এদেশে এমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আছে যার প্রতীক হলো গরু। স্বাভাবিক, কারণ কৃষিভিত্তিক দেশ হবার ফলে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ধারণাটির সঙ্গে কোথাও এই শান্ত, গৃহপালিত, কৃষি সহায়ক পশুটি বহুকাল ধরেই জড়িয়ে গেছে। কর্পোরেশন ব্যাংক তাই গরুকে তার প্রতীক স্থলে রেখে ঠিকই করেছে।
গরু এমন একটি প্রাণী যার লেজ থেকে নাকের ডগা টুকু, চামড়া, মাংস, শিং, দুধ, মায় গোবর ও গোমূত্র অব্দি মানুষের কাজে লাগে।পশুপালক থেকে কর্ষণক্ষম---মানুষের এই বিবর্তন সম্ভব হয়েছে গরুর উপর নির্ভর করে এই রকম বলা যেতেই পারে। এইসব অবশ্য আমরা শিশু কালে গরুর ওপর রচনা মকশো করতে গিয়েই জেনে ফেলেছি। পরিণত বয়সে এসে যা জানা এবং বোঝা হলো তা হচ্ছে এইরকম একটি উপকারী অহিংস পশুর ওপর প্রথমে মাতৃত্ব ও পরে দেবত্ব আরোপিত হলে তা হয়ে ওঠে রাজনীতির কান্ডারী দের হাতের অস্ত্র, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার কারণ ও আক্ষরিক অর্থেই ভোট বৈতরণী পার হবার মাধ্যম। গোরুর বিবর্তন- ইতিহাসের এই অনুসন্ধান ভক্তিভাব না জাগিয়ে প্রশ্নমুখর ব্যঙ্গের ঝিলিকে চোখ ধাঁধাবে এটাই প্রত্যাশিত। সে দিক থেকে শুভাশিস মৈত্রের "এক ডজন গরু ও অন্যান্য"কে ব্যঙ্গ রচনা বলা যেতেই পারে, কিন্তু সংকলনটি শুধু তাই নয়। তোষামুদে পুঁজি , সমাজ, রাজনীতি ও সুবিধাবাদী ভাঁড়- সকলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শানিত যুক্তি ও মানবিক বিশ্লেষণের চিরকেলে লড়াইয়ের একটা যুদ্ধ -দলিলও বটে।
ছোট ছোট লেখাগুলোর নামকরণ হয়েছে কোন চালু প্রবাদ বা বহুশ্রুত গানের লাইনের ছাঁদে। যেমন বিশ্বাসে মিলায় গরু, তর্কে দেশদ্রোহী, গো দের ওপর বিষফোঁড়া, বা দিনের শেষে গরুর দেশে।কখনো খুব প্রফেটিক হয়েছে তার প্রয়োগ । যেমন দাবার ঘোড়া হবে দাবার গরু। ব্যবহৃত হয়েছে আপাত সহজ অথচ বহুস্তরীয় অর্থে পূর্ণগর্ভা বাক্যবন্ধ -”নেতা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, চিন্তা করবেন না, আমরা ক্ষমতায় এলে ওটার জাতীয়তাবাদী কারেকশন করে নেব" অথবা “কেউ নিজের চোখে দেখেননি কখনো কারোর চামড়া গোটানো যায়… (কিন্তু) দিদিমণি যখন বলছেন,তখন মানতেই হবে,আলবাত চামড়া গোটানো যায়।"
এই যাবতীয় জটিলতা বর্জিত কথকতা হামেশাই নিয়ে যায় জটিল প্রশ্নমালার দিকে - গোটানো আস্তিন যেমন ফের খুলে ফেলা যায়, গোটানো চামড়াও কি তাই? গোটানোর পর সরকার কি আবার চামড়া ফিরিয়ে দেবে? প্রশ্নগুলো নস্টালজিক হয়ে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় দিদিমণি ও সরোজ দত্তকে- দুই মেরু -ফারাক রাজনীতিকে। সাংবাদিকের নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই দুই পক্ষের দুর্বলতা নিয়ে হাসেন লেখক। আর তা করেন তেতো স্বাদ কে দূরে রেখেই। স্যাটায়ার নয়, তাই হিউমারের অনায়াস ব্যবহার ছত্রে ছত্রে। পড়ার সময় চোখ লাল হয়ে ওঠে না বরং ঠোঁটে স্মিত হাসি ফোটে অথচ সেই হাসির আড়ালেই ঠিক হয়ে যায় পাঠকের কোন পক্ষে যাওয়া উচিত। এই যে সমঝদারদের জন্য বিপুল ইশারার ব্যবস্থা - এটাই "এক ডজন গরুও অন্যান্য” র মৌলিকতা।
যদি কারোর মনে হয় সহজ প্রশ্ন শিশুসুলভ, তাকে মনে করিয়ে দেব নোয়াম চমস্কির "সিম্পল কোয়েশ্চেন" দিয়ে আলোচনার কথা। এই যে স্পষ্ট সোজা কথায় হতভম্ব করে দেওয়ার ক্ষমতা এটা খুব বিরল বলে মেনেছেন তিনি। সহজ প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুবই কঠিন কাজ। অনায়াসে পেরে যাব এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলে ঠিকঠাক জবাব প্রায়ই আমাদের অধরা থেকে যায়। আর এই প্রশ্নগুলো করতে খুব হিম্মত এবং সহজ মানসিকতার প্রয়োজন হয়। স্পষ্টবাক সাহসী ছাড়া রাজার বস্ত্রহীন অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে কেইই বা দেখাবে! উত্তর আছে, অথচ সে সম্বন্ধে অসচেতন আমাদেরকে ধাক্কা দিতে যে ভাষা এবং মননের ধার প্রয়োজন তা এক ডজন গরু ও অন্যান্য-র আছে। জানা জিনিসকে উল্টেপাল্টে দেখার প্ররোচনা জোগাতে পারার জন্য যে খুব সূক্ষ্ম রসবোধ এবং অচেনা দক্ষতার প্রয়োজন, এই সংকলন তা প্রমাণ করে দেয়।
প্রচ্ছদ এবং ছাপাখানার ভূত সম্বন্ধে এইরকম বলতে পারলে ভালো হতো। প্রচ্ছদের ছবিটি বড়ই প্রত্যক্ষ, লেখাটির অপ্রত্যক্ষ প্রণোদনা এখানে অনুপস্থিত। বানান ভুল নজরে পরে - "রাজকোশ", "ছেড়া গেঞ্জি" এগুলো এই ঝকঝকে প্রকাশনায় না থাকলেই ভালো হত।
এক ডজন গরু
শুভাশীষ মৈত্র
ধানসিড়ি প্রকাশন