কান্না ও কষ্টের মুখোমুখি
বাস্তবে প্রথম পর্বের হিংসার পরেপরেই আমরা’র তথ্যানুসন্ধান দল তেলেনিপাড়ায় যায়। প্রথম যাওয়া হয় ১১ মে, ২০২০। সর্বশেষ যাওয়া ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০। প্রায় চার মাসের অধিক সময়ে কমপক্ষে ১৮ বার আমাদের দলটি কথা বলে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সকলের কাছে আমরা পৌঁছতে পারিনি, এ আমাদের ব্যর্থতা। প্রয়াস সত্ত্বেও অনেকে আমাদের কাছে মুখ খোলেন নি, তাঁদের কাছে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা দেখাতে পারিনি, এ আমাদের অসম্পূর্ণতা। অনেকে মুখ খুললেও নাম প্রকাশ করতে চাননি, আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এখানে এই বাস্তবতার ঝলক রাখা হলো।
(ক) দাঙ্গা যাদের কেড়েছে অনেককিছু
১। অনিতা কুমারী পাসওয়ান
৩ জুন, ২০২০ আমরা কথা বলি, তখন সকাল ১১ টা। সেই সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া হিন্দু বস্তি সারানোর কাজ হচ্ছিল। ওয়ার্ড নম্বর ১৩-র বিজেপি থেকে নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার পান্নালাল সাহুর তত্ত্বাবধানে মেরামতির কাজ হচ্ছিল।
অনিতা- এখানকার কথা বলছি শুনুন,সকালে ১১টার দিকে, হামলোগ খানাউনা বানা রহেথে, উপরসে বোতল ফেকনে লাগা,(পিছনের একটি চারতলা বাড়ি দেখিয়ে),বোতলে পেট্রোল ভরে ভরে ছুড়ছিলো,তাই দেখে বাচ্চা, বড়ো যত ছিলাম আমরা এক কাপড়ে পালাতে থাকি।কোনও সামান উমান কিছু বাঁচাতে পারিনি।ঘরে মান্ডির ৪০ হাজার টাকা ছিলো পুড়ে গেছে,দেখুন আমার সেলাই মেশিনের অবস্থা দেখুন, সব সামান দেখুন,পুড়ে শেষ, কেউ কিছু দিচ্ছেনা, তিন তিনটে ঘর... কত ধরে করে ৫ হাজার টাকা করে পেয়েছি।ওই তো বাবার পায়ে চোট লেগেছে ইস্কুলে খাবার আনতে গিয়ে,এখন আমরা কোনদিকে যাবো,বাবার চিকিৎসা করাবো, না ঘর বসাবো? (ক্রন্দনরত)
আমরা- কারা করেছে এই ক্ষতি?
অনিতা- মুখ তো চিনিনা,ওই সেলিমের কোঠি থেকে বোম ছুঁড়েছে,তখন আমরা পালাবো না ওদের মুখ দেখবে,আর কারুর নাম বলতেও সাহস পাচ্ছি না।
আমরা- এসব হলো কেনো? কোনও টেনশন ছিলো মহল্লায়? কিছু আভাস পাচ্ছিলেন?
অনিতা- কিছুই বুঝতে পারিনি, কেন হলো, একদম আচানক। বুঝতে পারলে আমরা ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে নিতাম কি না? আমার ২২-২৪ বছর বয়স হলো, ছোট থেকে কখনও এই ঝামেলা দেখিনি। শুনতাম তেলিনী পাড়ায় গোন্দোল পাড়ায় এদিক ওদিক ঝামেলা হয়েছে,কিন্তু আমাদের এখানে হয়নি। দেখুন এই যে দরকারী কাগজ পত্র, ছটপুজোর পিতলের বাসন সব পুড়িয়ে দিয়েছে। কে দেবে এত কিছুর ক্ষতিপূরণ?
২। আসমা ফিরদৌস, দিনেমার ডাঙ্গা
আমরা- বলুন কি হয়েছিল ওইদিন?
আসমা- আরে পুরা ঘর জ্বালা দিয়া।
আমরা- লোকাল লোকজন ছিল?
আসমা- চিনবো কি করে? মুখ তো সব বাঁধা ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়ে।
আমরা- কতজন ছিল?
আসমা- (আঙুল দিয়ে একটা বাড়ি দেখায়) ওইখানে সব দাঁড়িয়ে ছিল। আমার বাড়িতে ১০-১২ জন হামলা চালায়। অনেক জিনিস ছিল বাড়িতে। মেয়ের বিয়ের জিনিষ।
আমরা- আপনার স্বামী কি কাজ করেন?
আসমা- আমার স্বামী মৌলানা। রেডিমেড কাপড়ের ব্যবসা আছে। আমার বড় মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার। ইনফোসিস-এ চাকরি করে। ওর নাম আরজু ফিরদৌস।
৩। সরওয়ারি বিবি, ৩ নম্বর লাইন, পাইকপাড়া
আমরা রাস্তার ভিখারি হয় গেছি। না একটা গ্লাস না একটা বাটি। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যা কিছু ছিল সব নিয়ে গেছে ঘর থেকে। আমাদের দরজা বন্ধ ছিল। আমরা ভিতর ছিলাম। আমরা বেরিয়ে যাবার পর আগুন লাগিয়েছে।পুরো পুড়িয়ে দিয়েছিল। এইতো সবে মাত্র বানাচ্ছি। একদম তো ময়দান ছিল। এখন এদের দেওয়া পুরনো জামা কাপড় আছে শুধু। এই ঘর এই ঘর পাশে সমস্ত ঘর পুড়ে গেছিল। সরকার থেকে মাত্র ৮০০০ টাকা পেয়েছি।এটা ১২ তারিখের ঘটনা। দুপুর দেড়টায় পুড়িয়েছে। ঘর নিজের পয়সায় সারিয়েছি। সরকারের ৮০০০ টাকায় কি হয়? এখন তো আমাদের টাকা পয়সা নেই। একটা থালা বাটি ও নেই। আমরা ভাত খাব কি করে? এসব পুরোনো কাপড় পড়ে আছি। অন্য লোকের সাহায্য সাহায্য দেওয়া। আমরা এক কাপড়ে বেরিয়ে গেছিলাম। অন্যের দেওয়া কাপড় পড়েই চলছে। এই পরবের সময় আমরা স্কুলে ছিলাম। কি করে কি করব? একটা জলখাবার ক্লাস অবধি নেই। এখন এই ঘরটা হচ্ছে তাই দিনের বেলা আসি। রাত্রে আবার চলে যাব। কিভাবে থাকবো? ইলেকট্রিক তো নেই। লাইট নেই ফ্যান নেই। খাওয়া-দাওয়া সব এখন স্কুলেই। এখন তো এখানে থাকা সম্ভব নয়। কি করে আমরা থাকব সেটাই ভাবছি।
আমরা দরখাস্ত লিখেছিলাম। কি কি ক্ষতি হয়েছে তার একটা তালিকা। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ওরা দরখাস্ত নেইনি। বলল এসব এখানে জমা হবে না। লকডাউনের সময় ছিল। আমরা এখানকার বাড়িতে গেছিলাম। ওরা বললো এখানেই সব চলবে না। কিছুই জমা নেয়নি। এ সব ছেলেরাই আমাদের সাহায্য করেছিল। লতিফের ছেলে। এরা সবাই রাত্রে এসে আমাদের বার করে নিয়ে গেছে। এখানে এমডি আরমান আর নঈম ভাই ছিলেন। এরা সিভিক পুলিশ। এরাই ফ্রনট্রে ছিল। ইমাম উদ্দিন, আরমান এরা ছিলেন সামনে। এটাই সামনে থেকে সবাইকে বার করে নিয়ে গেছে। আমরা এখান থেকে বেরিয়েছি আর পুড়িয়ে দিয়েছে। নাহলে তো আমরা ঘরের মধ্যেই পূড়ে মরতাম। আমার ১৯৮০ সালে বিয়ে হয়েছে। ৫৩-৫৪ বছর হয়ে গেল। কখনো এরকম দেখিনি। ২০০১-এ হয়েছিল। কিন্তু এরকম হয়নি। আমরা এরকম দেখিনি।
৪। সালমা বিবি(নাম পরিবর্তিত), দিনেমার ডাঙ্গা
আমরা- কিছু কি বলবেন?
সালমা বিবি- চান করে এসেছিলাম তখন। তেলেনিপাড়ায় দুচারটে বোমা পড়লো। পুলিশ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ সবাইকে ডাকছিল, এস ভাই।
ওদের হাতে সবই ছিল। পিস্তল, বোম। আমাদের ঘরে কিছু ছিল না যে চালাবো। আমার ভাইরা ঠেকাতে পারেনি।
আমরা- কোথা থেকে লোক এসেছিল?
সালমা বিবি- সব জায়গা থেকে হিন্দুরা এসেছিল। মালাপাড়া, টিনাবাজার,উর্দিবাজার থেকে এসেছিল। অর্জুন সিং এই কাজ করিয়েছিল।
আমরা- আমরা শুনেছি অর্জুন সিং-এর লোকজন ঢুকেছে।
সালমা বিবি- হ্যাঁ নদী পেরিয়ে এসেছে, রাতের অন্ধকা্রে। শ্রীরামপুর থেকেও এসেছে। ১৫০ লোক নিয়ে এসেছে।
আমরা- আপনার কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে?
সালমা বিবি- হ্যাঁ হয়েছে। এতো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে আমরা কোথায় যাবো, বল?
এরপর তিনি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দেখাতে নিয়ে যান। আবার বলতে শুরু করেন...
-একটু বসার জায়গাও নেই। আমার বাচ্চাদের কোথাও আশ্রয় নেই। আমরা ইস্কুলে ছিলাম, সেখানেও চিল্লাচিল্লি হচ্ছে। আমরা চলে এলাম।
৫। সালাউদ্দিনের পরিবারের মহিলা, জি টি রোডের উপরে মাংসের দোকানের পাশের গলিতে
বহু বছর থেকে আছি, কখনও এরকম হয়নি। এই প্রথম...ওইদিন আমাদের পাশাপাশি লোক ও সাহায্য করেনি। সাড়ে বারোটা নাগাদ, সবে রান্না সেরে স্নান করবো, তখনই জামাই এসে বললো আগুন লেগে গেছে, পালাও পালাও করে পাঁচিল টপকে বাঁচতে হয়েছে,ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ভয়ে শুকিয়ে গেছে, তারপর থেকে ওরা আর এখানে ফিরে থাকতেই পারছে না, দিদার বাড়ি চলে গেছে। একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা, আর একজন আছে ৬ মাসের দুধের শিশু।
আমরা- ৫-৬ বছরের বাচ্চাটা বোধহয় খুব ভয় পেয়ে আছে?
মহিলা- হ্যাঁ, ওতো দেখেছে, বোধ হয়েছে। এখানে আনলেই বলছে এখানে থাকলে আবার যদি হয়। ঘুমের মধ্যে কেঁদে কেঁদে উঠে বলছে, আমায় নিয়ে চলো এখান থেকে, এখানে থাকবো না আমি। ওর আব্বু বোঝাচ্ছে, মোবাইল দেবো, এটা সেটা দেবো। বাচ্চা বলছে না,না আমি কিছু নেবো না,আমায় নিয়ে চলো,আমি শুধু তোমার কাছে থাকবো। ওর সামনে ইস্কুলের পরীক্ষাও আছে,কিন্তু ওর বই খাতা সব নষ্ট হয়ে হয়ে গেছে। কি করে কি করবে!
আমরা- ও কি পরীক্ষা দেবে?
মহিলা- উচ্চমাধ্যমিক।
আমরা- এটা কোন বাচ্চাটা?
মহিলা- এটা আমাদের আরেকটা বাচ্চা, এই যে বড়োছেলেটা। এডমিট কার্ড, আগের রেজাল্ট সব জ্বলে গেছে,গান্ধী ইস্কুলে পড়ে। ইস্কুলে চাল দিয়েছিলো, সেই চাল অব্দি পুড়ে গেছে।
আমরা- আপনাদের কেউ মারধর করেছে?
মহিলা- না, 4জন এসে ঘরের দরজায় লাথি মারছিলো, দরজা বন্ধ ছিলো, ভেঙে ঢুকতে পারেনি।ওদের মুখে সব ঢাকা দেওয়া ছিলো। পরে দমকল ,পুলিশ সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছিলো, কেউ আসেনি। শেষে সামনের বাড়ির লোক এসে জল ঢেলেছিলো।
আমরা- সামনের বাড়ির লোক? ওরা কি মুসলিম না হিন্দু?
মহিলা- না ওরা হিন্দুও না,মুসলিম ও না,ওরা বাঙালি আছে। আমরা ভাবছিলাম কোথায় যাবো? ওই বাঙালিবাবু সবাইকে নিয়ে গেলো, জল দিয়ে সবাই মিলে আগুন নিভিয়ে ছিলো।
আমরা- আপনারা বলছেন এর আগে কখনও কিছু হয়নি?
মহিলা- সেটাই তো, কখনও হয়নি। ওইদিকে তো হচ্ছিলো, হঠাৎ করে জানতে পারে এখানে দুটো মুসলিম ঘর আছে, দিই পুড়িয়ে। ঠাকুর্দার টাইম থেকে আছি, মিলেজুলে থাকবো, আমাদের বিয়েশাদীতে তোমরা আসবে, তোমাদের বিয়েশাদীতে আমরা যাবো। তোমার দোকানে আমরা যাবো, আমার দোকানে তোমরা আসবে, জিনিসপত্র কিনবে, এমন চলছিলো, এটা কি হলো মাঝখান থেকে...
(আবার একটা বাচ্চাকে কাছে নিয়ে এসে বলেন) এরা এসে থেকে দুপুরে খাবার খাচ্ছেনা, খালি এক কথা জিগ্যেস করছে, মা কি করে পুড়লো, কি হয়েছিলো,...
আমরা- আবার কি হতে পারে, কি মনে হচ্ছে?
মহিলা- একবার হয়ে গেলো, এবার ভয় ধরে গেছে আবার যদি হয়,মানুষতো জানছে না,তোমার মনে কি আছে,আমার মনে কি আছে।
আমরা- আচ্ছা এখানে করোনা ছড়িয়েছে?
মহিলা- এখানে, কই এদিকে তো ধরা পড়েনি একটাও।
৬। ঝুমা জয়সোয়াল
ভিক্টরিয়া জুট মিলের গেট থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে ১নম্বর কল বস্তি এলাকায় সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললেন বছর ৩৫এর ঝুমা জয়সোয়াল।
ঝুমা জয়সোয়াল- আমার স্বামীর নাম বিজয় জয়সোয়াল। উনি এখন ঘরে নেই, ঘর সারানোর টালি আনতে গেছেন।ওইদিন এগারোটা নাগাদ আমরা সেদিকে চলে গেলাম, বোমাবাজি হচ্ছিলো। শুনলাম ঝামেলা আবার হবে,পুলিশ ছিলো, পুলিশ ওদেরকেই পুরোপুরি সাপোর্ট করেছে। অন্ততঃ এখানে যে পুলিশরা ছিলো। সামনে লেডিজরা ছিলো,পিছনে জেন্টসরা দাঁড়িয়ে বোমা ছুঁড়ছিলো। পুলিশ ওদের কিছুই বলছেন,অথচ আমাদের কেউ ঠেকাতে এলে বলছে 'সরে যাও সরে যাও'।
আমরা- এটা কি পার্টি পার্টি নিয়ে লড়াই হলো?
ঝুমা জয়সোয়াল- না এটা পার্টি পার্টি নিয়ে না, এটা করোনা থেকে হলো। ওদের (মুসলিম) হচ্ছে যে, ওরা দেখাবে না, ট্রিটমেন্ট করাবে না,শুধু ছড়াবে। ওরা ট্রিটমেন্ট করতে নারাজ। এই ঘটনা শুধু এবছর না,তিন বছর আগেও হয়েছিল, তখন শুধু আমার ঘরটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, এবার পুরোটা মানে ধরুন ২৭ থেকে ৩২ খানা মতো ঘর জ্বালিয়েছে। ওদের টার্গেট হচ্ছে বারবার এরকম করবে যাতে ভয় পেয়ে আমরা যে ক ঘর হিন্দু আছি, আমরা উঠে চলে যাই, ওরা খালি করে বাজার পর্যন্ত এলাকা নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেবে।
আমরা- ঘর পুড়ে গেছে তো কোথায় এখন কদিন থাকছেন?অসুবিধার মধ্যে কাটছে তো খুব?
ঝুমা- অসুবিধা তো হচ্ছেই। কি করবো? এতদিন স্কুলে (শাস্ত্রী স্কুলের ত্রাণ শিবির) থাকলাম,এবার স্কুল ও বলছে যে যার নিজেদের ব্যবস্থা দেখো। কতদিন দেখবে? কেউই তো চিরদিন থাকতে দেবেনা।
আমরা- আবার ঝামেলা হওয়ার ভয় আছে কী? এখানে এসে আবার থাকতে পারবেন, কি মনে হচ্ছে?
ঝুমা- নীরবতা...
৭। সালাউদ্দিন আনসারি
ভদ্রেশ্বরে জি টি রোডের ওপর সালাউদ্দিনের বাড়ি এবং দোকান। ১২ মে সংগঠিতভাবে হিন্দু দাঙ্গাবাজরা তাঁর দোকান লুঠ করে। এখানে তাঁর সঙ্গে আমাদের কথোপকথনের নির্যাস।
সালাউদ্দিন- আমার নাম সালাউদ্দিন আনসারি। কয়েক পুরুষ ধরে এই বাংলায় বাস। কিন্তু হটাৎ সব উলটপালট হয়ে গেলো। ১২ মে ২০২০ দুপুর ১২ টা ৪৫ নাগাদ এখানে দাঙ্গা শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে এই ঘরে এসে দরজা আটকে দিই। তখন ওরা লুঠপাট চালাচ্ছে। দোকানে অনেক জিনিস ছিল, সব নিয়ে ওরা পালিয়েছে। যাবার আগে দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই ঘরেও লাথি মারছিল, আমি আর আমার ছেলে মিলে কোনরকমে ধরে রেখেছিলাম। ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল, সেই সিলিন্ডার দেখে ওরা পালিয়েছে। যদি আগুনে সিলিন্ডার ফেটে যায়, সেই ভয়ে।
আমরা- কতজন এসেছিল?
সালাউদ্দিন- লোক তো অনেক ছিল। আমরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঘরে এসে বন্ধ হয়ে ছিলাম।
আমরা- কেউ কি আপনার বা আপনাদের পরিচিত মুখ ছিল। স্থানীয় কেও?
সালাউদ্দিন- না আমরা তো দেখতেই পায়নি। আমরা তো ঘর বন্ধ করে রেখেছিলাম।
আমরা- এই এলাকায় কয়টি মুসলিম ঘর আছে?
সালাউদ্দিন- এই এলাকায় একটিই মুসলিম পরিবার।আমাদের পরিবার। আর একটি মাংসের দোকান। ওদের তেলিনিপাড়ায় বাড়ি।
আমরা- হ্যাঁ ফেরি ঘাট স্ট্রিটে।
সালাউদ্দিন- আর একটা সাইকেলের দোকান আছে। ওই দোকানটাও ভাঙচুর করেছে। কিন্তু আগুন লাগায়নি। বাঙালি একজনের দোকান ছিল। মাংসের দোকানটা ওই তেলিনিপাড়ার। ওটার শাটার ভেঙ্গেছে। আমাদের এখানে একটা মাজার আছে। সেখানেও ভাঙচুর করেছে। মাজারওয়ালার গাড়ি ছিল একটা, স্প্লেন্ডার, ওটাকে রোডের ওপর ফেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে। একটা এম এইট্টি গাড়ি ছিল, ওটাকেও ভাঙচুর করেছে। ওদের বাক্স ভেঙেছে।
আমরা- কোন পীরের মাজার?
সালাউদ্দিন- সত্যপীরের মাজার।
আমরা- সত্যপীরের মাজার। সেখানে নিশ্চয় সকলে আসতো। হিন্দুরাও তো আসতো?
সালাউদ্দিন- সবাই আসতো। সব জাতির মানুষ আসতো। হিন্দু, মুসলমান, মাদ্রাজি, উড়িয়া সবাই।
আমরা- বেছে বেছে এই মাজারকেই আক্রমণ করা হল। কোন আন্দাজ ছিল এই আক্রমণের?
সালাউদ্দিন- না কোন আন্দাজ ছিল না। এতদিন আছি এখানে, বাবা, ঠাকুর্দা থেকে আজ অব্দি, কোনদিন এইরকম হয়নি। এর আগে এত বড় বড় দাঙ্গা হল। ১৯৯২ সালে তো ভয়াবহ। কিন্তু আমাদের এইদিকে কখনও হয়নি। সব নিজের মত হয়ে গেছিলাম।
আমরা- এখন কি আবার পর হয়ে গেলেন?
...কিছুক্ষণ চুপ থাকেন সালাউদ্দিন আনসারি। উত্তর দেন না বা দিতে পারেন না।
আমরা- কতদিন আছেন আপনারা এখানে।
সালাউদ্দিন- ওই ব্রিটিশ আমল থেকে। আমাদের চার পুরুষ হল। আমার বাবা চটকলে কাজ করতেন। ভদ্রেশ্বর জুটমিল।
আমরা- এখন কেও চটকলে কাজ করেন?
সালাউদ্দিন- আমার ছোট ভাই, নিজামুদ্দিন কাজ করে। ৩৪০ টাকা দিনমজুরি ছিল, এখন একটু বেড়েছে, ৩৯০ টাকা হয়েছে।
আমরা- আপনাদের পরিবারে সদস্য কয়জন?
সালাউদ্দিন- আমরা চার ভাই। আমাদের চার ভাইয়ের চার স্ত্রী। দাদা ভাই মিলে তিন ছেলে, দুই মেয়ে।
আমরা- লুঠপাটের পর রাজনৈতিক দলের লোকজন কি এসেছিল? প্রশাসনের কেউ কি এসেছিল?
সালাউদ্দিন- হ্যাঁ আমাদের হেল্প করেছে, আমাদের পার্টির তরফ থেকেও হেল্প করেছে।
আমরা- আপনাদের পার্টি মানে?
সালাউদ্দিন- মানে পার্টির তরফ থেকে আমাদের পরিবারকে হেল্প করেছে। আশেপাশের লোকজনও হেল্প করেছে।
আমরা- আশেপাশের মানে কারা?
সালাউদ্দিন- আমাদের পাশের বাড়ি, পাড়ার কিছু লোক।
আমরা- তাঁরা হিন্দু?
সালাউদ্দিন- তাঁরা হিন্দু। মানুষ হিসাবেই সাহায্য করেছেন তাঁরা।
আমরা- আক্রমণের সময় কি কোন শ্লোগান উঠেছিল?
সালাউদ্দিন- না শ্লোগান এখানে ওঠেনি। ওই হৈহল্লা হল। আমি ছেলেকে পড়াচ্ছিলাম ঘরে। হটাৎ দুমদাম, ইট পাথর চলতে লাগলো। আমরা এই ঘর (ঘর দেখিয়ে) থেকে বেরিয়ে এইদিকে আসলাম। আগুন আগুন লেগে গেলো সব। আমার দোকান পুড়িয়ে দিল।
আমরা- যারা এসব করছিল তাদের হাতে অস্ত্র ছিল কি?
সালাউদ্দিন- (সন্ত্রস্ত) আমরা দেখিনি। যখন ওইসব দুমদাম আওয়াজ হচ্ছিল আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই ঘরে বন্ধ হয়ে গেলাম। আমরা লোক দেখিনি।
আমরা- সাইকেলের দোকানটা কার?
সালাউদ্দিন- আমার।
আমরা- কি কি জিনিষ পুড়েছে?
সালাউদ্দিন- ওই তো, সাইকেলের পুরো রিপায়ারিং পার্টস ছিল, সব পার্টস লুঠ হয়েছে। লুঠ করে ওরা সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। যতটা পেরেছে লুঠ করেছে, তারপর জ্বালিয়েছে। রবারের মালগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে।
আমরা- আপনাদের ভিতর পর্যন্ত আক্রমণ করতে আসেনি?
সালাউদ্দিন- ভিতর পর্যন্ত এসেছিল। ভিতরের ঘর, লকার ভেঙে সব গয়না, ঘড়ি, মোবাইল লুঠ করেছে। ভেবেছিলাম বুঝি পুড়ে গেছে। মোবাইলে আমি দাঙ্গার পর ফোন করেছি দুদিন, রিং হয়ে গেছে। এখন কিন্তু সুইচ অফ বলছে। থানায় অভিযোগ জানাতে যাচ্ছি, থানা কোন অভিযোগ নিচ্ছে না। আমাদের যত ডকুমেন্ট ছিল সব পুড়ে গেছে, থানা বলছে সেসব মিশিং বলে লিখতে হবে। সেটাও যখন দিচ্ছি, তখন বলছে নাম্বার দিয়ে লিখতে হবে। আমরা কি করে নাম্বার পাবো বলুন? আমার ছেলের বারো ক্লাসের পরীক্ষা আছে সামনের মাসে, এখন সে যে পরীক্ষা দেবে তার কোন কিছু ডকুমেন্ট নেই।
আমরা- কিন্তু পুড়িয়েছে, লুঠ হয়েছে এটা তো চোখে দেখা যাচ্ছে, তবুও এফ আই আর নিচ্ছে না?
সালাউদ্দিন- কোন এফ আই আর নিচ্ছে না, বলছে নাম দিয়ে অভিযোগ জানাতে। আমরা দেখিনি কাউকে কি করে নাম নেবো?
আমরা- লিখিত দরখাস্ত করেছেন আপনারা?
সালাউদ্দিন- হ্যাঁ অনেকবার থানায় গেছি আমরা। কমপক্ষে দশ বার তো হবেই। একবারও দরখাস্ত নেয়নি। ডকুমেন্ট পুড়ে গেছে বললাম, বললো পুড়ে গেছে বলা যাবে না, বলতে হবে হারিয়ে গেছে। ছেলের পরীক্ষা বলে তাতেই রাজি হলাম, তো বলছে নাম্বার দিতে হবে। অ্যাডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আমাদের কি মনে আছে? ইস্কুলে গেলাম, মাস্টার বললেন, ইস্কুল এখন বন্ধ, যখন খুলবে তখন আসবে।
আমরা- নেতারা তো এসেছিল বললেন, পুলিশ থেকে কেউ তদন্ত করতে এসেছিল। বা বিডিও, এসডিও কেউ চোখে দেখতে আপনাদের অবস্থা?
সালাউদ্দিন- না কেউ আসেনি।
আমরা- ক্ষতিপূরণ কিছু পেয়েছেন?
সালাউদ্দিন- পৌরসভা থেকে আট হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা বলে দিয়েছে। আর কিছু দেয়নি।
আমার- টাকা দিয়েছে মানেই তো আপনাদের ক্ষতি হয়েছে তা স্বীকার করছে, অথচ আপনাদের কমপ্লেন নেয়নি?
সালাউদ্দিন- না কমপ্লেন নিচ্ছে না। সি এন চ্যানেল আমার কথা লিখেছে, টিভিতেও দেখিয়েছে, কিন্তু প্রশাসন কিছু মানছে না। খবরও হয়েছে এই দাঙ্গা এবং আমাদের অবস্থা।
আমরা- সাইকেলের দোকানটা কার নামে, আপনার নামে?
সালাউদ্দিন- হ্যাঁ আমার নামেই। লাইসেন্স আছে। তার পাশে আর একটা সাইকেলের দোকান আছে, তেলেনিপাড়ায় থাকে, দোকানটার নাম স্টার সাইকেল, মুসলমানের দোকান।পাশে যে মাংসের দোকান ওরও তেলেনিপাড়ায় বাড়ি, এখানে দোকানদারি করে।
আমরা- কিছুক্ষণ আগে এই যে বললেন বাঙালির দোকানে হাত দিতে গিয়েও দেয়নি?
সালাউদ্দিন- না ভাঙচুর করেছে, সাইকেলগুলো বের করে সব পুড়িয়েছে।
আমরা- ওরা যে হিন্দুদের বা বাঙালিদের দোকান আক্রমণ করেনি আশেপাশেই তো বহু আছে, তার মানে ওরা জানতো কোনটা কার দোকান। কেউ চিনিয়ে দিয়ে থাকবে।
সালাউদ্দিন- কি করে আমরা বলতে পারি? আমরা যদি দেখতে পেতাম তাহলে বলতে পারতাম কে দেখিয়ে দিল?
আমরা- শুধু কি থানায় দরখাস্ত নিয়ে গেছিলেন?
সালাউদ্দিন- গেছিলাম। কাগজ সব কাউন্সিলর লিখে দিলেন। ওপর থেকে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ফোন করেছেন। বলছে কি যাও, চেয়ারম্যানকে ভোট দাও আর চেয়ারম্যান থেকে নাম্বার (হারিয়ে যাওয়া ডকুমেন্টগুলোর) টুকে নিয়ে আসবে। এইসব জানিয়ে চেয়ারম্যানকে বলছি, জানতে চেয়েছি, বলুন কি করবো? উনি বলেন, নতুন সব অফিসার এসেছে, কি করবো?
আমরা- আপনার হিসাব অনুযায়ী কত টাকার ক্ষতি হয়েছে?
সালাউদ্দিন- দোকানে ছিল আশি হাজার, আমার বউয়ের কাছে ছিল বাইশ হাজার, মোট এক লাখ দুই হাজার। আর মাল ছিল প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার। ঘরের জিনিসপত্র লকার ভেঙে নিয়ে গেছে, ঘড়ি, কানের দুল।
আমরা- থানায় লিখিত অভিযোগ নিয়ে গেছিলেন যাতে এফ আই আর হিসাবে নেওয়া হয় তা তো নেয়নি জানালেন। আর কোথাও গেছিলেন? যেমন এসডিও বা বিডিও অফিস বা জেলাশাসকের কাছে? বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ?
সালাউদ্দিন- না, এখানে যখন জমা হচ্ছে না তখন আর যাব কোথায়?
৮। গুলাম সরওয়ার, পাকিজা এফ জি স্ট্রীট
আমরা- কি হয়েছিল সেদিন?
গুলাম- ঝামেলা হয়েছিল রাত্রের বেলায়, মেন ব্যাপার হচ্ছে, এখানে একটা লোককে বলেছিল করোনা হয়েছে, করোনা নিয়ে ঝামেলা। লোকটার আগে থাকতেই শরীর খারাপ ছিল লকডাউনের মধ্যে। এখানে একটা হেলথ সেন্টার আছে আমাদের সেগুন বাগানে, ওই হেলথ সেন্টারে এসে গলা চেক আপ করেছে, হয়ত শরীর কিছু ডিস্টার্ব ছিল। ২-৪ দিন বাদে রিপোর্ট এলো কি নাম আছে ‘আসিফ’, ৫৬ বছর বয়স...সব কিছু হোল তো...তারপর লোকটাকে আমাদের ফাঁড়ি থেকে জেনারেল সাহাব এলেন, হয়তো ওনার কাছে ম্যাসেজ এসেছে, কাগজ বা কিছু এসেছে, কি এনাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে করোনার জন্য...কোয়ারেন্টাইনের জন্য, যতদিন থাকবে ততদিন রাখতে হবে, তাই নিয়ে গেলো লোক।
এইটা নিয়ে কানে কানে রটে গেলো কি আমাদের সেগুন বাগানে করোনা হয়েছে, কিন্তু...৩- ৪ দিন পর...তারপর এখানে একটা আমাদের তেলিনিপাড়া ফাঁড়ির সবথেকে ভালো কাজ করেছিল, বাজারে বেশি ভিড়ভাড় হচ্ছিল। জাস্ট এইটা একটা ময়দান আছে (ওনার বাঁদিকে) এখানে সবজির হাট বসালো, আর আমাদের নেহেরু স্কুল আই জায়গা বলে নাম আছে, সেটা...পরে...এম এল লেন জায়গার নাম হচ্ছে মুকারমাই লেন আমরা এম এল লেন শর্টকাটে বলি। ওই জায়গাটা...ওই জায়গাটা অর্ধেক ভাগ করে দিল, ওইখানে সবজি লাগাবে......এই খানে সবজি লাগাবে। লাগানোর পর লোকগুলো একটু অ্যাডজাস্ট হবে যেন একটু গায়ে গায়ে না থাকে। তারপর সবজির লোক এসেছে বেচার জন্য...গরিব লোক সকাল বেলায়, একটা লোক এখানে কল আছে...ওই পাড়াটা হচ্ছে হিন্দু পাড়া আমাদের পাঁচিল টপকে (ওনার ডানদিকে), হিন্দু পাড়া আর এইদিক সব মুসলিম পাড়া। তো এই গেছিল জল আনতে...তো বললো তোমাকে জল দেবো না আমরা, তোমাদের করোনা হচ্ছে...তো জাস্ট এই কথা নিয়ে ঝামেলা হল, সবজি-টোবজি ওরা এসে ফেলে দিলো। তো...আমাদের তেলিনিপাড়া জুটমিলের আগে মাদ্রাজি লাইন আছে, ওইখানে চেল্লামিল্লি হয়ে গেলো, কি না মুসলিমদের করোনা হয়েছে, আমরা কিছু নেবো না, আমরা কিছু দেবো না, এই সব নিয়ে ঝামেলা হবার পর...এইখানে রাত্রের বেলা হিন্দুরা ঝামেলা বাড়িয়ে দিলো...মুসলিম ভি বহুত আয়ে হয়ে থে, ওরা কিন্তু...ওরা অনেক কিছু চার্জ করছে...সেটা...বললে কি হবে সবাই জানে...আর এইটা করার পর, ওইখান থেকে লোক এইদিক থেকে এলো...চারদিক থেকে অ্যাটাক করছে, বলছে মুসলিমদের করোনা হয়েছে, চারদিক থেকে অ্যাটাক। কি মুসলিমরা আমাদের মারছে...কিন্তু সেটা কিছু হয়নি।
আমরা- কিন্তু মুসলিমরাও তো এককাট্টা হয়েছিল। আপনি জানালেন।
গুলাম- আমরা এক জায়গায় রয়েছিলাম...চারদিক থেকে লোক ঘিরে আসছে। আমাদের ওপর চার্জ করছে তারপর দিন...সরি সেইদিন এই লোকগুলো...বাইরে থেকে ৩০০-৪০০ লোক এসেছিল। খবর এসেছে কানে কানে ৩০০-৪০০ লোক ওপার থেকে এসেছে, সেই লোক হচ্ছে অর্জুন সিং-এর লোক। অনেক লোক বলল কি অর্জুন সিং-এর লোক। ওখান থেকে এসে মারামারি করলো, গুলি চালালো, বম্ব চালালো, আমার ঘরটা নষ্ট করলো...খুব কম করে ৪-৫ লাখ টাকা নষ্ট করলো। ঘরের ভিতর এসে আমার দুটি বৌদির বিয়ের সামান-এইসব ছিল সব নষ্ট করেছে। আমার দুটো নিজের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে...আমার বোনের পেটে বাচ্চা ছিল, ডেলিভারি কেস...তো ওকে বাঁচানোর জন্য আমাদের ইট লেগেছে। এই তো দাগ আছে মুখে (তাঁর মুখ দেখালেন)। সেটিং এখনও করায়নি, যাচ্ছিনা...ভয় লাগছে বাইরে যেতে যদি কিছু হয়ে যায়...তো দুদিন পর চন্দননগর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম বোনকে, সিজার হল, বাচ্চা হল, পেটে ব্যাথা ধরল...ওই তারপর একদিন ঠিক ছিল, শান্তি ছিল। তারপর আবার মঙ্গলবার ঝামেলা শুরু হল। ১১ টা থেকে শুরু চললো প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা। ঘরে কম সে কম ৩০-৪০ জন লোক এসেছে, ঘরের ওপর বোম চার্জ করেছে...গুলি চালিয়েছে...পাথর ছুড়েছে। আমাদের এখানে শারমিন ডাক্তারের ওখানে হেলথ সেন্টার আছে...রাত্রে ওখানে এসে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, আমরা অনেক বললাম, ‘স্যার ওখানে দেখুন, ওরা ঘর পোড়াচ্ছে’, আমরা গেলাম কথা বলতে...আমাদেরকে বন্দুক দেখিয়ে বললো, ‘তোরা যা ওইদিকে’। আমরা চলে এলাম...এইখানে। ৩০-৪০ জন মিলে আগুন লাগিয়েছে, হাতে বন্দুক-ফন্দুক নিয়ে, গাঁজা খাচ্ছিল, বসে ছিল, নটার সময় এই ঘরটাতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে গেলো ওপারে। তারপর থেকে ওপরে খবর গেলো কিনা জানিনা, পুলিশ অ্যাটাক করলো, ওরা সব পালিয়ে গেলো। কিছু লোক ধরা পড়লো, আর কিছু লোক পালিয়েছে। বেশি লোক বাইরে থেকে এসেছিল। এই জায়গার নাম হচ্ছে তাঁতিপাড়া, আর ওইদিকে গোন্দলপাড়া। আছে তালেনিপাড়া মাদ্রাজি লাইন, ভদ্রেশ্বর। চারিদিক থেকে লোক এসেছিল, বাইরে থেকে লোক এসেছিল, কম করে ৩০০-৪০০ জন লোক এসেছিল বাইরে থেকে মারার জন্য।
আমরা- এখন আপনারা কোন কোন জায়গা অ্যাভয়েড করছেন মানে যাচ্ছেন না।
গুলাম- মার্কেটে যাওয়া আসা করছি, কিন্তু জানে ভয় আছে।
আমরা- কোনদিকে বেশি ভয় আছে?
গুলাম- চারিদিকেই ভয় আছে। আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছি, যাওয়া হচ্ছে বাইরের জিনিষ আনার জন্য। বাইকে করে যাচ্ছি, মানে বেশি হাঁটাহাঁটি করছি না আমরা এখন।
আমরা- আপনারা কি গোয়ালাপাড়ার দিকে যাচ্ছেন?
গুলাম- গোয়ালাপাড়া আমরা যাচ্ছি না। ওইদিক থেকে অ্যাটাক হয়েছে, আমার বোন যার বাচ্চা হয়েছে, ওর শ্বশুর আর ছোট এক দেওর ছিল। ফ্ল্যাট থেকে টেনে এনে পুলিশ খুব মেরেছে, টেনে নিয়ে চলে গেছে। ওরা বলেছে কি আমরা রাইফেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, আমার বোনের শ্বশুর বললো, পুলিশ শুনল না, ওদেরকে টেনে নিয়ে চলে গেছে, কোন কথা শুনল না। অনেক লোক ধরা পড়েছে, ফ্লাটে অনেক ক্ষতি হয়েছে, ওইদিক থেকে লোক এসেছে, হাত নৌকা করে, যেটা করে মাছ ধরা হয়। কালো নৌকা। অনেক লোক এসেছিল, কয়েকজন ধরা পড়েছে, বোমা পেয়েছে।
আমরা- ওদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ?
গুলাম- ওরা নাকি দাঙ্গায় জড়িত। সব মিথ্যা অভিযোগ।
আমরা- কি মনে হচ্ছে আপনাদের, এখন কি শান্তি কায়েম হবে না আবার কিছু হবে?
গুলাম- এখন তো দেখছি ৪-৫ দিন ধরে শান্তিই আছে, বলা মুশকিল, কখন কি হয়, কেউ কিছু জানেনা...যখন বোম ফাটছে নিশ্চয় ওরা কিছু না কিছু রেডি করছে, এটাও হতে পারে, বলা মুশকিল এখন, কখন কি হবে।
আমরা- ক্ষতিপূরণ কিছু কি পেয়েছেন?
গুলাম- ও...আমার একজন লোক আছে ওখানে, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির ওখানে দরখাস্ত লেখা হয়েছে, থানাতে দেওয়া হয়েছে, হয়ত আমার বোনাই গিয়েছিল, কিছু পেয়েছে, আসলে এটা হচ্ছে আমার বোনাইয়ের ঘর, আমার নিজের ঘর হচ্ছে ওইদিকে, সেগুন বাগান মসজিদের কাছে আমার নিজের ঘর তৈরি হচ্ছে, লকডাউনে কাজটা বন্ধ হয়েছে, তাই এখানে থাকলাম, দুটো বৌদিও ছিলেন, ফুল ফ্যামেলি এখানে থাকলাম। ঘরের মধ্যে কিছু বাঁচেনি। লোকে জামা কাপড় দিচ্ছে, আমরা পরছি। এইতো কাল থেকেই এই গেঞ্জি পরে আছি, লুঙ্গি পরে আছি। নিজের কাছে টাকাও নেই যে কিছু কিনতে পারব, এমন অবস্থা। বোনের এক থেকে দেড় লাখ টাকা নগদে ছিল, বৌদিদের সোনার চেন ছিল- সব নিয়ে পালিয়েছে। তারপর আগুন লাগিয়েছে। কিছু বাঁচেই নি। আপনি এই ঘরের ছবি তুলুন, ভিডিও তুলুন, এই ঘরের কিছু নেই।
আহত জনের বিবরণ-
এই দাঙ্গায় আহত ক’জন, এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে পায়নি। স্থানীয় মানুষ যা বলেছেন তার সাপেক্ষে কাউকে হাজির করাতে বা তাঁদের পরিবারের কারুর সাথে কথা বলাতে পারেননি। স্বভাবতই এর সংখ্যা এবং আক্রমণ কারা প্রথম শুরু করেছিল এই তর্কে হারিয়ে গেছে প্রকৃত তথ্য। আমাদের তথ্যানুসন্ধানে আমরা দুইজন আহত ব্যক্তির কথা জানতে পারি।
১০ মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭ টায় ভদ্রেশ্বর এস এন জুটমিলের ৯ নম্বর এবং ১০ নম্বর লাইনের মধ্যে শ্লোগান দিতে দিতে আসে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দাঙ্গাবাজরা। পাল্টা শ্লোগান এবং আতঙ্কের আওয়াজ মুসলিমদের মধ্যে থেকেও শোনা যায়। এই ঘটনার কিছু ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকে (আমরা, এক সচেতন প্রয়াস ফোরাম এর সত্যতা পরীক্ষা করেনি)। এই সন্ধায় মুসলিম শ্রমিক কলোনি আক্রমণের ঘটনা আমরা হাজি মুহম্মদ মহসিন গার্লস স্কুলের ত্রাণ শিবিরে থাকা মুসলিম মহিলাদের কাছে শুনেছি। শুনেছি সিভিক পুলিসের কাছেও।
মুহম্মদ আজাদ এবং মঞ্জুর আলম এই আক্রমণে মারাত্মক জখম হন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁদের ভদ্রেশ্বর অঙ্কুর হাসপাতালে (এই ভদ্রেশ্বর পুরসভা পরিচালিত হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। মুহম্মদ আজাদের মাথা ফেটে গেছিল, আঙুল কেটে গেছিল। মঞ্জুর আলমের হাত ভেঙে গেছিল। জুনের ১০ তারিখে আমরা যখন ওনাদের কোয়ার্টারে যায় তখন ওনাদের নিজ পরিবারের কেউ ছিলেন না। আহত দুইজন তখনও হাসপাতালে। প্রতিবেশিরা যা জানান তা নিম্নরূপ-
আমরা ভাবিনি কখনও এইরকম হবে। আতঙ্কে বাচ্চারা অনেক রাত ঘুমতে পারেনি। মঞ্জুরের দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে। আজাদেরও দুই সন্তান। এত রক্ত দেখে ওদের অবস্থা কি হবে বুঝুন। ওরা এখন কেউ এখানে থাকছে না। প্রচুর খরচ হয়ে গেছে ওদের। কয়েক লক্ষ হবেই। তৃণমূল কংগ্রেস কিছুই দেয়নি। পুরসভা থেকে মাত্র চার হাজার। এদের হালাত খুব খারাপ। ঠিকা শ্রমিক এরা, কোন কাজ করতেও পারবে না।
(ক্রমশ…পরের পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার)
এই সিরিজটা সত্যি খুব ভালো হচ্চে।
"...ওরা হিন্দুও না,মুসলিম ও না,ওরা বাঙালি আছে। আমরা ভাবছিলাম কোথায় যাবো? ওই বাঙালিবাবু সবাইকে নিয়ে গেলো, জল দিয়ে সবাই মিলে আগুন নিভিয়ে ছিলো।..." - এই কথাটা বার বার পড়ছি।