শিক্ষক দিবসে আজ তো চারিদিক ভেসে যাবে সুখস্মৃতিতে। তা আমার মত কেউ কেউ নিশ্চয়ই আছে যারা জীবনটা শুরু করে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েছে নিতান্ত সাধারণ ছাত্রী বা খারাপ ছাত্রী হিসেবে, নন-এনটিটি হিসেবে, তাদের স্মৃতিগুলো খুব সুখের হয় না অনেকসময়ই, আমার কথা, তাদের কথা, সেইসব অ-সুখস্মৃতির তিনটে টুকরো থাকুক কোথাও লেখা।
১) আমি এমন একটা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, যার নাম কিম্বা গল্প শুনলে আমার এখনকার বন্ধুরা অস্বস্তি বোধ করে৷ এমনিতে লোকে ছোটবেলার স্কুল নিয়ে খুব স্মৃতিকাতর হয়৷ এমনই কোনও স্মৃতিচারণার মাঝে যদি আমি আমার স্কুলের গল্পটা বলে ফেলি তাহলে বেশ একটা মজার ব্যপার হয়৷ লোকে প্রথমে একটু চুপ করে যায়৷ তারপর যে যার মত যা বলছিল তাইই বলতে থাকে৷ যেন এমন কিছু বলাই হয় নি, যেন সব স্কুলেই শিক্ষিকারা হয় রাগী নয় স্নেহময়ী কিম্বা একইসাথে দুটোই, কিন্তু কেউ উদাসীন নয়, যেন সব স্কুলেই বেশ কঠোর নিয়মকানুন, যাকে ডিসিপ্লিন বলে, সেসব থাকে৷ যেন সব স্কুলেরই অন্তত একজন বন্ধুকে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায়- আর এমনিভাবে আমার স্কুলটা এক্কেবারে নেই-স্কুল হয়ে যায়৷ অথচ স্কুলটা তো আছে, এখনও দিব্বি আছে, আমার মত কতজনে পড়ে সেখানে৷ তাকে কি এমনি করে নেই হয়ে যেতে দেওয়া যায়! বল?
তিনক্লাস থেকে দশক্লাস অবধি সেই স্কুলটায় আমি পড়েছি। তার ঠিক পাশেই ছিল একটা ভাগাড়৷ জায়গাটা টিনের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, আশেপাশের গাছগুলোতে বসে থাকত অজস্র শকুন৷ একটা বসতবাড়ীও ছিল কাছেই৷ দু চারটে শকুন সেই বাড়ীটার বারান্দায় বা ছাদেও বসত আর আমরা অবাক হয়ে বলাবলি করতাম ঐ বাড়ীর লোকেরা থাকে কেমন করে ওখানে? আর কীভাবেই বা ওরকম একটা জায়গায় জমি কিনে বাড়ী বানাবার কথা ভাবতে পারল!! কোন্নগর, আমাদের ছোট্ট মফস্বলে তখনও কিছু বাড়ীতে খাটা পায়খানা ছিল, আর পৌরসভা সেইসব বাড়ী থেকে টিনের ট্যাঙ্কার ধরণের গাড়ি করে পুরীষ সংগ্রহ করে এনে ঐ ভাগাড়ে ফেলত৷ এছাড়াও সারা কোন্নগরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৃত জন্তুজানোয়ারও এনে ফেলা হত ওখানে৷ আমাদের ছিল মর্নিং স্কুল৷ সাড়ে দশটায় যখন স্কুল ছুটি হত, তখনই বর্জ্য সংগ্রহ করে গাড়িগুলো ফেরত আসত৷ তাদের কারো কারো আবার ঢাকনি ভেঙে যাওয়ায় মুখটা খোলা৷ হরিদ্রাবর্ণের বিভিন্ন শেড ও বিভিন্ন ঘনত্বের তরল, অর্ধতরল গড়িয়ে আসার দৃশ্য খুবই সুলভ ছিল৷ প্রথমদিন ঐ স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ভয়ংকর৷ আকাশ বাতাস আমোদিত করা সেই গন্ধের থাপ্পড় যে না খেয়েছে, সে বুঝবে না সে কি বীভৎস! এরকম গন্ধকেই নিশ্চয়ই শাস্ত্রে টাস্ত্রে পুতিগন্ধ বলে৷ এক দেড়মাস পর থেকে অবশ্য উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া না দিলে গন্ধ আর তেমন করে টের পেতাম না৷ স্কুলের এক শিক্ষিকা প্রায়ই বলতেন স্বর্গে তাঁর জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা হচ্ছে- স্রেফ মরার অপেক্ষা৷ কারণ এতদীর্ঘ নরকবাসের পর স্বর্গ ছাড়া আর কোথায়ওই তিনি যেতে পারেন না৷
ঐ ভাগাড়ের গন্ধটা আজও ছাড়তে চায় না আমাকে৷ মাঝে মাঝেই নাকে ফিরে আসে৷ কি যেন একটা অসুখ আছে না হঠাৎ হঠাৎ নাকে কোনও একটা গন্ধ এসে লাগে, যেটা হয়ত তখন সেখানে পাওয়ার কথাই না৷ কথা হল স্কুল কর্তৃপক্ষ ঐখানেই বা স্কুলটা স্থাপন করেছিলেন কেন কে জানে! ঐ ভাগাড় উঠিয়ে দেওয়ার জন্যও তাঁরা বিশেষ চেষ্টা করেন নি কখনওই৷ একই স্কুল বাড়ীতে সকালে একটি মেয়েদের ও একটি ছেলেদের প্রাইমারি স্কুল, মেয়ে দের একটি জুনিয়র হাই স্কুল (অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) ও একটি হাই স্কুল হত৷ দুপুরে ছেলেদের একটি হাই স্কুল হত৷ তো এই এতগুলি স্কুল মিলিয়ে প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীসংখ্যা কখনওই ৭০০ থেকে ৭৫০ র কম হত না৷ এই ৭০০-৭৫০ ছেলেমেয়ে প্রতিদিন বিদ্যালাভের সাথে সাথে গন্ধ সম্পর্কে সহনশীল হতেও শিখত৷ এই স্কুলগুলি অবশ্য কোন্নগরের ভাল স্কুলগুলির তালিকায় ছিল না৷ বিশেষত সকালের স্কুলগুলিতে প্রচুর প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়া থাকত৷ স্কুল ড্রপ-আউটের সংখ্যাও যথেষ্ট৷ তবে ড্রপ-আউটের ফলেও ছাত্রীসংখ্যা খুব একটা কমত না, কারণ অন্যান্য ভাল স্কুলগুলিতে একই ক্লাসে একাধিকবার অকৃতকার্য হওয়া ছাত্রীরা প্রায়ই এসে ক্লাস ভরিয়ে তুলত৷ তার ফলে কোন্নগরের সাধারণ লোকের এই স্কুলগুলি সম্পর্কে একটা তাচ্ছিল্যের মনোভাবই ছিল৷ শুধু বাইরের লোক নয়, শিক্ষক, শিক্ষিকারাও একইরকম তাচ্ছিল্যের মনোভাব দেখাতেন৷ সম্ভবত: এইজন্যই ভাগাড় ওঠানোর চেষ্টা তেমনভাবে করা হয় নি৷ বরং স্কুলটি আরও ভালভাবে 'ভাগাড়পাড়ার স্কুল' নামে পরিচিতি লাভ করেছে৷
তা এই ভাগাড়পাড়ার স্কুলের একদিকে ভাগাড়ের পাশেই মেথরপট্টি। সেখান থেকে কোনও ছাত্রী আমাদের স্কুলে কোনোদিনই আসে নি। কেউ কোনোদিন ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিল কিনা জানি না। ৮০ সাল নাগাদ ঐ মেথরপট্টির ভেতরেই একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়ে দেয় কোন্নগর মিউনিসিপালিটি। এই ভাগাড়পাড়া স্কুলের আরেকটা চলতি নাম ছিল মাস্টারপাড়া স্কুল। কারণ স্কুলের পেছন দিকের পল্লীটির নাম 'মাস্টারপাড়া'। সেই মাস্টারপাড়ার মাস্টারমশাইদের বাড়ী থেকেও কেউ কখনও পড়তে আসে নি আমাদের স্কুলে৷
স্কুলগুলো মূলতঃ তৈরী হয়েছিল ১৯৫০-৫২ নাগাদ বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব্ববঙ্গ) থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য, স্থানীয় অন্যান্য স্কুলগুলির ওপরে চাপ কমাতে। আরেকটা উদ্দেশ্য হল কিছু, তা যতই সামান্য হোক, কর্মসংস্থানের উদ্যোগ। 'কোন্নগর কল্যাণ পরিষদ' নামক রেজিস্টার্ড সোসাইটি তৈরী করেন কিছু খদ্দরধারী কিঞ্চিৎ অবস্থাপন্ন উদ্বাস্তু। স্কুলের জমিটির মাঝামাঝি একটি পাকা বাড়ী। তার নীচের তলায় বিভিন্ন সেকশানের টিচার্স কমন রুম বাদ দিয়ে ক্লাসরুম হল দুটো। দোতলায় আরো খান তিনেক। সামনে মাঠের বাঁ দিকে পাকা ঘর, মাথায় এসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দুটো ঘর, মেঝেটা পয়েন্টিং করা। তারপর ছিটে বেড়ার দেওয়াল, টালির চাল আর মাটির মেঝেওলা আরো দুটো ঘর। স্কুলের পেছনে ইঁটের দেওয়াল, টালির চাল আর পাকা মেঝেওলা টানা ক্লাসরুম পরপর ছয় সাতটা, বাঁদিকে এল শেপে আরো দুটো। এই অংশে যেতে গেলে একটা সরু পাকারাস্তা পেরিয়ে যেতে হত। এ রাস্তা মাস্টারপাড়ার কমন রাস্তা, লোক, আর সাইকেল মোটামুটি চলে, রিকশা কালেভদ্রে। ঐ যে টানা ক্লাসরুম, তার পাশেই একটা জল টলটলে মস্ত পুকুর।কোথাও কোনো বাউন্ডারি ওয়াল বা গেট ফেটের বালাই নেই। ভাগাড়ের সামনে দিয়ে এসে একটু এগিয়ে স্কুলের মাঠে ঢোকার সরু পায়েচলা পথ৷ দুপাশে নানারকম জংলি গাছে ভরা অঞ্চল৷ রাস্তার ওপারে মস্তবড় কচুরিপানাভরা পুকুর, প্রায় সারাবছর আর্ধেকের বেশী অংশ মাঠ হয়ে থাকে, বর্ষাকালে পুরোটা জলে ভরে যায়৷ কোন্নগরের তাবত্ ধোপা সেখানে সারাবছর কাপড় কাচে আর মাঠে ছড়িয়ে মেলে দেয়৷ ঐ মাঠের মধ্য দিয়ে শর্টকাট মারলে ভাগাড়ের প্রত্যক্ষদর্শন এড়ানো যায়৷ অবশ্য মনসাতলার মোড় থেকে সোজা গিয়ে মনসাতলা ব্যায়াম সমিতির পাশ দিয়ে ঢুকে পুকুরপাড়ের সরু ইঁটের রাস্তা ধরে এলেও স্কুলের ডানপাশে পৌঁছানো যায়, ভাগাড় এড়িয়ে৷ তা সে যারা বাটামোড়-জি টি রোডের দিক থেকে আসত তাদের পক্ষে সুবিধে৷ আমরা যারা স্টেশানের বা কালীতলার দিক থেকে যেতাম তারা তো মনসাতলার মোড়ের নেতাজী স্ট্যাচুর পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়তাম৷ কয়েকটা একতলা দোতলা বাড়ী দুপাশে, তার মধ্যে একটা ড: পি কে রায়ের; যাঁর দুই ছেলেই ডাক্তার৷ তারপরেই ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু তিনতলা বাড়ীটা, সাথে লাগোয়া আলকাতরা বানাবার ফ্যাকটরি| দু চারটে আলকাতরার ড্রাম রাস্তার পাশেও থাকত টাকত| এরপরেই রাস্তার ডানদিকে মেথরপট্টি, আর বাঁদিকে একটা মস্ত খেলার মাঠ; ১৫ই আগস্ট ওখানে সারাদিনব্যপী ফুটবল ম্যাচ হত আর শীতকালে চারদিন যাত্রা হত, মাঝেসাঝে বাইরে থেকে কোনও গ্রুপ থিয়েটারের দল এলে তাও| এই মাঠটার কোণাকুণি গেলেই নেমে পড়া যেত ঐ কচুরীপানাভরা পুকুরের পাশের শুকিয়ে ওঠা জমিতে| কোণাকুণি না গিয়ে সোজা রাস্তায় গেলে, মাঠ শেষ হয়ে বুনোফুলের ঝোপ আসবে বাঁ পাশে আর ডানপাশে ভাগাড়, ভাগাড়ের কোণাথেকে বাঁ দিকে বেঁকে এগিয়ে গেলে ডানেবাঁয়ে বুনোফুলের ঝোপ আর ধোপার পুকুর সাঙ্গে সঙ্গে যাবে যতক্ষণ না আসবে স্কুলে ঢোকার সেই সরু গলিটা| সে গলির দুপাশেও বুনোঝোপ, কিন্তু সে একটুখানি- এই ১২-১৪ পা হাঁটলেই স্কুলের মস্ত মাঠ, আর মাঠ শেষ হলেই স্কুলের মূল বিল্ডিং, একতলার লিন্টেলের ওপরে হলদে রঙের মধ্যে কালো রং দিয়ে বড় বড় করে লেখা 'রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়'| ডানদিকে আরেকটা মাঠ, মাঝখানে একটা মস্ত শিমূলগাছ| তারপর যতদূর চোখ যায় বুনোঝোপ আর ভাগাড়, শুধু মাঝে চোখটা অল্প বাধা পায় ঐ বাড়ীটায় যার বারান্দায় সবুজ রঙের দেওয়াল আর ছাদে, বারান্দার রেলিঙে বসা কয়েকটা শকুন|
রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়' হল ছেলেদের স্কুল, পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত, দুপুর এগারোটায় ক্লাস শুরু হয়| তাইজন্য আমাদের স্কুল শেষ হয় সকাল সাড়ে দশটায়, যাতে মেয়েদের স্কুলের সমস্ত কিছু গুটিয়ে ফেলা যায়, সব দিদিমণি ও মেয়েরা বেরিয়ে যেতে পারে| এইজন্য আমাদের স্কুলে কোনওদিন কোনও ক্লাসেই ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাস হয়নি, হওয়ার জায়গাই নেই তো| আমাদের স্কুলের নাম 'বালিকা শিক্ষা সদন জুনিয়র হাই' আর পরে নবম শ্রেণীতে 'বালিকা শিক্ষা সদন'| কিন্তু স্কুলের নাম তো লেখা রয়েছে 'রাজেন্দ্র স্মৃতি, তাহলে মেয়েদের স্কুলের নাম কোথায়? নেই নেই, কোনও বোর্ডে বা দেওয়ালের গায়ে নেই লেখা- আছে শুধু হলদে রঙের মাসিক বেতনের রসিদ বইয়ের পাতাগুলোর মাথায়্ মাথায়, রিপোর্ট কার্ডে, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, পুরস্কার বিতরণী কিম্বা সরস্বতী পুজোর আমন্ত্রণ পত্রে, আর কোত্থাও নেই| 'কোন স্কুলে পড়ো?'র উত্তরে তাই 'বালিকা শিক্ষা সদন' বললে কেউ বুঝতেই পারে না সে স্কুলটা কোথায়| তারপর যদি বল 'কোন্নগর কল্যাণ পরিষদ' তখন কেউ কেউ বুঝে ফেলে বলে ওঠে 'ওহোহো ভাগাড়পাড়া স্কুল'| কেউ যদি তাও না বোঝে তখন তাকে বল 'মাস্টারপাড়া স্কুল' তখন সেও এক্কেবারে বুঝে ফেলবে 'ওঃ ভাগাড়পাড়া স্কুল, আরে আগে বলবি তো'| তাই 'রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়'কে কেউ রাজেন্দ্র স্মৃতি, কেউ মাস্টারপাড়া আবার কেউবা ভাগাড়পাড়া ছেলেদের স্কুল বলে ডাকে, 'বালিকা শিক্ষা সদনের ছাত্রীদের সব্বাই কিন্তু ভাগাড়পাড়া স্কুলের ছাত্রী বলেই চেনে।
২) ক্লাস সিক্সের ঘরটা মস্ত বড় হল্, প্রায় ৭০ জন ছাত্রী অনায়াসে ধরে যায়, কিন্তু অত ছাত্রী তো হয় না এই স্কুলের সিক্সে| ফাইভে উঠে যারা পরীক্ষা দিয়ে অন্য কোনও স্কুলে চান্স পায়, তারা সবাই চলে যায়| যারা ফেল করে থেকে যায়, তাদের সাথে সাধনাদির প্রাথমিক বিভাগ থেকে আসা মেয়েরা আর কোনও স্কুলে ক্লাস সিক্সে কেউ তিনবার ফেল করলে যখন সেখান থেকে টিসি দিয়ে দেয়, তারা তখন এখানে এসে সিক্সে ভর্তি হয়| অন্য সব স্কুলেই নিয়ম হল একই ক্লাসে তিনব্ছরের বেশী থাকতে দেওয়া হয় না, তৃতীয়বারেও ফেল করলে টিসি দেওয়া হয়| ভাগাড়পাড়া স্কুলে অবশ্য এমন নিয়ম নেই, যতবার খুশী ফেল করে থাকা যায় এখানে| শুধু তিনবারের বেশী হয়ে গেলে সারা বছরের মাইনে ২৪ টাকার জায়গায় ৩৬ টাকা হয়ে যায়| এই হলঘরে বড়সড় পাঁচটা জানলা, মোটা মোটা লোহার শিক লম্বালম্বি বসানো| দুটো শিকের মধ্যের ফাঁক দিয়ে একটা রোগা মেয়ে দিব্বি গলে বেরিয়ে যেতে পারে| ক্লাসের পাশেই একটা কচুব্ন| আসলে ওটাও একটা মস্ত মাঠ, তবে শুধু মাঝ্খানে অনেকটা অংশ পরিস্কার আর পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণে কচুবনে ভর্তি, পূবদিকে আমাদের স্কুলের মাঠ| দুপুরে ছেলেদের স্কুলের ছেলেরা নাকি দুটো মাঠজুড়েই খেলে| পশ্চিমের কচুবন ঘেঁষে একটা মস্তবড় শিমূলগাছ, এপ্রিল মাসভর লাল টকটকে ফুলে ভরে থাকে| কিন্তু নীচে পড়ে থাকা শিমূলফুলগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় কেমন বিশ্রীমত দেখতে, উঁচুতে যখন ফুটে থাকে শুধু লাল টকটকে পাপড়ি দেখা যায়, তাই সুন্দর দেখায়, মাটিতে খসে পড়লে আসল রূপটা দেখা যায়| ক্লাসের পেছনে পাকা রাস্তা, রিকশা, সাইকেল চলে অনবরত| লোকজন বাজার করে ফেরে, ডোরাকাটা নাইলনের ব্যাগের মুখ দিয়ে উঁকি মারে কচুর লতি কি মুলোশাকের ডগা, ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা উর্ধশ্বাসে দৌড়ায় ট্রেন ধরতে| রাস্তাটার পাশেই সেই যে সেই পুকুরটা, ক্লাস থ্রীয়ের জানলা দিয়ে যাকে দেখতাম| সোমবার সকালে এই পেছনের জানলা দিয়েই আমরা নজর রাখতাম রেখাদি আসছেন কিনা| রেখাদি আমাদের ক্লাসটিচার, সোমবারে কলকাতা থেকে আসেন তাই ট্রেন থেকে নেমে এদিক দিয়ে আসতে দেখা যায়, অন্যদিন বাড়ী থেকে আসেন, সে এদিক দিয়ে দেখা যায় না| ওঁকে আসতে দেখলেই আমরা লক্ষ্মী শান্ত হয়ে বই নিয়ে বসে যাই| উনি এসে ক্লাসে গন্ডগোল হতে দেখলে এলোপাথাড়ি বেত চালান, অনেকটা পুলিশের লাঠিচার্জ করার কায়দায়, কারুর চোখে লাগল কি নাকে ঢুকে গেল সেসব খেয়ালও করেন না|
এতদিনে আমি বাড়ীতে বড়দের সবকথা না বলতে অথবা মিথ্যে বলতে বেশ শিখে গেছি; শিখে গেছি দাদুর খুচরো পয়সার বাক্স থেকে সময় সুযোগমত দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা তুলে নিতে| সিকি কিম্বা আধুলি নিতে সাহস হয় না, যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে বেদম মার খেতে হবে| তা দশ, পাঁচ পয়সায় দিব্বি চুরন, হজমীগুলি, কারেন্ট নুন খাওয়া হয়ে যায়| এদিকে মা টিফিনবাক্সে করে দুটো পাঁউরুটি টোস্ট করে, মাখন আর চিনি মাখিয়ে দিয়ে দেয়, কখনও কখনও সঙ্গে একটা আতা সন্দেশও থাকে| মাখনমাখানো পাঁউরুটি কেমন ত্যাকত্যাকে নরম হয়ে থাকে, ভাল্লাগে না| তারথেকে চুরন কিম্বা হজমীগুলি অনেক বেশী ভাল খেতে| পাঁউরুটি দুটো কল্পনাকে দিয়ে দিই, সেই যে কল্পনা একদিন খুব পেটের ব্যথায় কেঁদেছিল, তারপর থেকেই| সেদিন প্রেয়ারের সময় প্রমীলাদি একটু বেশী সময় ধরে ভাষণ দিচ্ছিলেন আর আমরা উসখুস করছিলাম, তাই দেখে উনি আরো অনেকক্ষণ ধরে আমাদের ধৈর্য্যশীল হওয়ার গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছিলেন- এমন সময় কল্পনা হঠাৎ তীব্র চীৎকার কেঁদে ওঠে- পেটে হাত দিয়ে বেঁকে কুঁজো হয়ে যায়| সবাই কেমন হতভম্ব হয়ে যখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা, তখন আয়া মিনুদি এসে ওকে টপ করে কোলে তুলে টীচার্স রুমে নিয়ে শুইয়ে দেয়, দিদিমণিরাও সব তাড়াতাড়ি পেছন পেছন যান| আমরা এলোমেলোভাবে যে যার ক্লাসে চলে যাই, লাইনটাইন আর করি না| অন্য সব ক্লাসে দিদিমণিরা চলে গেলেও আমাদের ক্লাসে রেখাদি আসেন না, আমরা একজন দুজন করে গিয়ে কমনরুমে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি কল্পনা তখনও ফোঁপাচ্ছে আর রেখাদি সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বকছেন রাতের খাবার হজম না হওয়া সত্ত্বেও সকালের খাবার খাওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার না খেয়ে মুখরোচক খাবার খাওয়ার জন্য- উনি জানতেন না কল্পনার বেশীরভাগ দিনই রাত্রে খাওয়া হয় না, সকালেও না, ওর মা দুপুরের পর এসে রান্না করলে ওরা সবাই বিকেলের দিকে একবার খায়- কল্পনার মা যেসব বাড়ী কাজ করে তারা কেউ কোনওদিন রুটি বা মুড়ি দিলে রাত্রে ওরা একগাল খায়, নাহলে আবার সেই পরেরদিন বিকেলে - জানতে চানও নি অবশ্য| মিনুদি কোত্থেকে একঠোঙা মুড়ি এনে ওর হাতে দিয়ে বলে 'তুই আস্তে আস্তে একটু করে জল দিয়ে দিয়ে খা দিকিনি'| রেখাদির দিকে তাকিয়ে বলে 'আপনি ক্লাসে যান দিদিমণি, এই মুড়িটুকু খাইয়েই আমি ওকে ক্লাসে দিয়ে আসছি'| আমরা চুপি চুপি ফিরে আসি| আমি জানি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে পেটে খুব ব্যথা হয়, বাবা বলত রাত্রে না খেলে অনেকক্ষণ পেট্খালি থাকবে, পেটে খুব ব্যথা হবে| কল্পনা পরে আমাদের বলেছিল মিনুদি ওর নিজের টিফিনের মুড়িটুকু দিয়েছিল খেতে, কল্পনা খেতে চায় নি, মিনুদি জোর করে খাইয়ে দেয়| বলার সময় কল্পনা আমাদের দিকে তাকায় না, বাইরের ঝোপের বুনোফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, হলুদ রঙের পাপড়ির ছোট্ট ছোট্ট ফুল, মাঝখানে পরাগরেণুর চারপাশে গাঢ় লালচে কমলা একটা বর্ডার দেওয়া- অমনি লালচে হয়ে উঠতে থাকে ওর নাকের ডগা, চোখের চারপাশ- ওকে কেমন অচেনা লাগে|
টিফিনের পরে ফোর্থ পিরিয়ডে ইরাদিদিমণির ইতিহাস ক্লাস| উনি এসেই একজন একজন করে দাঁড় করিয়ে মুখ্স্থ বলতে বলেন, যেমন আমাকে হয়ত জিগ্যেস করলেন শেরশাহের রাজ্যশাসন সম্পর্কে কী জান? আমাকে বই থেকে আগাগোড়া মুখ্স্থ বলে যেতে হবে গড়গড়িয়ে, উনি হয়ত দুই তিন প্যারাগ্রাফ শুনে বুঝে গেলেন আমি মুখস্ত করেছি, তখন আমাকে বসিয়ে দিয়ে রীমাকে জিগ্যেস করলেন তার পর থেকে বলতে| তারমানে রীমাকে চতুর্থ প্যারা থেকে বলে যেতে হবে| আর মাঝখানে থেমে গেলেই বেত দিয়ে প্রচন্ড মার| কিন্তু এই মারের কথা আমরা প্রাইমারী থেকেই শুনে আসছি বটে তবে নিজেরা দেখি নি হাফ ইয়ার্লির আগে| আমি খেয়াল করে দেখেছিলাম উনি এসে রোজই ডানদিকের ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথম থেকে পড়া ধরতে শুরু করেন, তারপর ডান, বাঁ, ডান, বাঁ করে এগোতে থাকেন| যার যেমন বসার জায়গা, সেই অনুযায়ী পাতার নির্দিষ্ট অংশ মুখস্থ করে গেলেই চলে, পুরো পড়া তৈরী করার কোনও দরকার নেই| এটা সকলকে বুঝিয়ে দেওয়ায় সবাই খুব খুশী, এই ক্লাসের সবাই পড়া পারে বলে ইরাদিও খুশী| কিন্তু হাসিখুশী তো আর তেমন পাকাপোক্ত কিছু নয়, একটু ফ্ঙ্গবেনে ব্যপার, তাই হাফ ইয়ার্লির খাতা বেরোবার দিন ইরাদি ক্লাসে এলেন দুটো বেত হাতে নিয়ে, যদি একটা ভেঙে যায় তাহলে যাতে অসুবিধে না হয়| ক্লাসের দুজন মাত্র ইতিহাসে পাশ করেছে, বাকী সব ফেল| আমাদের হাফ ইয়ার্লির খাতা দেখানো হত| কোনও কোনও দিদিমণি স্রেফ খাতা হাতে দিয়েই ছেড়ে দিতেন, কেউ কেউ আবার খাতা দেওয়ার সময় কিছু ভুলত্রুটি যা সহজেই এড়ানো যেত, সেগুলো সম্বন্ধে প্রত্যেককে আলাদা করে বলে দিতেন| তা ইরাদি এক এক করে রোল নাম্বার ধরে ধরে ডাকছেন আর খাতা হাতে দিয়েই বেত দিয়ে সপাৎ সপাৎ করে পায়ে মার| সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ- পাতা উল্টানোর আওয়াজটুকুও নেই- অনিতা গেল খাতা আনতে- অসম্ভব রোগা অনিতা, কাগজের মত ফ্যাকাশে ফর্সা- প্রথম্ মারটা পড়তেই দুলে উঠল হাওয়ালাগা গাছের মত- হাওয়া কেটে কেটে বেত উঠছে- নামছে- উঠছে- নামছে- শুঁউউইই করে একটা প্রায় শোনা যায় না এমন আওয়াজ- সামনের বেঞ্চের মেয়েরা দেখল অনিতার পায়ের কাছে ঈষৎ হলুদাভ তরল জমা হচ্ছে দ্রুত- অনিতা দুইহাতে মুখ ঢেকে ওখানেই হাঁটুগেড়ে বসে পড়ছে|
৩) তখন কলেজ, খানিক ইচ্ছেয় খানিক দিশেহারা চাপে অনার্সের সাবজেক্টে এক প্রফের টোলে সাপ্তাহিক তিনদিন হাজিরা। নির্দিষ্ট সালনির্ভর এগজাম ফ্রেন্ডলি নোট লিখিয়ে ও সেই নোট উগরানোর পরীক্ষা নিয়ে নিয়ে তোতাকাহিনীর পুনরাবৃত্তি। টোল ফোলগুলোর যে কারণে সৃষ্টি আর কি! তো একদিন পন্ডিতমশাই সকল ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ বলছিলেন অতি মাইডিয়ার ভঙ্গীতে। তাঁর ভাষ্যে কেউ মহান গবেষক, কেউ বা অতি জনপ্রিয় অধ্যাপিকা । বেশ খানিকটা শুনলাম, ব্যাকবেঞ্চার আমার সে তালিকায় স্থান নেই। তা প্রবাদে তো বলেইছে কুঁজোরও চিৎ হয়ে শুতে সাধ হয়, অতএব আমিও খুব কিছু না ভেবেই নিজের কথাও জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম। তৎক্ষণাৎ রসিক পন্ডিতমশাইয়ের (হ্যাঁ রসিক বলে তাঁর বেশ নামডাক ছিল) ত্বরিত জবাব "তোকে দেখলেই মনে হয় বলছিস 'হ্যাঁগা টিপিনবাক্সটা নিয়েচ তো?' Dumbstruck শব্দটা তখন আমি জানতাম না অবশ্য, খালি বাংলা গপ্পোবই পড়তাম তো।
জানতাম না অবশ্য আরো অনেক কিছুই। সেক্সিস্ট, মিসোজিনিস্ট এই শব্দগুলোও অজানা ছিল, অজানা ছিল ফেমিনিজমের অ আ ক খ, তারও প্রায় পাঁচ বছর পরে কলেজ স্ট্রীটে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাব একটা ছেঁড়াখোঁড়া 'দ্য ফিমেল ইউনাখ' যার প্রথম কয়েক পাতা নেই, আর সেইটা পড়ে উল্টে পাল্টে যাবে আমার ভাবনাচিন্তা। বুঝতে শিখব ভেতরে জমে ওঠা রাগ ক্ষোভ আদৌ ভুল নয় অন্যায় নয়। কিন্তু সে তো অনেক পরে, সে পন্ডিতমশাইয়ের সাথে আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি দিনও যোগাযোগ রাখি নি। কিন্তু সেই কতকিছু না-জানা সময়েও স্রেফ বরে-পোষা-ঘরে-পোষা হয়ে যে থাকবো না এ আমি নিশ্চিত জানতাম। ওনার কেন মনে হল এরকম থাকতে পারি? নাকি তত ভাল রেজাল্ট নাও করতে পারে এমন স্ত্রীলিঙ্গের মানুষটির জন্য এটাই ভবিতব্য বলে তিনি মনে করেন? যারা ততটা ভাল নয় ত্যাদের আত্মবিশ্বাস আরো কমিয়ে দেওয়াই ভাল শিক্ষকের কর্তব্য?
নাহ এগুলো কোনওটাই জেনে নেওয়া হয় নি। ডাম্বস্ট্রাক শব্দটা না জানলেও ঐটাই হয়ে গিয়েছিলাম তো।
তবে এখন মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয় লোকটিকে যদি ঠাটিয়ে একটা চড় লাগাতে পারতাম, শুধু এই কথার জন্যই নয়, অকাতরে বলে যাওয়া অজস্র সেক্সিস্ট জোকসের জন্যও।