বাংলাদেশে জনমতের উপরে ভিত্তি করে বিবর্তন সংক্রান্ত একটা অধ্যায় ক্লাস সিক্সের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিবর্তন নিয়ে আমার জ্ঞানে যতদূর ধরল তা লেখার চেষ্টা করলাম।
বানর থেকে মানুষ হইছে এমন কথা ডারউইন বলছে না বলে নাই এই বিতর্ক পরে করি। আপনি বিবর্তন শুনলেই যে ক্ষেপে জান তার কারণ কী তা আগে শুনি। বানর মানুষ এগুলা অনেক দূরের বিষয়। বিবর্তন বলতে আসলে কী বুঝায় আগে ওইটা বুঝেন। বিবর্তন অবৈজ্ঞানিক বলে কোন বিজ্ঞানী রায় দিল তা আমার জানা নাই। আমার জানা আছে বিবর্তন অস্বীকার করলে জিনতত্ত্ব, মাইক্রোবায়োলজি, চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা সব বাতিল করে দিতে হবে। যাই হোক, এগুলা ম্যালা উপরের বিষয়, মাথা গরম হয়ে যেতে পারে। সহজে বিবর্তন বলার চেষ্টা করে দেখি।
মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতিতে প্রাণীর টিকে থাকা দিয়েই সব হচ্ছে। ধরেন একটা জায়গা বরফে ঢাকা। সেখানে প্রাণী সাদা রঙের, বা এমন একটা রঙ যা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সহজ হয়। কারণ? কারণ হচ্ছে টিকে থাকা। সাদা বরফে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সহজ হয়, শিকার আর শিকারি দুইয়ের জন্যই তাই সাদা রঙের জরুরি দরকার। এই যে প্রাণীর রঙ সাদা বা ধূসর রঙের হল মেরু অঞ্চলে, এইটা বিবর্তনের ফলে হইছে। সময় লাগছে কিন্তু এক সময় প্রাণীর টিকে থাকার জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে সাদা রঙের প্রাণী হাজির হয়েছে মেরু অঞ্চলে। একই রকম মেরু অঞ্চলের আরেক প্রাণী শীল মাছ, পেঙ্গুইন, শরীরে গঠন এমন যে প্রচণ্ড শীতের ভিতরে পানিতে নামছে, গোসল করছে। শরীর ওইভাবেই তৈরি হয়েছে। এমন হাজারও উদাহরণ আছে। মরুভূমিতে উট মাইলের পরে মাইল চলে, কীভাবে? শরীরে পরিবর্তন এসেছে, পাকস্থিলিতে পানির আলাদা ব্যাগ আছে, উট নিজের ওজনের চেয়ে তিন গুন বেশি পানি পান করতে পারে। এগুলা সবই উটের টিকে থাকার জন্য হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছরের অভিযোজনের ফলে তৈরি হয়েছে। উট পাখি এক সময় উড়তে পারত, এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে পাখা, দরকার নাই তাই শরীরে বিবর্তনের মাধ্যমে বাদ পরে যাচ্ছে পাখা। আমাদের শরীরেও বিবর্তনের চাক্ষুষ প্রমাণ রয়েছে। আমাদের আক্কেল দাঁত, এপেন্ডিক্স, টনসিল, এগুলার এক সময় কাজ ছিল, এখন নাই তাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে এই সব অঙ্গ। আপনার পায়ের কড়ে আঙুল ছোট কেন? এইটা এক সময় থাকবেই না। এবং এইটা এখন যেমন আজ থেকে দুই তিন হাজার বছর আগেও এমন ছিল না। লক্ষ বছর আগে তো অবশ্যই অন্য রকম ছিল। আমাদের চলমান বিবর্তন শরীর থেকে ওই আঙুল বাদ দিচ্ছে ধীরে ধীরে। এর সাথে প্রাণীর আবির্ভাবের সম্পর্ক কী? বিজ্ঞান বলছে এমন করে করে আলাদা প্রাণীই সৃষ্টি হয়েছে এক সময়। টিকে থাকছে যে সে আছে বাকিরা হারায় গেছে। প্রকৃতিই ধীরে ধীরে টিকে থাকার জন্য যেমন দরকার তেমন করে এনেছে বর্তমান চেহারায়।
কঠিন বা বিশ্বাস হচ্ছে না? আরও বাস্তব কিছু উদাহরণ দেই। এখন একজন শিশু অতি সহজে স্মার্ট ফোন চালায় ফেলে, কীভাবে? ঠিকমত কথা বলতে পারে না কিন্তু লক খুলে ইউটিউব চালাচ্ছে এমন দৃশ্য আমরা এখন দেখে অভ্যস্ত। আপনার মনে হয় নাই যে এই আশ্চর্য কাণ্ড কীভাবে ঘটছে? কে শিখায় ওই বাচ্চাকে? দেখে শিখলে তো সবারই পারার কথা, আমি তো এমন অনেক মানুষকেই চিনি যারা স্মার্ট ফোন আতঙ্কে ভুগেন! ও সহজে টেকনোলোজি আয়ত্তে নিয়ে নিচ্ছে এইটা আমার কাছে বিবর্তন বলে মনে হয়।
আপনি খেয়াল করে দেখেন রাস্তাঘাটে এত কুকুর, অথচ কয়টা কুকুর গাড়ির নিচে চাপা পরে মরে? আমাদের বাচ্চাকে আমরা সাবধানে রাখি, রাস্তা পাড় হাওয়া শিখাই। ওদেরকে কে শিখাইছে? ওদের মস্তিষ্ক বিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তন হয়েছে। আজকে থেকে দুই তিনশ বছর আগের কোন কুকুরকে যদি আজকের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায় চোখের নিমিষে গাড়ির নিচে পরে মরে যাবে। কিন্তু এখনকার কুকুরেরা ঠিক নগর সভ্যতার সাথে অভিযোজিত হয়ে গেছে। এমন অনেক প্রাণী আছে যারা বিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে টিকে আছে। আর এগুলাই বিবর্তনের পক্ষের যুক্তি। ক্ষুদ্র জীবাণুতে এর উপস্থিতি আরও পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। এই যে অ্যান্টি বায়োটিক খান আর কয়দিন পরেই বলেন যে কাজ করে না, অন্য আরেকটা দেন, পাওয়ার বাড়ায় দেন, কেন বলেন? ওই ব্যাকটেরিয়া সমানে বিবর্তনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করে চলছে। অ্যান্টি বায়োটিক যেটা ওকে মেরে ফেলছে ওইটার প্রতিরোধ নিয়ে পরেরটা আসছে, বিবর্তনের মাধ্যমেই এই কাজ হচ্ছে। মশার কয়েলে কাজ করে না বলে চিল্লাফাল্লা করেন, কাজ করে না কেন? মশাও বিবর্তিত হচ্ছে, আপডেট কয়েল না ফলে মশা তাড়াতে পারবেন না।
কাজেই বানর মানুষ দিয়ে চিন্তা না করে প্রকৃতিতে বিবর্তনের উপস্থিতি দিয়ে চিন্তা করেন তাহলে উত্তর পাবেন। বিবর্তনকে অস্বীকার করার কোন উপায় এখন আর নাই। বিবর্তন মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলে লক্ষ লক্ষ টাকা পুরস্কারে ব্যবস্থা আছে। যারা মিথ্যা দাবী করে তারা এইসবে সময় নষ্ট না করে ভাল মত ঝাঁপিয়ে পড়ুন আর লক্ষ টাকা কামই করে নিন আর আমরাও ভুল একটা তত্ত্ব থেকে মুক্তি পাই!
এবার আসি ধর্মর সাথে বিরোধ নিয়ে। ধর্ম দিয়ে বিবর্তনের উত্তর পাওয়া যাবে না। ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞানের উত্তরই দেওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে নানা প্রশ্ন করা, উত্তর খোঁজা। আর ধর্মের কাজ হচ্ছে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা। বাইবেল মতে ধর্ম বলছে ঈশ্বর ছয় দিনে মহাবিশ্ব তৈরি করে সাত নাম্বার দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন। বিজ্ঞান বলছে সূর্য গ্রহ নক্ষত্র যদি তৈরি করে থাকে তখন তাহলে সূর্য ছাড়া কোন দিনের হিসাব দিলেন ঈশ্বর? দিন রাতের পরিমাপ কীভাবে করল? এমন বেমাক্কা প্রশ্নের সোজা সহজ উত্তর দেওয়া যাবে না, আধ্যাত্মিক উত্তর হয়ত দেওয়া যাবে। কিন্তু আসলে দরকারও নাই। ধর্ম ধর্মের জায়গায়, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের জায়গায়। আপনি যদি ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বই লিখতে চান তাহলে বিবর্তন না শুধু বই থেকে আরও অনেক কিছুই ফালায় দিতে হবে, বিজ্ঞান বইই হয়ত ছুঁড়ে ফেলে দিতে হতে পারে। সব ধর্মগ্রন্থে আছে এইটা ধর্মগ্রন্থে কোথাও লেখা আছে? ভারতে সব বেদে আছে বলে আর আমাদের এখানে সব কোরানে আছে! একেবারে সব তত্ত্ব নিখুঁত ভাবে মিলায় দিবে বেদের নানা শ্লোক দিয়ে, মানতে পারবেন? আর কোরানে কই লেখা আছে দুনিয়ার সব আবিষ্কারের সূত্র কোরানে দেওয়া আছে? যেইটা আল্লা কয় নাই ওইটা আপনে হুদাই বলে পাপ বাড়াচ্ছেন কেন? বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের জায়গায় থাকতে দিন আর ধর্মকে ধর্মের জায়গায়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।