(৪) পুলিশ পলিটিক্স এবং
তেলেনিপাড়ায় পুলিশের ভূমিকা ঠিক কি ছিল এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়েছে আমাদের তথ্য অনুসন্ধান পর্বে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ যে কথাগুলি বলেছে তা হলো এইরকম-
১। দাঙ্গা হয়নি, দাঙ্গা করতে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এই দাঙ্গা ঘটতে দেওয়ার ভুমিকায় স্পষ্টত দৃশ্যমান না হলেও নেপথ্যে তাদের ভূমিকা ‘স্পষ্ট’। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যখন মুসলিম নিন্দা ও করোনা ছড়ানোর প্রচার চালানো হচ্ছে তখন পুলিশ নির্লিপ্ত।
২। ১০ মে’র সাম্প্রদায়িক হিংসার পরে যে কোন দিন আবার সংঘর্ষ হতে পারে এই আঁচ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কিছু ব্যবস্থা নেয়নি। ভাটপাড়া থেকে দাঙ্গাবাজরা এসেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দুত্ব শক্তি গুন্ডা জড়ো করেছে, পুলিশের না জানলে এটা হয়?
৩। এফ আই আর নিতে না চাওয়া, লুঠ হওয়া বা আগুনে পুড়ে যাওয়া সত্ত্বেও জোর করে ‘হারিয়ে গেছে’ এই বয়ানে দরখাস্ত লেখা করানো।
৪। পুলিশের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে ঘটনায় ইন্টারভেন করার ভূরি ভূরি অভিযোগ এসেছে। ১০ মে দৃশ্যত হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকান ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, লুঠ করা হয়। দুদিন বাদেই, ১২ তারিখ তার ‘বদলা’ নিতে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের মতে দুটি ‘চিত্রনাট্য’ই পুলিশের। ১০ মে মুসলিম দাঙ্গাবাজদের জিতে যাওয়া, ১২ মে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের জিতিয়ে দেওয়া। প্রযত্নে পুলিশ, প্রশাসন। প্রযত্নে রাজনীতি। মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ‘আমরা’ প্রায় শচারেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে তেলেনিপাড়ায়, দাঙ্গা বিধস্ত এলাকায়। যারা উপরিউক্ত অভিযোগগুলি করেছেন, সোজাসুজি। ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। রাখা হচ্ছে কতিপয় কথোপকথন।
(ক) সিভিক পুলিশের সঙ্গে কথোপকথন
সিভিক পুলিশ- যেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, তেলেনিপাড়া থেকে ফোন এলো যে এখানে ঢুকে মারছে। আমি আমাদের আইজি সাহেবকে ফোন করি। উনি বলেন ঠিক আছে, আমি ফোর্স পাঠাচ্ছি। এরপরে খানিকক্ষণ চলে যায়, তারপরে আমি আবার ফোন করে বলি, স্যার ফোর্স তো এখনও আসেনি। স্যার বলেন ঠিক আছে, তোমার সাথে কে আছে? আমি বলি আজহারউদ্দিন(নাম পরিবর্তিত, অন্য সিভিক পুলিশ)। উনি বলেন তোমরা যাও, ফোর্স চলে গেছে। আমরা এলাকায় আসি, দেখি কেউ আসেনি। আর ওরা তরোয়াল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দোকান ভাঙছে, স্করপিও গাড়ি ভাঙছে।
আমরা- কোথায়?
সিভিক পুলিশ- ওই যে ৯ নম্বর লাইনে। আমরা এসব দেখে আবার ফিরে চলে আসি। তারপর এখান থেকে আমি লালা ভাই, ইমামুদ্দিন আর আলীকে নিয়ে যাই। তারপর ওরা পালায়, ফাঁকা হয়। তারপর আমরা ওখানকার লোকেদের বের করি। তারপরের দিন আর কিছু হয়নি। তারপরের দিন হঠাৎ এখানে ঝামেলা হয়ে যায়। ১২টা -১২.৩০ এর সময় ঝামেলা হয়। এরপর আমি তখনও ওই স্কুলের কাছে বসে স্যারকে ফোন করি।
আমরা- ৯ নম্বর লাইনে ঝামেলা কবে হয়েছিল?
সিভিক পুলিশ- ১০ তারিখ এখানে হয়, মারাত্মক আহত হন দুইজন। তারপর আবার ১২ তারিখ হয়। ওইদিন মুসলমানদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়।
এরপর আমি অঙ্কুর নার্সিং হোমের কাছ থেকে (ওখানেই ডিউটিতে ছিলাম) সাহেবদের ফোন করি কিন্তু ওনারা বসে ছিলেন। বড়বাবুকে ফোন করেছিলাম, উনি ধরছিলেন না।
আমরা- বড়বাবু এখনও আছেন?
সিভিক পুলিশ- না বদলি হয়ে গেছেন। ওনার নাম নন্দন পানিগ্রাহি। এরপর আমি আর বেশি ফোন করিনি। রোজা চলছিল। এরপর রাতে চেয়ারম্যান স্যারের লোক আসে, আমরা বলি সব।
আমরা- কি বলেন?
সিভিক পুলিশ- হ্যাঁ কোনো প্রশাসন আসেনি। পাবলিক তো দেখেছে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান কেউ আসেনি। অঙ্কুর নার্সিং হোমের পাশেই ফায়ার ব্রিগেড, আসতে এক মিনিট টাইম লাগে কিন্তু আসেনি। জল বন্ধ ছিল। তবে তাকে দোষ দেবো না, জল যে চালু করে ও তো মানুষ, ও ফেঁসে গেছিলো। পরে গিয়ে জলের পাম্প হাউস খোলা হয়। এইসব কথা ডি এম সাহেবের লোককে বলেছিলাম, যে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়াম্যান কেউ আসেনি আমাদের এলাকায়। ৯ নম্বর লাইনের দাঙ্গা পীড়িত মুসলমান পরিবারগুলোকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেসব কেউ দেখতে আসেনি। সব কিছু হয়ে যাওয়ার চারদিন বাদে কিছু লোক এসেছিল। এইসব কথা বলেছিলাম বলে ওনার খারাপ লেগেছিল। ইমাম উদ্দিন এর ভাইজার বাড়িতে ওই লোকেদের রাখা হয়েছিল তাকে ফোন করে ভাইস চেয়ারম্যান বলে, ‘তোমাদের বহুৎ নাটক হচ্ছে’, মানে হুমকি দেয়। ইমামের ভাই বলে যে আপনি ভাইস চেয়ারম্যান তো কি হয়েছে যা মনে হবে তাই করবেন। এটাই গিয়ে ওরা ডিএসপি সাহেবকে বলে দেয়। তারপর আমাদের ফাঁড়িতে ডাকা হয়। আমাদের বলা হয় যে তোমরা তো প্রশাসনের লোক তোমাদের তো এইসব বলা উচিত নয়। আমি বলি প্রশাসনের লোক তো ঠিক আছে কিন্তু আপনাকে তো দেখতে হবে কে ঠিক বলছে কে ভুল বলছে?
এইসব প্রশ্ন তোলার জন্য আমাদের দুজনকে ট্রান্সফার করা হয়েছে।
আমরা- কোথায়?
সিভিক পুলিশ- এখন চন্দননগরে।
(খ) আমরা তথ্যানুসন্ধান দলঃ হুমকি, আটক এবং তেলেনিপাড়ার সেপাইরা
১০ জুন, তেলেনিপাড়ার সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হিংসার ঠিক এক মাস। আমরা গিয়েছিলাম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে, কথা শুরু হয় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ স্কুল থেকে। এখানে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
তখন বেলা প্রায় দেড়টা। তথ্যানুসন্ধান দলের দুইজন, ফারুক উল ইসলাম ও শুভঙ্কর সেনগুপ্ত তেলেনিপাড়ায় এফ জি স্ট্রিটের পাকিজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, কথা বলছিলেন জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করছিলেন দাঙ্গার স্বরূপ, ব্যক্তি মানুষের অসহায়ত্ব। হঠাৎ পুলিশ বাহিনীর আগমন। ভদ্রেশ্বর থানার আই সি, কৌশিক কুমার ব্যানার্জির নেতৃত্বে ১০-১২ জনের সেই দলটি তাদের ঘিরে ধরে, বলে, ‘আপনারা এখানে ছবি তুলছেন কেন, কথা বলছেন কেন?’ উত্তরে ফারুক জানান, ‘মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবো না? তাছাড়া এখন তো ১৪৪ ধারা লাগু নয়।’ উত্তরে উক্ত আই সি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে থানায় চলুন’। ফারুক ও শুভঙ্করকে তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফোন মারফৎ এই খবর পেলে দলটির ওপর দুই সদস্য শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী এবং অমিতাভ সেনগুপ্ত তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে যান।
প্রায় দেড় ঘণ্টা বসার পর আমাদের ডাকা হয় তেলেনিপাড়া আউটপোস্টের ইনচার্জ অতনু মাজি’র অফিসঘরে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন ভদ্রেশ্বর থানার আই সি, কৌশিক কুমার ব্যানার্জি এবং ডি এস পি, চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট, পলাশ চন্দ্র ঢালি, আই পি এস। শুরু হয় কথিত ‘ইন্টারোগেশান’। এখানে ব্যক্তি বিশেষের নামেই এই কথোপকথন রাখা হলো।
কৌশিক- কয়জন ছিলেন আপনারা?
শুভ প্রতিম- আমরা চারজন।
কৌশিক- চারজন কোথায়? আরও কয়েকজন তো ছিলেন? ওখানে তো দুজনকে দেখলাম, আরও ছিল।
শুভ প্রতিম- না আমরা চারজনই ছিলাম। লোকাল একজন ছিলেন যে আমাদের জাস্ট দেখিয়ে দিচ্ছিলো।
কৌশিক- আপনার কোথায় ছিলেন?
শুভ প্রতিম ও অমিতাভ- আমরা পরে এলাম। আমরা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুলে ছিলাম।
কৌশিক- ওই তো আপনার সঙ্গে তো আরও দুইজন ছিল (শুভঙ্করকে দেখিয়ে)
শুভঙ্কর- না, ওই তো ওই ছেলেটা ছিল যার বাড়িতে গিয়েছিলাম, চশমা পড়া ওই ছেলেটা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছিল।
পলাশ চন্দ্র- আপনাদের টিমে কয়জন লোক ছিল?
শুভঙ্কর- চারজন।
পলাশ চন্দ্র- সেই চারজনই এসেছেন?
শুভঙ্কর- হ্যাঁ।
পলাশ চন্দ্র- হ্যাঁ তো আপনারা কি জন্যে এসেছেন? আপনারা কারা?
শুভ প্রতিম- আমরা একটা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত, আমরা রিসার্চের কাজ করি।
পলাশ চন্দ্র- কি আছে, প্রমাণ কি আছে? (কাগজপত্র দেখতে চেয়ে)
শুভ প্রতিম- না আমাদের কাছে কোন কাগজপত্র নেই। আপনাকে আমরা ইমেলে পাঠাতে পারি। আমরা এখানে আসি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ স্কুলের ম্যাথস-এর টিচার, উনি আমাদের বলেন যে এখানে কিছু সমস্যা আছে, এরকম না যে এখানে থাকা মানুষজন খাবার পাচ্ছে না, কিন্তু এখানে টুকটাক কিছু সমস্যা আছে, আপনারা যদি আসেন।
পলাশ চন্দ্র- আমার কথা শুনুন।
শুভ প্রতিম- হ্যাঁ বলুন।
পলাশ চন্দ্র- আপনারা এখানে এসেছেন, জানেন এখানের অবস্থা কি?
শুভ প্রতিম- এখন তো ১৪৪ ধারা নেই।
কৌশিক- ১৪৪ নেই তো কি?
পলাশ চন্দ্র- আশ্চর্য লোক তো!
কৌশিক- আপনারা আউটসাইডার, আপনারা প্রভোকেসান দিতে এসেছেন কিনা বুঝবো কি করে?
শুভ প্রতিম- তাহলে আমাদের কাজ দেখতে হবে। প্রভোকেশানের কথা আসছেই না।
কৌশিক- ১৪৪ নেই বলে আপনারা আউটসাইডার এখানে ঢুকে যাবেন?
শুভ প্রতিম- আমাদের আউটসাইডারের সংজ্ঞা জানা নেই। আমরা আউটসাইডার নই। আমরা তো এখানেরই লোক।
কৌশিক- কোথা থেকে এসেছেন?
শুভ- হুগলী জেলার কেউ শ্রীরামপুর, কেউ চন্দননগর। কেউ অন্য জেলা থেকে।
কৌশিক- আপনারা কেউ ভদ্রেশ্বর বা তেলেনিপাড়ার নন?
পলাশ- কোন বেসিসে আপনারা এখানে এসেছেন?
শুভ প্রতিম- বললাম তো, রিসার্চ গ্রুপ হিসাবে এসেছি। আমরা পিস নিয়ে কাজ করি।
পলাশ- বললেই হলো?
শুভ প্রতিম- তাহলে তো দেখতে হয় আমাদের কাজ, দেখুন।
পলাশ- কি আছে, কোন আইডেন্টিটি কার্ড?
শুভ- আছে। (দেখানো হলো)
পলাশ- এটা কি কোন এন জি ও?
শুভ- এটা একটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
পলাশ- আমি যেটা বলবো, সেটা ডাইরেক্টলি উত্তর দেবেন।
শুভ- আমি তো আপনাকে ডাইরেক্টলি উত্তর দিচ্ছি।
পলাশ- আমার কথা শুনুন (জোরে) আপনাকে যেটা জানতে চেয়েছি সেটা বলুন। আই ডোন্ট লাইক ইট।
শুভ- সেটা আপনি বুঝে নিন। আমি তো বললাম, ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেমন অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশানাল। সেইরকম।
(কার্ড দেখার পর)
পলাশ- ঠিক আছে, এখন বলুন আপনাদের আসার প্রয়োজনটা কি?
শুভ- ওই যে বললাম, আমরা একটি রিসার্চ গ্রুপ, এখানে ইস্কুলে এসেছিলাম দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের অবস্থা বুঝতে। আমরা যদি কিছু সাহায্য করতে পারি এই উদ্দেশ্যেই আসা। আমরা ইতিমধ্যে আমপান দুর্গতদের জন্য গিয়েছিলাম। এখানে উপস্থিত এমন দুইজন গিয়েছিল। (ফারুক ও অমিতাভকে দেখিয়ে)। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। (অমিতাভকে দেখিয়ে)।
এখানেও মানুষজনের ক্ষতি কি বুঝতে চাইছি, ওদের দুবেলা খাবার শিবিরে পাচ্ছে, কিন্তু আরও প্রয়োজন আছে। অনেকে এক কাপড়ে চলে এসেছেন, অনেকের নিত্য ওষুধ দরকার। মেডিক্যাল ক্যাম্পের কথা হচ্ছিল, কিন্তু সেক্ষেত্রে গেদারিং-এর ব্যাপার আছে, এখন তা সমস্যার। প্রশাসনের অনুমতি দরকার। এইসব নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা।
পলাশ- কথা বলে কি হবে? শুভ প্রতিম বাবু, আপনাদের পারপাসটা কি?
শুভ- বললাম তো কয়েকবার, কথা বলে বোঝা ওদের সমস্যাটা কি? এটা আমাদের কাজ। এই যেমন মেডিক্যাল ক্যাম্পের প্রস্তাব। মেয়েদের শালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি দেওয়ার প্রস্তাব।
অমিতাভ- আপনারা যদি আমাদের রিপোর্ট দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন আমরা কি করি। কোন প্রোভকেসনের কাজ আমরা করিনা।
পলাশ- আপনারা যে বলছেন, তার প্রমাণ কি? দেখুন আপনারা বোকা নন, আমিও বোকা নই। এটা সেন্সেটিভ ইস্যু। গ্রুপ থিয়েটার এসে ভুলভাল, একটা রিউমার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করে, যাদের এগেন্সটে আমরা ১৭ টা কেস করেছি। অভিযোগ, স্প্রেডিং অফ ফলস ইনফর্মেশন। প্রচুর লোক বলেছে, আর ওদের এগেন্সটে যথাসম্ভব আমরা কেসেস স্টার্ট করেছি। এটা এমন কোন বিশেষ এলাকা নয় যে আপনারা আমপানের মত এসে কিছু করবেন। এটা ভেরি কমুন্যালি সেন্সেটিভ এরিয়া। বহুবছর ধরে সেন্সেটিভ এরিয়া। তারপর আপনারা যে বললেন, এখানে ১৪৪ ধারা নেই, আমরা আসতে পারি, এটা আপনাদের ভুল। তাহলে এখানে একমাস আমরা ডিউটি করতে আসতাম না। তাই জানতে চাইছি আপনারা কেন এসেছেন? এই আপনারা ফটো তুললেন, তারপর কোথাও পাঠিয়ে দিলেন তখন?
অমিতাভ- আমরা মিডিয়া নই।
শুভ- যেমন ভাটপাড়া, সেখানে দাঙ্গা পীড়িতদের জন্য আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাচ্ছি, কলকাতার দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সহায়তায়। এখন লকডাউন বলে অবশ্য বন্ধ। সেখানে আমরা প্রশাসনকে জানিয়েই সেসব করেছি।
পলাশ- দেখুন এখানে আলাদা। আপনারদের মনে হলো না যে থানার পারমিশান নেওয়া দরকার।
শুভ- দেখুন এখানে ১৪৪ ধারা লাগু নেই, আমাদের মনে হয়নি অনুমতি নিতে হবে।
অমিতাভ- রিলিফের ব্যাপারে যদি কিছু করা হতো, আপনাদের কাছে আসতাম।
পলাশ- আপনারা ঢুকছেন, আপনাদের মনে হলো না একবার বড়বাবুকে জানাই, যে 'স্যার আমরা এনকোয়ারি করবো'। আপনাদের মনে হলো না?
শুভ- দেখুন মানুষ যখন ডাকছে, তারা কথা বলতে চাইছে, তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন...
পলাশ- কে ডেকেছে?
শুভ- ওই যে বললাম, ইস্কুলের মাস্টার, এলাকার সমাজসেবী, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, আপনারা না জানলেও, আমাদের পরিচিতি আছে যেহেতু আমরা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিয়ে কাজ করি।
পলাশ- মনে করলেন না বড়বাবুকে জানানো উচিত? আপনি জানেন না আপনারা কোন বিপদে আছেন। (সজোরে) আই অ্যাম ট্রাইং টু হেল্প ইউ।
শুভ- থ্যাংকস ফর দ্যাট।
পলাশ- ডোন্ট ট্রাই টু জাস্টিফাই।
শুভ- নো উই ডিডনট জাস্টিফাই আওয়ারসেল্ফ। আমরা আমাদের কাজ করেছি মাত্র।
পলাশ- ১৮ নম্বর কেসে আমরা আপনাদের এগেন্সটে বলবো।
শুভ- (হেসে) তা আপনি করতে পারেন।
পলাশ- আপনাদের ভালোর জন্য বলছি, আর আপনি বলছেন? আপনাদের বিরুদ্ধে কেস করবো। এখানে ইনভেস্টিগেসান করতে এসেছেন, ফটো তুলেছেন, কথা বলেছেন, দেখাবো আপনাদের কি করতে পারি? জানেন আমরা কি করতে পারি? আপনাদের বিরুদ্ধে কেস করবো।
শুভ- আমাদের যা বলার আমরা বলেছি, আপনি যা করার করুন।
কিছু ক্ষণ বাদে, আবার-
পলাশ- আপনারা ভাবেন কি, আপনারা হিউম্যান রাইটস আছেন বলে আপনারা যা ইচ্ছে করতে পারেন, একটা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে...
কৌশিক- আপনাদের কি এন এইচ আর সি’র আপ্রুভ আছে?
শুভ- এন এইচ আর সি’র আপ্রুভ আবার কি?
কৌশিক- স্টেট হিউম্যান রাইটস-এর আপ্রুভ আছে?
শুভ- আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে এন এইচ আর সি’কে জানাই।
পলাশ- সে তো যে কেউ জানাতে পারে।
শুভ- ঠিকই।
কৌশিক- আপনাদের কোন এফিলিয়েশান আছে এন এইচ আর সি-র?
শুভ- ওরকম কোন এফিলিয়েশান হয় না। ‘আমরা’ একটি রেজিস্টার্ড বডি, আমাদের কাজের ক্ষেত্রর মধ্যে মানবাধিকার আছে, ক্ষেত্র গবেষণা আছে। আমরা পিস (শান্তি) নিয়ে কাজ করি।
অমিতাভ- আমাদের রেজিস্ট্রেশান আছে।
কৌশিক- আপনারা একটি রেজিস্টার্ড অরগানাইজেশান?
অমিতাভ- অবশ্যই।
পলাশ- (কর্কশ গলায়) যেখানে ঝামেলা হয়, সেখানে আসতে গেলে অনুমতি নিতে হয়, permission of the local authority.
কৌশিক- ছবি তুলতে গেলেও অনুমতি নিতে হয়। সাধারণ মানুষকেও।
শুভঙ্কর- আমরা মিডিয়ার লোক নই।
কৌশিক- তাহলে তুলছিলেন কেন? মিডিয়াকেও নিতে হয়। আপনারা ছবি তুলছিলেন কেন? What is the purpose of video?
শুভ- মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই ভিডিও তোলা হচ্ছিল। এটাই purpose.
শুভঙ্কর- দোকানটা ভাঙচুর হয়েছে, এটা দেখাচ্ছিলেন। তাও পুরোটা নেওয়ার আগেই আপনারা চলে এলেন।
কৌশিক- আমরা দেখবো, আপনারা কি শুট করেছেন।
শুভঙ্কর- অবশ্যই।
কৌশিক- কি উদ্দেশ্য ছিল ছবি তোলার।
শুভঙ্কর- দেখুন আমি ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফার। এই রিসার্চ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখানে এসেছি।
কৌশিক- কিসের রিসার্চ?
শুভঙ্কর- কিসের রিসার্চ তা বলা হয়েছে। আমরা এখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলে কিছু ত্রাণ দেওয়ার বিষয়েও ভাবনাচিন্তা করছিলাম। আর তাই ছবি তোলা হচ্ছিল।
কৌশিক- কিসের ত্রাণ?
শুভঙ্কর- কিসের ত্রাণ তাও আপনাকে বলা হয়েছে, উনি (শুভ প্রতিম) যা বলেছেন তাই।
কৌশিক- আপনাদের উদ্দেশ্য কি? কি করতে চাইছেন?
আমিতাভ- আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে চাইবো।
কৌশিক- এখন কি করে সম্ভব?
অমিতাভ- হ্যাঁ, এইজন্য প্রশাসনের অনুমতি নিতে হলে নেবো। আমরা জামাকাপড়ও দিতে চাই। আমরা কিনেছি জামাকাপড়।
কৌশিক- ওইসব দিতে গেলে আপনাদের লোকাল থানায় পারমিশান নিতে হবে। কিন্তু আজ এসেছিলেন কেন বুঝতে পারছি না।
ফারুক- আপনাদের অনেকবার বলা হয়েছে।
কৌশিক- এসে শুধু একশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
শুভ ও ফারুক- না আমরা সকলের সঙ্গেই কথা বলতে চাই, বলেছিও।
শুভ- শাস্ত্রী স্কুল, যেখানে দাঙ্গা ...।
কৌশিক- আপনারা এসেছিলেন বলে ক্রাউড অ্যাসেম্বেল হচ্ছে, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং ভায়োলেট হচ্ছে, সোশ্যাল গ্যাদারিং হয়েছে, লকডাউন ভায়োলেট হচ্ছে বলে আপনাদের আগেন্সটে কেস করবো।
শুভ প্রতিম- করুন।
পলাশ- ওদের ডিটেলস নিয়ে নিন (কৌশিক বাবুকে নির্দেশ)। কটা ক্যামেরা আছে আপনাদের কাছে (শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে)?
শুভঙ্কর- দেখুন, ক্যামেরা আছে, কিন্তু ছবি কিচ্ছু নেই। আমরা তখন কিছু শুরু করিনি (ফটোগ্রাফি)। সবে ক্যামেরা বের করেছি, আপনারা বাধা দিয়েছেন।
এরপর ক্যামেরা থেকে ডিস্ক খোলা হয়, পলাশ বাবু তা ল্যাপটপে দেখেন।
শুভ প্রতিম- আমাদের নাম, ধাম কে নেবেন?
তপন নামে কাউকে উচ্চস্বরে ডাকেন পলাশ বাবু। বলেন আমাদের কাছে থেকে কার্ড নিতে। এরপর ওনারা দুজন আমাদের উক্ত চেম্বারে বসিয়ে রেখে বাইরে যান। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসেন উভয়েই, শুরু হয় একে একে আমাদের নাম-ধাম লেখা। কে কি করেন, এই প্রসঙ্গে অমিতাভ জানান তিনি একটি কলেজে পড়ান ইত্যাদি। এই পর্ব শেষ হলে কৌশিক বাবু বলেন, আপনাদের বসতে হবে, এখানের ইনচার্জ অতনু মাজি জানাবে আপনাদের কি করতে হবে, কখন যাবেন।
আমাদের চেম্বারের বাইরে বসতে বলা হয়। আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর, অতনু মাজি আসেন, তিনি বলেন,
অতনু মাজি- আমরা জেনেছি আপনারা কারা। আপনাদের বিষয়ে একাধিক ফোন আসে। আসলে আমাদের এগুলো করতে হয়।
আমরা- বুঝলাম। তাইবলে আমাদের এতক্ষণ বসিয়ে রাখবেন, আমাদের কাজে একরকম বাধা দেওয়া হলো। আমরা তো মানুষের সঙ্গে কথা বলতেই পারি।
অতনু মাজি- হ্যাঁ বুঝেছি। ঠিক আছে, আপনাদের কোন সহযোগিতা লাগলে জানাবেন।
আমরা- ধন্যবাদ। আমরা কি এখন যেতে পারি?
অতনু মাজি- হ্যাঁ।
উল্লেখ্য আমরা তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে আমাদের বেআইনি আটক এবং গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়ার প্রেক্ষিতে চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটকে ঘটনার পরদিন, ১১ জুন, ২০২০ তারিখে অভিযোগ দায়ের করি। আমরা জানাই ওই এলাকায় যাবার জন্য পুলিশের অনুমতি নেওয়ার পুলিশি দাবি সম্পূর্ণ বেআইনি একটি দাবি। আমরা এই এলাকায় সংঘর্ষের স্বরূপ বুঝতে আমাদের সংগঠনের নীতি অনুসারে ক্ষেত্র গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে চাই, তা যেন নির্বিঘ্নে করতে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও জানানো হয়।
১৩ জুন, ২০২০ আমরা’র পক্ষ থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের এবং মানবাধিকার কর্মীদের কাছে অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকদের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার আর্জি জানিয়ে অভিযোগ জানানো হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এই অভিযোগ পত্র গ্রহণ করে (DIARY NUMBER- 7817/IN/2020)।
যা হারালাম গঙ্গাপারে
আমরা, এক সচেতন প্রয়াস-এর তরফে তেলিনিপাড়া অঞ্চলে সংঘর্ষ পরবর্তী তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে এক বিচিত্র জনবিন্যাসকে আমরা দেখেছি। ভিক্টরিয়া বা গোন্দোলপাড়া জুটমিল সংলগ্ন শ্রমিক মহল্লায় কুরমালী ভোজপুরীর মতো আঞ্চলিক হিন্দি ভাষী গরীব মানুষ, ঐতিহ্যগতভাবে উর্দুভাষী (অধুনা হিন্দিভাষী) সম্পন্ন মুসলিম,বা দরিদ্র হিন্দি-উর্দুভাষী মুসলিম, খাটাল ব্যবসায় যুক্ত বড়ো সংখ্যার হিন্দিভাষী গোয়ালা, দর্জির কাজে যুক্ত বা ছোট অস্থায়ী চাকরী করা হিন্দু বা মুসলিম মানুষ- যারা অধিকাংশই প্রায় তিন প্রজন্মের বেশি এখানে কাটিয়ে ফেলেছেন। আর অদ্ভুত ভাবে স্থানীয় মানুষের মুখে একটি ভাগ করা করি চালু আছে, হিন্দু, মুসলিম আর বাঙালি। শ্রমিক মহল্লার বাইরে জি টি রোডের উপরে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, চাকুরীজীবী বাংলাভাষীরাই- ‘বাঙালি’। তারা অতীত থেকেই হিন্দিভাষী দলিত হিন্দুদের থেকে আলাদা রয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে সংঘর্ষের হেতু খুঁজতে গেলে জনবিন্যাস আর সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে না বুঝলে অনেকটাই না বোঝা থেকে যাবে।
হুগলী নদীর তীরের অবস্থিত চন্দননগর,ভদ্রেশ্বর,চাঁপদানী, রিষড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটির মতো জনপদগুলিতে সুদূর অতীত থেকেই জলপথের সুবিধার কারণে ডাচ, গ্রীক, জার্মান, ফরাসী, পর্তুগিজ, দিনেমার(ডেনমার্কের বণিকদের স্থানীয় উচ্চারণে 'দিনেমার' বলা হতো) ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকদের আগমনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে প্রভাবিত হয়। বাংলার মুসলমানি আমলে বড়ো অংশ অবাঙালী মুসলিম প্রথমে ভদ্রেশ্বরে পরে অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসবাস করতে থাকে। স্বাধীনতার আগে ও পরে এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষমতা আস্তে আস্তে করায়ত্ত করে সাহু, তেওয়ারী,আগরওয়ালরা। জলপথে কাঁচামাল পরিবহনের সুবিধার জন্য অবিভক্ত নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার পাটের উপর ভরসা করে গড়ে ওঠে চটকলগুলি। মিলগুলিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে গরীব ও দলিত মানুষেরাও আসেন দলে দলে ,নদী তীরবর্তী মিল লাগোয়া অঞ্চলে বসতি ,শ্রমিক মহল্লা গড়ে ওঠে, এখানে যাকে লাইন বলা হয়। প্রসঙ্গত, ১৮৭২ সালে চাঁপদানীতে (ওম্যালি সাহেব,হুগলী ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার) এবং মতভেদে ১৮৫৫ সালে রিষরায় জর্জ অকল্যান্ড (হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, সুধীর কুমার মিত্র, ১৯৪৮) বাংলায় প্রথম চটকল প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে দেখেছি অ্যাঙ্গাস, ভদ্রেশ্বর, ভিক্টরিয়া, গোন্দোলপাড়া এই চারটি উল্লেখযোগ্য জুটমিল, যেখানে উপদ্রুত অঞ্চলের শ্রমিকরা কাজ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাম শ্রমিক আন্দোলনের অনেক সক্রিয়তার সাক্ষী হুগলী তীরের জুটমিলগুলো, কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরে তথ্যানুসন্ধান গিয়ে ‘আমরা’ দেখেছে শ্রমিক মহল্লার নূন্যতম জীবনধারণের সুবিধাগুলোর দিকে লেঅফ, ছাঁটাই, মজুরীবৃদ্ধি ইত্যাদি ইস্যুতে ব্যস্ত থাকা মজদুর ইউনিয়নগুলো ফিরেও তাকায়নি, ভদ্রেশ্বর পুরসভাও তাকায়নি। পানীয় জলের সমস্যা, স্বাস্থ্যের সুরক্ষার মতো বিষয়ে কথা উঠলে ধর্ম নির্বিশেষে মহল্লার বাসিন্দারা ক্ষোভ জানিয়েছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্যপরিসংখ্যান সূত্র দেবে যে অতীতে শ্রমিক মহল্লাগুলিতে বারবার জলবাহিত বা জীবাণু বাহিত সংক্রমক অসুখ ছড়িয়েছে। নদী পারাপারের ঘাট সংস্কার নিয়ে কথা উঠতে সাম্প্রতিক অতীতে তেলিনিপাড়া ঘাটের দুর্ঘটনার কথাও উঠে আসে।
কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন-
১) প্রথমেই প্রশ্ন থাকবে চন্দননগর,ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানি কি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নতুন দেখছে? উত্তর না। তথ্যানুসন্ধানের কাজে যুক্ত ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর এক স্থানীয় সহকর্মী যেমন জানালেন ২০০৫ সালে তার কৈশোরে তিনি এলাকায় সংঘর্ষের কারণে ৪ মাস কারফিউ দেখেছেন, তেমন রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মীর স্মৃতিতে উঠে এলো যুক্তফ্রন্টের আমলে দাঙ্গা বাধতে তৎকালীন পুলিশ মন্ত্রী জ্যোতি বসু এলাকায় দাঁড়িয়ে ‘দেখামাত্র গুলি’-র আদেশ দিয়েছিলেন। বোঝায় যাচ্ছে দাঙ্গার এক ধারাবাহিক ইতিহাস আছে চন্দননগর-ভদ্রেশ্বর-চাঁপদানিতে।
২) তেলেনিপাড়ার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা উঠছে যে, এটা তেলিনীপাড়া অঞ্চলে শুরু হলেও চন্দননগর উর্দিবাজার থেকে ভদ্রেশ্বরের আরও কিছু জায়গায়ও বিক্ষিপ্তভাবে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই একে ‘তেলিনিপাড়া দাঙ্গা’ বলা হবে কিনা? বা আদৌ ‘দাঙ্গা’ বলা যাবে কিনা? যদিও সাধারণ ও ব্যবহৃত শব্দের দিকেই আমরা আস্থা রেখেছি। মুখোমুখি দুই সম্প্রদায়ের সশস্ত্র সংঘর্ষ প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। প্রাণহানি, বা যৌন অপরাধ যা দাঙ্গার দুটি সার্বজনীন লক্ষণ তাও ঘটেনি, তবে ঘটেছে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তিহানি, আর অপরপক্ষকে সন্ত্রস্ত করা, এবং স্থানচ্যুত করার উদ্দেশ্যে ভয় এর পরিবেশ বজায় রাখা। আহতের তথ্য আমরা জেনেছি, কিন্তু ‘অনেকে আহত হয়েছেন’-এই তথ্যর সত্যতা জানা যায়নি।
৩) বেছে বেছে বাড়ি, দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজাবাজার অঞ্চলের হিন্দু পরিবারগুলি, বা দিনেমারডাঙার সারি দিয়ে পুড়ে যাওয়া মুসলিম বাসিন্দারা, সবাই জানাচ্ছেন অন্য সম্প্রদায় তাদের উচ্ছেদ করে দিতে চায়, তাই আবারও যেকোনও দিন হামলা হতে পারে। অতীতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দেখলেও মূলতঃ মুসলিমরা জানান এতোটা পরিকল্পিত ও সংগঠিত আক্রমণ তারা এর আগে দেখেননি।
সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। 'আমরা এক সচেতন প্রয়াস' কালিয়াচক থেকে ধুলাগড়, বসিরহাট থেকে রাণীগঞ্জ আসানসোল, বা অতি সম্প্রতি গঙ্গার এপার ওপারে ভাটপাড়া ও তেলিনিপাড়ায় ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের নিবিড় তথ্যানুসন্ধানের কাজ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার একটা প্যাটার্ন বা ধাঁচা, ছক খুঁজতে চেয়ে যেটা সবচেয়ে বেশী চোখে পড়েছে তা হলো পলিটিক্যাল রিলিজিওন বা রাজনৈতিক ধর্মের রিভাইভ্যাল বা নবোত্থান, যা গোটা দেশের গত একদশকের পালাবদলেরই সমান্তরাল। ‘আমরা’ একটি বাক্যে যার নির্যাস টানে ‘হিন্দু আরও হিন্দু হয়েছে, মুসলমান আরও মুসলমান’। তেলিনিপাড়ার ক্ষেত্রেও ছবিটা একই, হুগলী পাড়ের চটকল অর্থনীতি নির্ভরশীল জনপদ দাঙ্গা আগেও দেখেছে বারবার। দলিত হিন্দু আর গরীব মুসলিম পাশাপাশি থেকেছে, ‘পার্থক্য’ নিয়েই, অসূয়া সংঘর্ষে গড়িয়েছে আবার রুটি রুজির নৈমিত্তিক সমস্যায় তা থিতিয়েও গেছে। কিন্তু লাগাতার রাজনৈতিক ইন্ধন এবারের ছবিটায় নতুন কিছু উপাদান যোগ করেছে, ‘আমরা’ এটাকে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হিসেবেও দেখছে। সহাবস্থানের যুক্তিকে যেখানে অসহিষ্ণুতার যুক্তি পর্যুদস্ত করে ফেলছে।
‘আমরা’-র তথ্যানুসন্ধানে উঠে আসা স্থানীয় বাসিন্দাদের মৌখিক অভিযোগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা আর মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো সংঘর্ষ ক্ষয়ক্ষতির ছবি, রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতি - এসব আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় গত বছরে প্রায় একই ধাঁচে ঘটনা ঘটেছিলো নদীর ওপারে নৈহাটি ভাটপাড়ায়। বাইরে থেকে সশস্ত্র বহিরাগতদের জড়ো করা, ঘর দোকান বেছে বেছে লুঠ, সংগঠিত আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ,রাজনৈতিক নির্দেশে পুলিশ ও দমকলের রাশ টেনে রাখা,ঘটনাস্থলে দেরীতে পৌঁছনো, থানায় অভিযোগ না নিতে চাওয়া, দাঙ্গা ঠেকাতে সক্রিয় না হওয়া, অলিখিতভাবে প্রশাসনের মধ্যে রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ হয়ে যাওয়া-এসব আসন্ন বিধান সভা নির্বাচনের আগে বারবার সংঘর্ষ ঘটার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে, এবং অতীতের তুলনায় নির্দিষ্ট ভাবে পার্থক্য চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ বসিরহাটের ক্ষেত্রে নমঃশুদ্র ও পৌন্ড্রক্ষত্রিয়দের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ক্রবর্ধমান সক্রিয়তা যেভাবে লক্ষ করা গেছে, সেভাবেই ভাটপাড়া ও তেলিনিপাড়ার ঘটনায় হিন্দিভাষী দলিত হিন্দুদের মধ্যে অসূয়া ও আগ্রাসন রোপন করা হচ্ছে। রাণীগঞ্জ আসানসোলের তথ্যানুসন্ধানের সময়ও দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রামনবমীকে কেন্দ্র করে নতুন ‘পরিকল্পিত আগ্রাসন’-এর দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। বলেছেন রামনবমীর জুলুস মিছিল বহু বছর ধরেই স্বাভাবিক ধর্মীয় আচরণ হিসেবে দেখেছেন তারা কিন্তু সম্প্রতি তার বদলে যাওয়া চেহারা তাদের ভয় ধরাচ্ছে। ‘আমরা’ খতিয়ে দেখেছে, লুঠ, আগুন লাগানো, অন্য সম্প্রদায়কে এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার ভয় দেখানো- এগুলো ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছে। গোটা রাজ্য জুড়ে ছোট ছোট মাত্রার দাঙ্গা ঘটিয়ে চলা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। তেলেনিপাড়ার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী মানুষ ‘আমরা’কে জানিয়েছেন এবারের দাঙ্গা দেখে তাদের মনে হয়েছে ‘এত বছর থেকেছি, কিন্তু আর বোধহয় থাকা যাবে না, চলে যেতে হবে’। কোথায়? তারা জানেন না কোথায়। ‘আমরা’ টের পেয়েছি, হয়তো সত্যিই উচ্ছেদ লক্ষ্য নয়, সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ভীত সন্ত্রস্ত এক সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’-র কুঁকড়ে থাকা নাগরিকে পরিণত করা। আর অগ্রাসী ধর্ম সাংগঠনিক ভাবে নিজের অনুগামীদের আত্মবিশ্বাস দিতে চায়, কাজ না থাকা যুবকদের ঝিমিয়ে পড়তে না দিয়ে ‘দাঙ্গা’র নেশায় ডুবিয়ে রাখে। যুবকদের অনেকের রিংটোনে রামকে নিয়ে অধুনা প্রচলিত ঝংকার সমৃদ্ধ গান। তেলিনিপাড়াতেও অভাব বেরোজগারী ভোলাতে পরিচিত রাস্তাই বেছে নেওয়া হয়েছে।
(খ) সামাজিক (ও সমাজ-মনের), রাজনৈতিক (ও প্রশাসনিক) চিহ্নগুলি
১। প্রাচীর দীর্ঘ ও মজবুত হচ্ছে। দাঙ্গাগ্রস্ত পাইকপাড়া এলাকায় ত্রাণ শিবির করা হয়, দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই আসেন। আরও কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয় দুই সম্প্রদায়ের মন বুঝতে, কাছাকাছি আনতে। বলা যায়, প্রাচীরে ফাটল ধরানো এখনও দূরের নক্ষত্র।
২। লকডাউন পর্বে, করোনা অতিমারির ঘোর দুর্দিনে এই সাম্প্রদায়িক অশান্তি। করোনাকে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের রক্তাক্ত নজির। বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের এবারের সাম্প্রদায়িকতায় শামিল হওয়া। শ্রমিক বস্তিগুলোতে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের শূন্যতা। সূচক একাধিক।
৩। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব হিন্দু ও মুসলমান শিবিরে বিভক্ত। অর্থাৎ হিন্দু নেতা হিন্দুদের হয়ে, মুসলিম নেতা মুসলিমদের হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভাজনে, হিংসায় শরিক হয়েছে। আরএসএস-এর উপস্থিতি যতটা না প্রকট তার চেয়ে বেশি প্রকট সমাজমনে হিন্দুত্বের উপস্থিতি। সংগঠিত আক্রমণ, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরএসএস মাথা কাজ করছে, তেলেনিপাড়ার বাতাসে বারুদের গন্ধ প্রকট।
৪। গঙ্গার দুইপারের বিজেপির দুই সাংসদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রশ্নাতীত। অথচ তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোন আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইনি বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা কোন দলীয় তদন্তের কথা জানা যায়নি তৃণমূলের অভিযুক্ত কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। ঘৃণা ও সন্দেহ ছড়ানোর দায়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কোন গ্রুপের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধের কোন ধারা প্রয়োগের খবর নেই। যদিও প্রায় এক পক্ষ কাল এই অঞ্চলে বন্ধ করা হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা।
৪। প্রশাসনের ‘দাঙ্গা করতে দেওয়া’, বিভিন্নভাবেই স্পষ্ট হয়েছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করতে হলে মিথ্যা প্রচার, উত্তজনা, দাঙ্গা দরকার হবে। এটি ঘটমান বর্তমান।
৫। হুগলী নদীর দুই পার (এবং সারা রাজ্যেই) ধরে বিগত চার বছরে উৎসব, পূজাপার্বণ-এর বৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নজরে আসে। উৎসবের সার্বজনীনতার, জৌলুসের পাশাপাশি রাজনৈতিক ধর্মের উত্থান ঘটে চলেছে। মিশ্র জনবসতি এলাকায় এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রতিযোগিতা। বারুদ মজুদ থাকলে একটা দেশলাই যথেষ্ট।
৬। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিক হয়ে হিন্দি বলয়ের শুরু। শেষ হয়েছে, রাজস্থানে। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দুত্বের সামাজিকীকরণ প্রায় সম্পূর্ণ। পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ, শরিয়তি ইসলামের সামাজিকীকরণ সেখানেও প্রায় সম্পূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ক্রমে সংঘর্ষের চিহ্নগুলি ফুটে উঠেছে। সমাজ হস্তগত হলে, রাজনৈতিক ধর্মের জয় হাসিল করা সহজ হয়ে ওঠে।
সমাপ্ত
সংঘর্ষ সমীক্ষার উপর এত বিশদে অথচ বিশ্লেষণ-ধর্মী প্রতিবেদন খুব কম পড়েছি। 'মানবিকতা' ছাড়া অন্য কোন আদর্শের প্রতি অনুগত না থাকলেই এমন প্রতিবেদন লেখা যায়। 'আমরা,এক সচেতন প্রয়াস'-কে কুর্নিশ।