযাত্রাগুলি শহরের পাঁচটি প্রধান মসজিদের সামনে দিয়ে দুপুরে ও সন্ধ্যায় নমাজের আধঘণ্টা করে সময়াবধি বাদ দিয়ে অন্য সময়ে বাজনা বাজিয়ে যেতে পারবে।
সহাবস্থান কায়েম রাখতে এই সিদ্ধান্ত উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ মেনে নেন, কিন্তু হেডগেওয়ারের তা পছন্দ হয়নি। আজানের জন্য বরাদ্দ সময়ে বাজনা বন্ধ রাখতে তিনি রাজি ছিলেন না। তাঁর ভাষায়, “মুসলমানরা যখনই বলবে ‘বাজনা বন্ধ কর’, তখনই যেন আরও জোরে জোরে কর্কশ আওয়াজে বাজনা বাজানো হয়।” তিনি স্বয়ংসেবকদের নির্দেশ দিলেন এই শোভাযাত্রাগুলিতে অংশগ্রহণ করতে।
তীব্র মুসলিম বিরোধিতার মনোভাব নিয়ে আরএসএস-এর প্রসার হতে থাকল নাগপুরে। হিন্দু আধিপত্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমরা ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকল। শুধু শোভাযাত্রা নয়, স্বয়ংসেবকদের মোতায়েন করা হতে থাকল সেইসব জায়গায়, যেখানে সাধারণত মুসলিমদের আনাগোনা ছিল, যেমন শুক্রবার-তালাও বা তুলসীবাগ ইত্যাদি স্থানে।
নাগপুরের সাধারণ হিন্দুদের মুসলিম-বিরোধী করতে সংঘ হিন্দু একতার ওপর জোর দেয়। এই একতা যে আসলে মুসলিম-বিরোধিতার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প রচনা ভিন্ন কিছু নয় তা অচিরেই বোঝা যায়। হেডগেওয়ারের ভাষায়, “হিন্দুদের মনের মধ্যে ‘আমি’র স্থানে, ‘আমরা’ পঁয়ত্রিশ কোটি’ এই রাষ্ট্রীয় অস্মিতার মনোভাব গড়ে তোলা আবশ্যক।” সংঘের ইতিহাসে থেকে জানতে পারছি, নাগপুর দিয়েই তাদের ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষ’ প্রকল্পের হাতেখড়ি। আক্রান্ত হলে মুসলমানরা কতটা তা জানতে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হল। মহারাষ্ট্রে গণেশ উৎসব এক বড়ো পার্বণ, আমরা জানি। গণেশ উৎসবকে ‘রাজনৈতিক ধর্ম’-এর বড়ো হাতিয়ার করেছিলেন তিলক। বলা যেতে পারে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের নির্মাণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে সে প্রসঙ্গে আলোচনা রাখা হচ্ছে না।
বিজেপি-র রাজ্যসভা সাংসদ রাকেশ সিনহা হেডগেওয়ারের জীবনীকার। তিনি বলেছেন, ‘হিন্দুদের একত্রিত করার জন্য হেডগেওয়ার আরএসএস গঠন করেন। তিনি দীর্ঘকালীন ব্রিটিশ-মুঘল শাসনে হিন্দুদের ওপর চাপানো বিধিনিষেধ থেকে তাদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁরা যাতে তাঁদের সংস্কৃতি পালন করতে পারেন সে জন্য জায়গা দিতে চেয়েছিলেন। আরএসএসের শপথেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে হিন্দু জাতির স্বাধীনতার উল্লেখ আছে।’
হেডগেওয়ারের অন্যতম জীবনীকার, সি পি ভিসিকার তাঁর গ্রন্থ, ‘কেশব সংঘনির্মাতা’-তে দেখিয়েছেন কীভাবে আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা মুসলিমদের বিষাক্ত সাপের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
(১)
নাগপুরে সেবারে গণেশ উৎসব এবং একটি মুসলিম শোভাযাত্রা এক দিনে পড়ে গিয়েছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৭-এ মুসলমানদের এই শোভাযাত্রা ছিল, তিন বছর আগে সৈয়দ মীর সাহেবের প্রয়াণের স্মরণে। এদিকে মহারাষ্ট্রের গণেশ উৎসবে মহালক্ষ্মী একটি বিশেষ দিন, বিশেষ অনুষ্ঠান। শোভাযাত্রা একই দিনে থাকায় হিংসার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, নাগপুর বহুবার দাঙ্গার হিংসা দেখেছে। এবার আরএসএস-এর নির্দেশে সংঘর্ষের সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে অস্ত্র মজুদ করা হল।
নাগপুরে মোহিতের প্রাসাদে ১৯২৫-এ যে সংঘের শুরু ১৯২৭ সালে এসে তার বিস্তার লক্ষ করার মতো। বয়সের ক্রমানুসারে পৃথক পৃথক দল গঠন করা হয়। যেমন ‘লব’ এবং ‘চিলিয়া’ নামক দলে দশ বছরের কম বয়সি ছেলেদের রাখা হয়। ‘কুশ’, ‘ধ্রুব’ ও ‘প্রহ্লাদ’ নামক দলে যথাক্রমে সদ্য তরুণ, কিশোর ও বালকদের রাখা হয়। ‘ভীম’ দলে একটু অধিক বয়সী তরুণ এবং ‘ভীষ্ম’ দলে প্রৌঢ়দের রাখা হয়। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সংঘের শিবির হতে থাকে। সেই শিবিরগুলিতে ৭০-৮০ জন তরুণের লাঠি নিয়ে আক্রমণাত্মক অনুশীলন উপস্থিত পথচারীদের উত্তেজিত করত। বলা বাহুল্য পথচারীদের মধ্যে যারা মুসলিম তাদের উত্তেজনায় আশঙ্কা অধিক ছিল।
‘প্রহার’ এই শব্দে জোর দেওয়া হত। সংঘের প্রথম দিকের কর্মকর্তা আন্না সোহোনী ভাষায়, ‘প্রহারে এমন উদ্দীপনা ও বেগ থাকা উচিত যেন সামনে দাঁড়ানো শত্রু মার খেয়েই জমিতে পড়ে যায়।’ তিনি নিজেও এইরকম ‘প্রহার’-এ অংশগ্রহণ করতেন তা বলা বাহুল্য। স্বয়ংসেবকদের দৈহিক কসরতের সাথে সাথে ‘মগজ ধোলাই’ করার জন্য বই পড়তে দেওয়া হত। দুটি বাজেয়াপ্ত বই, ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘খতরে কি ঘণ্টি’ এই তালিকায় ছিল। সাধারণ হিন্দুদের আরও বেশি করে হিন্দুত্বে আকৃষ্ট করতে বই দুটি বিলিও করা হত।
যে আন্না সোহোনীর কথা আলোচনা প্রসঙ্গে এল, তাঁকে নিয়ে দু-কথা বলা যাক। এই ব্যক্তিটি ছিলেন দাঙ্গাবাজ। সংঘীদের অস্ত্রপ্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নিজের গৃহকে একটি অস্ত্র কারখানায় পরিণত করেন তিনি। বাঘনখ, ছুরি, বর্শা, তলোয়ার ইত্যাদি সেখানে নির্মিত হত বলে সংঘ সূত্রেই জানা যায়।
হেডগেওয়ারের জন্মদিনে সোহোনী তাঁকে একটি ছুরি উপহার দেন। প্রকাশ্যে তা দেওয়ায় হেডগেওয়ার অবশ্য সতর্ক করেন, বলেন, ‘যে কাজ করতে বলা হয়েছে সেটা করতে হবে, কিন্তু তার জন্য এত ঢাকঢোল পেটাবার দরকার নেই’।
৪ সেপ্টেম্বর হেডগেওয়ার নাগপুরে ছিলেন না। হিন্দুদের পক্ষ থেকে যে আক্রমণ হতে পারে তেমন কোনও আন্দাজ মুসলমানদের ছিল না। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে হেডগেওয়ারের নাগপুর থেকে চলে যাওয়া ছিল মুসলমানদের আরও বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই। দাঙ্গায় যাতে হিন্দুরা ‘জয়লাভ’ করে সেই জন্য পরিকল্পনা মাফিক ব্লুপ্রিন্ট রচনা করে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক আন্না সোহোনীর নেতৃত্বে স্বয়ংসেবকরা মোহিতের প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের আড়ালে বেলা ১১ টা থেকে জড় হতে থাকে। আন্না তাদের ১৬ টি দলে ভাগ করেন। ডা. মুঞ্জের বাড়ি থেকে মহাল পর্যন্ত সব গলি-ঘুঁজিতে সশস্ত্র স্বয়ংসেবক মোতায়েন থাকে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২৫ জন যুবক থাকে পথে। সশস্ত্র। (ডা. হেডগেওয়ার জীবনচরিত, নারায়ণ হরি পালকর)
নারায়ণ হরি পালকর রচিত, হেডগেওয়ার জীবনচরিত স্বয়ং সেবকদের কাছে মূল্যবান একটি বই। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে (পৃষ্ঠা ১৫৯-১৬১) দাঙ্গায় হিন্দুদের বীরগাথার যেরূপ বর্ণনা আছে তা এই রকম —
তারা (স্বয়ংসেবকরা) আত্মরক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিল। নিজেদের পরাক্রম তথা পুরুষার্থের উপর তাদের ভরসা ছিল। উত্তেজনায় তাদের বাহুদণ্ডের মাংসপেশীগুলি টান-টান হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ পরেই মিছিল (মুসলমানদের) বড় রাস্তা ছেড়ে গালিগালাজ ও মারপিট করতে করতে ওয়াইকর গলিতে ঢুকে পড়ল। কিন্তু গলির মধ্যে এক পাশে চুপিসাড়ে যে স্বয়ংসেবকরা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা ওই সংকীর্ণ গলিতে গুণ্ডারা (মুসলমানরা) প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর প্রহার মার শুরু করে দিল। মুসলমানরা মাথা ফেটে রক্তাক্ত শরীরে পিছন ফিরে পালাতে শুরু করে দিল।
...রবিবার সারা শহরে সংঘর্ষ চলতে থাকে, কিন্তু তাতে হিন্দুদেরই আধিপত্য ছিল।
......তিন-চার দিন ধরে জাতি, পন্থ, পেশা, ইত্যাদির কৃত্রিম বিভেদ ভুলে হিন্দুরা যে একতা ও জাগরুকতার প্রদর্শন করে, তার ফলে মুসলমানদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল এবং ওরা সরকারি সৈন্যদের ছত্রছায়ায় তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের গোন্ডরাজার কেল্লায় নিয়ে গেল। কয়েকশত মুসলমান হাসপাতালে নিজেদের পাপের ফল ভোগ করতে লাগলো। প্রায় দশ-পনেরো জন ইহলোক ত্যাগ করে চিরদিনের মতো হিজরত করতে চলে গেল। হিন্দুদের মধ্যে চার-পাঁচজন বীরগতি লাভ করল। এই সংঘর্ষের দরুন নাগপুরের জীবনে হিন্দুদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হল।
নাগপুরের প্রত্যেকটি চৌমাথায় এখন সৈনিকদের সঙ্গীনের চমক প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। সেনারা না এলে হিন্দুদের প্রতিকারের ফলে পরাভূত মুসলমানদের অবস্থা আরও খারাপ হত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার (১৮৮৯-১৯৪০)-এর পর আরএসএস-এর সরসংঘচালক হন মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকার (১৯০৬-১৯৭৩)। আরএসএস-এর প্রসারে তাঁর অবদান যথেষ্ট। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ, ‘We or Our Nationhood Defined’-এ হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে তিনি স্পষ্ট অবস্থান রাখেন। বলা যেতে পারে হিন্দুত্বের অন্যতম আকর গ্রন্থ সেটি। অ-হিন্দুদের প্রসঙ্গে ভয়ংকর কিছু কথা এই বইয়ে লেখা হয়।
“হিন্দুস্থানের অ-হিন্দু জনগণকে হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি (race) এবং সংস্কৃতির মহিমা প্রচার ব্যতীত অন্য কোনও ধারণা বর্জন করতে হবে। অর্থাৎ তাদের কেবল এই দেশে ও তার যুগযুগান্ত ব্যাপী ঐতিহ্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও কৃতঘ্নতার দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করলেই হবে না বরং তার পরিবর্তে ভালবাসা ও আরাধনার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।”
হ্যাঁ, এই বাচন (ও আচরণ) যে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাদের ‘ঘরানা’, নাগপুর দাঙ্গা দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের হিংসায় হাতেখড়ি-যা আজকের এই সময়ে সংঘ পরিবার এবং তার রাজনৈতিক শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি অনুসরণ করে, অক্ষরে অক্ষরে। এই ঘরানারই অনুসারী ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদী। গুজরাট গণহত্যায় যাঁর উত্থান এবং ‘হেট ক্যাম্পেনিং’; ‘মব লিঞ্চিং’; ‘নাগরিকত্ব আইন, ২০১৯’; ‘রাম মন্দিরের উদ্বোধন’ ইত্যাদিতে যাঁর বিস্তার।
তাই এর স্বরূপ কতটা সাংঘাতিক তা জানা জরুরি। জানা জরুরি হিন্দুত্বের তত্ত্ব ও তা রূপায়ণের হালহকিকত, যার মধ্যে হিন্দুত্ব সন্ত্রাসের পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রথিত আছে। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খণ্ড সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলিতে আরএসএস নতুন নতুন শিবিরের উদ্বোধন করে চলেছে। বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি সংগঠনের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতিতে ভক্তি ও সহজিয়ার চিরায়ত পথে হিন্দুত্বের মিশেল ঘটাতে সচেষ্ট থাকছে। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ এই সব কিছু জানতে এবং রাজনৈতিক ধর্মের স্বরূপ উন্মোচনে প্রায় দশক-অধিক কাল তথ্যানুসন্ধান চালাচ্ছে। আরএসএস সদর দপ্তরে যাওয়া সেই ধারাবাহিকতার এক অংশ মাত্র।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বিভেদের রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ। এবং একই সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারক ও বাহক। ভারতে মুসলিম লীগ ২০২০ তে তৈরী হয়!!!
হেডগেওয়ার এর কংগ্রেসে থাকা র খিলাফত আন্দোলন নিয়ে কিছু তথ্য থাকলে ভালো হতো। ১৯১০ সালে কলকাতার দাঙ্গার কথা লেখা হলো .কিন্তু কারা করলো এই দাঙ্গা? একপক্ষ মারলে তো র দাঙ্গা বলা যায় না ! নাগপুর থেকে হিন্দুরা এসেছিলো নাকি? ওরাই শুরু করেছিলো হয়তো! আচ্ছা নাগপুরের দাঙ্গা থেকে তো আর এস এস বেড়ে উঠলো কিন্তু কলকাতার দাঙ্গা থেকে কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গড়ে উঠলো নাকি? একটু আলোকপাত করলে ভালো হতো।
একটা দাঙ্গার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াতে আর এস এস জন্মাল আর বাড়তে বাড়তে আজ ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করে নিলো! শুধু বিদ্বেষ থেকে কি হয় এসব? একটু বিশদে বলবেন ?
মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকার কোথা থাকে এসে হেডগেওয়ার এর থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিলো সেটা এক্টু বিশদে জানালে ভালো হয়। আর একটা জিনিস যার খুব ইচ্ছে আর এস এস ভাগ হয়েছে নাকি? মানে ওই আর এস এস(হেডগেওয়ার) বা আর এস এস(গোলওয়ালকার)। দুলালের তালমিছির মতো আর চিহ্ন আছে নাকি ওদের?
হিংসা আর জাতি বিদ্বেষের শেকড় বিশ্লেষণে বার বার শিউরে উঠছি! কবে মানুষ হবো আমরা?
শিউরে উঠলাম। আরও জানতে ইচ্ছে করছে...