পাথরগুলোতে দুইহাতের ভর রেখে হাঁচড় পাঁচড় করে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা উঠে একটা ন্যাড়া চাতাল মত পেয়ে এলিয়ে বসে পড়ে জিভ বার করে হ্যা হ্যা করে খানিকক্ষণ হাঁপাল মঙ্গলা। একটু ধাতস্থ হতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল দলের আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না ধারেকাছে, এই চাতালের মত জায়গাটা হবে তা প্রায় আধা কিলোমিটার লম্বা। ঘাসটাস তেমন কিছু নেই, ন্যাড়া ম্যাটম্যাটে লালচে এবড়ো খেবড়ো জমি আর দুই দিকেই খাড়া উঁচু পাহাড়। আধা কিলোমিটার পরে দেখা যাচ্ছে চাতাল বা রাস্তাটা একেবারে বাঁই করে ঘুরে গেছে। এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে দুইদিকের পাহাড়দুটো যেন মুখোমুখী এগিয়ে এসেছে একটা আরেকটাকে জড়িয়ে ধরবে বলে। পিঠের বস্তারমত ব্যাগটা আরেকটু কাছে টেনে জলের বোতল বার করে একঢোঁক জল খায় মঙ্গলা তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার ধপাস করে বসে পড়ে। নাহ হাতেপায়ে যেমন ব্যথা তেমনি ঝিঁঝি ধরে অবশভাব। একঢোঁক জলে গলাও ভেজে নি তেমন। পা ছড়িয়ে টান করে আস্তে আস্তে হাঁটুর নীচে থেকে কিছুক্ষণ টেপার পর সাড় ফিরল। আরো এক ঢোঁক জল খেয়ে আবার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে মঙ্গলা। দলের লোকজন এতক্ষণে কোথায় চলে গেছে কে জানে! এতবড় গতরখানায় ওর শক্তি সামর্থ্য নেহাৎ কম নয়, এলাকার লোকে একবাক্যে বলে ‘মঙলার আমাদের যেমন টেরাকের মতন গতর তেমনি ক্ষ্যামতা। এক দুটো যজ্ঞিবাড়ির কাজ ও একাই উতরে দিতে পারে।’ তা সত্যিই পারে অবশ্য ও। খান পঞ্চাশেক থালা বাসন মেজে ফেলা কি ডেকোরেটারের বড় বড় কড়াই, ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে একা একাই নামানো এসব ওর গায়েই লাগে না, কিন্তু এই খাড়াই পাহাড়ে উঠতে একেবারে দম বেরিয়ে যাচ্ছে।
বাঁকের কাছে এসে দেখা গেল মুখোমুখী পাহাড় দুটো যে একেবারে সামনে এগিয়ে এসেছে তা নয়, আসলে ওখেনটায় একটাই পাহাড়, নীচে দিয়ে একজন মানুষ যেতে পারে এইটুকু ফাঁক কাটা আর পাহাড়ের মাথাও এমন নেমে এসেছে যে একজন মোটামুটি খাড়াইয়ের লোকও হেঁটে পেরুতে পারবে না, হয় বুকে হেঁটে নয় হামাগুড়ি দিয়ে পেরোতে হবে। অমন সুড়ঙ্গের মত জায়গাটা একলা একলা পেরুবে, আগে পাছে কেউ নেই ভেবে মঙ্গলা একটু দমে গেল। মনে মনে একটু দুঃখমতও হল, দলের লোকেরা এমন একটা জায়গাতেও ওর জন্য একটু দাঁড়াল না গো! সুড়ঙ্গটা বেশ বড়ই বলতে হবে। অনেক দূরে একটা বিন্দুর মত আলো দেখা যাচ্ছে, ওইটেই তাহলে বেরোবার মুখ। যদি ভেতরে সাপ থাকে? এত উঁচুতে কি সাপ হয়? নাহ সাপ তো শীতের দিনে ঘুমোয়, এখানে যা ঠান্ডা, সাপ থাকলেও ঘুমিয়ে থাকবে তবে – উবু হয়ে বসে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে গিয়ে মঙ্গলা বোঝে পিঠের ব্যাগ নিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া যাবে না, ব্যাগটা আটকে যাবে। বুকে হেঁটে পিঠে ব্যাগ নিয়ে গেলে মাঝখানে আটকে যায় যদি! হাত ধরে টেনে বা ব্যাগটা ধরে দেবার মত কেউ নেই, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে শেষে ব্যাগ থেকে দড়ি বের করে হাতের সাথে আলগা করে বেঁধে ব্যাগটা আগে ঠেলে দিয়ে পেছনে নিজে বুকে ঘষটে ঢুকে পড়ে। ভেতরে নিয়মিতই লোক চলাচল হয় সম্ভবতঃ, অথবা দলের লোকেরা গেছে তাই বেশ পরিস্কার আর মসৃণ, পাথরের দেওয়াল জায়গায় জায়গায় ভিজে স্যাঁতসেতে, কেমন শ্যাওলাটেও বোধহয়, হাতে লাগে পিসলা পিসলা। সিকিভাগ এগিয়েই মনে হয় এই বুঝি পাহাড় নেমে এলো পিঠে, মাটির নীচে কাঁপছে যেন, ও কিসের আওয়াজ না গুমগুম করে - নাহ শুধুশুধু ভয় পেয়ে যাচ্ছে, ভয় পেলে চলবে না, ওকে ঐ আলোমুখে পৌঁছাতেই হবে। কিছু না, এই তো শেতলার থানে দন্ডী কাটার মতন। এই তো এবচ্ছরও শেতলাপুজোর সময় দন্ডী কেটেছে। তা ওদের ওখেনে শেতলাপুজোর সময় কত দূর দূর থেকে লোক আসে, খুব জাগ্রত ঠাকুর, যে যা মানসিক করে ঠিক পেয়ে যায়।
মঙ্গলার মানসিকও তো পূর্ণ হয়েইছিল, বিয়েটা পাকা হয়েছিল দেখেই না ও দন্ডী কেটে শোধ দিল। নাহলে এই কত বচ্ছর যাবৎ কম কথা শুনেছে নাকি? মা তো উঠতে বসতে ‘গতরখাকী, অমন গতর দেখে কোনও ছেলে ধারে ঘেঁষবেনে। দুবেলা ভাতের থালাটে নিয়ে বসিস ক্যানে, লজ্জাহায়া নাই তোর?’ ওদের করাতীপাড়ার ছেলেগুলো অবশ্য ওকে শুনিয়ে তেমন টোন কাটে নি, কিন্তু পাড়া থেকে বেরোলেই তো ‘ঐ দ্যাখ ট্রাক আসছে, ১৬ চাকার ট্রাক। চল ট্রাকে উঠি।’ মাঝে মাঝে ওর হাইওয়েতে উঠে ট্রাকের নীচে মাথা দিতেই ইচ্ছে হত। অথচ ছোটবেলায় যখন লম্বাটম্বা ছিল, ভাল দৌড়াতে পারত বলে প্রাইজ টাইজ পেত তখন নিজের চেহারার জন্য একটু একটু গর্বই ছিল। তারপর তো বারো না পুরতেই বুকদুটো পুরন্ত হয়ে গেল, মাথায় আরো খানিক লম্বা হল, হাড়গুলো এমনিই চওড়া, তাতে গত্তি লেগে বেশ হাইঁয়ে পাঁইয়ে একটা গতর হল, রাস্তায় পাঁচটা লোক ঘুরে তাকাত, কেউ দু’কলি গান ভাঁজত তো কেউ চোখে ইশারা করত তখন সত্যি কথা, মঙ্গলার এমনি বেশ ভালই লাগত। এদিকে আবার ক্লাসের আর পাঁচটা মেয়েরও আস্তে আস্তে চেহারাছবিতে বদল আসা শুরু হল। এর মধ্যে ফার্স্ট গার্ল সুমতি ধাড়ার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারত না কেউ। রোগাটে পাতলা গড়ন, চোখালো নাক আর ঝিকমিকে চোখ নিয়ে সুমতি পাড়া বেপাড়ার প্রায় সক্কলের চোখের মণি হয়ে উঠল। সুমতির মা মঙ্গলাকেই ভার দিলেন সুমতির পাশে পাশে থেকে খেয়াল রাখতে যাতে কেউ ওর কোন ক্ষতি না করতে পারে। তা সুমতির গায়ে গায়ে ঘুরতেও মঙ্গলার বেশ লাগত। শহরে থেকে কলেজে পড়তে চলে যাবার সময় সুমতি কেঁদেছিল ‘মুঙলি তোকে ছাড়া আমি একলা একলা ঘুরব কেমন করে?’ ওর বুকের মধ্যে কেমন উথালপাথাল করে উঠেছিল - আলতো করে মুখটা ধরে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিল, বড় ইচ্ছে হয়েছিল সুমতির বুকে একবার মাথাটা রাখে।
মঙ্গলা নিজেও পড়াশোনায় খুব খারাপ ছিল না, ফেল টেল কোনদিন করে নি, একচান্সেই উচ্চমাধ্যমিক অবধি পাশ করে গেছে। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে পি ডিভিশান পাওয়ায় কাছের কলেজে পাসকোর্সেও চান্স পেল না, যেতে হত জেলাসদরের কলেজে। তা দাদা সে কলেজ থেকে ফর্ম তুলতেই দেয় নি, ‘অমন গতর দেখিয়ে দেখিয়ে অদ্দূরে পড়তে যাবার কোনও দরকার নেই।’ মা বলল বড়োছেলেকে ‘এবারে বুনের বিয়ে দ্যাখ বাবা, ওকে পার করে তোর বিয়েটা দেব।’ মঙ্গলা বাড়ি বসে মাকে রান্নাবান্না ঘরের কাজে সাহায্য করতে লাগল, সাথে পাড়া বেপাড়ার কটা জামা পাজামা সেলাই, উলের জামা বানানোর অর্ডারও নিতে লাগল। সেই আজ আট বচ্ছর কোথায় বিয়ে কোথায় কি! কতজনা এসে মায়ের বানানো কচুরি, মিষ্টি, রাধাবল্লভী আলুর দম খেয়েদেয়ে কেউ ‘পরে খবর দেব’ বলে চলে গেছেন কেউ আবার সরাসরি চেহারার খোঁটা দিয়ে এমন হাতীর মত মেয়ে পার করতে কদ্দুর কি খরচাপাতি করতে পারবে সেসব খবর নেবার চেষ্টা করেছেন। মঙ্গলার ওদিকে এক গোঁ কিছুতেই পণ দিয়ে বিয়ে করবে না সে। এই নিয়ে কম অশান্তি হয় নি মা বাপের সাথে। এমন এক পাত্রের মাকে মঙ্গলা বলে ফেলেছিল ‘আপনারা শহরে গিয়ে মন্দিরের সামনে আঁচল পেতে বসতে পারেন তো, শুনেছি দিনে পাঁচ ছয় হাজার রোজগার হয়। ও দুই তিন মাস বসলেই আপনার বেশ ক লাখ ...’ কথা শেষ করতে পারে নি, মায়ের ঠাস সপাটে নামে মঙ্গলার গালে। ছোট বোনটাকে ধরে সামলায় নিজেকে, শান্ত পায়ে গিয়ে মাছমাংস কোটার বঁটিটা আর একগাছা নারকেল দড়ি এনে মায়ের সামনে ধরে বলে ‘হাত পা বেঁধে গলা কাটো আমার, নাতো পণ দিলে আমি তোমাদেরই কেটে ফেলব হয়ত।’ ওর চোখ দেখে মা বাবা দাদা কারো আর কিচ্ছু বলার সাহস হয় নি, টাকার মূল্যে পার করার প্রস্তাবের সেখানেই ইতি।
সুড়ঙ্গের ওপারে এসে দেখে দিব্বি সব গাছপালা, কত নীচে থেকে ভুর্জ আর হিমহিজল গাছেরা উঠে এসে আরো কত উপরে চলে গেছে। রাস্তাটা তেমন চওড়া নয় তবে ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। এতটা পথ ঘষটে এসে হাতপাগুলো কেমন জ্বালাজ্বালা করছে। ব্যাগটা মাথায় দিয়ে চিৎ হয়ে শোয় ও। অনেক উপরে গাছের ফাঁকে ফাঁকে তীব্রনীল আকাশে সূর্য্যের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এত গাছ বলেই হয়ত এদিকটায় একটু হাওয়াও আছে ফুরফুরে। রওনা দেবার আগে উঠে জ্যাকেট খুলে কামিজের হাতা সরিয়ে হাতদুটো পরীক্ষা করে, নাহ ঠিক চামড়া ওঠে নি তবে ছড়ে ছড়ে গেছে ঘষটে আসার দরুণ, ধার করে আনা জ্যাকেটটা তেমন পুরু নয় তো। ব্যাগ থেকে মলম বার করে লাগিয়ে নেয়, চিন চিন জ্বালা নিয়েই আবার নিজেকে মুড়ে নিয়ে রওনা দেয়। রাস্তাটা এদিকে বেশ খাড়া ঢালু, পা ফসকালেই একদম খাড়াই পড়তে হবে। পা একটু কাঁপছে, দুই পায়ের মধ্যে যতটা সম্ভব ফাঁক রেখে আড়াআড়ি পা ফেলে নামতে থাকে, মিনিট পঁচিশেক নামার পরেই চারপাশে যেন সাদা পর্দা ঝোলানো, ফুট ছয়েক লম্বা ঝোপ সাদা ফুলে ছেয়ে আছে গোড়া থেকে আগা অব্ধি। চলতে গিয়ে নাকে মুখে লেগে যাচ্ছে ফুল, ফুলের রেণু লেগে নাক গলা চুলকাতে থাকে। খানিক গিয়েই শেষ হয়ে গেল ফুলের ঝোপ। এবারে আর তেমন খাড়া নয় একদৌড়েই নেমে যাওয়া যায়। আধা কিলোমিটার নীচে একটা ঘাসেভরা উপত্যকা, তাতে নানা রঙের কত ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে, হাওয়ায় দুলছে। অনেক দূরে বিন্দুর মত ক’খানি ঘর আর বোধহয় নদী বা জলাশয় কিছু একটা। তীব্রনীল আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায় না এত উজ্জ্বল।
ছোট বিন্দুর মত ঘরগুলো ক্রমশঃ বড় হতে হতে আস্ত চালাঘর, বেশ কয়েক ঘরের ধর্মশালা, নাকি চটি, একটা ছোট্ট মন্দির – এইসব হয়ে যায়। জনা তিনেক লোকও দেখা যায়, একজন তো পৈতেধারী, নিশ্চয়ই মন্দিরের পুরুত হবে। একজন কিছু কাঠ কেটে ছোট ফালি করছে আর একজন ধর্মশালার বারান্দায় চুপ করে বসে আছে। কিন্তু দলের লোকজন সব কই? ওদের তো বোধহয় এখানেই দুদিন থাকার কথা। পুরুতমশাইকে জিগ্যেস করলে জানা যায় নাহ কোন বাঙালি দল তো গত মাস দুয়েকের মধ্যে এদিকে আসে নি। বারান্দা থেকে উঠে এসে চটির মালিক ঘরে আসতে অনুরোধ করে, দৃঢ় প্রত্যয়ে জানায় যারাই আসুক, যবেই আসুক এখানেই আসতে হবে। এটাই মহাদেব মন্দিরের দ্বার। এখান থেকেই যাত্রা শুরু হয়। হয়ত তারা এতটা চড়াই ভাঙার সাহস পায় নি, ওপাশের উপত্যকা ঘুরে আসছে, তাহলে সন্ধ্যে হয়ে যাবে এখানে পৌছাতে। এতক্ষণে মাথার ওপরে একটা ছাদ পেয়ে মঙ্গলার শরীর আর বয় না, নদীমুখো বারান্দায় ধুসো কম্বল পাতা, সেখানেই এলিয়ে পড়ে। ‘ওদিকের উপত্যকা’টা কোথায় কে জানে!
সঙ্গীরা চায় নি, একা মেয়েছেলে তায় অমন গতর, পথেঘাটে যদি একটা সব্বনাশ কিছু হয় তো দায়িত্বটা কে নেবে? মঙ্গলা শেষে একটা কাগজে ওর কিছু হলে দলের কেউ দায়ী থাকবে না, কাউকে কিচ্ছু জিগ্যেস করা যাবে না - লিখে দিয়ে সঙ্গ নেয়। অনেক দূরে খাড়া হিমহিজল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে ও-ও যদি এইখানে ওদের পাশে গাছ হয়ে থেকে যেতে পারত – অমনি ঋজু, অমনি কালচে সবুজ চকচকে পাতা ছড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। অথচ দেখো রতনদের বাড়ি থেকে যখন বিয়ের দিন দেখতে বলল কি খুশীই না হয়েছিল ওরা বাড়িশুদ্ধু সব্বাই, পাড়াপড়শী, এমনকি দূরের আত্মীয়স্বজনরাও এসে বলে গেল মেয়ের কপাল খুব ভাল, অমন ভরভরন্ত জমজমাট পরিবারের বৌ হওয়া ভাগ্যের ব্যপার।
সে অবশ্য এখনো সবাই বলছে ওর ভাগ্য খুব ভাল। বিয়ে হল একপয়সা দাবী দাওয়া নেই। বেনারসীটাও বেশ ভাল দিয়েছিল, করাতীপাড়ায় অমন ঠাসা কাজের ভারী বেনারসী আর কারো নেই। বিয়ে হয়ে গেল, বৌ ভাতে বাড়ির লোকজন যেতেও কত্ত খাতির। ফুলশয্যার রাতে কি যে হল, রতন মারধোর করেছে কি জোর খাটিয়েছে এমনও কোন খবর নেই, তবু মঙ্গলা অমন সাজানো বিছানাটা ভাসিয়ে বমি করে রাখল। সকাল না হতে রতন সেই যে টকটকে লাল চোখ নিয়ে বেরিয়ে গেল মঙ্গলা ও বাড়িতে থাকতে আর একদিনও ওঘরে ঢোকে নি। তারপর তো অষ্টমঙ্গলার দিন একটা ছোট হাতি এনে খাট আর আলমারিটা চাপিয়ে মঙ্গলাকে ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে দিয়ে নিজে একটা কিসে করে যেন এসে বাপের বাড়ি রেখে গেল। বৌ ত্যাগ করলে খাট বিছানা ফেরত দেয় এমন সুপাত্র ভূভারতে কেউ কখনো দেখেছে? তো দোষটা কার শুনি? সে রাতের কথা মনে হলেই মঙ্গলার মুখে টকজল ভাঙে ওয়াক ওঠে। চটিমালিক এসে ‘মাঈজি’ ডেকে চটকা ভাঙিয়ে একগ্লাস গরম চা, মোটা মোটা কখানা রুটি আর কুঁদরুর সবজি রেখে যায়। গরম চা খাবার পেটে পড়তে শরীর মনের অবশ ভাবটা কাটে। ভয় উঁকি দেয় ওকে ফেলে কি সবাই অন্য কোথাও চলে গেল? জনে জনে বলেছে কাছেপিঠে কত তীর্থ আছে সেখানে যাও দিনের দিন ঘুরে এসো। অদ্দূরে যাবে কেন? মঙ্গলার কাছে এর কোন নিশ্চিত জবাব তো ছিল না যে বলবে কেন। সেই কোনকালে ইস্কুলে ‘লাইবেরিদিমণি’ ওদের হিমালয়ের গল্প পড়ে শোনাতেন সে কোথায় মনের কোণায় ছিল, হঠাৎই একেবারে ছিলেছেঁড়া টানে টানলে। খাওয়া শেষ করে তোলা জলে হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড় বদলে পায়ে পায়ে নদীর দিকে এগিয়ে যায়, মাথার মধ্যে গুনগুন করে দিদিমণির গল্প, সুমতীর হাসি, ওদের দলবেঁধে পরামর্শ বড় হলে ওরাও যাবে অমনি লাঠি নিয়ে হেঁটে হেঁটে।
নগাধিরাজ হিমালয় স্মিতমুখে সস্নেহে তাকিয়ে থাকেন।
Khub sundor lekha.