১.
‘জমা করার চাইরদিন পর টাকা ফেরত নিছে, এমন নজীর আছে আর? হুঁশ আছে তো তোমার, মামনি?’ লোকটি যখন বলতে থাকে, তখন তার কণ্ঠটা চিবানোই থাকে, একটুও তাতের আভাস নেই। যেমনটি ছিল না যখন তিনি দিন চারেক আগে কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিলেন দুই বান্ডিল টাকা হাতে নিয়ে, আর বলছিলেন, ‘মামনি টাকাটা জমা নিয়া নেও তাড়াতাড়ি, জরুরি টিটি আছে একটা।‘ সেদিনও সফেদ পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরিহিত ছিলেন। আর ছিল বেলী ফুলের গন্ধটা, যা তার উপস্থিতিকে সদর্পে ঘোষণা করতে থাকে ব্যাংক শাখাটায় ঢোকা মাত্রই। প্রায় ষাট ছুঁইছঁই একটা মানুষ; কিন্তু পোশাকের বাহার, চুলের স্টাইল, আর আতরের ভুসভুস গন্ধ লজ্জাতে ফেলে দেয় এমনকি ছোকরা কাস্টমারদেরও।
আর এ কারণেই শাখাটির ক্যাশ অফিসার ডেইজি লোকটির প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ অনুভব করে। যখন ছোকরা সব কাস্টমারদের ঘাম-ধুলোয় ভেজা হাত ছুঁয়ে আসা ময়লা টাকাগুলো উপুড় হয়ে পড়তে থাকে, আর করোনাবিহীন দুনিয়াতেও মুখের মাস্কটা আরো একটু বেশী করে গুঁজে দিতে থাকে সে, তখন ষাটোর্ধ্ব লোকটির ছবি কাউন্টার লাইনের পেছনে একটুখানি ভেসে উঠলে তার সেই মাস্কখানাই যেন নড়েচড়ে উঠে ভেতরের হাসির পল্লবে। ডেইজির চাকরির বয়স মাত্রই দু’বছরের, কিন্তু তার রয়েছে দ্রুত টাকা গোণা ও একই সাথে অচল ও জাল নোট খুঁড়ে আনার যাদুকরী ক্ষমতা!
কিন্তু সেই ক্ষমতার পিলারই কেঁপে উঠে সেদিন, যখন এমনকি ছোটখাট ভিড়ও ছিল না। দু’তিনটে নোট অবশ্য সে ফেরত দিয়েছিল; আর ঐ তরুণ দেখতে বয়স্ক লোকটি একটুও হামতাম না করে বদলে দিয়েছিল। এমনকি জমা স্লিপটি হাতে করে মামনি’র গুনগান গাইতে গাইতে বিদায়ও নিয়েছিল। লোকটির এ ধরণের স্তূতিবাক্যে প্রথম প্রথম একটু আড়ষ্ঠ বোধ করলেও পরে উপভোগ করতে শুরু করেছিল ডেইজি। সে জানত, এ তার পরিশ্রম ও দক্ষতার স্বীকৃতি, তোষামুদে করে পাওয়া কোন জিনিস নয়।
কিন্তু সেদিন সন্ধেয় সেই মামনি ডাকটাই যেন আতংকে রূপ নিল, যখন দেখতে পেল আট দশটা অচল নোট লুকিয়ে-চুরিয়ে রয়েছে ক্যাশের গাদায়। ফ্লাইয়ার লাগানো থাকে, তাই কারোরই বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে, নোটগুলো শাখার জনপ্রিয়তম ক্যাশ অফিসার ডেইজি তারান্নুমের কাউন্টার থেকেই উদিত হয়েছে। আর ডেইজি হন্তদন্ত হয়ে ডিনোর খাতায় চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে, টাকাগুলোর আগমন তার অতি শ্রদ্ধেয় ঐ তরুণ দেখতে বয়স্ক গ্রাহকটির থলে বেয়েই! যেখানে বেশিরভাগ গ্রাহকের পকেট লেপ্টে-চেপ্টে থাকে দুমড়ানো-মোচড়ানো সব নোট, সেখানে এই লোকটির টাকাগুলো সব সময়ই সারি বেঁধে শোয়ানো থাকে একটি সুদৃশ্য ব্যাগে, আর নোটগুলোর শরীর থেকে লোকটির নিজের শরীরের মতই একটা গন্ধ বেরোয়।
রাগ, না, ভয় থেকে বলতে পারবে না, সারা শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল ডেইজির! এমন নয় যে, টাকাগুলোর ক্ষতিপূরণ দেয়ার সামর্থ্য তার বা তার পরিবারের নেই। আবার এমনো নয়, ভয়ানক শাস্তি নেমে আসতে যাচ্ছে এজন্য তার উপর। আসলে সে যখন টাকাগুলো নিয়েছিল, তখন হঠাৎই কারেন্ট চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জেনারেটর চালু হলেও আলো কম ছিল, তা তো সিসিটিভিই প্রমাণ করবে। সুতরাং, কর্তৃপক্ষের কাছে ওয়াকওভার পাবে, এ নিয়েও নেই কোন শংকা। কিন্তু তারপরেও একটা ক্ষোভ ক্রমশ দলা পাকাচ্ছিল তার মধ্যে! এমনকি যখন ফোনটা দিয়েছিল সে ঐ সন্ধ্যেতেই, লোকটিকে একটুও বিপর্যস্ত শুনাচ্ছিল না। সব সময় যেরকম থাকেন, তেমনি শান্ত আর মিহি সুরে বলে যাচ্ছিলেন তিনি ওপ্রান্ত থেকে, ‘একটুও ভেবো না, মামনি। এখন তো আমি অনেক দূরে। আগামিকাল হাজির হচ্ছি ব্যাংকের গেইট খোলার সাথে সাথেই।‘
২.
পরদিন গেইট খুলল, হাফ বেলাও হয়ে গেল, তবু লোকটির দেখা পেল না ডেইজি। অথচ এত ভীড়ের মধ্যেও সে কিন্তু একটা চোখ ঠিকই খাড়া রেখেছিল সদর দরজাটার দিকে। তাছাড়া ক্যাশের লাইনের মধ্যেও চোখের লাইটটা ফেলে যাচ্ছিল সে ক্ষণে ক্ষণে। লেনদেন সময় যখন অন্তিম পর্বে অবস্থান করছিল, হঠাৎ করেই কী একটা ছবি ভেসে উঠেই যেন সুড়ুৎ করে ডুবে গেল তার চোখের উপর। এরপর যখন ম্যানেজারের রুম থেকে মিহি গলাটা ভেসে এল, সে কাউন্টার, কাস্টামার, ক্যাশ সব ফেলে দৌঁড়ুলো সেখানে।
‘বলেন স্যার, এইডা হয়? চলে কোথাও?’ ম্যানেজারের দরাজায় দাঁড়িয়ে শুনতে পেল ডেইজি, তেমনি মিহি গলায় যেন কুঠার ঠুকে যাচ্ছে লোকটা। অথচ সে আর তার ইনচার্জই শুধু জানত ব্যাপারটা, ম্যানেজারকে এসব ছোটখাট বিষয় কখনো জানায় না তারা। সে যে বকা শুনার ভয়ে, তা নয়। আসলে এমন দৈনন্দিন খুঁটিনাটিগুলো নিয়ে ম্যানেজারের মনোযোগ ভঙ্গ করার রেওয়াজ নেই ব্যাংকে।
যে ক্ষোভটা নাড়ার আগুনে নিভু নিভু করে জ্বলছিল, তা-ই যেন দপ করে জ্বলে উঠল প্রলয়ংকরি রূপ ধরে, আর যে কাজটা এই দুই বছরে একদিনের জন্যও করতে দেখা যায়নি তাকে, তাই করে বসল ডেইজি। দরজা ভেদ করে ম্যানেজারের সামনেই ক্ষুদ্ধ হায়েনার মত দাঁড়াল সে লোকটির মুখোমুখি, আর বলতে লাগল, ‘আপনার সাহস তো কম না? নকল টাকা গছিয়ে দিয়ে আবার বড় গলায় কথা বলতেসেন? কী মনে করেন আপনি নিজেকে? খুব চালাক, তাই না? এজন্যই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন আজ? লাভ নাই, সিসিটিভিতে সব প্রমাণ ….’
‘কী প্রমাণ করবেন আপনি? কাউন্টার ছেড়ে যাওয়ার পর তাকে ডেকে অন্যায় তো আপনিই করেছেন! যদি টাকা নকল হয়েই থাকে, তাহলে আপনি তা গ্রহণ করলেন কেন? এজন্য অফিসিয়াল অ্যাকশান নেয়া হতে পারে আপনার …?’ ডেইজিকে মাঝপথে থামিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন ম্যানেজার সাহেব, কিন্তু এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন যে নিজেও শেষ করতে পারলেন না, হাঁপাতে লাগলেন!
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল ম্যানেজার স্যারকে ডেইজি। যে লোকটি উঠতে বসতে সবাইকে তার সুনাম করে, বলে যে তার মত এমন চোখ-কান খোলা অফিসার আর চোখে পড়েনি, সেই কিনা…তাও কাস্টমারেরই সামনে….! আর পারল না ডেইজি, শ্রাবণের ভরা বর্ষা সব বাঁধ ছাপিয়ে নেমে আসতে লাগল অকূল ধারায়!
৩.
‘এই নোটগুলা ঠিক আছে তো?’ কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠল ডেইজি। চোখ দুটো তখনো ফুলে ছিল, নোনা জলের আঁচড়ানোর দাগ তখনো লেগে ছিল মুখের এখানে সেখানে।
কিছুক্ষণ আগে ডেইজি যখন ম্যানেজারকে নিজের একাউন্ট থেকে ক্ষতিপূরণ করে দেয়ার কথা বলে বেরিয়ে আসছিল, তখন লোকটা উঠে দাঁড়ায়, আর ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে, ‘কয়ডা টাকাই তো …থাক ফেরত দিতে কইয়া দেন… আমার লস হইলে হোক, কিন্তু কারো চাকরীর ক্ষতি হোক চাই না!’
তারপর দশ মিনিটও যায়নি, লোকটা ফিরে এসেছে, আর ডেইজির কাউন্টারে সে ক’টা নোটই ধরেছে জমা করার জন্য, যে ক’টা নোট সে ফেরত নিয়ে গিয়েছিল। ডেইজি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে, এক পর্যায়ে লোকটিই নীরবতা ভাংগে সেই চিবানো কণ্ঠে,‘ আমি তো ঠিকই চালায় নিলাম! ওরা চেনে আমারে! মালগুলি ডেলিভারি নেওনের পর যখন অন্য টাকার মধ্যে গুঁইজা দিলাম নোটগুলা, একবার চেকও করল না!’
ডেইজি যখন আগের মতই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কোন কথা না বলে, তখন লোকটার মুখমন্ডল ফের বেজে উঠে, ‘তুমি অহনো অনেক ছোট, মামনি। তয় কথাডা মাথায় রাইখো সব সময়… দুনিয়াতে চলতে গেলে চালায় নিতে অয় সবকিছু!’
ডেইজির দৃষ্টিটা এবার সরে গিয়ে পাশেই অবস্থিত ভল্টের পাথুরে দেয়ালটার উপর যেন আশ্রয় নেয়। শরীরটা কেমন ভার ভার লাগতে থাকে তার, আর মনে হতে থাকে, বয়সটা যেন হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেছে!
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।